সাদাকালো-প্রাদেশিকতা বনাম স্বতন্ত্র রাজ্য তেলেঙ্গানা by আহমদ রফিক
'প্রাদেশিকতা' শব্দটির বিশেষ অর্থবোধক চরিত্রের সঙ্গে আমাদের অর্থাৎ একদা পাকিস্তানবাসী বাঙালির পরিচয় খুব কম নয়। ১৯৪৭ সালের আগস্টে দেশবিভাগ সূত্রে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মুসলিম লীগ নেতাদের মুখে এ শব্দটির রাজনৈতিক তাৎপর্য-ব্যাখ্যা অনেক দেখা গেছে।
স্বয়ং পাকিস্তানের স্থপতি নামে পরিচিত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বা প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান থেকে পূর্ববঙ্গীয় (বা বলা চলে ঢাকাইয়া) খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতায়ও শোনা গেছে প্রাদেশিকতার যত তমঃগুণের বয়ান।
জিন্নাহ সাহেবের ঐতিহাসিক ঢাকা সফরকালে (১৯৪৮ মার্চ) রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) জাতির উদ্দেশে বয়ানে তিনি প্রাদেশিকতার বিপজ্জনক চরিত্র ব্যাখ্যা করেন নানাভাবে। তাঁর মতে, 'এ কথা বলা অর্থহীন যে আমরা বাঙালি বা সিন্ধি কিংবা পাঠান বা পাঞ্জাবি, এখন আমরা সবাই মুসলমান। ইসলাম আমাদের এ শিক্ষাই দিয়েছে যে আপনারা যে যা হোন না কেন, আপনি একজন মুসলমান। কাজেই সবাই মিলে জাতি গড়ে তুলতে হলে প্রাদেশিকতা বর্জন করতে হবে।' এর পরও তিনি জোর গলায় ঘোষণা দেন, যারা প্রাদেশিকতার প্রশ্রয় দেয়, তারা পাকিস্তানের দুশমন।
আসলে পাঞ্জাবি প্রভুত্ব, উর্দুভাষীর প্রভুত্ব রক্ষার জন্যই জননন্দিত নেতার ওই কৌশলী ভাষণ। জিন্নাহর মতো বিদগ্ধ ব্যক্তির জানা থাকার কথা যে সবাই মিলে দেশগড়া যায়, কিন্তু বিভিন্ন জাতিসত্তা মিলে এক জাতি গড়া যায় না। তাদের রাজনৈতিক প্রয়োজনে, ক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থে সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে (যা তখন বিদেশি পণ্ডিতদের ভাষায় ছিল 'অদ্ভুত রাষ্ট্র') তারা জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, এমনকি অস্তিত্বই অস্বীকার করতে চেয়েছে। কিন্তু ভাষিক জাতিসত্তার এমনই শক্তি, যা প্রাদেশিকতার অজুহাতে বাতিল করা যায় না। এ ক্ষেত্রেও যায়নি, ভারতীয় উসকানির কথা বলেও যায়নি।
১৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের বক্তৃতায় একই কথা বলেন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন। জিন্নাহর পূর্বোক্ত ভাষণ অনুকরণ করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি ঠেকাতে গিয়ে উর্দু রাষ্ট্রভাষার পক্ষে ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রাদেশিকতার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণার ভঙ্গিতে বলেন,'পাকিস্তানকে আমরা এছলামী রাষ্ট্ররূপে গঠন করিতে যাইতেছি। যে এছলামে কোনো প্রকার ভেদাভেদ নাই সে রাষ্ট্রে কেমন করিয়া প্রাদেশিকতার বীজ বপন চলিতে পারে?
মরহুম কায়েদে আজম বলিয়াছেন, প্রাদেশিকতা যে বা যাহারা প্রশ্রয় দেয়, তাহারা পাকিস্তানের দুশমন।'
তিনি আরো বলেন, 'রাষ্ট্রের নিরাপত্তার পক্ষে বাহিরের হুমকি অপেক্ষা প্রাদেশিকতাই অধিকতর মারাত্মক।' পাকিস্তানের উর্দুভাষী শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশ্য ছিল পূর্বাঞ্চলের বাংলাভাষীদের মতোই সিন্ধি, পশ্তু ও বালুচ ভাষিক জাতিসত্তাকে বিকশিত হতে না দেওয়া এবং অস্থানিক উর্দুভাষাভিত্তিক পাকিস্তানি জাতি-জাতীয়তা পত্তন করা_তার মৃত্তিকা-ঘনিষ্ঠ শিকড়ের অস্তিত্ব নাই থাকুক। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল উলি্লখিত জাতিসত্তাগুলোর শোষণ। বাংলাদেশ যদিও একাত্তরে মুক্তি পেয়েছে, অবশিষ্ট তিন ভাষিক ভূখণ্ডের শাসন-শোষণ ঠিকই চলছে।
প্রসঙ্গত একটু ভিন্ন কথা, সংশ্লিষ্ট বলেই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সিন্ধুর রাজধানী করাচিতে মূল বাসিন্দা সিন্ধিরা এখন সংখ্যালঘু, ভারত থেকে আসত উর্দুভাষী অর্থাৎ কথিত মোহাজেররা (বাংলাদেশে যারা এককথায় 'বিহারি' নামে পরিচিতি), সেখানে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী হিসেবে আর্থসামাজিক দাপট চালিয়ে যাচ্ছে। সিন্ধিভাষীরা এখন কোণঠাসা। অনেকটা নিজ দেশে পরবাসীর মতো।
সীমান্ত প্রদেশ ও বালুচিস্তানে বিষয়টা একটু ভিন্ন চরিত্রের। এদের মধ্যে বালুচদের ওপর আঘাতটা পড়েছে বেশি। ভাষিক জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে ওখানে প্রাণহানি (গণহত্যার পর্যায়ে) ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অবিশ্বাস্য। আইয়ুব আমলে ওদের আয়ত্তে আনতে বালুচিস্তানে আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ এবং 'বালুচিস্তানের কসাই' নামে কুখ্যাত টিক্কা খানের বর্বরতা ছিল তুলনাহীন। কিন্তু থেকে থেকে জেগে উঠেছে বালুচ জাতীয়তার চেতনা। এই তো কিছুকাল আগে খুন হলেন বালুচ জাতীয়তাবাদী নেতা নওয়াব আকবর বুগ্তি। কিন্তু তাতেও মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহ্য স্তব্ধ হয়নি।
আর পশতুভাষী পাখতুনদের (সাধারণ ভাষায় পাঠান) ওপর হিংস্র আক্রমণ তো চলে ১৯৪৭ থেকে সীমান্ত গান্ধী বাদশা খানের আমল থেকে। ব্রিটিশরাজের শেষ মুহূর্তের চাতুরী ও জাতীয় কংগ্রেসের আদর্শবাদী স্খলন (বাদশা খানের ভাষায় দীর্ঘকালের মিত্রকে নেকড়ের মুখে ছুড়ে ফেলা) পাখতুনদের জাতীয় চেতনার প্রতি ছিল প্রবল আঘাত। জেল আর নির্বাসনে বাদশাখানের (খান আবদুল গাফফার খানের) মৃত্যু, পুত্র ওয়ালি খানের আপ্রাণ চেষ্টায়ও পাখতুনদের মুক্তি মেলেনি পাকিস্তানি শাসন-শোষণের কবজা থেকে। প্রতিষ্ঠিত হয়নি তাদের বহু-আকাঙ্ক্ষিত পাখতুনিস্তান। স্বীকার্য যে বাংলাদেশের মুক্তির পেছনে দুটো প্রধান কারণ মূল পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের সীমান্ত-সানি্নধ্যের অনুপস্থিতি এবং মুক্তিযুদ্ধে ভারত-রাশিয়ার নানামাত্রিক সাহায্য।
ভাষিক জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের চেতনাকে শাসকগোষ্ঠী অনেক সময়ই প্রাদেশিকতা বা বিচ্ছিন্নতাবাদ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। যেমন_সিংহল তথা শ্রীলঙ্কায় তামিল ভাষাভাষীর আত্মশাসনের সংগ্রাম, স্পেনে বাস্কভাষীদের বিচ্ছিন্নতাবাদী লড়াই তথা মুক্তিসংগ্রাম কিংবা ঝাড়খন্ডে, আসামে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আত্মশাসনের লড়াই কোথাও সফল, কোথাও ব্যর্থ। কিন্তু এগুলোর সূচনা কিন্তু ভাষিক অধিকার বা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের অধিকারের দাবিতে, পরে বিচ্ছিন্নতার।
অতিসম্প্রতি দক্ষিণ ভারতে পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের প্রস্তাব নিয়ে শুরু হয়েছে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ধাঁচের লড়াই, যা এখনো সহিংস পন্থা অবলম্বন করেনি। অথচ আমরা জানি, গত শতকের চলি্লশের দশকে তেলেঙ্গানার কৃষকবিদ্রোহ শ্রেণী-সংগ্রামের ধারায় সমাজবাদীদের মনে কী প্রত্যাশাই না জাগিয়েছিল! 'তেলেঙ্গানা তুমি জান সূর্যের ঠিকানা'র মতো কাব্যপঙ্ক্তি সমাজবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এক অসম্ভব স্বপ্ন দেখিয়েছিল তৎকালীন সমাজবাদী চিন্তার তরুণদের ও বুদ্ধিবৃত্তিক বলয়ের কিছুসংখ্যক মানুষকে।
তেলেঙ্গানার কৃষকদের মুক্তির লড়াই তৎকালীন বঙ্গদেশের প্রগতিশীল মানসকে আদর্শবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল লড়াইয়ের পথ ধরতে এবং কিছুটা হলেও স্থানীয় কৃষক আন্দোলনে কিংবা তেভাগার সংগ্রামে উত্তাপ সরবরাহ করতে পেরেছিল। 'তেলেঙ্গানা' হয়ে ওঠে লড়াইয়ের প্রতীক, মুখে মুখে উচ্চারিত নাম। কিন্তু ব্রিটিশ রাজনীতির কূটচাতুর্য এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের পর কংগ্রেসী প্রভুত্ববাদী রক্ষণশীলতার প্রভাব ও স্থানীয় সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তায়ন তেলেঙ্গানা ট্র্যাজেডির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে সর্দার প্যাটেলের ক্রুর দমন নীতির কারণে।
কিন্তু বহুজাতিক-বহুভাষিক ভারতে জাতিসত্তার আত্মশাসনের লড়াই, যা মূলত হিন্দি আধিপত্যবাদবিরোধী, নানা ফর্মে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী নেহরুর রাজ্য পুনর্গঠন হিন্দিবিরোধী উগ্রতার কিছু প্রশমন ঘটালেও স্বায়ত্তশাসন বা বিচ্ছিন্নতার লড়াই পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। ভূখণ্ড বিভাজন নয়া রাজ্যগঠন প্রক্রিয়া ধীরপায়ে হলেও চলেছে। বলা যায় চালাতে হয়েছে।
কিছুদিন আগে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে 'তেলেঙ্গানা' নামে পৃথক রাজ্য গঠনের দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে। 'ফের উত্তাল অন্ধ্র'। ভাবা যায় না রাজ্যের বিধানসভা থেকে ৭২ জন বিধায়কের পদত্যাগ। আবার এদের ৩৫ জনই রাজ্য-শাসক কংগ্রেস দলের। এমনকি পদত্যাগ করেছেন এ রাজ্য থেকে লোকসভায় নির্বাচিত ১১ জন কংগ্রেস দলীয় সংসদ সদস্য (এমপি) এবং রাজ্যসভার দুজন কংগ্রেস সংসদ সদস্য।
তেলেঙ্গানা-পরিস্থিতি কেন্দ্রীয় জোট সরকারকে সংকটে ফেলে দিয়েছে। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য রাজ্যে ও কেন্দ্রে শক্তি সংহত করার লক্ষ্যে জনসমর্থন আদায় করতে গিয়ে কংগ্রেস পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এ উদ্দেশ্যে তেলেঙ্গানাপন্থীদের সঙ্গে রাজনৈতিক জোটও গঠন করে কংগ্রেস। যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকা। সে জন্য যেকোনো দলের সঙ্গে জোট বাঁধা চলে। উপমহাদেশের রাজনীতিতে এমন নৈরাজ্যিক আচরণ খুবই সচরাচর। বাংলাদেশের দলীয় রাজনীতিও এর ব্যতিক্রম নয়।
যেকোনো কারণে হোক বা বিশেষ কোনো কারণে হোক, তেলেঙ্গানাবিষয়ক পূর্ব প্রতিশ্রুতি থেকে কংগ্রেস সরে আসতে চাইছে। এ বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্তের টানাপড়েনে বিষয়টা স্পষ্ট। চুক্তিভঙ্গ বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ রাজনৈতিক রীতিনীতির স্খলন বা বিচ্যুতি। তাতে সাধারণ মানুষের কাছে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে বাধ্য। কিন্তু প্রচলিত রাজনীতিতে কোনো চুক্তিভঙ্গই আদর্শ চুক্তির পর্যায়ে পড়ে না। অর্থাৎ দলগুলো এসবের ধার ধারে না। আমার ধারণা, কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত ওই চুক্তিকে কোনো প্রকার মূল্য দেবে না। কোনো না কোনো অজুহাতে সেখান থেকে সরে আসবে।
সেই দেশ বিভাগের সময় থেকে দেখে আসছি রাজনীতির মূল্য লক্ষ্য ক্ষমতা দখল বা ক্ষমতা ধরে রাখা_তা যেভাবেই হোক। সে ক্ষেত্রে নীতি বা আদর্শ অর্থহীন শব্দ। ক্ষমতার জন্য দলীয় রাজনীতি পারে না, এমন কোনো কাজ নেই। পরম রাজনৈতিক শত্রু বা বিরোধী আদর্শের সঙ্গে জোট বাঁধতেও দলগুলোর বাধে না। আপসবাদিতা ও চুক্তিভঙ্গ উপমহাদেশীয় রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। রাজনীতিকদের যে চরিত্র রক্ষার কোনো দায় নেই, এমন প্রবাদ (অপবাদ?) সর্বজনবিদিত।
রাজনীতির বহুরূপী চরিত্রের সঙ্গে মানুষ পরিচিত। কিন্তু সংস্কৃতি অঙ্গনের এদিকটা ভিন্ন চরিত্রে দেখতে চায় মানুষ, সাহিত্য, সংস্কৃতি বা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে। গণতান্ত্রিক বা সমাজবাদী আদর্শের ঢাকঢোল পেটায় এমন সাহিত্যিক বা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বা সংবাদপত্র গোষ্ঠীর চোখে তেলেঙ্গানা রাজ্যের স্বতন্ত্র 'স্ট্যাটাস' যদি প্রাদেশিকতা দোষে দুষ্ট বিবেচিত হয়, তাতে অবাক না হয়ে পারা যায় না।
এদের যুক্তি হলো তেলেঙ্গানা স্বতন্ত্র রাজ্যের 'স্ট্যাটাস' পেলে সে দৃষ্টান্ত গোর্খাল্যান্ড বা কাশ্মীরকে বিচ্ছিন্নতাবাদে নতুন শক্তি জোগাবে। কিন্তু এ যুক্তি ধোপে টেকে না। কারণ তেলেঙ্গানার দাবি বিচ্ছিন্নতার নয়, স্বাধীন রাষ্ট্রের নয়। আর কাশ্মীর! শুরুতে তাদের দাবি ছিল বিশেষ কিছু সুবিধার। শেখ আবদুল্লাই কাশ্মীররাজকে ভারত ডোমিনিয়নে যুক্ত হতে সমর্থন জুগিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে নেহরু সরকার সেসব দাবি মানেনি। কাশ্মীরের রাজনীতি অনেক জটিলতা, অনেক অনাচারের মধ্য দিয়ে স্বাধীন কাশ্মীর ও পাকিস্তানি কাশ্মীরের দাবিতে গিয়ে পেঁৗছেছে। এর দায় কেন্দ্রীয় সরকারের এবং তা আমাদের আলোচ্য নয়।
যুক্তির প্রশ্নই যদি ওঠে, তাহলে তা একাধিক প্রশ্নের জন্ম দেয়। প্রশ্ন উঠতে পারে এ ধরনের যুক্তি ঝাড়খন্ডের বেলায় ওঠেনি কেন? কিংবা তেলেঙ্গানাকে অন্ধ্র রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার সময় রাজনৈতিক ঔচিত্যের কথা ওঠেনি কেন? আসলে তেলেঙ্গানার স্বাতন্ত্র্য নিয়ে তথাকথিত গণতন্ত্রীদের আপত্তির কারণ কি তেলেঙ্গানার পূর্বতম সংগ্রামী ইতিহাস? অন্তত আমার তো তা-ই মনে হয়।
কারণ ভারতীয় গণতন্ত্রীদের কট্টর সমাজবাদ-বিরোধিতা তো রীতিমতো এক ইতিহাস। ব্রিটিশরাজ শাসনের আমল থেকে নানাভাবে এর প্রকাশ। গান্ধী-প্যাটেল-রাজেন্দ্র প্রসাদ থেকে কেউ ব্যতিক্রম নন। সে উত্তরাধিকারের অবসান ঘটেনি দীর্ঘ সময়েও। কাজেই কেন্দ্রীয় সরকার যে তেলেঙ্গানা ইস্যুটাকে ঝুলিয়ে রাখবে এবং কংগ্রেসী বা গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক শিবির যে তালি বাজাবে তাতে সন্দেহের কোনো কারণ নেই।
তেলেঙ্গানা পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে ভালোভাবেই জানে, সুসংগঠিত ও আধুনিক চরিত্রের কেন্দ্রীয় সামরিক শক্তি গায়ের জোরে অনেক বাস্তবতা অস্বীকার করতে পারে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতবোনের কারো কারোর সাম্প্রতিক নম্র কণ্ঠস্বরও আপস-সমঝোতার সুর তার প্রমাণ। তবে গোর্খাল্যান্ডের ক্ষেত্রে সামরিক শক্তি নমনীয় কেন, তার কারণ বোঝা যায় না। যাই হোক, পরিস্থিতি বিচার করেই বোধ হয় তেলেঙ্গানা সংগ্রামের বদলে সংসদীয় ভদ্রপন্থায় তাদের দাবি আদায় করতে চাইছে। উলফার মতো সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ধরতে চাইছে না। তা সত্ত্বেও কংগ্রেস সমর্থক ও ডানপন্থী বুদ্ধিজীবীরা ঠিকই প্রাদেশিকতার পচা স্লোগান তুলে তেলেঙ্গানার দাবি বানচাল করে দিতে চাইছে। এ শান্তিপূর্ণ লড়াইয়ে তেলেঙ্গানার জয়-পরাজয় এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের গর্ভে। এ বিষয়ে আশাবাদী হওয়া কঠিন। এর কারণ রাজনীতিকদের চারিত্রিক অনিশ্চয়তা।
লেখক: ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক ও রবীন্দ্র গবেষক
জিন্নাহ সাহেবের ঐতিহাসিক ঢাকা সফরকালে (১৯৪৮ মার্চ) রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) জাতির উদ্দেশে বয়ানে তিনি প্রাদেশিকতার বিপজ্জনক চরিত্র ব্যাখ্যা করেন নানাভাবে। তাঁর মতে, 'এ কথা বলা অর্থহীন যে আমরা বাঙালি বা সিন্ধি কিংবা পাঠান বা পাঞ্জাবি, এখন আমরা সবাই মুসলমান। ইসলাম আমাদের এ শিক্ষাই দিয়েছে যে আপনারা যে যা হোন না কেন, আপনি একজন মুসলমান। কাজেই সবাই মিলে জাতি গড়ে তুলতে হলে প্রাদেশিকতা বর্জন করতে হবে।' এর পরও তিনি জোর গলায় ঘোষণা দেন, যারা প্রাদেশিকতার প্রশ্রয় দেয়, তারা পাকিস্তানের দুশমন।
আসলে পাঞ্জাবি প্রভুত্ব, উর্দুভাষীর প্রভুত্ব রক্ষার জন্যই জননন্দিত নেতার ওই কৌশলী ভাষণ। জিন্নাহর মতো বিদগ্ধ ব্যক্তির জানা থাকার কথা যে সবাই মিলে দেশগড়া যায়, কিন্তু বিভিন্ন জাতিসত্তা মিলে এক জাতি গড়া যায় না। তাদের রাজনৈতিক প্রয়োজনে, ক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থে সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে (যা তখন বিদেশি পণ্ডিতদের ভাষায় ছিল 'অদ্ভুত রাষ্ট্র') তারা জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, এমনকি অস্তিত্বই অস্বীকার করতে চেয়েছে। কিন্তু ভাষিক জাতিসত্তার এমনই শক্তি, যা প্রাদেশিকতার অজুহাতে বাতিল করা যায় না। এ ক্ষেত্রেও যায়নি, ভারতীয় উসকানির কথা বলেও যায়নি।
১৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের বক্তৃতায় একই কথা বলেন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন। জিন্নাহর পূর্বোক্ত ভাষণ অনুকরণ করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি ঠেকাতে গিয়ে উর্দু রাষ্ট্রভাষার পক্ষে ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রাদেশিকতার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণার ভঙ্গিতে বলেন,'পাকিস্তানকে আমরা এছলামী রাষ্ট্ররূপে গঠন করিতে যাইতেছি। যে এছলামে কোনো প্রকার ভেদাভেদ নাই সে রাষ্ট্রে কেমন করিয়া প্রাদেশিকতার বীজ বপন চলিতে পারে?
মরহুম কায়েদে আজম বলিয়াছেন, প্রাদেশিকতা যে বা যাহারা প্রশ্রয় দেয়, তাহারা পাকিস্তানের দুশমন।'
তিনি আরো বলেন, 'রাষ্ট্রের নিরাপত্তার পক্ষে বাহিরের হুমকি অপেক্ষা প্রাদেশিকতাই অধিকতর মারাত্মক।' পাকিস্তানের উর্দুভাষী শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশ্য ছিল পূর্বাঞ্চলের বাংলাভাষীদের মতোই সিন্ধি, পশ্তু ও বালুচ ভাষিক জাতিসত্তাকে বিকশিত হতে না দেওয়া এবং অস্থানিক উর্দুভাষাভিত্তিক পাকিস্তানি জাতি-জাতীয়তা পত্তন করা_তার মৃত্তিকা-ঘনিষ্ঠ শিকড়ের অস্তিত্ব নাই থাকুক। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল উলি্লখিত জাতিসত্তাগুলোর শোষণ। বাংলাদেশ যদিও একাত্তরে মুক্তি পেয়েছে, অবশিষ্ট তিন ভাষিক ভূখণ্ডের শাসন-শোষণ ঠিকই চলছে।
প্রসঙ্গত একটু ভিন্ন কথা, সংশ্লিষ্ট বলেই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সিন্ধুর রাজধানী করাচিতে মূল বাসিন্দা সিন্ধিরা এখন সংখ্যালঘু, ভারত থেকে আসত উর্দুভাষী অর্থাৎ কথিত মোহাজেররা (বাংলাদেশে যারা এককথায় 'বিহারি' নামে পরিচিতি), সেখানে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী হিসেবে আর্থসামাজিক দাপট চালিয়ে যাচ্ছে। সিন্ধিভাষীরা এখন কোণঠাসা। অনেকটা নিজ দেশে পরবাসীর মতো।
সীমান্ত প্রদেশ ও বালুচিস্তানে বিষয়টা একটু ভিন্ন চরিত্রের। এদের মধ্যে বালুচদের ওপর আঘাতটা পড়েছে বেশি। ভাষিক জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে ওখানে প্রাণহানি (গণহত্যার পর্যায়ে) ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অবিশ্বাস্য। আইয়ুব আমলে ওদের আয়ত্তে আনতে বালুচিস্তানে আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ এবং 'বালুচিস্তানের কসাই' নামে কুখ্যাত টিক্কা খানের বর্বরতা ছিল তুলনাহীন। কিন্তু থেকে থেকে জেগে উঠেছে বালুচ জাতীয়তার চেতনা। এই তো কিছুকাল আগে খুন হলেন বালুচ জাতীয়তাবাদী নেতা নওয়াব আকবর বুগ্তি। কিন্তু তাতেও মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহ্য স্তব্ধ হয়নি।
আর পশতুভাষী পাখতুনদের (সাধারণ ভাষায় পাঠান) ওপর হিংস্র আক্রমণ তো চলে ১৯৪৭ থেকে সীমান্ত গান্ধী বাদশা খানের আমল থেকে। ব্রিটিশরাজের শেষ মুহূর্তের চাতুরী ও জাতীয় কংগ্রেসের আদর্শবাদী স্খলন (বাদশা খানের ভাষায় দীর্ঘকালের মিত্রকে নেকড়ের মুখে ছুড়ে ফেলা) পাখতুনদের জাতীয় চেতনার প্রতি ছিল প্রবল আঘাত। জেল আর নির্বাসনে বাদশাখানের (খান আবদুল গাফফার খানের) মৃত্যু, পুত্র ওয়ালি খানের আপ্রাণ চেষ্টায়ও পাখতুনদের মুক্তি মেলেনি পাকিস্তানি শাসন-শোষণের কবজা থেকে। প্রতিষ্ঠিত হয়নি তাদের বহু-আকাঙ্ক্ষিত পাখতুনিস্তান। স্বীকার্য যে বাংলাদেশের মুক্তির পেছনে দুটো প্রধান কারণ মূল পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের সীমান্ত-সানি্নধ্যের অনুপস্থিতি এবং মুক্তিযুদ্ধে ভারত-রাশিয়ার নানামাত্রিক সাহায্য।
ভাষিক জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের চেতনাকে শাসকগোষ্ঠী অনেক সময়ই প্রাদেশিকতা বা বিচ্ছিন্নতাবাদ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। যেমন_সিংহল তথা শ্রীলঙ্কায় তামিল ভাষাভাষীর আত্মশাসনের সংগ্রাম, স্পেনে বাস্কভাষীদের বিচ্ছিন্নতাবাদী লড়াই তথা মুক্তিসংগ্রাম কিংবা ঝাড়খন্ডে, আসামে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আত্মশাসনের লড়াই কোথাও সফল, কোথাও ব্যর্থ। কিন্তু এগুলোর সূচনা কিন্তু ভাষিক অধিকার বা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের অধিকারের দাবিতে, পরে বিচ্ছিন্নতার।
অতিসম্প্রতি দক্ষিণ ভারতে পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের প্রস্তাব নিয়ে শুরু হয়েছে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ধাঁচের লড়াই, যা এখনো সহিংস পন্থা অবলম্বন করেনি। অথচ আমরা জানি, গত শতকের চলি্লশের দশকে তেলেঙ্গানার কৃষকবিদ্রোহ শ্রেণী-সংগ্রামের ধারায় সমাজবাদীদের মনে কী প্রত্যাশাই না জাগিয়েছিল! 'তেলেঙ্গানা তুমি জান সূর্যের ঠিকানা'র মতো কাব্যপঙ্ক্তি সমাজবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এক অসম্ভব স্বপ্ন দেখিয়েছিল তৎকালীন সমাজবাদী চিন্তার তরুণদের ও বুদ্ধিবৃত্তিক বলয়ের কিছুসংখ্যক মানুষকে।
তেলেঙ্গানার কৃষকদের মুক্তির লড়াই তৎকালীন বঙ্গদেশের প্রগতিশীল মানসকে আদর্শবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল লড়াইয়ের পথ ধরতে এবং কিছুটা হলেও স্থানীয় কৃষক আন্দোলনে কিংবা তেভাগার সংগ্রামে উত্তাপ সরবরাহ করতে পেরেছিল। 'তেলেঙ্গানা' হয়ে ওঠে লড়াইয়ের প্রতীক, মুখে মুখে উচ্চারিত নাম। কিন্তু ব্রিটিশ রাজনীতির কূটচাতুর্য এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের পর কংগ্রেসী প্রভুত্ববাদী রক্ষণশীলতার প্রভাব ও স্থানীয় সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তায়ন তেলেঙ্গানা ট্র্যাজেডির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে সর্দার প্যাটেলের ক্রুর দমন নীতির কারণে।
কিন্তু বহুজাতিক-বহুভাষিক ভারতে জাতিসত্তার আত্মশাসনের লড়াই, যা মূলত হিন্দি আধিপত্যবাদবিরোধী, নানা ফর্মে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী নেহরুর রাজ্য পুনর্গঠন হিন্দিবিরোধী উগ্রতার কিছু প্রশমন ঘটালেও স্বায়ত্তশাসন বা বিচ্ছিন্নতার লড়াই পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। ভূখণ্ড বিভাজন নয়া রাজ্যগঠন প্রক্রিয়া ধীরপায়ে হলেও চলেছে। বলা যায় চালাতে হয়েছে।
কিছুদিন আগে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে 'তেলেঙ্গানা' নামে পৃথক রাজ্য গঠনের দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে। 'ফের উত্তাল অন্ধ্র'। ভাবা যায় না রাজ্যের বিধানসভা থেকে ৭২ জন বিধায়কের পদত্যাগ। আবার এদের ৩৫ জনই রাজ্য-শাসক কংগ্রেস দলের। এমনকি পদত্যাগ করেছেন এ রাজ্য থেকে লোকসভায় নির্বাচিত ১১ জন কংগ্রেস দলীয় সংসদ সদস্য (এমপি) এবং রাজ্যসভার দুজন কংগ্রেস সংসদ সদস্য।
তেলেঙ্গানা-পরিস্থিতি কেন্দ্রীয় জোট সরকারকে সংকটে ফেলে দিয়েছে। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য রাজ্যে ও কেন্দ্রে শক্তি সংহত করার লক্ষ্যে জনসমর্থন আদায় করতে গিয়ে কংগ্রেস পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এ উদ্দেশ্যে তেলেঙ্গানাপন্থীদের সঙ্গে রাজনৈতিক জোটও গঠন করে কংগ্রেস। যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকা। সে জন্য যেকোনো দলের সঙ্গে জোট বাঁধা চলে। উপমহাদেশের রাজনীতিতে এমন নৈরাজ্যিক আচরণ খুবই সচরাচর। বাংলাদেশের দলীয় রাজনীতিও এর ব্যতিক্রম নয়।
যেকোনো কারণে হোক বা বিশেষ কোনো কারণে হোক, তেলেঙ্গানাবিষয়ক পূর্ব প্রতিশ্রুতি থেকে কংগ্রেস সরে আসতে চাইছে। এ বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্তের টানাপড়েনে বিষয়টা স্পষ্ট। চুক্তিভঙ্গ বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ রাজনৈতিক রীতিনীতির স্খলন বা বিচ্যুতি। তাতে সাধারণ মানুষের কাছে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে বাধ্য। কিন্তু প্রচলিত রাজনীতিতে কোনো চুক্তিভঙ্গই আদর্শ চুক্তির পর্যায়ে পড়ে না। অর্থাৎ দলগুলো এসবের ধার ধারে না। আমার ধারণা, কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত ওই চুক্তিকে কোনো প্রকার মূল্য দেবে না। কোনো না কোনো অজুহাতে সেখান থেকে সরে আসবে।
সেই দেশ বিভাগের সময় থেকে দেখে আসছি রাজনীতির মূল্য লক্ষ্য ক্ষমতা দখল বা ক্ষমতা ধরে রাখা_তা যেভাবেই হোক। সে ক্ষেত্রে নীতি বা আদর্শ অর্থহীন শব্দ। ক্ষমতার জন্য দলীয় রাজনীতি পারে না, এমন কোনো কাজ নেই। পরম রাজনৈতিক শত্রু বা বিরোধী আদর্শের সঙ্গে জোট বাঁধতেও দলগুলোর বাধে না। আপসবাদিতা ও চুক্তিভঙ্গ উপমহাদেশীয় রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। রাজনীতিকদের যে চরিত্র রক্ষার কোনো দায় নেই, এমন প্রবাদ (অপবাদ?) সর্বজনবিদিত।
রাজনীতির বহুরূপী চরিত্রের সঙ্গে মানুষ পরিচিত। কিন্তু সংস্কৃতি অঙ্গনের এদিকটা ভিন্ন চরিত্রে দেখতে চায় মানুষ, সাহিত্য, সংস্কৃতি বা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে। গণতান্ত্রিক বা সমাজবাদী আদর্শের ঢাকঢোল পেটায় এমন সাহিত্যিক বা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বা সংবাদপত্র গোষ্ঠীর চোখে তেলেঙ্গানা রাজ্যের স্বতন্ত্র 'স্ট্যাটাস' যদি প্রাদেশিকতা দোষে দুষ্ট বিবেচিত হয়, তাতে অবাক না হয়ে পারা যায় না।
এদের যুক্তি হলো তেলেঙ্গানা স্বতন্ত্র রাজ্যের 'স্ট্যাটাস' পেলে সে দৃষ্টান্ত গোর্খাল্যান্ড বা কাশ্মীরকে বিচ্ছিন্নতাবাদে নতুন শক্তি জোগাবে। কিন্তু এ যুক্তি ধোপে টেকে না। কারণ তেলেঙ্গানার দাবি বিচ্ছিন্নতার নয়, স্বাধীন রাষ্ট্রের নয়। আর কাশ্মীর! শুরুতে তাদের দাবি ছিল বিশেষ কিছু সুবিধার। শেখ আবদুল্লাই কাশ্মীররাজকে ভারত ডোমিনিয়নে যুক্ত হতে সমর্থন জুগিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে নেহরু সরকার সেসব দাবি মানেনি। কাশ্মীরের রাজনীতি অনেক জটিলতা, অনেক অনাচারের মধ্য দিয়ে স্বাধীন কাশ্মীর ও পাকিস্তানি কাশ্মীরের দাবিতে গিয়ে পেঁৗছেছে। এর দায় কেন্দ্রীয় সরকারের এবং তা আমাদের আলোচ্য নয়।
যুক্তির প্রশ্নই যদি ওঠে, তাহলে তা একাধিক প্রশ্নের জন্ম দেয়। প্রশ্ন উঠতে পারে এ ধরনের যুক্তি ঝাড়খন্ডের বেলায় ওঠেনি কেন? কিংবা তেলেঙ্গানাকে অন্ধ্র রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার সময় রাজনৈতিক ঔচিত্যের কথা ওঠেনি কেন? আসলে তেলেঙ্গানার স্বাতন্ত্র্য নিয়ে তথাকথিত গণতন্ত্রীদের আপত্তির কারণ কি তেলেঙ্গানার পূর্বতম সংগ্রামী ইতিহাস? অন্তত আমার তো তা-ই মনে হয়।
কারণ ভারতীয় গণতন্ত্রীদের কট্টর সমাজবাদ-বিরোধিতা তো রীতিমতো এক ইতিহাস। ব্রিটিশরাজ শাসনের আমল থেকে নানাভাবে এর প্রকাশ। গান্ধী-প্যাটেল-রাজেন্দ্র প্রসাদ থেকে কেউ ব্যতিক্রম নন। সে উত্তরাধিকারের অবসান ঘটেনি দীর্ঘ সময়েও। কাজেই কেন্দ্রীয় সরকার যে তেলেঙ্গানা ইস্যুটাকে ঝুলিয়ে রাখবে এবং কংগ্রেসী বা গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক শিবির যে তালি বাজাবে তাতে সন্দেহের কোনো কারণ নেই।
তেলেঙ্গানা পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে ভালোভাবেই জানে, সুসংগঠিত ও আধুনিক চরিত্রের কেন্দ্রীয় সামরিক শক্তি গায়ের জোরে অনেক বাস্তবতা অস্বীকার করতে পারে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতবোনের কারো কারোর সাম্প্রতিক নম্র কণ্ঠস্বরও আপস-সমঝোতার সুর তার প্রমাণ। তবে গোর্খাল্যান্ডের ক্ষেত্রে সামরিক শক্তি নমনীয় কেন, তার কারণ বোঝা যায় না। যাই হোক, পরিস্থিতি বিচার করেই বোধ হয় তেলেঙ্গানা সংগ্রামের বদলে সংসদীয় ভদ্রপন্থায় তাদের দাবি আদায় করতে চাইছে। উলফার মতো সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ধরতে চাইছে না। তা সত্ত্বেও কংগ্রেস সমর্থক ও ডানপন্থী বুদ্ধিজীবীরা ঠিকই প্রাদেশিকতার পচা স্লোগান তুলে তেলেঙ্গানার দাবি বানচাল করে দিতে চাইছে। এ শান্তিপূর্ণ লড়াইয়ে তেলেঙ্গানার জয়-পরাজয় এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের গর্ভে। এ বিষয়ে আশাবাদী হওয়া কঠিন। এর কারণ রাজনীতিকদের চারিত্রিক অনিশ্চয়তা।
লেখক: ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক ও রবীন্দ্র গবেষক
No comments