তথ্য অধিকার আইন- জবাবদিহি নিশ্চিত করা হোক by সাদেকা হালিম
তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো জনগণের ক্ষমতায়ন করা। গত ২৮ সেপ্টেম্বর ছিল আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস। এই দিবসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন আলোচনায় আমার অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছে।
নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক ও সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিরা এ আইনকে বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ আইন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কেননা, এ আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে দুর্নীতি প্রতিরোধ, দায়িত্বশীল সরকার ও প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব। তথ্য অধিকার হলো মানুষের মৌলিক মানবাধিকার।
সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ধারা অনুযায়ী মানুষের চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত হতে হবে। তথ্য অধিকার আইন ধারা ৪-এ উল্লেখ আছে, ‘প্রত্যেক নাগরিকের কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে তথ্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে এবং কর্তৃপক্ষও একজন নাগরিককে তথ্য প্রদানে বাধ্য থাকিবে।’ তাই বলা যায়, এ আইন ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের ওপর তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে। একজন নাগরিক তথ্য অধিকার আইনের ৭ ধারায় বর্ণিত তথ্য ব্যতীত অন্য সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বিদেশি অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত এনজিওর কাছে নির্দিষ্ট ফরমে আবেদন করে তথ্য চাইতে পারেন। তেমনিভাবে ধারা ৩২-এ আটটি গোয়েন্দা সংস্থা কোনো তথ্য প্রদান করবে না কিন্তু দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনসংক্রান্ত তথ্য প্রদানে বাধ্য। আবেদনকারী (ধারা-৯) দ্বারা তথ্য প্রদানে অনীহা আইনের লঙ্ঘন এবং তথ্যপ্রার্থী সে ক্ষেত্রে আইনি প্রতিকার চাইতে পারেন। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে তথ্য অধিকার আইনের মধ্যে সম্পৃক্ত করা হয়নি। উন্নত ও অনুন্নত বিশ্বের বেশ কিছু দেশে এদের বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের আইনেও এটা নেই। বেসরকারি খাত আমাদের দেশীয় সম্পদ নিয়ে কাজ করে। জনগণও এসব বিষয়ে জানতে চায়। যেহেতু সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে ‘জনগণই হবে প্রজাতন্ত্রের মালিক’, সে অর্থে অবশ্যই বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে তথ্য অবমুক্তকরণ নীতিমালার মাধ্যমে তথ্য উন্মোচন করতে হবে।
এ যাবৎ (২০১০ থেকে ২০১২ সাল) তথ্য কমিশনে মোট দায়ের করা অভিযোগের সংখ্যা হচ্ছে ২৬৬, আমলে গৃহীত হয়েছে ১১১টি, আমলে গৃহীত শুনানির মাধ্যমে নিষ্পত্তিকৃত অভিযোগের সংখ্যা ৯৬, নিষ্পত্তি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে ১৯টি এবং বেশ কিছু অভিযোগ ত্রুটিপূর্ণ আছে। সেই সব অভিযোগ ত্রুটিপূর্ণ, যে অভিযোগুলো যথাযথ তথ্য প্রদানের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্তৃক আবেদন করা হয়নি, তথ্য অধিকার আইনের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায়, অভিযোগের সঙ্গে তথ্যপ্রাপ্তির আবেদন থাকলেও আপিল আবেদনের কপি সংযুক্ত না থাকায় এবং তথ্য কমিশনে সরাসরি অভিযোগ দায়ের। এ ছাড়া অভিযোগ খারিজ করা হয়েছে যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর তথ্যপ্রাপ্তির আবেদন না করার কারণে বা কেবল অনুলিপি দেওয়ায়। কিন্তু তথ্য কমিশন ত্রুটিপূর্ণ অভিযোগকারীদের আবেদন সংশোধনকল্পে পুনরায় অভিযোগ করার জন্য নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে। তথ্য কমিশনে নিষ্পন্ন করা অভিযোগগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যেসব বিষয়ে বেশি অভিযোগ আসছে, সেগুলো হলো: কৃষি/জমিসংক্রান্ত, সরকারি-বেসরকারিসংক্রান্ত সরকারি উন্নয়ন/বরাদ্দ/ প্রকল্পসংক্রান্ত, উপজেলা/পৌরসভা/ইউনিয়ন/সিটি করপোরেশনসংক্রান্ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্রঋণ/সমবায় নীতিমালা, হাসপাতাল, সরকারি-বেসরকারি শিল্প কারখানা, চিংড়িশিল্প, নারী নির্যাতন, প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং দেশের প্রচলিত আদালত কর্তৃক আদেশসংক্রান্ত। অভিযোগগুলো বিশ্লেষণে লক্ষণীয় যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তথ্য পেতে বঞ্চিত হয়ে বেশি অভিযোগ করছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে তাদের অভিযোগ নিষ্পন্ন হওয়ার জন্য দু-তিনবার ঢাকায় আসতে হচ্ছে এবং অনেক সময় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তথ্য কমিশনে অনেক অভিযোগ রয়েছে, যা দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই অনেক ক্ষেত্রে দুদকের অনেক কাজও কমিয়ে দিচ্ছে। দুদকের আইনের সঙ্গে তথ্য আইনের সাদৃশ্য আছে। দুদক তদন্ত ও পরিদর্শন করে ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের অধীনে অভিযোগ নিষ্পত্তি করে। তথ্য আইন সিভিল প্রসিডিউর, ১৯০৮-এর অধীনে অভিযোগ নিষ্পত্তি করে। তথ্য আইন ও দুদক আইন সম্মিলিতভাবে দুর্নীতি দূরীকরণে ব্যবহার করা যায়।
এ আইন বাস্তবায়নে ব্যাপকভিত্তিক জনসচেতনতা সৃষ্টি করাই কমিশনের একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ বলে মনে করি। তথ্য কমিশনের পাশাপাশি সুশীল সমাজ এবং যেসব এনজিও তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নে পার্টনারস ইন দ্য স্ট্রাগল হিসেবে কাজ করেছে, তাদেরও এ ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। তথ্য কমিশনের দুটি চাঞ্চল্যকর রায় সবার দৃষ্টি কেড়েছে। সম্প্রতি তথ্য কমিশন নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়ার জন্য জরিমানা করে এবং ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন, যিনি আপিল কর্তৃপক্ষ ছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ওই দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাইকোর্টে রায়ের বিরুদ্ধে রিট করলে সেটি খারিজ হয়ে যায়। আরও উল্লেখ করা যায় যে মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়নের যিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, আপিল কর্তৃপক্ষের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও তথ্য আবেদনকারীকে সঠিক সময়ে তথ্য না দেওয়ার কারণে কমিশন ৫০০ টাকা জরিমানা করে। সুধী সমাজ ও গণমাধ্যম তথ্য কমিশনকে এসব রায়ের জন্য অভিনন্দিত করেছে।
বেসরকারি সংগঠন আয়োজিত গণশুনানিতেও তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার শুরু হয়েছে। তথ্য অধিকার আইন বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করছে কি না, সেই লক্ষ্যে ব্যাপক হারে ব্যবহূত হলে প্রান্তিক জনগণের জন্য সুফল বয়ে আনবে। তথ্য অধিকার আইনের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রশাসনের সর্বস্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা যাবে। তথ্য অধিকার আইনটি ব্যবহার করে পত্র-পত্রিকার অনেক সাংবাদিক অনুসন্ধানীমূলক প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। একটি গণতান্ত্রিক এবং জবাবদিহিপূর্ণ রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠায় তথ্য অধিকার আইনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনসংক্রান্ত ঘটনাসমূহের তথ্য আদায়ের লক্ষ্যে এ আইন অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহূত হতে পারে। তথ্য আইনের সঠিক প্রয়োগের ফলে সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধ রচিত হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োগ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এটি সমাজের ও প্রশাসনের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। জনগণের তথ্য অধিকার আইন নিশ্চিতকরণে সরকারের সর্বাত্মক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।’ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে সাম্প্রতিক পার্বত্য এলাকায় আদিবাসীদের প্রতি এবং কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধপল্লি ও উপাসনালয়ে মর্মান্তিক ও অমানবিক হামলায় প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটনে এই এলাকার অধিবাসীরা আইনটি ব্যবহার করে প্রশাসনের (সিভিল ও পুলিশ) ভূমিকা এবং বিভিন্ন রাজনীতিবিদ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দায়িত্ব পালনে ভূমিকাসংক্রান্ত তথ্য আদায় করে তাঁদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে। এর মাধ্যমে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক ঘটনার মূল উৎসগুলো রাষ্ট্রের পক্ষে চিহ্নিত করা সম্ভব।
সাদেকা হালিম: তথ্য কমিশনার (প্রেষণে), অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।
সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ধারা অনুযায়ী মানুষের চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত হতে হবে। তথ্য অধিকার আইন ধারা ৪-এ উল্লেখ আছে, ‘প্রত্যেক নাগরিকের কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে তথ্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে এবং কর্তৃপক্ষও একজন নাগরিককে তথ্য প্রদানে বাধ্য থাকিবে।’ তাই বলা যায়, এ আইন ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের ওপর তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে। একজন নাগরিক তথ্য অধিকার আইনের ৭ ধারায় বর্ণিত তথ্য ব্যতীত অন্য সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বিদেশি অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত এনজিওর কাছে নির্দিষ্ট ফরমে আবেদন করে তথ্য চাইতে পারেন। তেমনিভাবে ধারা ৩২-এ আটটি গোয়েন্দা সংস্থা কোনো তথ্য প্রদান করবে না কিন্তু দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনসংক্রান্ত তথ্য প্রদানে বাধ্য। আবেদনকারী (ধারা-৯) দ্বারা তথ্য প্রদানে অনীহা আইনের লঙ্ঘন এবং তথ্যপ্রার্থী সে ক্ষেত্রে আইনি প্রতিকার চাইতে পারেন। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে তথ্য অধিকার আইনের মধ্যে সম্পৃক্ত করা হয়নি। উন্নত ও অনুন্নত বিশ্বের বেশ কিছু দেশে এদের বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের আইনেও এটা নেই। বেসরকারি খাত আমাদের দেশীয় সম্পদ নিয়ে কাজ করে। জনগণও এসব বিষয়ে জানতে চায়। যেহেতু সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে ‘জনগণই হবে প্রজাতন্ত্রের মালিক’, সে অর্থে অবশ্যই বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে তথ্য অবমুক্তকরণ নীতিমালার মাধ্যমে তথ্য উন্মোচন করতে হবে।
এ যাবৎ (২০১০ থেকে ২০১২ সাল) তথ্য কমিশনে মোট দায়ের করা অভিযোগের সংখ্যা হচ্ছে ২৬৬, আমলে গৃহীত হয়েছে ১১১টি, আমলে গৃহীত শুনানির মাধ্যমে নিষ্পত্তিকৃত অভিযোগের সংখ্যা ৯৬, নিষ্পত্তি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে ১৯টি এবং বেশ কিছু অভিযোগ ত্রুটিপূর্ণ আছে। সেই সব অভিযোগ ত্রুটিপূর্ণ, যে অভিযোগুলো যথাযথ তথ্য প্রদানের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্তৃক আবেদন করা হয়নি, তথ্য অধিকার আইনের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায়, অভিযোগের সঙ্গে তথ্যপ্রাপ্তির আবেদন থাকলেও আপিল আবেদনের কপি সংযুক্ত না থাকায় এবং তথ্য কমিশনে সরাসরি অভিযোগ দায়ের। এ ছাড়া অভিযোগ খারিজ করা হয়েছে যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর তথ্যপ্রাপ্তির আবেদন না করার কারণে বা কেবল অনুলিপি দেওয়ায়। কিন্তু তথ্য কমিশন ত্রুটিপূর্ণ অভিযোগকারীদের আবেদন সংশোধনকল্পে পুনরায় অভিযোগ করার জন্য নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে। তথ্য কমিশনে নিষ্পন্ন করা অভিযোগগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যেসব বিষয়ে বেশি অভিযোগ আসছে, সেগুলো হলো: কৃষি/জমিসংক্রান্ত, সরকারি-বেসরকারিসংক্রান্ত সরকারি উন্নয়ন/বরাদ্দ/ প্রকল্পসংক্রান্ত, উপজেলা/পৌরসভা/ইউনিয়ন/সিটি করপোরেশনসংক্রান্ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্রঋণ/সমবায় নীতিমালা, হাসপাতাল, সরকারি-বেসরকারি শিল্প কারখানা, চিংড়িশিল্প, নারী নির্যাতন, প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং দেশের প্রচলিত আদালত কর্তৃক আদেশসংক্রান্ত। অভিযোগগুলো বিশ্লেষণে লক্ষণীয় যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তথ্য পেতে বঞ্চিত হয়ে বেশি অভিযোগ করছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে তাদের অভিযোগ নিষ্পন্ন হওয়ার জন্য দু-তিনবার ঢাকায় আসতে হচ্ছে এবং অনেক সময় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তথ্য কমিশনে অনেক অভিযোগ রয়েছে, যা দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই অনেক ক্ষেত্রে দুদকের অনেক কাজও কমিয়ে দিচ্ছে। দুদকের আইনের সঙ্গে তথ্য আইনের সাদৃশ্য আছে। দুদক তদন্ত ও পরিদর্শন করে ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের অধীনে অভিযোগ নিষ্পত্তি করে। তথ্য আইন সিভিল প্রসিডিউর, ১৯০৮-এর অধীনে অভিযোগ নিষ্পত্তি করে। তথ্য আইন ও দুদক আইন সম্মিলিতভাবে দুর্নীতি দূরীকরণে ব্যবহার করা যায়।
এ আইন বাস্তবায়নে ব্যাপকভিত্তিক জনসচেতনতা সৃষ্টি করাই কমিশনের একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ বলে মনে করি। তথ্য কমিশনের পাশাপাশি সুশীল সমাজ এবং যেসব এনজিও তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নে পার্টনারস ইন দ্য স্ট্রাগল হিসেবে কাজ করেছে, তাদেরও এ ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। তথ্য কমিশনের দুটি চাঞ্চল্যকর রায় সবার দৃষ্টি কেড়েছে। সম্প্রতি তথ্য কমিশন নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়ার জন্য জরিমানা করে এবং ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন, যিনি আপিল কর্তৃপক্ষ ছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ওই দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাইকোর্টে রায়ের বিরুদ্ধে রিট করলে সেটি খারিজ হয়ে যায়। আরও উল্লেখ করা যায় যে মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়নের যিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, আপিল কর্তৃপক্ষের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও তথ্য আবেদনকারীকে সঠিক সময়ে তথ্য না দেওয়ার কারণে কমিশন ৫০০ টাকা জরিমানা করে। সুধী সমাজ ও গণমাধ্যম তথ্য কমিশনকে এসব রায়ের জন্য অভিনন্দিত করেছে।
বেসরকারি সংগঠন আয়োজিত গণশুনানিতেও তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার শুরু হয়েছে। তথ্য অধিকার আইন বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করছে কি না, সেই লক্ষ্যে ব্যাপক হারে ব্যবহূত হলে প্রান্তিক জনগণের জন্য সুফল বয়ে আনবে। তথ্য অধিকার আইনের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রশাসনের সর্বস্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা যাবে। তথ্য অধিকার আইনটি ব্যবহার করে পত্র-পত্রিকার অনেক সাংবাদিক অনুসন্ধানীমূলক প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। একটি গণতান্ত্রিক এবং জবাবদিহিপূর্ণ রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠায় তথ্য অধিকার আইনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনসংক্রান্ত ঘটনাসমূহের তথ্য আদায়ের লক্ষ্যে এ আইন অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহূত হতে পারে। তথ্য আইনের সঠিক প্রয়োগের ফলে সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধ রচিত হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োগ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এটি সমাজের ও প্রশাসনের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। জনগণের তথ্য অধিকার আইন নিশ্চিতকরণে সরকারের সর্বাত্মক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।’ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে সাম্প্রতিক পার্বত্য এলাকায় আদিবাসীদের প্রতি এবং কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধপল্লি ও উপাসনালয়ে মর্মান্তিক ও অমানবিক হামলায় প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটনে এই এলাকার অধিবাসীরা আইনটি ব্যবহার করে প্রশাসনের (সিভিল ও পুলিশ) ভূমিকা এবং বিভিন্ন রাজনীতিবিদ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দায়িত্ব পালনে ভূমিকাসংক্রান্ত তথ্য আদায় করে তাঁদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে। এর মাধ্যমে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক ঘটনার মূল উৎসগুলো রাষ্ট্রের পক্ষে চিহ্নিত করা সম্ভব।
সাদেকা হালিম: তথ্য কমিশনার (প্রেষণে), অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।
No comments