চারদিক-ভাইবে রাধারমণ বলে...
‘জলে গিয়াছিলাম সই/ কালো কাজলের পাখি দেইখা আইলাম কই...’, ‘কারে দেখাবো মনের দুঃখ গো/ আমি বুক চিড়িয়া/ অন্তরে তুষের অনল জ্বলে গইয়া গইয়া...’, ‘ভ্রমর কইও গিয়া/ শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে অঙ্গ যায় জ্বলিয়ারে ভ্রমর/ তারে কইও গিয়া...’, ‘ভাইবে রাধারমণ বলে শোনরে কালিয়া...’ এমন অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা সিলেটের মরমী বৈষ্ণব সাধক কবি রাধারমণ দত্ত।
বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে এই মরমী সাধককে ধামাইল গানের জনক বলা হয়। গত ১৩ নভেম্বর ছিল তাঁর ৯৫তম মৃত্যুবার্ষিকী।
বৈষ্ণব এই মরমী কবির ৯৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে গত ১৮ নভেম্বর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে হয়ে গেল স্মরণোৎসব। আলোচনায়-গানে-নৃত্যে তিনি স্মরিত হয়েছেন।
শ্রীমঙ্গল পৌরসভা শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে যৌথভাবে এ উৎসবের আয়োজন করে ধামাইল নৃত্য উন্নয়ন পরিষদ ও শ্রীমঙ্গল সাংস্কৃতিক একাডেমি। এর পৃষ্ঠপোষকতা করেন ধামাইল গীতের সংগ্রাহক রামকৃষ্ণ সরকার, বুলবুল আনাম, নীহারেন্দু কর, সুলতান মোহম্মদ ইদ্রিস, জহর তরফদার প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে প্রধান ও বিশেষ অতিথি ছিলেন মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শেখ মতিয়ার রহমান ও শ্রীমঙ্গল পৌরসভার মেয়র মো. মহসীন মিয়া। রাধারমণের জীবনী, তাঁর অনন্য সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা করেন মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক সাইয়্যিদ মুজীবুর রহমান, কবি ও লোকজ গবেষক মাহফুজুর রহমান, প্রাবন্ধিক ও গবেষক আহমদ সিরাজ, মৌলভীবাজার শিল্পকলা একাডেমীর সাধারণ সম্পাদক আকবর আলী, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর রাধারমণ স্মৃতি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. আফরোজ মিয়া। সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্ত্তীর সভাপতিত্বে এবং অনিতা দেবের সঞ্চালনায় এতে স্বাগত বক্তব্য দেন শ্রীমঙ্গল চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জহর তরফদার।
অধ্যাপক সাইয়্যিদ মুজীবুর রহমান তাঁর বক্তব্যে জগন্নাথপুরে রাধারমণের বেদখল হয়ে যাওয়া বাড়ি পুনরুদ্ধারের দাবি জানিয়ে বলেন, রাধারমণের অনেক গীতিকাব্য যেমনিভাবে হারিয়ে গেছে, তেমনিভাবে হারিয়ে গেছে তাঁর বসতভিটাও। তিনি বলেন, তাঁর বংশধরেরা যদি না থাকেন তা হলে তাঁর বসতবাড়ি অর্পিত সম্পত্তি হতে পারে। কিন্তু রাধারমণের বংশধরেরা মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছেন। তাঁরা এ দেশেরই নাগরিক।
কবি ও লোকজ গবেষক মাহফুজুর রহমান বলেন, রাধারমণের গানে রয়েছে প্রেম, বিরহ, হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের বাস্তব চিত্র। ঈশ্বর প্রেমকে তিনি নতুন আঙ্গিকে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি দেহতত্ত্ব, প্রেম, ভজন, বিরহ, অনুরাগ, ধামাইলসহ প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার গান রচনা করেছেন।
প্রাবন্ধিক ও গবেষক আহমদ সিরাজ বলেন, বিভিন্ন সময়ে রাধারমণের গানের বেশ কিছু গানের বই প্রকাশিত হয়েছে। ড. নির্মলেন্দু ভৌমিক, অধ্যাপক মো. মনসুর উদ্দিন, সৈয়দ মুরতজা আলী, নন্দ লাল শর্মা, মাহমুদা খাতুন, অধ্যাপক দেওয়ান মো. আজরফসহ আরও কয়েকজন বিদগ্ধজন তাঁর সৃষ্টিকে সংগ্রহ করেছেন। প্রখ্যাত লোকতত্ত্ববিদ চৌধুরী গোলাম আকবর সিলেট মদন মোহন কলেজ সাহিত্য পরিষদের মাধ্যমে একটি বই প্রকাশ করেন। এতে রাধারমণের তিন শতাধিক গান স্থান পেয়েছে। রাধারমণের বেশ কিছু গান বাংলা একাডেমির সংগ্রহেও রয়েছে। শ্রীমঙ্গলের রামকৃষ্ণ সরকারসহ আরও অনেকেই এখনো তাঁর গান সংগ্রহ করছেন। তবে অবিকৃত অবস্থায় তাঁর গানগুলো সংগ্রহ করাটা জরুরি। এটা খুবই কঠিন কাজ। কেননা তিনি তাঁর রচনা লিখে যাননি।
মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শেখ মতিয়ার রহমান বলেন, শ্রীমঙ্গলে এই প্রথমবারের মতো রাধারমণের ৯৫তম মৃত্যুবার্ষিকীকে উপলক্ষ করে স্মরণোৎসব উদ্যাপন হলো। আমাদের শত বছরের লোকজ সংস্কৃতির প্রাণ এসব ব্যক্তিত্বকে নিয়ে যত বেশি অনুষ্ঠান হবে তত বেশি আমাদের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হবে। আমাদের প্রজন্ম বাংলা এবং বাঙালির শত-সহস্র বছরের ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হবে। তিনি এসব উদ্যোগে জেলা প্রশাসন থেকে সব রকম সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
রাধারমণ সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের কেশবপুর গ্রামে ১২৪১ বঙ্গাব্দে (১৮৩৩ খ্রি.) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রাধামাধব দত্ত। মাত্র নয় বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। মা সুবর্ণা দেবীর কাছেই তাঁর বড় হওয়া। ১২৭৫ বঙ্গাব্দে মৌলভীবাজারের আদপাশা গ্রামে নন্দকুমার সেন অধিকারীর কন্যা গুণময়ী দেবীকে বিয়ে করেন। দুই পুত্র ও স্ত্রী একযোগে মারা যাওয়ায় তিনি সংসারবিরাগী হয়ে যান। বাড়িসংলগ্ন নলুয়ার হাওরে একটি পর্ণ কুটির তৈরি করে সেখানে সাধন-ভজন শুরু করেন। ওই কুটিরে তিনি মুখে মুখে গান রচনা করে সুর ধরে গাইতেন। তাঁর ভক্তরা শুনে লিখে রাখতেন। এ কারণে তাঁর নিজ হাতে রচিত গানের কোনো পাণ্ডুলিপি নেই। রাধারমণ দত্ত ৮২ বছর বয়সে ১৩২২ বঙ্গাব্দের ২৬ কার্তিক (১৯১৫ খ্রি.) পরলোক গমন করেন। তাঁর জন্মস্থান জগন্নাথপুর উপজেলার কেশবপুর গ্রামে। হিন্দুরীতি অনুযায়ী তাঁকে দাহ না করে বৈষ্ণব মতবাদ অনুযায়ী সমাহিত করা হয়।
বিশ্বজ্যোতি চৌধুরী
No comments