আরণ্যক :৪০ বছর পেরিয়ে by সাইফুল ইসলাম

দীর্ঘদিন জনতার কাতারে যে কোনো সংগঠনের দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর_ বিশেষ করে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের। রাজনৈতিক দলে জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নেতা সৃষ্টি হয়, সে নেতার পরিচিতি-ইমেজ বাড়ে_ জনতার কাতার থেকে নেতা উঠে যায় অনেক ওপরে। তখন নেতা নিজেকে ক্ষমতাবান-বুদ্ধিমান মনে করে। সে নেতা আর নিচে নামতে চায় না, আসতে চায় না জনতার কাতারে।


দলকে সে নিজের মতো করে পরিচালনা করতে চায়, এ কারণে এক সময় দল জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গণবিরোধী চরিত্র ধারণ করে। সাংস্কৃতিক সংগঠনের বেলায় এ কথা আরও বেশি প্রযোজ্য, বিশেষ করে যখন সংস্কৃতিকে বাণিজ্যিকীকরণের চেষ্টা সর্বত্র। সাংস্কৃতিক কর্মীদের অনেকেই দ্রুত তারকা বনে যান, উঁচু পারিশ্রমিকে পারফর্ম করেন, সমাজের কাছে খুব সহজেই হয়ে ওঠেন পরিচিত মুখ। ফলে সমাজে তার আলাদা একটা কদর হয়। এক সময় এই তারকারা গরবে পা মাটিতে রাখতে চায় না, জনতার কাতারে ফিরতে চায় না মন। ফলে তারা বা তাদের সংগঠন দূর আকাশের তারার মতোই মিলিয়ে যায় এক সময়। তখন মানুষের প্রয়োজনে, যুগের প্রয়োজনে আবার জন্ম নেয় নতুন সংগঠন। তারা মানুষের পাশে দাঁড়ায়। নইলে মানবজাতির বিকাশ যে রুদ্ধ হয়ে পড়ত।
এর ব্যতিক্রম যে নেই তা কিন্তু নয়। কোনো কোনো সংগঠন মানুষের পাশে থাকতে সাধনা করে। এ জন্য প্রয়োজনে সংগঠন নিজেকে পরিবর্তন করে, যুগোপযোগী করে। এ কারণে ওই সব সংগঠন দীর্ঘজীবী হয়। এমনি একটি সংগঠন আরণ্যক নাট্যদল, যার ৪০ বছর পূর্তি আজ। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এটা নিশ্চয়ই একটা দীর্ঘ সময়।
১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধের তারুণ্য নিয়ে মুনীর চৌধুরীর 'কবর' নাটক মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে আরণ্যক নাট্যদল । তারপর অন্যদের মতোই পথচলা, তবে কীভাবে জনতার কাছাকাছি থাকা যায় সে পথ খোঁজার চেষ্টা ছিল তাদের সবসময়। 'কবর', 'পশ্চিমের সিঁড়ি', 'গন্ধর্ব নগরী' মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে ছিল তাদের এই পথ খোঁজার চেষ্টা। এক সময় পথ পেয়ে যায় তারা। মঞ্চে আনে 'ওরা কদম আলী', 'ইবলিশ', 'ওরা আছে বলেই'। এ সময় অনেকেই বলতে থাকেন, আরণ্যক মঞ্চে রাজনৈতিক স্লোগান দিচ্ছে, এটা শিল্প নয়। কিন্তু আরণ্যক নাট্যদল এসব থোড়াই কেয়ার করে তাদের যাত্রা অব্যাহত রাখে। সফল হয় জনতার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা। ১৯৮২ সালে আরণ্যক একটি নাট্যদল হয়েও ১ মে শ্রমিক দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠান শুরু করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। এটাও ছিল তাদের জনতার কাতারে থেকে জনতার পক্ষে কথা বলারই চেষ্টা। এখানেও সফল হয় আরণ্যক। এক সময়ে মে দিবস ছিল শুধুই শ্রমিকদের। আরণ্যকের এ প্রচেষ্টার পর থেকেই মে দিবস হয়ে ওঠে সমগ্র জনতার।
ইতিমধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পরিবর্তন আসে, পতন ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়নের। এ পরিবর্তনেও জনতার কাতারে থাকার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায় আরণ্যকের। সোভিয়েত ইউনিয়নের পটপরিবর্তনের পর আরণ্যক নাট্যদল মঞ্চে আনে 'খেলা খেলা' নাটক। এক সময় আরণ্যক নাট্যকর্মীরা দেখতে পায় স্বাধীনতাবিরোধীরা আবারও জেঁকে বসছে তাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে। জনতা তাদের মূলোৎপাটনের সংকল্প করছে। তাই তো 'জয়জয়ন্তী' নাটক মঞ্চে এনে আবারও জনতার পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে আরণ্যক। এভাবেই তারা মঞ্চে আনে মঞ্চনাটকের হারানো দলিল 'লেবেদেভ'। 'সঙক্রান্তি' নাটকের মধ্যে তারা ধরে রাখার চেষ্টা করে কৃষকের হারানো সংস্কৃতি সঙযাত্রাকে। আদিবাসী মানুষের লড়াইয়ের কথাও বাদ দেয় না তারা, আদিবাসীদের সাম্প্রতিক লড়াইয়ের কথা তুলে আনে 'রাঢ়াঙ' নাটকে। অতীত ঘেঁটে মঞ্চে আনে 'ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর' নাটক।
জনতার কাতারে থাকার চেষ্টায় গত ৪০ বছর তারা সফলতার পরিচয়ই দিয়েছে বলা চলে। কারণ এই সময়েই অনেক নাট্য দল হারিয়ে গেছে নিয়মিত নাটক মঞ্চায়ন না করতে পেরে। কেউ কেউ পরিণত হয়েছে বার্ষিক নাটকের সংগঠনে। কিন্তু আরণ্যক নাট্যদল টিকে আছে, দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ঢাকাসহ সারাদেশের মঞ্চে। জনতার সঙ্গে থাকার এই সাধনা যদি অব্যাহত থাকে তবে তারা টিকে থাকবে অনাগত বহুদিন।

সাইফুল ইসলাম :ছড়াকার ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.