চরাচর-শৈলবানি দার্জিলিং by আলফাজ চৌধুরী
দার্জিলিং শব্দের উৎপত্তি তিব্বতীয় ভাষায় দুটি শব্দ থেকে। প্রথম শব্দটি দর্জে, যার অর্থ হলো দেবরাজ ইন্দ্রের হাতে থাকা শস্ত্র-বজ্র। দ্বিতীয় শব্দটি হলো লিং, অর্থাৎ জায়গা। বজ্রপাতের জায়গা মানেই দার্জিলিং। দার্জিলিং সম্বন্ধে আরেকটি কথা প্রচলিত আছে, তা হলো- লেপচা উপজাতীয় ভাষায় 'দার-জু-লয়াং'; যার অর্থ সৌন্দর্যের দেবী, কামদেব জায়া, রতির নিবাসস্থান। তিব্বতের এক লামারও নাম ছিল দরজে, যিনি ১৭৫৬ সালে পর্বতের এক উচ্চ নির্জন শৃঙ্গের ওপর একটি মঠ স্থাপন করেন, যা বর্তমানে দার্জিলিংয়ের 'অবজারভেটরি হিল'।
ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজের প্রাক্কালে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ১৭৮০ সালে একদল জনগোষ্ঠীর মানুষ সুদূর পূর্বে, সিকিম রাজ্যে প্রবাহিত তিস্তা নদীর তীরে গমন করে। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ প্রশাসন এ ঘটনাকে সহজভাবে নিতে পারেনি। তারা এ ঘটনাকে নেপালের সঙ্গে চুক্তিভঙ্গের আখ্যা দেয়। ফলে ১৮৩১ সালে নেপালের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ বাধে। ব্রিটিশরা সিকিম রাজার পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করে। ১৮১৬ সালে সেই যুদ্ধে নেপাল পরাজয় স্বীকার করে ব্রিটিশদের সঙ্গে একটি চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করে। ফলে নেপাল রাজ্যকে প্রায় চার হাজার বর্গমাইল জমি ছেড়ে দিতে হয়। এই অঞ্চলটাই বর্তমান দার্জিলিং পর্বতমালার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যপূর্ণ বিস্তৃত ক্ষেত্র। নেপাল ও সিকিমের মধ্যে চোরাবালির মতো একটা সুপ্ত মতভেদ থেকেই যায়। ১৮২৮ সালে ক্যাপ্টেন সি এ লয়েড ও জে গ্র্যান্ট নামে ব্রিটিশের দুই আধিকারিক নেপাল ও সিকিমের মধ্যে থাকা আন্তরিক কলহ মেটানোর জন্য দার্জিলিংয়ের চুংটঙে অবস্থান করেন। ব্রিটিশের এই দুই আধিকারিক সেই সময় দার্জিলিংয়ের প্রাকৃতিক সম্ভার দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়েন। তাঁরা দার্জিলিংকে একটা স্যানিটোরিয়াম হিসেবে পরিবর্তিত করার পরিকল্পনা হাতে নেন। ১৮৪৯ সালে সিকিমের রাজার সঙ্গে ব্রিটিশের সম্পর্কে ফাটল ধরে। যেকোনো কারণেই হোক, ব্রিটিশের দুই আধিকারিককে সিকিমরাজ বন্দি করেন। ব্রিটিশ প্রশাসন এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করে এবং পরিশেষে সিকিমরাজ তাঁদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এ সম্পর্কবিচ্ছেদের কারণে ব্রিটিশ প্রশাসন সিকিমের বার্ষিক মাসোহারা বন্ধ করে দেয় এবং এর পরেই দার্জিলিংয়ের এ অঞ্চলকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়। দার্জিলিংয়ের বিস্তৃত শৈল অঞ্চলে ১৮৪৭ সালে লোরটো কনভেন্ট, ১৮৬৪ সালে সেন্ট পল স্কুল, ১৮৮৮ সালে সেন্ট জোসেফ স্কুল স্থাপিত হয় এবং তার পর থেকেই দার্জিলিং শিক্ষাক্ষেত্রে এক প্রধান জনপদ হয়ে ভারতের মানচিত্রে স্থান পায়। পরে ১৮৮১ সালের জুন মাসে এখানে রেলস্টেশন স্থাপিত হয় এবং তার পর থেকেই দার্জিলিংয়ের টয়ট্রেন বিশ্বের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। কৃষিক্ষেত্রেও দার্জিলিংয়ের অবদান উল্লেখযোগ্য। ১৮৬৮ সালে এখানে প্লান্টার্স ক্লাব ও ১৮৭৮ সালে বোটানিক্যাল গার্ডেনের কাজ আরম্ভ হয়। ১৯২১ সালে এখানে টাউন হল স্থাপিত হয়, যা বর্তমানে দার্জিলিং পৌরসভার কার্যালয়। ঠিক এই সময়েই দার্জিলিংয়ে চা-শিল্পের ভিত্তি স্থাপন হতে থাকে। জনপদের এই উন্নতি প্রকল্পে সেই সময় বহু বহিরাগত লোক নির্মাণকার্যকে কেন্দ্র করে দার্জিলিংয়ে আসেন এবং এখানকার কৃষি ও নির্মাণকার্যে নিজেদের সহযোগিতা দিয়ে দার্জিলিংয়ের উন্নতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। দার্জিলিং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যসম্পন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের ভাঁড়ার। দার্জিলিংয়ের কেবল চা-শিল্পই ভারতবর্ষের অর্থনীতিতে এক মুখ্য ভূমিকা পালন করে এসেছে। দার্জিলিংয়ের অন্য সম্পদ হলো- বনজ সম্পদ ও প্রাকৃতিক বর্ষারণ্য। ২৯ মে, ১৯৫৩ সালে সর্বপ্রথম যে দুই পর্বতারোহী বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টে আরোহণ করে ইতিহাস গড়েছিলেন তাঁরা হলেন- এডমন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগে। এই তেনজিং নোরগে ছিলেন দার্জিলিংয়ের ভারতীয় নাগরিক। এই ঐতিহাসিক ঘটনা দ্বারা প্রেরিত হয়ে পরবর্তীকালে তেনজিং নোরগে দার্জিলিংয়ে পর্বত আরোহণ প্রশিক্ষণের জন্য হিমালয় মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। দার্জিলিংয়ের দ্রষ্টব্য স্থানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- দার্জিলিংয়ের টয়ট্রেন, যা বর্তমানে ইউনেস্কো দ্বারা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের স্থান লাভ করেছে, বাতাসিয়া লুপ ও যুদ্ধ স্মারক, টাইগার হিল, অবজারভেটরি হিল, চা-বাগান, জাপানি শান্তিস্তূপ (বৌদ্ধ মঠ), ধীরধাম মন্দির, ম্যাল ও চৌরাস্তা, ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট, বৌদ্ধ মঠগুলো, হিমালয় জুলজিক্যাল পার্ক, রোপওয়ে ও বোটানিক্যাল গার্ডেন।
আলফাজ চৌধুরী
আলফাজ চৌধুরী
No comments