আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৩৭)-মায়ের আলমারি খুলে তাঁর শাড়িগুলো স্পর্শ করে দেখতাম by আলী যাকের
গেণ্ডারিয়া থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের কিছু রাহা খরচ বরাদ্দ ছিল। আমার জন্য লোহারপুলের গোড়া থেকে সদরঘাট হয়ে গুলিস্তান এবং গুলিস্তান থেকে হেঁটে বিশ্ববিদ্যালয় আর ঝুনু কাঠের পুলের ওপর দিয়ে ধোলাইখাল পেরিয়ে সেখান থেকে রিকশায় ইউনিভার্সিটি। দুজনের দুই পথ এই কারণে যে প্রথমত দুজনের দুই ভিন্ন সময়ে ক্লাস ছিল আর ঝুনু মেয়ে বলে রিকশায় যাওয়ার বিশেষ সুযোগ পেত।
তবে আমরা ভাইবোনে মিলে নিজেদের মধ্যে একটা ছোট্ট ষড়যন্ত্রমূলক বোঝাপড়া করে নিয়েছিলাম। আমরা দুজনে একই সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাসে করে ইউনিভার্সিটি যেতাম। কেউ যদি ক্লাসের অনেক আগেই পেঁৗছে যেত, তাহলে সে অপেক্ষা করত তার ক্লাসের জন্য। এভাবে তিন-চার দিন পয়সা বাঁচিয়ে আমরা নাজ সিনেমা হলে ঘড়ড়হ ঝযড়-িতে ঝঃঁফবহঃং' ঈড়হপবংংরড়হ-এ ছবি দেখতাম। এই সময় অসাধারণ সব ছবি আমরা দেখেছি। যেমন_সোফিয়া লরেন অভিনীত 'টু উইমেন', চার্লস ডিকেন্সের 'এ টেল অব টু সিটিজ', ফেলিনির 'লা ডলচেভিটা', 'ফল অব দ্য রোমান এম্পায়ার', এলিজাবেথ টেলর অভিনীত 'ক্লিওপেট্রা', চার্লটন হেস্টন এবং গ্রেগরি পেক অভিনীত 'দ্য বিগ কান্ট্রি', 'বেনহুর' এসব অবিস্মরণীয় ছবি।
এ সময়ে দিদির আগ্রহে এবং নেতৃত্বে আমরা ঢাকার বাইরে বেশ কয়েকবার পিকনিক করতে গিয়েছিলাম ময়নামতি, জয়দেবপুর ও মধুপুর। এসব স্মৃতিও ভোলার নয়। পাশাপাশি আমাদের মুকুলমেলার কাজ চলছিল। এই সময়ে গেণ্ডারিয়াতে মুকুলমেলার মুখপত্র হিসেবে আমরা প্রান্তিক নামে দেয়ালপত্রিকা প্রকাশ করলাম। স্মর্তব্য যে আমাদের মুকুলমেলা 'প্রান্তিক মুকুলমেলা' হিসেবে পরিচিত ছিল। এ সময় মওলানা আকরম খাঁর ছেলে বদরুল আনাম খাঁ আজাদ পত্রিকার স্বত্বাধিকারী হিসেবে মুকুলমেলার দেখাশোনা করতেন। তাঁরই অর্থানুকূল্যে আমরা এক সেট ড্রাম উপহার পাই এবং আমাদের প্যারেড, পিটি আরো উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। প্রান্তিক আয়োজিত সাহিত্য বাসর আমাদের খুবই আকর্ষণ করত। সেখানে আমরা সবাই যে যেমন পারি গল্প-কবিতা লেখার চেষ্টা করতাম। যখন আমরা দ্বিগুণ উৎসাহে সব বিষয় নিয়ে কাজ করে চলেছি তখন '৬৩-র শেষের দিকে মায়ের রোগটা আবার ফিরে এল। আমরা ভেবেছিলাম কলকাতায় চিকিৎসার পর মা বোধ হয় সম্পূর্ণ ভালো হয়ে গেছেন। তখনো জানতাম না মায়ের সেরে ওঠা ছিল সাময়িক নিরাময়। তাঁর ডাক্তার আমাদের বললেন আবার কলকাতায় নিয়ে যেতে। এবারে মায়ের সঙ্গে আমি আর ঝুনু কলকাতায় গেলাম। সেবারই প্রথম আমাদের অ্যারোপ্লেন চড়া। মনে পড়ে ইস্পাহানিদের পরিচালনায় 'ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ' বলে একটি কম্পানি ডাকোটা বিমান দিয়ে ঢাকা-কলকাতার মধ্যে চলাচল করত। প্লেনে চড়ে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম বৈকি, তবে মায়ের অসুখ নিয়ে ভীষণ শঙ্কিত ছিলাম। তখনো জানি না কলকাতার বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা কী বলবেন।
কলকাতার হাসপাতালে মাকে নিয়ে যাওয়ার পর নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলো। তারপর আমাদের বলা হলো যে মায়ের অসুখের চিকিৎসা যে জন্য করা হয়েছিল, শরীরের সে অংশটি এখন সম্পূর্ণরূপে ক্যান্সারমুক্ত। তবে এর মানে এই নয় যে অসুখটি শরীরের অন্য কোথাও দেখা যেতে পারে না। এ রকম অবস্থায় ওঁরা বললেন যে যখন যে অসুবিধা হবে, সেই অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে হবে। আমরা ডাক্তারদের এই কথায় সম্পূর্ণ আশ্বস্ত হতে পারলাম না। আমার বড় মামার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন কলকাতার নামকরা শল্যচিকিৎসক। তিনি বললেন, মায়ের চিকিৎসাটি ভুল হয়েছে। প্রথমেই অপারেশন করে তারপর রে দেওয়ার দরকার ছিল। এখন অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। তেমন আর কিছু করার নেই। ঢাকায় থাকতেই একটি অনুসন্ধানে ধরা পড়েছিল, তাঁর ফুসফুসে যক্ষ্মা রয়েছে। সেই মতে চিকিৎসা চলতে লাগল। আমরা তাঁর যক্ষ্মার সুচিকিৎসার জন্য কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের তখনকার প্রধান ডক্টর পি কে সেনকে নিয়ে এসেছিলাম। সহজে তাঁর সময় পাওয়া যেত না তখন, কিন্তু আমার নানার বন্ধু এক ডাক্তারের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমাকে বলা হয়েছিল, আমি যেন মায়ের অবস্থার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে ইংরেজিতে একটি প্রতিবেদন লিখে রাখি, যা দেখে ডক্টর সেন মায়ের অসুখ সম্বন্ধে একটি প্রাথমিক ধারণা করতে পারেন। ডক্টর সেন একদিন বিকেলে মাকে দেখতে এলেন। আমার লেখা প্রতিবেদনটি পড়লেন, তারপর মাকে পরীক্ষা করলেন। পরীক্ষা করার আগে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি ডাক্তারি পড়াশোনা করি কি না? যখন আমি বললাম, আমি সমাজবিজ্ঞানে অনার্স পড়ছি, তখন তিনি খুব অবাক হলেন। বোধ হয় তিনি আর্টসের ছাত্রের কাছ থেকে এমন দুরারোগ্য ব্যাধি সম্বন্ধে এ রকম একটি প্রতিবেদন আশা করেননি। আসলে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, হাসপাতালে যাতায়াত এবং নানা রকম রিপোর্ট পড়ে পড়ে আমি প্রায় অর্ধ-চিকিৎসক হয়ে গিয়েছিলাম। যাহোক, ডক্টর সেনও বললেন যে ওষুধপত্র যা দেওয়া হয়েছিল তা-ই চলবে এবং যদি মায়ের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়, তাঁকে যেন জানানো হয়। ওই অবস্থায় মাকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসার ভরসা পাচ্ছিলাম না। ইতিমধ্যে দিদি ঢাকা থেকে কলকাতায় চলে এলেন। আমি দিদি আর ঝুনুকে মায়ের কাছে রেখে ঢাকায় ফিরে এলাম। তখন '৬৪ সাল। আমার সাবসিডিয়ারি বিষয়গুলো এবং ফাংশনাল ইংলিশের পরীক্ষা সমাসন্ন। পড়ালেখায় মন দেওয়া খুবই দরকার, কিন্তু কিছুই ভালো লাগছিল না। এমনকি বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গল্প করতেও ভালো লাগত না। কী একটা কারণে ইউনিভার্সিটি তখন বন্ধ ছিল।
আমি গেণ্ডারিয়ার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম আর বাড়িতে এসে মায়ের বিছানার ওপরে চুপচাপ শুয়ে থাকতাম। মাঝমধ্যে মায়ের আলমারি খুলে তাঁর শাড়িগুলো স্পর্শ করে দেখতাম। এভাবে দিন কেটে যাচ্ছিল।
(চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
এ সময়ে দিদির আগ্রহে এবং নেতৃত্বে আমরা ঢাকার বাইরে বেশ কয়েকবার পিকনিক করতে গিয়েছিলাম ময়নামতি, জয়দেবপুর ও মধুপুর। এসব স্মৃতিও ভোলার নয়। পাশাপাশি আমাদের মুকুলমেলার কাজ চলছিল। এই সময়ে গেণ্ডারিয়াতে মুকুলমেলার মুখপত্র হিসেবে আমরা প্রান্তিক নামে দেয়ালপত্রিকা প্রকাশ করলাম। স্মর্তব্য যে আমাদের মুকুলমেলা 'প্রান্তিক মুকুলমেলা' হিসেবে পরিচিত ছিল। এ সময় মওলানা আকরম খাঁর ছেলে বদরুল আনাম খাঁ আজাদ পত্রিকার স্বত্বাধিকারী হিসেবে মুকুলমেলার দেখাশোনা করতেন। তাঁরই অর্থানুকূল্যে আমরা এক সেট ড্রাম উপহার পাই এবং আমাদের প্যারেড, পিটি আরো উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। প্রান্তিক আয়োজিত সাহিত্য বাসর আমাদের খুবই আকর্ষণ করত। সেখানে আমরা সবাই যে যেমন পারি গল্প-কবিতা লেখার চেষ্টা করতাম। যখন আমরা দ্বিগুণ উৎসাহে সব বিষয় নিয়ে কাজ করে চলেছি তখন '৬৩-র শেষের দিকে মায়ের রোগটা আবার ফিরে এল। আমরা ভেবেছিলাম কলকাতায় চিকিৎসার পর মা বোধ হয় সম্পূর্ণ ভালো হয়ে গেছেন। তখনো জানতাম না মায়ের সেরে ওঠা ছিল সাময়িক নিরাময়। তাঁর ডাক্তার আমাদের বললেন আবার কলকাতায় নিয়ে যেতে। এবারে মায়ের সঙ্গে আমি আর ঝুনু কলকাতায় গেলাম। সেবারই প্রথম আমাদের অ্যারোপ্লেন চড়া। মনে পড়ে ইস্পাহানিদের পরিচালনায় 'ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ' বলে একটি কম্পানি ডাকোটা বিমান দিয়ে ঢাকা-কলকাতার মধ্যে চলাচল করত। প্লেনে চড়ে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম বৈকি, তবে মায়ের অসুখ নিয়ে ভীষণ শঙ্কিত ছিলাম। তখনো জানি না কলকাতার বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা কী বলবেন।
কলকাতার হাসপাতালে মাকে নিয়ে যাওয়ার পর নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলো। তারপর আমাদের বলা হলো যে মায়ের অসুখের চিকিৎসা যে জন্য করা হয়েছিল, শরীরের সে অংশটি এখন সম্পূর্ণরূপে ক্যান্সারমুক্ত। তবে এর মানে এই নয় যে অসুখটি শরীরের অন্য কোথাও দেখা যেতে পারে না। এ রকম অবস্থায় ওঁরা বললেন যে যখন যে অসুবিধা হবে, সেই অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে হবে। আমরা ডাক্তারদের এই কথায় সম্পূর্ণ আশ্বস্ত হতে পারলাম না। আমার বড় মামার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন কলকাতার নামকরা শল্যচিকিৎসক। তিনি বললেন, মায়ের চিকিৎসাটি ভুল হয়েছে। প্রথমেই অপারেশন করে তারপর রে দেওয়ার দরকার ছিল। এখন অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। তেমন আর কিছু করার নেই। ঢাকায় থাকতেই একটি অনুসন্ধানে ধরা পড়েছিল, তাঁর ফুসফুসে যক্ষ্মা রয়েছে। সেই মতে চিকিৎসা চলতে লাগল। আমরা তাঁর যক্ষ্মার সুচিকিৎসার জন্য কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের তখনকার প্রধান ডক্টর পি কে সেনকে নিয়ে এসেছিলাম। সহজে তাঁর সময় পাওয়া যেত না তখন, কিন্তু আমার নানার বন্ধু এক ডাক্তারের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমাকে বলা হয়েছিল, আমি যেন মায়ের অবস্থার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে ইংরেজিতে একটি প্রতিবেদন লিখে রাখি, যা দেখে ডক্টর সেন মায়ের অসুখ সম্বন্ধে একটি প্রাথমিক ধারণা করতে পারেন। ডক্টর সেন একদিন বিকেলে মাকে দেখতে এলেন। আমার লেখা প্রতিবেদনটি পড়লেন, তারপর মাকে পরীক্ষা করলেন। পরীক্ষা করার আগে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি ডাক্তারি পড়াশোনা করি কি না? যখন আমি বললাম, আমি সমাজবিজ্ঞানে অনার্স পড়ছি, তখন তিনি খুব অবাক হলেন। বোধ হয় তিনি আর্টসের ছাত্রের কাছ থেকে এমন দুরারোগ্য ব্যাধি সম্বন্ধে এ রকম একটি প্রতিবেদন আশা করেননি। আসলে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, হাসপাতালে যাতায়াত এবং নানা রকম রিপোর্ট পড়ে পড়ে আমি প্রায় অর্ধ-চিকিৎসক হয়ে গিয়েছিলাম। যাহোক, ডক্টর সেনও বললেন যে ওষুধপত্র যা দেওয়া হয়েছিল তা-ই চলবে এবং যদি মায়ের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়, তাঁকে যেন জানানো হয়। ওই অবস্থায় মাকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসার ভরসা পাচ্ছিলাম না। ইতিমধ্যে দিদি ঢাকা থেকে কলকাতায় চলে এলেন। আমি দিদি আর ঝুনুকে মায়ের কাছে রেখে ঢাকায় ফিরে এলাম। তখন '৬৪ সাল। আমার সাবসিডিয়ারি বিষয়গুলো এবং ফাংশনাল ইংলিশের পরীক্ষা সমাসন্ন। পড়ালেখায় মন দেওয়া খুবই দরকার, কিন্তু কিছুই ভালো লাগছিল না। এমনকি বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গল্প করতেও ভালো লাগত না। কী একটা কারণে ইউনিভার্সিটি তখন বন্ধ ছিল।
আমি গেণ্ডারিয়ার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম আর বাড়িতে এসে মায়ের বিছানার ওপরে চুপচাপ শুয়ে থাকতাম। মাঝমধ্যে মায়ের আলমারি খুলে তাঁর শাড়িগুলো স্পর্শ করে দেখতাম। এভাবে দিন কেটে যাচ্ছিল।
(চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments