বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫৪৪ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আবদুল মালেক, বীর প্রতীক সাহসী এক যোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধকালে ভারত থেকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে রাতে প্রায়ই আসতেন আবদুল মালেকসহ (আবদুল মালিক) একদল মুক্তিযোদ্ধা।


তাঁদের দলনেতা ছিলেন আবদুল মতিন পাটোয়ারী। রাতে টহল দিয়ে সকালে তাঁরা ফিরে যেতেন ভারতের মাটিতে।
মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা ও চলাচল সীমিত রাখার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীও রাতে ওই এলাকায় আসত। তারা সারা রাত গোপনে কোনো স্থানে অবস্থান করত। কোনো কোনো দিন টহলও দিত।
আবদুল মালেকরা প্রায়ই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হতেন। তখন তাঁরা পাকিস্তানিদের আক্রমণ করতেন। আবার কোনো দিন তাঁরা ফাঁদ (অ্যাম্বুশ) পাততেন। পাকিস্তানিদের বাগে পেলে অতর্কিতে আক্রমণ চালাতেন। এভাবে তাঁরা কয়েকবার গেরিলা অপারেশন করেন। এর মাধ্যমে তাঁরা পাকিস্তানিদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় ২৪ নভেম্বর রাতেও আবদুল মালেকরা সীমান্তসংলগ্ন বাংলাদেশের মাটিতে আসেন। সারা রাত টহল দেন। পরদিন ২৫ নভেম্বর সকালে ভারতের মাটিতে ফিরে যাবেন—এমন সময় তাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দলের মুখোমুখি হন।
এরপর দুই পক্ষে তুমুল সম্মুখযুদ্ধ হয়। গোলাগুলিতে শান্ত এলাকা নিমেষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দলটি সেনা আর রাজাকার-সমন্বয়ে মিশ্রিত দল ছিল। বেশ বড়। আবদুল মালেকসহ মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। সীমান্ত থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী গোলাবর্ষণের মাধ্যমে তাঁদের সহযোগিতা করে।
প্রায় তিন ঘণ্টা সম্মুখযুদ্ধ হয়। এরপর পাকিস্তানিরা পিছু হটে যায়। তবে দূর থেকে দুই পক্ষে গুলিবিনিময় অব্যাহত থাকে। আকস্মিক এ যুদ্ধে পাকিস্তানিদের দু-তিনজন নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। তিনজন সেনা ও আটজন রাজাকারকে মুক্তিযোদ্ধারা আটক করতে সক্ষম হন। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেন।
সম্মুখযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আবদুল মালেকসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আটক পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের সীমান্তের ওপারে নিয়ে যান। দূরে অবস্থানরত পাকিস্তানিরা তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি করে। তখন আবদুল মালেক গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। তাঁর পেটে গুলি লাগে।
এ ঘটনা মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরে (১৯৭১ সালের আগে বৈদ্যনাথতলা, ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর নামকরণ করা হয়)। এর অবস্থান জেলা সদরের দক্ষিণে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন।
আবদুল মালেক চাকরি করতেন ইপিআরের সিগন্যালসে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন ঢাকার পিলখানা সদর দপ্তরে। ২৫ মার্চ রাতে আক্রান্ত হওয়ার পর আরও সাতজনের সঙ্গে কৌশলে পালাতে সক্ষম হন। এরপর যশোর হয়ে ভারতে যান। তাঁকে মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আবদুল মালেক পরে ৮ নম্বর সেক্টরের লালবাজার সাবসেক্টরে যুদ্ধ করেন। অনেক যুদ্ধে তিনি প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন। এর মধ্যে রতনপুর, বাগোয়ান বাগান, শিমুলতলার যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
২০ জুলাই তিনি সহযোদ্ধাদের সঙ্গে মুজিবনগরে টহলরত ছিলেন। দুপুরে তাঁরা খবর পান, মুজিবনগরের কাছে বাগোয়ান বাগানে পাকিস্তানি সেনার একটি দল ঘোরাঘুরি করছে। তাঁরা দ্রুত সেখানে গিয়ে পাকিস্তানিদের আক্রমণ করেন। প্রায় এক ঘণ্টা যুদ্ধ হয়। দুজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো ক্ষতি হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষত মুজিবনগরের যুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. আবদুল মালেককে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২২১। তাঁর প্রকৃত নাম আবদুল মালিক।
আবদুল মালেকের (আবদুল মালিক) পৈতৃক বাড়ি সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার নগর গ্রামে। বসবাস করেন সিলেট শহরে (ঠিকানা উদয়ন, ৩৫/৩ ইলাশকান্দি, আম্বরখানা)। তাঁর বাবার নাম মোয়াজির আলী, মা হারী বিবি। স্ত্রী রেহেনা সিকদার। তাঁদের দুই ছেলে।
সূত্র: আবদুল মালেক বীর প্রতীক, মো. আবদুল হান্নান (মুক্তিযোদ্ধা) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৮।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
ৎashedtৎ@pৎothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.