সাক্ষাৎকার শামসুজ্জামান খান-বইমেলার আয়োজন সম্প্রসারিত করা উচিত by ইকবাল হাসান
বাঙালি জাতির মননের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত বাংলা একাডেমী। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ফসল এই জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা ভাষা ও সাহিত্য গবেষণার জন্য প্রধানতম কেন্দ্র। ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতি গবেষণার পাশাপাশি গত প্রায় তিন দশকের অধিককাল মাসব্যাপী সফল বইমেলার আয়োজন করছে প্রতি বছর ১ ফেব্রুয়ারি থেকে।
বইমেলা এখন এতটাই বিস্তৃত যে, বাংলা একাডেমীর পক্ষে এটা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকেই মনে করেন বইমেলার আয়োজন বাংলা একাডেমীর প্রাঙ্গণ থেকে বাইরে সম্প্রসারিত হওয়া উচিত। এসব বিষয় তো বটেই বাংলা একাডেমীর সার্বিক কর্মকাণ্ড নিয়ে সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক, বিশিষ্ট লোকসাহিত্য গবেষক-লেখক শামসুজ্জামান খান
সমকাল : গবেষণা ও সৃজনশীল সাহিত্য প্রকাশ একাডেমীর প্রধান দায়িত্ব। মূল এই দায়িত্বের বাইরে বইমেলা করার বাড়তি দায়িত্ব থেকে বাংলা একাডেমীর অব্যাহতি মিলবে কবে?
শামসুজ্জামান খান : মূলত বাংলা একাডেমীর কাজ গবেষণামূলক। আমাদের এখানে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র রয়েছে বইয়ের প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে। এ ধরনের বইমেলার আয়োজন করার দায়িত্ব ছিল জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের। যে কোনো কারণেই হোক, তারা ব্যর্থ হয়েছে বা করতে পারেনি। কিন্তু লেখক, সাহিত্যিক, প্রকাশক সবার দাবি, বইমেলা অবশ্যই করতে হবে এবং সেটি বাংলা একাডেমী করলেই ভালো হয়। কারণ, একুশের আবেগের সঙ্গে একাডেমীর একটি গভীরতর সম্পর্ক রয়েছে। তাছাড়া বাংলা একাডেমী যে বিশাল বইমেলার আয়োজন করছে তাতে একুশের চেতনা এবং বাঙালির সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটে বলে এই মেলার মাধ্যমে এক ধরনের সাংস্কৃতিক চেতনারও সৃষ্টি হয়। তরুণ প্রজন্মের কাছে এই চেতনা পেঁৗছে দেওয়া জরুরি। এদিকে লক্ষ্য রেখে অন্য কোনো সংস্থা করছে না বলেই একাডেমী বইমেলার দায়িত্ব নিয়েছে। তবে এখানেই একাডেমীর গবেষণার কর্ম কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে জন্য বইমেলা বর্তমান অবস্থায় যেভাবে হয়, সেভাবে করা বাংলা একাডেমীর জন্য কঠিন কাজ হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত প্রস্তাব হলো, এই বইমেলাকে আংশিকভাবে বাংলা একাডেমীতে রেখে বাকি অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে সম্প্রসারিত করা উচিত।
এটা করা হলে বইমেলা একটি পরিচ্ছন্ন মেলায় পরিণত হবে। আর একুশের আবেগের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলা একাডেমী ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের গভীর আত্মিক যোগ রয়েছে। কারণ, মেডিকেল কলেজের কাছেই '৫২ সালে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। শহীদ মিনারও মেডিকেল কলেজের মতোই বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের আরও বেশি সংলগ্ন। মেলা যেহেতু সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন, সে জন্য এই ধরনের একটি ব্যবস্থাই যথাযথ হবে বলে মনে করি।
সমকাল : গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে একাডেমীতে ব্যাপক রাজনৈতিক নিয়োগের অভিযোগ আছে। বর্তমান সরকারের আমলেও এ ধরনের অভিযোগ শোনা যায়। কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন কী?
শামসুজ্জামান খান : এ সরকারের আমলে কোনো ধরনের নিয়োগই হয়নি। যা হয়েছে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের আমল নিয়ে যে কথা উঠেছে, তা সত্যি নয়। কয়েকটি প্রকল্পের জন্য শুধু কয়েকজন গবেষক সাময়িকভাবে চুক্তিভিত্তিক কাজ করছেন। রাজনৈতিক নিয়োগ দেওয়া ব্যক্তিদের এখন বাদ দেওয়ার ব্যাপারটি বেশ জটিল এবং এ ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া অমানবিকও বটে। আপাতত আমরা বিষয়টি নিয়ে ভাবছি না।
সমকাল : স্টল বরাদ্দ নিয়ে প্রতি বছর নানা অভিযোগ ওঠে। এবারও উঠেছে_ বইমেলার নিয়মনীতি মানা হয়নি। প্রতিবার এ অভিযোগ ওঠার কারণ বলবেন কি?
শামসুজ্জামান খান : এটা একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। এটা নির্ধারিত হয় একটি কমিটির মাধ্যমে এবং এই কমিটিতে প্রকাশকবৃন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি, সাংস্কৃতিক জোটের প্রতিনিধি এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গও যুক্ত আছেন। তারপরও যদি কোনো প্রকাশক এই অভিযোগ তোলেন, তাহলে আমাদের দিক থেকে কিছুই বলার নেই। এই মেলা একটি বিশাল মেলা। এই মেলার আয়োজন করা খুব দুরূহ একটি কাজ। এর মধ্যেও আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে মেলাটি পরিচালনা করছি এবং এ ক্ষেত্রে সবাইকে খুশি করা অসম্ভব।
সমকাল : রাজনৈতিক লেজুড়ভিত্তিক সংগঠনগুলোর স্টল বরাদ্দ বন্ধ হচ্ছে না কেন?
শামসুজ্জামান খান : এটা বন্ধ করতে গেলে বইমেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠ, বাংলা একাডেমীতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে শক্তিশালী একটি জাতীয় কমিটির মাধ্যমে স্টল বরাদ্দ করতে হবে। তাহলে হয়তো ওই ধরনের স্টলের সংখ্যা কমানো সম্ভব হবে।
সমকাল : অভিধান প্রণয়নসহ অনেক ভালো কাজ আপনারা করেছেন। কিন্তু উচ্চশিক্ষায় বাংলা গ্রন্থ প্রকাশের জন্য পরিভাষা কোষ তৈরি থমকে আছে কেন?
শামসুজ্জামান খান : এই কাজটি থেমে নেই এবং এটা এতটাই উন্নত মানের হয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গেও এর চাহিদা বিপুল। তবে পাঠ্যপুস্তক রচনার জন্য এক ধরনের বিশেষ জ্ঞান এবং রচনাশৈলী আয়ত্ত করা প্রয়োজন। সে ধরনের পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা আমাদের দেশে কম।
এখন আমরা সীমিত সংখ্যক পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করব, তা গুণে-মানে উন্নত হতে হবে। কোনো পাঠ্যপুস্তক জনপ্রিয় হলেও দ্বিতীয়বার ছাপা হবে না। কারণ, সে বই প্রকাশে প্রকাশকরাই উৎসাহিত হবেন। একাডেমী বরং নতুন কোনো বিষয়ে মানসম্মত পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করলেই উচ্চশিক্ষায় পাঠ্যপুস্তকের অভাব দ্রুত দূর করা সম্ভব হবে।
আত্মসমালোচনার জন্য এ কথা আমরা বলতে পারি যে, ইতিপূর্বে পাঠ্যপুস্তকের বরাদ্দ টাকায় যেসব বই প্রকাশ করা হয়েছে, তার অনেকগুলোই প্রকৃত প্রস্তাবে দুর্বল বা পাঠ্যপুস্তক নয়।
সমকাল : এক সময় বিশ্বসাহিত্যের ক্লাসিক গ্রন্থ প্রকাশ করে একাডেমী যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিল। ওই ধরনের অনুবাদের কাজ প্রায় তিন যুগ ধরে বন্ধ। এই প্রকল্পটি নতুনরূপে চালু করার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন কি?
শামসুজ্জামান খান : সৈয়দ আলী আহসান সাহেব যখন পরিচালক ছিলেন, তখন এ ধরনের গ্রন্থ যথেষ্ট পরিমাণে প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তীকালে পরিচালক বা মহাপরিচালকবৃন্দ আর এদিকটায় নজর দেননি। আমরা বাংলা একাডেমীর জন্য একটি নতুন আইন প্রণয়ন করে ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ে পেশ করেছি। এতে একটি শক্তিশালী অনুবাদ ও অভিধান বিভাগ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই আইনটি পাস হলে একাডেমীতে অনুবাদকর্ম আগের মতো প্রকাশ হতে পারবে এবং অভিধান বিভাগও একাডেমীর অভিধানগুলো নিয়মিত হালনাগাদ করার ব্যবস্থা করতে পারবে।
সমকাল : 'উত্তরাধিকার' পত্রিকাটি আপনি সহজপ্রাপ্য এবং জীবন্ত করে তুলেছেন। কিন্তু পাশাপাশি শিশু-কিশোর পত্রিকা 'ধানশালিকের দেশে' ত্রৈমাত্রিক বলা হলেও গত ৩ বছরে মাত্র দুটি সংখ্যা বেরিয়েছে।
শামসুজ্জামান খান : একজন মহাপরিচালকের পক্ষে একাডেমীর কাজ পরিচালনাই সার্বক্ষণিক সময় দাবি করে। তারপরও সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসার কারণে আমি 'উত্তরাধিকার' পত্রিকাটি নিয়মিত দেখাশোনা করছি। লেখাগুলো পড়ি, নিজে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং একটি টিমের মাধ্যমে পত্রিকাটিকে এমন উন্নত পর্যায়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
'ধানশালিকের দেশে'র জন্য এই সময়টা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে কী করা যেতে পারে সে বিষয়ে বিভিন্ন বিকল্প নিয়ে ভাবা হচ্ছে।
সমকাল : বাংলা একাডেমীর সদস্যপদ লাভ করেছেন বহু অলেখক। অযোগ্য-অলেখকদের বাদ দেওয়ার জন্য একাডেমীর গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করার কথা ভাবছেন কি?
শামসুজ্জামান খান : এখন থেকে সদস্যপদ যাতে যোগ্য ব্যক্তিরা পেতে পারেন তার জন্য আমি সদস্যবিধি পরিবর্তন করেছি। এখন সদস্য হওয়া আর আগের মতো সহজ হবে না। যাদের অযোগ্য সদস্য বানানো হয়েছে, তাদের সদস্যপদ বাতিল করা এই মুহূর্তে হয়তো সম্ভব নয়। তবে এ ব্যাপারে আইন করার কথা আমাদের চিন্তাভাবনায় রয়েছে।
সমকাল : বাংলা একাডেমীর সাহিত্য পুরস্কার বহুদিন কলুষিত ছিল, আপনি একাডেমী পুরস্কারটিকে মর্যাদাবান করেছেন। আমার প্রশ্ন, এমন দিন কি আসবে যেদিন কেউ জানতে
পারবে না মনোনয়নকারী ২৫ জন সদস্য কে বা কারা?
শামসুজ্জামান খান : পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে মানোন্নয়নদাতাদের নাম প্রকাশের ক্ষেত্রে কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করেছি। এরপর এক্ষেত্রে তদবিরের সুযোগ কমেছে বলে মনে করি। কিন্তু তবুও পুরস্কারপ্রত্যাশীরা অনুমান করেই বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
পুরস্কারের ব্যাপারে আমি বরাবরই যতদূর সম্ভব কঠোর থেকেছি। কোনো ধরনের দলবাজি, অনুরোধ ও তদবিরের কাছে মাথানত করিনি।
সমকাল : গবেষণা ও সৃজনশীল সাহিত্য প্রকাশ একাডেমীর প্রধান দায়িত্ব। মূল এই দায়িত্বের বাইরে বইমেলা করার বাড়তি দায়িত্ব থেকে বাংলা একাডেমীর অব্যাহতি মিলবে কবে?
শামসুজ্জামান খান : মূলত বাংলা একাডেমীর কাজ গবেষণামূলক। আমাদের এখানে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র রয়েছে বইয়ের প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে। এ ধরনের বইমেলার আয়োজন করার দায়িত্ব ছিল জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের। যে কোনো কারণেই হোক, তারা ব্যর্থ হয়েছে বা করতে পারেনি। কিন্তু লেখক, সাহিত্যিক, প্রকাশক সবার দাবি, বইমেলা অবশ্যই করতে হবে এবং সেটি বাংলা একাডেমী করলেই ভালো হয়। কারণ, একুশের আবেগের সঙ্গে একাডেমীর একটি গভীরতর সম্পর্ক রয়েছে। তাছাড়া বাংলা একাডেমী যে বিশাল বইমেলার আয়োজন করছে তাতে একুশের চেতনা এবং বাঙালির সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটে বলে এই মেলার মাধ্যমে এক ধরনের সাংস্কৃতিক চেতনারও সৃষ্টি হয়। তরুণ প্রজন্মের কাছে এই চেতনা পেঁৗছে দেওয়া জরুরি। এদিকে লক্ষ্য রেখে অন্য কোনো সংস্থা করছে না বলেই একাডেমী বইমেলার দায়িত্ব নিয়েছে। তবে এখানেই একাডেমীর গবেষণার কর্ম কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে জন্য বইমেলা বর্তমান অবস্থায় যেভাবে হয়, সেভাবে করা বাংলা একাডেমীর জন্য কঠিন কাজ হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত প্রস্তাব হলো, এই বইমেলাকে আংশিকভাবে বাংলা একাডেমীতে রেখে বাকি অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে সম্প্রসারিত করা উচিত।
এটা করা হলে বইমেলা একটি পরিচ্ছন্ন মেলায় পরিণত হবে। আর একুশের আবেগের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলা একাডেমী ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের গভীর আত্মিক যোগ রয়েছে। কারণ, মেডিকেল কলেজের কাছেই '৫২ সালে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। শহীদ মিনারও মেডিকেল কলেজের মতোই বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের আরও বেশি সংলগ্ন। মেলা যেহেতু সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন, সে জন্য এই ধরনের একটি ব্যবস্থাই যথাযথ হবে বলে মনে করি।
সমকাল : গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে একাডেমীতে ব্যাপক রাজনৈতিক নিয়োগের অভিযোগ আছে। বর্তমান সরকারের আমলেও এ ধরনের অভিযোগ শোনা যায়। কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন কী?
শামসুজ্জামান খান : এ সরকারের আমলে কোনো ধরনের নিয়োগই হয়নি। যা হয়েছে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের আমল নিয়ে যে কথা উঠেছে, তা সত্যি নয়। কয়েকটি প্রকল্পের জন্য শুধু কয়েকজন গবেষক সাময়িকভাবে চুক্তিভিত্তিক কাজ করছেন। রাজনৈতিক নিয়োগ দেওয়া ব্যক্তিদের এখন বাদ দেওয়ার ব্যাপারটি বেশ জটিল এবং এ ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া অমানবিকও বটে। আপাতত আমরা বিষয়টি নিয়ে ভাবছি না।
সমকাল : স্টল বরাদ্দ নিয়ে প্রতি বছর নানা অভিযোগ ওঠে। এবারও উঠেছে_ বইমেলার নিয়মনীতি মানা হয়নি। প্রতিবার এ অভিযোগ ওঠার কারণ বলবেন কি?
শামসুজ্জামান খান : এটা একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। এটা নির্ধারিত হয় একটি কমিটির মাধ্যমে এবং এই কমিটিতে প্রকাশকবৃন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি, সাংস্কৃতিক জোটের প্রতিনিধি এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গও যুক্ত আছেন। তারপরও যদি কোনো প্রকাশক এই অভিযোগ তোলেন, তাহলে আমাদের দিক থেকে কিছুই বলার নেই। এই মেলা একটি বিশাল মেলা। এই মেলার আয়োজন করা খুব দুরূহ একটি কাজ। এর মধ্যেও আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে মেলাটি পরিচালনা করছি এবং এ ক্ষেত্রে সবাইকে খুশি করা অসম্ভব।
সমকাল : রাজনৈতিক লেজুড়ভিত্তিক সংগঠনগুলোর স্টল বরাদ্দ বন্ধ হচ্ছে না কেন?
শামসুজ্জামান খান : এটা বন্ধ করতে গেলে বইমেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠ, বাংলা একাডেমীতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে শক্তিশালী একটি জাতীয় কমিটির মাধ্যমে স্টল বরাদ্দ করতে হবে। তাহলে হয়তো ওই ধরনের স্টলের সংখ্যা কমানো সম্ভব হবে।
সমকাল : অভিধান প্রণয়নসহ অনেক ভালো কাজ আপনারা করেছেন। কিন্তু উচ্চশিক্ষায় বাংলা গ্রন্থ প্রকাশের জন্য পরিভাষা কোষ তৈরি থমকে আছে কেন?
শামসুজ্জামান খান : এই কাজটি থেমে নেই এবং এটা এতটাই উন্নত মানের হয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গেও এর চাহিদা বিপুল। তবে পাঠ্যপুস্তক রচনার জন্য এক ধরনের বিশেষ জ্ঞান এবং রচনাশৈলী আয়ত্ত করা প্রয়োজন। সে ধরনের পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা আমাদের দেশে কম।
এখন আমরা সীমিত সংখ্যক পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করব, তা গুণে-মানে উন্নত হতে হবে। কোনো পাঠ্যপুস্তক জনপ্রিয় হলেও দ্বিতীয়বার ছাপা হবে না। কারণ, সে বই প্রকাশে প্রকাশকরাই উৎসাহিত হবেন। একাডেমী বরং নতুন কোনো বিষয়ে মানসম্মত পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করলেই উচ্চশিক্ষায় পাঠ্যপুস্তকের অভাব দ্রুত দূর করা সম্ভব হবে।
আত্মসমালোচনার জন্য এ কথা আমরা বলতে পারি যে, ইতিপূর্বে পাঠ্যপুস্তকের বরাদ্দ টাকায় যেসব বই প্রকাশ করা হয়েছে, তার অনেকগুলোই প্রকৃত প্রস্তাবে দুর্বল বা পাঠ্যপুস্তক নয়।
সমকাল : এক সময় বিশ্বসাহিত্যের ক্লাসিক গ্রন্থ প্রকাশ করে একাডেমী যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিল। ওই ধরনের অনুবাদের কাজ প্রায় তিন যুগ ধরে বন্ধ। এই প্রকল্পটি নতুনরূপে চালু করার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন কি?
শামসুজ্জামান খান : সৈয়দ আলী আহসান সাহেব যখন পরিচালক ছিলেন, তখন এ ধরনের গ্রন্থ যথেষ্ট পরিমাণে প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তীকালে পরিচালক বা মহাপরিচালকবৃন্দ আর এদিকটায় নজর দেননি। আমরা বাংলা একাডেমীর জন্য একটি নতুন আইন প্রণয়ন করে ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ে পেশ করেছি। এতে একটি শক্তিশালী অনুবাদ ও অভিধান বিভাগ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই আইনটি পাস হলে একাডেমীতে অনুবাদকর্ম আগের মতো প্রকাশ হতে পারবে এবং অভিধান বিভাগও একাডেমীর অভিধানগুলো নিয়মিত হালনাগাদ করার ব্যবস্থা করতে পারবে।
সমকাল : 'উত্তরাধিকার' পত্রিকাটি আপনি সহজপ্রাপ্য এবং জীবন্ত করে তুলেছেন। কিন্তু পাশাপাশি শিশু-কিশোর পত্রিকা 'ধানশালিকের দেশে' ত্রৈমাত্রিক বলা হলেও গত ৩ বছরে মাত্র দুটি সংখ্যা বেরিয়েছে।
শামসুজ্জামান খান : একজন মহাপরিচালকের পক্ষে একাডেমীর কাজ পরিচালনাই সার্বক্ষণিক সময় দাবি করে। তারপরও সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসার কারণে আমি 'উত্তরাধিকার' পত্রিকাটি নিয়মিত দেখাশোনা করছি। লেখাগুলো পড়ি, নিজে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং একটি টিমের মাধ্যমে পত্রিকাটিকে এমন উন্নত পর্যায়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
'ধানশালিকের দেশে'র জন্য এই সময়টা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে কী করা যেতে পারে সে বিষয়ে বিভিন্ন বিকল্প নিয়ে ভাবা হচ্ছে।
সমকাল : বাংলা একাডেমীর সদস্যপদ লাভ করেছেন বহু অলেখক। অযোগ্য-অলেখকদের বাদ দেওয়ার জন্য একাডেমীর গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করার কথা ভাবছেন কি?
শামসুজ্জামান খান : এখন থেকে সদস্যপদ যাতে যোগ্য ব্যক্তিরা পেতে পারেন তার জন্য আমি সদস্যবিধি পরিবর্তন করেছি। এখন সদস্য হওয়া আর আগের মতো সহজ হবে না। যাদের অযোগ্য সদস্য বানানো হয়েছে, তাদের সদস্যপদ বাতিল করা এই মুহূর্তে হয়তো সম্ভব নয়। তবে এ ব্যাপারে আইন করার কথা আমাদের চিন্তাভাবনায় রয়েছে।
সমকাল : বাংলা একাডেমীর সাহিত্য পুরস্কার বহুদিন কলুষিত ছিল, আপনি একাডেমী পুরস্কারটিকে মর্যাদাবান করেছেন। আমার প্রশ্ন, এমন দিন কি আসবে যেদিন কেউ জানতে
পারবে না মনোনয়নকারী ২৫ জন সদস্য কে বা কারা?
শামসুজ্জামান খান : পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে মানোন্নয়নদাতাদের নাম প্রকাশের ক্ষেত্রে কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করেছি। এরপর এক্ষেত্রে তদবিরের সুযোগ কমেছে বলে মনে করি। কিন্তু তবুও পুরস্কারপ্রত্যাশীরা অনুমান করেই বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
পুরস্কারের ব্যাপারে আমি বরাবরই যতদূর সম্ভব কঠোর থেকেছি। কোনো ধরনের দলবাজি, অনুরোধ ও তদবিরের কাছে মাথানত করিনি।
No comments