রামুর তাণ্ডব নিয়ে দোষারোপের আড়ালে by মাহমুদুল বাসার
রামু, উখিয়া, টেকনাফ ও চট্টগ্রামের পটিয়ায় যে বর্বরোচিত ঘটনা ঘটল, তাকে নাকি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলা চলে না! এমনই বলেছেন, আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের নেতা ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম। তিনি বলেছেন, 'রামু, উখিয়া ও টেকনাফের ঘটনা কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নয়, এটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ।
এ হামলা অত্যন্ত পরিকল্পিত। বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্যই এটা করা হয়েছে। একে হালকা করে দেখা উচিত নয়। একই সঙ্গে এই ঘটনাকে রাজনৈতিক রং দেওয়া কারো জন্য সুফল বয়ে আনবে না।' (কালের কণ্ঠ, ১৪ অক্টোবর, ২০১২)।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে চলছে এখন চরম আত্মকলহ; তাঁরা এখন সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্ত। ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের বিবৃতির মধ্যেও তার ছায়া পড়েছে। তিনি দুকূল রক্ষা করে গা-বাঁচানো বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি স্পষ্টভাবে সরকারকে থ্রেট দিয়ে বলেছেন, এই ঘটনাকে রাজনৈতিক রং দেওয়া কারো জন্য সুফল বয়ে আনবে না।
পঁচাত্তরপরবর্তী সামরিক শাসকরা তো 'বিদেশ' বলতে শুধু ভারতকেই বোঝাতেন। সব দোষ ভারতের ওপর চাপিয়ে দিতেন। এমনই মনে হতো তাঁদের কথা শুনে যে পৃথিবীতে ভারতই বাংলাদেশের শত্রু আর একমাত্র পাকিস্তান আমাদের মিত্র। ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের বিবৃতি পড়ে মনে পড়ল সে সব কথা। বলেছেন তিনি, 'বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্যই এটা করা হয়েছে।'
বৌদ্ধপল্লীতে হামলাকারীরা এতই ইনটেলেকচুয়াল যে তারা বিদেশিদের সঙ্গে পরামর্শ করে শুধুই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য এহেন তাণ্ডব চালিয়েছিল। এ কথাই বলতে চান ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম।
পাকিস্তান নামক একটি নিরেট সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে আমরা ২৪ বছর বসবাস করেছি। আইয়ুব-মোনায়েম ও টিক্কা-ইয়াহিয়া খানের মতো দুর্বৃত্ত শাসকরা আমাদের বছরের পর বছর শাসন করেছে, তারা আমাদের প্রভু ছিল। যদি ইংরেজরা এ দেশে তাদের সমর্থক তৈরি করতে পারে, তাহলে পাকিস্তানি শাসক-শোষকরাও সমর্থক তৈরি করেছে নিঃসন্দেহে এ দেশে।
পাকিস্তান সমর্থকদের বলবান, গর্জনশীল অস্তিত্ব আমরা দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই টের পেয়েছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো অবিসংবাদিত নেতাকে রাতারাতি ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর জন্য, তার ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করার জন্য তখনকার অধিকাংশ বিরোধী দল সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আশ্রয় নিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল কমরেড মণি সিংহের কমিউনিস্ট পার্টি এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের ন্যাপ। তারা কি বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেকড় মেলতে পারল? তারা কি হালে পানি পেল? ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগে এ দেশে স্লোগান শুনেছি, 'মুজিব-মণি-মোজাফফর বাংলার মীর জাফর।' এই স্লোগান সাম্প্রদায়িক উস্কানি থেকে দেওয়া হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর সরকারকে বলা হতো 'ভারতের পুতুল সরকার'। এই বক্তব্যের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উস্কানি লুকিয়ে আছে।
শের-ই-বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কমরেড মণি সিংহ ও অধ্যাপক মোজাফফর সারাজীবন রাজনীতি করে বাংলাদেশের মাটিতে যে অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ অবকাঠামো নির্মাণ করেছিলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড তা ভেঙে চুরমার করে দেয়। পঁচাত্তরপরবর্তী রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক শক্তি অপ্রতিরোধ্য গতিতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যাই করা হয়েছে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অপরাধে। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা বিদেশে সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দিয়েছে খুনের কারণ হিসেবে। ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের বেনিফিশিয়ারিরা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে ১৯৭১-এ লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের ম্যান্ডেট পরিবর্তন করে সাম্প্রদায়িক স্টেট পলিসি গ্রহণ করে। তারা সংবিধানের মতো সর্বজনীন দলিলকে ধর্মভিত্তিক করে, সংবিধান এখনো ধর্মীয় পক্ষপাতযুক্ত। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে?
এভাবে রাজনৈতিক স্বার্থে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে দানবের মতো বলীয়ান করা হয়েছে। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক অপশক্তি এতটাই জোরালো যে শেখ হাসিনাকে সর্বক্ষণ ভয়ে ভয়ে পা গুনে গুনে চলতে হয়। তিনি রোজা-নামাজ করেন তার ছবি ক্যালেন্ডারে প্রকাশ করে দেখাতে হয়। তিনি ভয়ে 'ধর্মনিরপেক্ষ' কথাটি উচ্চারণ করেন না, বলেন, 'অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলব।'
যে দেশে একটি বাম সংগঠন গড়ে উঠতে পারল না, যে দেশে উদীচী নামক সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠানে বোমা মেরে মানুষ হত্যা করা হলো, সিনেমা হলে বোমা মেরে মানুষ হত্যা করা হলো, যাত্রাশিল্পীদের প্যান্ডেল জ্বালিয়ে দেওয়া হলো, নৌকায় ভোট দেওয়ার অপরাধে হাজার হাজার মানুষকে উদ্বাস্তু করা হলো, নারী ধর্ষণ করা হলো, যে দেশে জামায়াতে ইসলামীর মতো যুদ্ধাপরাধী রাজানৈতিক সংগঠন ক্রমেই শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে, সে দেশের রামু, উখিয়া, টেকনাফে শুধু বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার ভোঁতা দৃষ্টিতে নারকীয় তাণ্ডব চালানো হয়েছে- এ কথাও আমাদের বিশ্বাস করতে হবে?
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে চলছে এখন চরম আত্মকলহ; তাঁরা এখন সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্ত। ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের বিবৃতির মধ্যেও তার ছায়া পড়েছে। তিনি দুকূল রক্ষা করে গা-বাঁচানো বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি স্পষ্টভাবে সরকারকে থ্রেট দিয়ে বলেছেন, এই ঘটনাকে রাজনৈতিক রং দেওয়া কারো জন্য সুফল বয়ে আনবে না।
পঁচাত্তরপরবর্তী সামরিক শাসকরা তো 'বিদেশ' বলতে শুধু ভারতকেই বোঝাতেন। সব দোষ ভারতের ওপর চাপিয়ে দিতেন। এমনই মনে হতো তাঁদের কথা শুনে যে পৃথিবীতে ভারতই বাংলাদেশের শত্রু আর একমাত্র পাকিস্তান আমাদের মিত্র। ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের বিবৃতি পড়ে মনে পড়ল সে সব কথা। বলেছেন তিনি, 'বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্যই এটা করা হয়েছে।'
বৌদ্ধপল্লীতে হামলাকারীরা এতই ইনটেলেকচুয়াল যে তারা বিদেশিদের সঙ্গে পরামর্শ করে শুধুই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য এহেন তাণ্ডব চালিয়েছিল। এ কথাই বলতে চান ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম।
পাকিস্তান নামক একটি নিরেট সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে আমরা ২৪ বছর বসবাস করেছি। আইয়ুব-মোনায়েম ও টিক্কা-ইয়াহিয়া খানের মতো দুর্বৃত্ত শাসকরা আমাদের বছরের পর বছর শাসন করেছে, তারা আমাদের প্রভু ছিল। যদি ইংরেজরা এ দেশে তাদের সমর্থক তৈরি করতে পারে, তাহলে পাকিস্তানি শাসক-শোষকরাও সমর্থক তৈরি করেছে নিঃসন্দেহে এ দেশে।
পাকিস্তান সমর্থকদের বলবান, গর্জনশীল অস্তিত্ব আমরা দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই টের পেয়েছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো অবিসংবাদিত নেতাকে রাতারাতি ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর জন্য, তার ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করার জন্য তখনকার অধিকাংশ বিরোধী দল সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আশ্রয় নিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল কমরেড মণি সিংহের কমিউনিস্ট পার্টি এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের ন্যাপ। তারা কি বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেকড় মেলতে পারল? তারা কি হালে পানি পেল? ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগে এ দেশে স্লোগান শুনেছি, 'মুজিব-মণি-মোজাফফর বাংলার মীর জাফর।' এই স্লোগান সাম্প্রদায়িক উস্কানি থেকে দেওয়া হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর সরকারকে বলা হতো 'ভারতের পুতুল সরকার'। এই বক্তব্যের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উস্কানি লুকিয়ে আছে।
শের-ই-বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কমরেড মণি সিংহ ও অধ্যাপক মোজাফফর সারাজীবন রাজনীতি করে বাংলাদেশের মাটিতে যে অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ অবকাঠামো নির্মাণ করেছিলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড তা ভেঙে চুরমার করে দেয়। পঁচাত্তরপরবর্তী রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক শক্তি অপ্রতিরোধ্য গতিতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যাই করা হয়েছে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অপরাধে। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা বিদেশে সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দিয়েছে খুনের কারণ হিসেবে। ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের বেনিফিশিয়ারিরা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে ১৯৭১-এ লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের ম্যান্ডেট পরিবর্তন করে সাম্প্রদায়িক স্টেট পলিসি গ্রহণ করে। তারা সংবিধানের মতো সর্বজনীন দলিলকে ধর্মভিত্তিক করে, সংবিধান এখনো ধর্মীয় পক্ষপাতযুক্ত। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে?
এভাবে রাজনৈতিক স্বার্থে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে দানবের মতো বলীয়ান করা হয়েছে। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক অপশক্তি এতটাই জোরালো যে শেখ হাসিনাকে সর্বক্ষণ ভয়ে ভয়ে পা গুনে গুনে চলতে হয়। তিনি রোজা-নামাজ করেন তার ছবি ক্যালেন্ডারে প্রকাশ করে দেখাতে হয়। তিনি ভয়ে 'ধর্মনিরপেক্ষ' কথাটি উচ্চারণ করেন না, বলেন, 'অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলব।'
যে দেশে একটি বাম সংগঠন গড়ে উঠতে পারল না, যে দেশে উদীচী নামক সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠানে বোমা মেরে মানুষ হত্যা করা হলো, সিনেমা হলে বোমা মেরে মানুষ হত্যা করা হলো, যাত্রাশিল্পীদের প্যান্ডেল জ্বালিয়ে দেওয়া হলো, নৌকায় ভোট দেওয়ার অপরাধে হাজার হাজার মানুষকে উদ্বাস্তু করা হলো, নারী ধর্ষণ করা হলো, যে দেশে জামায়াতে ইসলামীর মতো যুদ্ধাপরাধী রাজানৈতিক সংগঠন ক্রমেই শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে, সে দেশের রামু, উখিয়া, টেকনাফে শুধু বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার ভোঁতা দৃষ্টিতে নারকীয় তাণ্ডব চালানো হয়েছে- এ কথাও আমাদের বিশ্বাস করতে হবে?
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
No comments