স্মরণ-স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল আবদুল্লাহ আলমুতী
আজ ৩০ নভেম্বর। কৃতী বিজ্ঞান লেখক, মনস্বী শিক্ষাবিদ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ড. আবদুল্লাহ আলমুতী শরফুদ্দীনের ত্রয়োদশ মৃত্যুবার্ষিকী। পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধে রাজশাহী কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে আবদুল্লাহ আলমুতীর কর্মজীবন শুরু।
অধ্যাপনার পাট চুকিয়ে পরে তিনি অন্য সরকারি চাকরিতে যোগ দেন এবং কালক্রমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে অধিষ্ঠিত হন। জীবদ্দশায় ড. আলমুতী নানা শিক্ষামূলক কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
মূলত পদার্থবিজ্ঞানী হলেও আলমুতী ছিলেন একজন একনিষ্ঠ গণিত অনুরাগী ব্যক্তি। ১৯৮০ সালের ৫-৭ অক্টোবর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ গণিত সমিতির উদ্যোগে দ্বিতীয় গণিত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে অধ্যাপনা করছি। সম্মেলনের এক অধিবেশনে সভাপতির আসন অলংকৃত করেন ড. আলমুতী। অধিবেশনের অন্যতম বক্তা হিসেবে সে সময়ই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ-পরিচয়। ছিপছিপে গড়নের হাস্যোজ্জ্বল এ মানুষটি ছিলেন নিরহংকার, অমায়িক ও মিষ্টভাষী। বক্তৃতা-বিবৃতিতেও তিনি ছিলেন পারঙ্গম। দেড় দশক পেরিয়ে দেশবরেণ্য এ শিক্ষাবিদের সঙ্গে ফের আমার একটা যোগসূত্র সৃষ্টি হয়ে গেল। বাংলাদেশ গণিত সমিতির মুখপত্র গণিত পরিক্রমার সম্পাদনার কার্যভার ন্যস্ত হয়েছে আমার ওপর। এখনো এ দায়িত্বে রয়েছি। লেখার জন্য অনুরোধ জানালে ‘গণিতের আদিযুগ: প্রাচ্যের কাছে প্রতীচ্যের ঋণ’ শীর্ষক একটা লেখা পাঠিয়ে দেন তিনি। গণিত পরিক্রমার সপ্তম খণ্ডে (১৯৯৭) লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে। মুখপত্রটির উ ৎকর্ষ সাধনে তাঁর পরামর্শ ও ভূমিকা ছিল দৃষ্টিগ্রাহ্য।
গণিত পরিক্রমা অষ্টম খণ্ডে আরেকটি লেখা প্রকাশের প্রত্যাশায় ড. আলমুতীর সঙ্গে প্রায়ই আমার যোগাযোগ হতো। মাঝেমধ্যে তাঁর ফ্রি স্কুল স্ট্রিট হাতিরপুলের বাসায়ও সাক্ষা ৎ করেছি। বলতে গেলে ১৯৯৭ সালের মার্চ থেকে দেড় বছর যতবার তাঁর সাহচর্যে গিয়েছি, অতি আন্তরিকতার সঙ্গে ও খোলামেলাভাবে তিনি কথা বলেছেন। শেষের বিশেষ তারিখটি মনে পড়ে, ২ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮। সেদিন তাঁকে খুবই প্রসন্ন মনে হচ্ছিল। কে জানত, ওই দিনই হবে তাঁর সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষা ৎ।
লেখার ব্যাপারে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে তিনি আমাকে টেলিফোন করতে বললেন। ২৫ সেপ্টেম্বর টেলিফোন করলাম। শুনলাম তিনি অসুস্থ। পত্রিকার খবরে জানলাম, ড. আবদুল্লাহ আলমুতী বারডেম হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। পরে সুচিকি ৎসার জন্য তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছে। পরবর্তী সংবাদ: আবদুল্লাহ আলমুতী ক্যানসারে আক্রান্ত। মুমূর্ষু অবস্থায় রয়েছেন। তাঁর রোগমুক্তির জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে দেশবাসীর কাছে দোয়া কামনা করা হয়েছে। এই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী সম্পর্কে এসব খবর পড়ে মনটা বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাঁকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হলো। ১৯৯৮ সালের ১৬ নভেম্বর বেলা একটায় তাঁর বাসায় যাই। শয্যাশায়ী ও অচেতন অবস্থায় তাঁকে একপলক দেখলাম।
১৯৯৭ সংখ্যার আমাদের মুখপত্রে প্রকাশিত প্রবন্ধটি আলমুতীর প্রথম ও শেষ লেখা। গণিতের আদিযুগ: প্রাচ্যের কাছে প্রতীচ্যের ঋণ দিয়ে তিনি আমাদের ঋণী করে গেলেন। আর কোনো দিন লেখা পাব না তাঁর কাছ থেকে। ১৯৯৮ সংখ্যার পরিক্রমায় তাঁর আরেকটি লেখা প্রকাশের আশা ত্যাগ করলাম। বরং তাঁকে নিয়েই ওই সংখ্যায় ‘একজন লেখকের তিরোধান: আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি’ শিরোনামে আমি লেখা প্রকাশ করেছি।
১৯৯৮ সালের ৩০ নভেম্বর বিকেল পাঁচটা ৪০ মিনিটে ঢাকার বারডেম হাসপাতালে আলমুতী ইহলোক ত্যাগ করেন। দুরারোগ্য ব্যাধি তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে চিরতরে। তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন সুযোগ্য সন্তানকে হারাল। বিজ্ঞানের অঙ্গনে শূন্যতার সৃষ্টি হলো। আমাদের শিক্ষা, সাহিত্য ও বিজ্ঞান সাধনায় তিনি রেখেছেন অমূল্য অবদান। এর স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক, স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, ভারতের কলিঙ্গ পুরস্কারসহ বেশ কিছু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। জাতির জন্য এ বিজ্ঞানী রেখে গেছেন তাঁর সাধনার স্বর্ণফসল।
ত্রয়োদশ মৃত্যুবার্ষিকীতে আবদুল্লাহ আলমুতীর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। শোকার্ত পরিবার-পরিজনের প্রতি জানাই গভীর সমবেদনা। এই বড় মাপের সুন্দর মনের মানুষটিকে আমরা পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। স্মরণ করছি তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবন। সর্বোপরি, আমাদের স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল ড. আবদুল্লাহ আলমুতী শরফুদ্দীন।
এম শামসুর রহমান
সাবেক প্রফেসর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
মূলত পদার্থবিজ্ঞানী হলেও আলমুতী ছিলেন একজন একনিষ্ঠ গণিত অনুরাগী ব্যক্তি। ১৯৮০ সালের ৫-৭ অক্টোবর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ গণিত সমিতির উদ্যোগে দ্বিতীয় গণিত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে অধ্যাপনা করছি। সম্মেলনের এক অধিবেশনে সভাপতির আসন অলংকৃত করেন ড. আলমুতী। অধিবেশনের অন্যতম বক্তা হিসেবে সে সময়ই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ-পরিচয়। ছিপছিপে গড়নের হাস্যোজ্জ্বল এ মানুষটি ছিলেন নিরহংকার, অমায়িক ও মিষ্টভাষী। বক্তৃতা-বিবৃতিতেও তিনি ছিলেন পারঙ্গম। দেড় দশক পেরিয়ে দেশবরেণ্য এ শিক্ষাবিদের সঙ্গে ফের আমার একটা যোগসূত্র সৃষ্টি হয়ে গেল। বাংলাদেশ গণিত সমিতির মুখপত্র গণিত পরিক্রমার সম্পাদনার কার্যভার ন্যস্ত হয়েছে আমার ওপর। এখনো এ দায়িত্বে রয়েছি। লেখার জন্য অনুরোধ জানালে ‘গণিতের আদিযুগ: প্রাচ্যের কাছে প্রতীচ্যের ঋণ’ শীর্ষক একটা লেখা পাঠিয়ে দেন তিনি। গণিত পরিক্রমার সপ্তম খণ্ডে (১৯৯৭) লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে। মুখপত্রটির উ ৎকর্ষ সাধনে তাঁর পরামর্শ ও ভূমিকা ছিল দৃষ্টিগ্রাহ্য।
গণিত পরিক্রমা অষ্টম খণ্ডে আরেকটি লেখা প্রকাশের প্রত্যাশায় ড. আলমুতীর সঙ্গে প্রায়ই আমার যোগাযোগ হতো। মাঝেমধ্যে তাঁর ফ্রি স্কুল স্ট্রিট হাতিরপুলের বাসায়ও সাক্ষা ৎ করেছি। বলতে গেলে ১৯৯৭ সালের মার্চ থেকে দেড় বছর যতবার তাঁর সাহচর্যে গিয়েছি, অতি আন্তরিকতার সঙ্গে ও খোলামেলাভাবে তিনি কথা বলেছেন। শেষের বিশেষ তারিখটি মনে পড়ে, ২ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮। সেদিন তাঁকে খুবই প্রসন্ন মনে হচ্ছিল। কে জানত, ওই দিনই হবে তাঁর সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষা ৎ।
লেখার ব্যাপারে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে তিনি আমাকে টেলিফোন করতে বললেন। ২৫ সেপ্টেম্বর টেলিফোন করলাম। শুনলাম তিনি অসুস্থ। পত্রিকার খবরে জানলাম, ড. আবদুল্লাহ আলমুতী বারডেম হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। পরে সুচিকি ৎসার জন্য তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছে। পরবর্তী সংবাদ: আবদুল্লাহ আলমুতী ক্যানসারে আক্রান্ত। মুমূর্ষু অবস্থায় রয়েছেন। তাঁর রোগমুক্তির জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে দেশবাসীর কাছে দোয়া কামনা করা হয়েছে। এই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী সম্পর্কে এসব খবর পড়ে মনটা বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাঁকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হলো। ১৯৯৮ সালের ১৬ নভেম্বর বেলা একটায় তাঁর বাসায় যাই। শয্যাশায়ী ও অচেতন অবস্থায় তাঁকে একপলক দেখলাম।
১৯৯৭ সংখ্যার আমাদের মুখপত্রে প্রকাশিত প্রবন্ধটি আলমুতীর প্রথম ও শেষ লেখা। গণিতের আদিযুগ: প্রাচ্যের কাছে প্রতীচ্যের ঋণ দিয়ে তিনি আমাদের ঋণী করে গেলেন। আর কোনো দিন লেখা পাব না তাঁর কাছ থেকে। ১৯৯৮ সংখ্যার পরিক্রমায় তাঁর আরেকটি লেখা প্রকাশের আশা ত্যাগ করলাম। বরং তাঁকে নিয়েই ওই সংখ্যায় ‘একজন লেখকের তিরোধান: আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি’ শিরোনামে আমি লেখা প্রকাশ করেছি।
১৯৯৮ সালের ৩০ নভেম্বর বিকেল পাঁচটা ৪০ মিনিটে ঢাকার বারডেম হাসপাতালে আলমুতী ইহলোক ত্যাগ করেন। দুরারোগ্য ব্যাধি তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে চিরতরে। তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন সুযোগ্য সন্তানকে হারাল। বিজ্ঞানের অঙ্গনে শূন্যতার সৃষ্টি হলো। আমাদের শিক্ষা, সাহিত্য ও বিজ্ঞান সাধনায় তিনি রেখেছেন অমূল্য অবদান। এর স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক, স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, ভারতের কলিঙ্গ পুরস্কারসহ বেশ কিছু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। জাতির জন্য এ বিজ্ঞানী রেখে গেছেন তাঁর সাধনার স্বর্ণফসল।
ত্রয়োদশ মৃত্যুবার্ষিকীতে আবদুল্লাহ আলমুতীর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। শোকার্ত পরিবার-পরিজনের প্রতি জানাই গভীর সমবেদনা। এই বড় মাপের সুন্দর মনের মানুষটিকে আমরা পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। স্মরণ করছি তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবন। সর্বোপরি, আমাদের স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল ড. আবদুল্লাহ আলমুতী শরফুদ্দীন।
এম শামসুর রহমান
সাবেক প্রফেসর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments