জলবায়ু পরিবর্তন-বিপন্নতা নিয়ে ব্যবসা নয় by ম এম খালেকুজ্জামান

ডিজাস্টার ফিকশন মুভি ২০১২ গত বছর মুক্তি পাওয়া আলোচিত চলচ্চিত্রগুলোর একটি। ঘরোয়া ডিভিডি প্লেয়ারে কিংবা আধুনিক সিনেপ্লেক্সের বড় পর্দায় আরও জীবন্তভাবে ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করার রুদ্ধশ্বাস অনুভূতি নিয়েছেন অনেকেই। পর্বতসমান বিশাল বিশাল ঢেউ ধেয়ে আসছে লোকালয়ের দিকে, আর তার আঘাতে দ্রুতই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে দিল্লি থেকে ওয়াশিংটন তাবৎ বড় বড় শহর।


কেবল চীনারাই এই প্রলয়ংকরী ধ্বসংযজ্ঞ থেকে বাঁচার চেষ্টা হিসেবে তিনটি বৃহদাকার নৌযান প্রস্তুত রেখেছে। যাতে ঠাঁই হয়েছে প্রভাবশালী কিছু দেশের রাজন্যবর্গের। সঙ্গে অন্য কিছু দেশের অল্পসংখ্যক ভাগ্যবান সাধারণ লোকেরও জায়গা মেলে। সব মিলিয়ে পরিচালকের মুন্সিয়ানা ও স্পেশাল ইফেক্ট নিয়ে মুখরোচক আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে ঘোরলাগা দর্শক। কিন্তু এ প্রশ্ন কি কারও মনে জাগে? বিক্ষুব্ধ জলবায়ু কবে না ফুঁসে ওঠে ঘটিয়ে দিয়ে যায় জাপানের সুনামি ও ভূমিকম্পের মতো আরও কোনো ট্র্যাজেডি!
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন মানবজাতির অস্তিত্ব তথা সভ্যতার জন্য প্রধানতম হুমকি। জলবাযু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে ঝুঁকির মুখে মানুষের সার্বিক নিরাপত্তা ও অধিকারসমূহ। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১০০ বছরে দশমিক ৭৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়েছে বলে আইপিসিসির সমীক্ষায় জানা যায়। সাগরের জলরাশির উচ্চতা যেভাবে বাড়ছে, তা অব্যাহত থাকলে সমুদ্র উপকূলবর্তী দ্বীপরাষ্ট্রগুলো ২০৫০ সালের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট দেশ বাংলাদেশ হারাবে তার উপকূলবর্তী ভূমির ১৭ থেকে ২০ শতাংশ। যেটুকু থাকবে তাতে সমুদ্রের লোনা পানি ঢুকে ৩০ শতাংশের বেশি জমির উর্বরতা নষ্ট হবে। খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে। ফলে খাদ্য নিরাপত্তাহীন দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি তৈরি হবে। প্রায় দুই কোটি জনসমষ্টি হবে স্থায়ীভাবে ভিটেমাটিহীন শরণার্থী।
জাতিসংঘের গত কানকুন সম্মেলনে দেওয়া প্রতিবেদন মতে, জলবায়ু পরিবর্তনে ১০ হাজার ভাগে বাংলাদেশের ভূমিকা মাত্র ৭ ভাগ। বাংলাদেশে জনপ্রতি কার্বন নিঃসরণের মাত্রা দশমিক তিন টনেরও কম। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে এই মাত্রা জনপ্রতি ২০ টন। অথচ ম্যাপলক্রফট ও জার্মান ওয়াচ নামের দুটি জলবায়ু গবেষণা কেন্দ্রের সমীক্ষায় বলা হয়, এ-সংক্রান্ত ঝুঁকি ও বিপদের আশঙ্কার দিক থেকে বাংলাদেশ সবার ওপরে অর্থাৎ ১ নম্বরে!
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে কপ-সিক্সটিন নামে সর্বশেষ সম্মেলনটি হয়েছিল কানকুনে। তবে এর আগের বছরের কপ-ফিফটিন বা কোপেনহেগেন সম্মেলনকেই নীতিনির্ধারণী হিসেবে ধরা হয়। ওই সম্মেলনের অন্যতম সিদ্ধান্ত ছিল জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবিলায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য ৩০ বিলিয়ন ডলারের একটি তহবিল প্রতিষ্ঠা। যার মেয়াদ ২০১২ সাল পর্যন্ত। এরপর ২০১২ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরের জন্য ঘোষণা দেওয়া হয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল। যে তহবিলের প্রধান অনুদানকারী পক্ষ হবে শিল্পোন্নত দেশগুলো। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিলিয়ন ডলারের প্রসঙ্গ আসতেই বড় বড় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলো শুরু করে জলবায়ুকেন্দ্রিক নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ। পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দেশ অ্যাডাপটেশন মিটিগেশন ইত্যকার ফন্দিফিকির করে তথাকথিত ‘রাজনৈতিক আপস’-এর ফলস্বরূপ কোপেনেহেগেন অ্যাকর্ড নামের কাগুজে দলিল বিশ্বকে উপহার দেয়। ক্ষতির কারণ তৈরি করা দেশগুলো কর্তৃক ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য এক নির্মম পরিহাস হচ্ছে এই কোপেনহেগেন অ্যাকর্ড। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ব্রাজিল, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের কারণে সৃষ্ট সংকটকে সম্ভাবনাময় ‘ক্লাইমেট বিজনেস ভেঞ্চার’-এ পরিণত করল তার এক দুর্দান্ত রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রদর্শনী যেন এ-সংক্রান্ত সম্মেলনগুলো। আর সেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশেকে বন্যার ঝুঁকিতে প্রথম, সুনামির ঝুঁকিতে তৃতীয় আর ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে ষষ্ঠ অবস্থানের কথা প্রতিষ্ঠা করে ক্ষতিপূরণমূলক তহবিলের টাকা দাবি করতে হয়। কিন্তু ক্ষতিপূরণ তহবিলের অর্থের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশের জোরালো অবস্থানের কথা বিশ্বকে জানানো। আসন্ন ডারবান সম্মেলনে সেটাই করা উচিত।
বাংলাদেশ যদিও জলবায়ু পরিবর্তনে হুমকির মুখে থাকা বিপন্ন দেশের অন্যতম, তবে দ্বীপদেশ মালদ্বীপ কিংবা পৃথিবীর চতুর্থ ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র টুভালুও কম বিপন্ন নয়। বিপন্নতায় বাংলাদেশের কাছাকাছি অবস্থান হলেও রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে পুরোপুরি বিপরীত অবস্থানে দেশ দুটি। বাংলাদেশের ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রত্যাশা আমাদের রাষ্ট্রীয় অবস্থান হলেও টুভালুর প্রধানমন্ত্রী অপিসাই ইলেমিয়ার প্রতিবাদী উচ্চারণ ‘আমাদের অস্তিত্ব টাকার বিনিময়ে বিক্রি করতে চাই না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যখন জলবায়ু শরণার্থীদের বিভিন্ন দেশে অভিবাসনের সুযোগদানের প্রত্যাশা করেন, সেখানে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ বলেন, ‘আমরা দেশ ছাড়তে চাই না, আমরা টিকে যেতে পারি যদি পৃথিবী আমাদের প্রতি যত্নবান হয়।
যাদের সভ্যতা বিকাশের মিল-কারখানার চুল্লি থেকে নির্গত ধোঁয়ায় চোখ জ্বলে আমাদের মতো দেশের মানুষের, কোনো অপরাধ না করেও সাহায্যের ঝুলিটি মেলে ধরব তাদেরই দিকে? একবার কি ভেবে দেখেছি, তখন আসলে দূর থেকে আমাদের কেমন দেখায়? সে কি নিঃস্ব রিক্ত সহায়হীন করুণাপ্রার্থীর রূপ নয়? কোপেনহেগেন কিংবা কানকুনের মতো সম্মেলনগুলোতে আমাদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অবস্থান কী ছিল, আর ভবিষ্যতে কী হবে, তা পর্যালোচনা করার সময় এসেছে এখন। মূল্যহীন নই আমরা। বিপন্নতা ব্র্যান্ডিং করে ক্ষতিপূরণের অর্থ পাওয়ার চেয়ে বিপন্নতা রোধে শক্ত রাজনৈতিক অবস্থান গড়তে পারলে তা দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সম্মানিত হবে নিঃসন্দেহে।
এম এম খালেকুজ্জামান: পরিবেশবিদ।

No comments

Powered by Blogger.