সময়ের প্রতিধ্বনি-দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেবেন না by মোস্তফা কামাল

দেশের মানুষের কথা এখন আর কেউ ভাবে না। দেশ কোথায় গেল, দেশের মানুষের কী হলো, তা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের এখন মূল টার্গেটই হচ্ছে পরস্পরকে ঘায়েল করা। বিরোধীপক্ষ চায় যেকোনো উপায়ে সরকারকে টেনেহিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামাতে।


আর সরকারপক্ষ বিরোধীপক্ষকে কতভাবে হেনস্তা করা যায়, সেই কাজে লিপ্ত রয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং প্রধান বিরোধী দল বিএনপির একগুঁয়ে মনোভাবের কারণে চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরে চার-চারজন মানুষের প্রাণহানি হলো; এর দায় কে নেবে? কে দেবে নিহত চারজনের পরিবারকে সান্ত্বনা? স্বজনদের বুকফাটা কান্নার শব্দ কি আমাদের নেতানেত্রীদের কানে পৌঁছবে?
চাঁদপুর এবং লক্ষ্মীপুরে কী এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল যে পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হলো? কে গুলি করার নির্দেশ দিল? কেন দিল? এসব প্রশ্ন বারবারই সামনে চলে আসছে। নাকি তৃতীয়পক্ষ ইস্যু সৃষ্টির জন্য কোনো সুযোগ নিল; সে বিষয়টিও অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। আমরা বরাবরই দেখে আসছি, রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করতে এমন ধরনের কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটানো হয়। যা কারো কাম্য নয়। গণতান্ত্রিক সরকারের পুলিশও কি স্বৈরতান্ত্রিক আমলের পুলিশের মতো আচরণ করবে? এভাবেই কিছু অতিউৎসাহী পুলিশ সদস্য সরকারকে বিব্রত করে। সেই পুলিশের পক্ষ নিয়েই সরকারকে বিবৃতি দিতে হয়! বলতে হয়, পুলিশ যা করেছে ঠিক করেছে!
বিলম্ব না করে সরকারের উচিত অতি দ্রুত চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরের ঘটনার তদন্ত এবং দোষীদের বিচারের ব্যবস্থা করা। তা না হলে এর সব দায় কিন্তু সরকারের ওপরই বর্তাবে।
বলতে দ্বিধা নেই, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ হঠাৎ কেন জানি অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। বলা যায়, বিরোধী দলের সঙ্গে পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়ায় নেমেছে দলটি। গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় এমন আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। আওয়ামী লীগ জনগণের মধ্য থেকে গড়ে ওঠা একটি রাজনৈতিক সংগঠন। রাজধানী থেকে তৃণমূল পর্যন্ত এই দলের রয়েছে শক্ত ভিত্তি। দলটির দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগ সব সময়ই নেতৃত্ব দিয়েছে। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছে। বাঙালি জাতি গঠন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে জীবন দিতে হয়েছে। নিশ্চয়ই সেই ইতিহাস ভুলে যায়নি আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ এমন একটি সংগঠন, যে দলের বেশির ভাগ সময়ই আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কেটেছে। সরকার পরিচালনার সুযোগ খুব কমই পেয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সারা জীবনই আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। ২৩ বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ছিলেন। বিনিময়ে দেশের মানুষ পেল স্বাধীনতা। অথচ সেই মানুষটি মাত্র সাড়ে তিন বছর দেশ গঠনের সুযোগ পেলেন! তারপর দীর্ঘ সময় আওয়ামী লীগকে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামে থাকতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে দেশের রাজপথ। এই ইতিহাসও নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্বের অজানা নয়।
তার পরও কেন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা? বিরোধী দল গণমিছিল করলেই কি সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়ে যাবে? সরকার বেকায়দায় পড়ে যাবে? তাহলে কেন পাল্টা কর্মসূচি দেওয়া হলো? এটা জনগণের কাছে পরিষ্কার, গণমিছিলের কর্মসূচি ব্যাহত করতেই আওয়ামী লীগ পাল্টা কর্মসূচি দিয়েছে।
আমরা সবাই জানি, গত রবিবার প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের গণমিছিলের কর্মসূচি ছিল। এই কর্মসূচি তারা এক মাস আগেই ঘোষণা করেছিল। সেই থেকেই বিএনপি প্রস্তুতি নিয়ে আসছিল। গণমিছিল কর্মসূচির কয়েক দিন আগে থেকে আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলা শুরু করলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট নাশকতা সৃষ্টি করতে পারে। সে জন্যই এ ধরনের গণমিছিলের কর্মসূচি দিয়েছে। বিরোধী দলের নাশকতার আশঙ্কায় প্রধানমন্ত্রীও সংশ্লিষ্টদের নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে বৈঠক করেন।
সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে চায়। এই অভিযোগ খণ্ডন করতে হবে বিএনপিকেই। কিন্তু বিএনপি এখনো জনগণের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার করতে পারেনি। বিএনপি বারবারই বলছে, 'বিচার আমরাও চাই, তবে সেই বিচার আন্তর্জাতিক মানের এবং স্বচ্ছ হতে হবে।' তাহলে তো বিচারপ্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিএনপিকে অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু বিএনপি কিছুতেই জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া ভাব কাটাতে পারছে না। আসলে জামায়াতকে ছাড়তেও চাচ্ছে না। বিএনপি নেতাদের ধারণা, জামায়াত ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না। তাই অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, জামায়াতের ইস্যু বাস্তবায়নের জন্য বিএনপি ব্যবহৃত হচ্ছে। বিএনপিতে জামায়াতপন্থী কয়েকজন নেতা বেশ সক্রিয়। তাঁরা খালেদা জিয়াকে ভুল বুঝিয়ে বিএনপিকে জামায়াতিকরণ করতে বাধ্য করছেন। এ কারণে মুক্তিযোদ্ধাপন্থী নেতারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির নেতা-কর্মীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন।
আসলে বিএনপি যতই জামায়াতের দিকে ঝুঁকছে, দেশের সাধারণ মানুষের সমর্থনও ততই হারাচ্ছে। সাধারণ মানুষ বিএনপিকে 'না বাম, না ডান'পন্থী একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে দেখতে আগ্রহী। এ ধরনের মধ্যপন্থী নীতির কারণেই কিন্তু বিএনপির উত্থান ঘটেছিল। সেই অবস্থান থেকে বিএনপি অনেকটাই সরে গেছে। ফলে আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপি সাধারণ মানুষের সমর্থন খুব একটা পাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আওয়ামী লীগের ওপর বিরক্ত হয়ে মানুষ বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়ে।
বিএনপি মধ্যপন্থী অবস্থান তৈরি করতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকা কঠিন হবে বলে মনে করি। মুসলিম লীগের ইতিহাস সচেতন মহলের অজানা নয়। পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগই ছিল সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল। এখন সেই দলের নামগন্ধও নেই। বিএনপির ভ্রান্ত নীতির কারণে মুসলিম লীগের মতো অবস্থা যেন না হয়, সে জন্য বিএনপিকে সতর্ক থাকতে হবে।
বিএনপির বিরুদ্ধে আরো একটি অভিযোগ করা হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে। বলা হচ্ছে, বিএনপি নাশকতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তারা নাকি অবৈধ উপায়ে (সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে) ক্ষমতায় যেতে চায়। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় সেটা সম্ভব নয়। যদি বিএনপি নাশকতামূলক কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু নাশকতার অভিযোগ এনে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার কোনো মানে হয় না! বিএনপি রবিবার গণমিছিলের কর্মসূচি দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ পরদিন দিতে পারত। একই দিন কেন ক্ষমতাসীন দলকে সমাবেশ ডাকতে হবে? তা ছাড়া দেশের অভিভাবক হিসেবে সরকারের হস্তক্ষেপ করা উচিত ছিল। কিন্তু আমরা দেখলাম, প্রধান দুটি দলের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির কারণে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করতে বাধ্য হলো।
বিএনপি শনিবার সন্ধ্যায় নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে। গণমিছিলের কর্মসূচি রবিবারের পরিবর্তে সোমবার আহ্বান করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগও সোমবার ঢাকায় সমাবেশ ডাকে। এটা কী ধরনের আচরণ! আবার বলা হচ্ছে, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই নাকি রবিবারের সমাবেশ কর্মসূচি স্থগিত করেছে ক্ষমতাসীন দল। বিএনপি এবারও আওয়ামী লীগের আগেই কর্মসূচি দিয়েছে। একই দিন আওয়ামী লীগকেও সমাবেশ করতে হবে কেন? একদিন পরে করলে কি সমাবেশে লোক কম হতো? নাকি সমাবেশ সফল না হওয়ার ভয় ছিল?
যেহেতু আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পুলিশের ওপর, সেহেতু পুলিশ সঠিক কাজটিই করেছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কি তার দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করেছে? নাকি ক্ষমতায় গিয়ে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ভুলে গেছে? বিএনপি যদি নাশকতার কোনো ফাঁদ পেতেই থাকে তাহলে সেই ফাঁদে কিন্তু তারা নিজেরাই পড়বে! আর এ ক্ষেত্রে যদি কোনো ষড়যন্ত্র হয়ে থাকে, তাহলে জনগণ নিশ্চয়ই তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকবে। নিকট-অতীতের ঘটনাপ্রবাহ কারোরই অজানা নয়। বিগত নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবির কারণ তাদের অতীতের কর্মকাণ্ড। আবার একই কারণে ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়েছিল। উভয় দলেরই মনে রাখা প্রয়োজন, দেশের জনগণ সবচেয়ে বড় বিচারক। তাদের বিচার বড়ই কঠিন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতাদের উদ্দেশে আবারও বলি, প্রতিহিংসার রাজনীতি করে দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেবেন না। তাতে নিজেদেরই ক্ষতি হবে। আপনাদের সংঘাতের রাজনীতির সুযোগ নিতে পারে তৃতীয় পক্ষ। আপনাদের নিজেদের ভুলের কারণে তৃতীয় পক্ষের হাতে ক্ষমতা চলে গেলে তা পুনরুদ্ধার করা কিন্তু কঠিন হয়ে পড়বে। কাজেই সহিংস রাজনীতি পরিহার করে অহিংসার পথ বেছে নিন। সমঝোতায় পৌঁছতে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসুন। শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করুন। আমরা আশা করি, উভয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.