তত্ত্বাবধায়ক সরকার, খাসতালুক ও অবাঞ্ছিত গণতন্ত্র by মো. জাকির হোসেন

এক ব্যক্তি প্রায়ই তার স্ত্রীকে মারধর করত। ক্ষোভ সংবরণ না করতে পেরে স্ত্রী একদিন তার স্বামীকে বলে, যত ক্ষমতা ঘরের বউয়ের সঙ্গে, পারলে বাইরে ক্ষমতা দেখান। স্ত্রীকে ক্ষমতা দেখানোর পরিকল্পনা করে স্বামী।


পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সে একদিন একটি লাঠিতে লাল কাপড় বেঁধে বাড়ির পাশের রেললাইনে দাঁড়িয়ে একটি চলন্ত ট্রেনের উদ্দেশ্যে লাঠিটি দোলাতে থাকে। ট্রেনের চালক লাল কাপড়ের সংকেতকে সমূহ বিপদ মনে করে ট্রেন থামিয়ে দেয়। তখন লোকটি তার স্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলে, আমার কত ক্ষমতা, আমার কথা বলারও প্রয়োজন হয় না, ইশারাতে ট্রেন থেমে যায়। থেমে যাওয়া ট্রেনের গার্ড ট্রেন থেকে নেমে লাল কাপড় দেখানোর কারণ জানতে চাইলে স্বামীপ্রবর স্ত্রীকে ক্ষমতা দেখানোর জন্য এমনটি করেছে বলে জানায়। গার্ড এ কথা শুনে তার গালে কষে এক চড় মারে। দূরে দাঁড়িয়ে স্ত্রী সবই দেখছিল। স্বামী ফিরে এলে স্ত্রী জিজ্ঞেস করে, আপনার এত ক্ষমতা, তাহলে আপনাকে ওই লোক চড় মারল কেন? স্বামী জবাব দেয়, আমার ক্ষমতা আমি দেখিয়েছি, ওর ক্ষমতা ও দেখিয়েছে। আমাদের সরকারি ও বিরোধী দল যারা দেশকে খাসতালুক মনে করে, সেই খাসতালুকের দখল ধরে রাখা কিংবা দখল পুনরুদ্ধারের জন্য তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে যে যার ক্ষমতা দেখাচ্ছে। মহাজোট সরকারে প্রধানমন্ত্রীর পর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের শীর্ষে অনির্বাচিত উপদেষ্টারা থাকলেও অনির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে সরকার গঠন হবে না বলে প্রধানমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে বিরোধী দলও তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না বলে অনড় অবস্থান গ্রহণ করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দুই দলের ক্ষমতার দাপটের ফলে তৃতীয় কেউ আমাদের শিশু গণতন্ত্রের গালে চপেটাঘাত করতে পারে বলে কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন।
প্রিয় পাঠক, অমাদের রাজনীতিবিদরা দেশকে খাসতালুক মনে করেন বলেই ভয়ানক দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থপাচারের বিষয়ে দেশ-বিদেশে তোলপাড় হলেও এর বিরুদ্ধে কিছু লোকদেখানো পদক্ষেপ ছাড়া কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। যদি কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হতো তাহলে ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্কের গবেষণামতে, দেশ থেকে দুই লাখ কোটি টাকা কিভাবে পাচার হলো? দেশের অর্থনীতির একটি বিরাট অংশ কিভাবে কালো টাকানির্ভর হয়ে গেল? বাস্তবতা হলো, নিজ দলের আদালতে প্রমাণিত দুর্নীতিবাজদের দুর্নীতিকেও রাজনীতিবিদরা দুর্নীতি বলে মানতে নারাজ। কেননা তাঁরা মনে করেন, নিজেদের খাসতালুক থেকে অর্থ নিজের পকেটে ভরা দুর্নীতি নয়। নিজের তালুক থেকে অর্থ সরিয়ে বিদেশে প্রেরণ কোনোভাবেই পাচার নয়। নিজের সম্পদ কি কেউ নিজেই চুরি করতে পারে?
অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের দ্বিতীয় যাত্রা শুরু। সেই থেকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয় দলই দুই মেয়াদে দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছে। উভয় দলেরই দ্বিতীয় মেয়াদের সরকার নিয়ে মানুষ কেবল বিরক্ত ও হতাশই নয়, রীতিমতো ক্ষুব্ধ। এমনকি উভয় দলের কিছু অন্ধ-অনুসারী ছাড়া বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি-সমর্থন রয়েছে এমন মানুষও তাদের নিজ নিজ ভালোবাসার দলের সরকার পরিচালনা ও বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা নিয়ে বিরক্ত, হতাশ ও ক্ষুব্ধ। তাদের বিরক্তি ও হতাশার অন্তর্গত কারণ হলো, জনসাধারণ ভোট দিয়ে রাজনৈতিক দলকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেয় দেশকে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী পরিচালনা ও তত্ত্বাবধান করার জন্য। পাওয়ার অব অ্যাটর্নির শর্ত অনুযায়ী সরকারের দায়িত্ব দেশ পরিচালনা করা আর বিরোধী দলের কাজ হলো সরকারের কাজের তত্ত্বাবধান করা। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো বারবার পাওয়ার অব অ্যাটর্নির শর্ত ভঙ্গ করে দেশকে তাদের খাসতালুকে পরিণত করেছে। তাই তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু নিয়ে সৃষ্ট সংকটে জনসাধারণ ভীষণ ক্ষুব্ধ। কেননা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দেশে নানামুখী বিচার-বিশ্লেষণ চলছে, এটিকে ঘিরে যে নানা আশঙ্কার কথা উচ্চারিত হচ্ছে, সেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজন কিংবা সংবিধান থেকে ছুড়ে ফেলা কোনো ক্ষেত্রেই জনসাধারণের অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি কোনো দলই। আর এটি না করার কারণ হলো, আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল এ দেশের মালিকানা যতটুকু জনগণের বলে মনে করে, তার চেয়ে বেশি তাদের খাসতালুক বলে বিশ্বাস করে। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দুই দলের মধ্যে মরণপণ যুদ্ধের পেছনে মূল কারণ গণতন্ত্র শক্তিশালীকরণ নয়, বরং খাসতালুকের দখল ধরে রাখা কিংবা দখল পুনরুদ্ধারের লড়াই। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজন করাকে আমাদের গণতন্ত্র মোটাতাজাকরণ প্রকল্প হিসেবে যাঁরা দেখছেন, তাঁরা আমাদের গণতন্ত্রের মূল সমস্যা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পেরেছেন বলে প্রতীয়মান হয় না। অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটি শর্ত মাত্র। একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন গণতন্ত্র শক্তিশালীকরণে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারবে কি না তা অন্যান্য শর্তপূরণের ওপর নির্ভরশীল। তাই পর পর চার মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও নির্বাচনের পর আমাদের সরকার ব্যবস্থা কার্যত এক ব্যক্তির শাসনে পর্যবসিত হয়েছে। আমাদের সংবিধানের মধ্যেই এক ব্যক্তির শাসন তথা নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রের অবারিত সুযোগ রয়েছে। আর এটি যত দিন বহাল থাকবে, তত দিন তত্ত্বাবধায়ক দাওয়াই দিয়ে গণতন্ত্রের রোগ সারানো সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। সংবিধানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ভারসাম্যহীন ক্ষমতার বণ্টনের মধ্যেই নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রের বীজ উপ্ত রয়েছে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন এতটাই ভারসাম্যহীন যে রাষ্ট্রপতিকে প্রদত্ত ক্ষমতা একধরনের অনুদানের পর্যায়ে পড়ে, যা দিয়ে কোনোমতে রাষ্ট্রপতির পদ টিকিয়ে রাখা যায়, গণতন্ত্রের জন্য কার্যকর কোনো অবদান রাখা যায় না। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁর অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন এবং প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে কী পরামর্শ দিয়েছেন সে বিষয়ে আইনগতভাবে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা একধরনের আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এ ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিরাজমান রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে নিজস্ব বিচার-বিবেচনার কোনো সুযোগ রাষ্ট্রপতির নেই। সংবিধানের ৫৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতি সংসদ সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্থাভাজনকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিতে বাধ্য। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর একজন দলীয় ব্যক্তিকে প্রকাশ্য ব্যালটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা হয়। এভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত একজন রাষ্ট্রপতির পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তাঁর সঙ্গে কোনো ধরনের অনানুষ্ঠানিক আলোচনা না করে কেবল রাষ্ট্রপতির একক বিবেচনায় প্রধান বিচারপতি নিয়োগ বাংলাদেশের জন্য কোনো স্বাভাবিক ঘটনা হতে পারে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে গণতন্ত্রের সহযাত্রী হতে হলে সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁর অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন। এর স্থলে প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ সংস্থার (উদাহরণস্বরূপ নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, আইন কমিশন, অডিটর জেনারেল, অ্যাটর্নি জেনারেল ইত্যাদি) চেয়ারম্যান ও সদস্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁর অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন- সংযোজন করা হলে একদিকে যেমন ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি হবে; অন্যদিকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণের হাত থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে। এর ফলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেধাভিত্তিক নিয়োগের সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে, যা ধীরে ধীরে বিরোধী দলসহ সাধারণভাবে জনমনে আস্থার সঞ্চার করবে বলে আশা করা যায়। আর এভাবেই আমাদের গণতন্ত্রের এগিয়ে যাওয়ার পথ মসৃণ হতে থাকবে।
সংবিধানের ৬৭ অনুচ্ছেদ আমাদের গণতন্ত্রের জন্য এক প্রাণঘাতী অসুখ। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদের অনুমতি না নিয়ে ৯০ বৈঠক দিবস সংসদে অনুপস্থিত থাকলে সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হওয়ার বিধান আছে। আমাদের সংসদ সদস্যরা পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। পাঁচ বছরে মোট এক হাজার ৮২৫ দিন। পাঁচ বছরের প্রতিদিনই বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও ৯০তম দিনে হাজিরা দিয়ে মাত্র ২০ বার সংসদে উপস্থিত হয়ে পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করা সম্ভব। বাস্তবে যেহেতু পাঁচ বছরের প্রতিদিনই সংসদ অধিবেশনে থাকে না, তাই মাত্র ৮-১০ বার সংসদে হাজিরা দিয়ে সংসদ সদস্যের মেয়াদ পূর্ণ করা যায়। খাসতালুককে কেন্দ্র করে আমাদের সংঘাতময় রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে বিরোধী দল গত চার মেয়াদেই নানা অজুহাতে দিনের পর দিন সংসদের বৈঠকে অনুপস্থিত থেকেছে। এমনকি সামনের সারিতে বসতে না পারার কারণেও বিরোধী দল সংসদ বর্জনকে বেছে নিয়েছে। বিরোধী দলবিহীন সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা অতিসহজেই নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রের সুযোগ করে দেয়। কাজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে অর্থবহ করতে হলে সংবিধান সংশোধন করে একটানা ৯০ কর্মদিবস সংসদে অনুপস্থিতির কারণে সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হওয়ার বিধান পরিবর্তন করে ৯০ কর্মদিবসের পরিবর্তে তা সাত থেকে ১০ কর্মদিবসে নামিয়ে আনতে হবে। এক মেয়াদে সর্বোচ্চ দুইবারের অধিক টানা সংসদ বর্জনের ক্ষেত্রে সংসদ অধিবেশনে অনুপস্থিতির দিনগুলোতে কোনো ধরনের বেতন-ভাতা প্রদান না করার বিধান সংবিধানে সংযোজন করতে হবে।
মজার ব্যাপার হলো, বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে সংযোজনের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করলেও গণতন্ত্রের স্বার্থে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতার বিধান ও দিনের পর দিন সংসদে অনুপস্থিত থেকেও সংসদ সদস্যের মেয়াদপূর্ণ ও সব ধরনের ভাতা ও সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তি সংক্রান্ত বিধান সংশোধনীর ক্ষেত্রে নিশ্চুপ। সরকারি দলও সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে এসব বিষয় এড়িয়ে গেছে। কারণ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অলিখিত সমঝোতা হচ্ছে, খাসতালুকের দখল যখন পাই, তখন নিরঙ্কুশ আধিপত্য চাই। কারো সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে রাজি নই। কিন্তু এসব বিষয়ে সংশোধনী ব্যতিরেকে কেবল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন খাসতালুকের দখল হস্তান্তরের মধ্যে সীমিত হয়ে পড়বে। তালুকের দখল নিয়ে মাঝেমধ্যেই সহিংস লড়াই হবে। আর এভাবেই আমাদের গণতন্ত্র অবাঞ্ছিত হয়ে পড়বে।
লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.