ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলনের বাংলাদেশি প্রেক্ষিত-রাজনীতি by ম. ইনামুল হক
'আমরা ৯৯%' আন্দোলনও সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদ এবং তার সহোদর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সচেতন জনগণের প্রতিবাদ। এ প্রতিবাদ তথাকথিত 'সন্ত্রাসবাদ'-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত খোদ যুক্তরাষ্ট্র থেকেই উত্থিত। তাই একে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বলার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের মতো দেশে 'আমরা ৯৯%' আন্দোলনের গুরুত্ব অত্যধিক।
২০১২ সালে এ আন্দোলন ধনী-গরিব_ সর্বস্তরের জনগণের আন্দোলনে রূপ নিতে পারে
এবং বাংলাদেশে একটি বিকল্প রাজনৈতিক ধারার সূচনা
করতে পারে
কানাডার এডবাস্টার একটি অলাভকারী, ভোগবিরুদ্ধ, পরিবেশবাদী সংগঠন। গত বছর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি নিউইয়র্কের ওয়ালস্ট্রিটের জুকোটি পার্কে যে প্রতিবাদ কর্মসূচির সূচনা করেছিল, তা এখন ছড়িয়ে গেছে। প্রতিবাদকারীরা প্রধানত সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, করপোরেট শোষণ, দুর্নীতি এবং সরকার ও রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যবস্থার ওপর তদবিরকারীদের প্রভাবের বিরুদ্ধে মত কথা তুলে ধরেন। তাদের মূল স্লোগান ছিল, 'আমরা ৯৯ শতাংশ'। এর অর্থ হলো, যারা ধনসম্পদ কুক্ষিগত করেছে তারা ১% আর বাকি জনগণ ৯৯%। ডিসেম্বর ২০১১ নাগাদ ওয়ালস্ট্রিটের প্রতিবাদ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে গেছে ও সারাবিশ্বে আলোড়ন তুলেছে।
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১১ সন্ধ্যায় উপস্থিত জনতার সাধারণ সভা এক ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে। তাতে যা বলা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে, ভবিষ্যৎ বিশ্বে মানবজাতির রক্ষা নির্ভর করে পরস্পর সহযোগিতা, রাষ্ট্র কাঠামো কর্তৃক ব্যক্তির মৌলিক অধিকার রক্ষা, জনগণের কাছ থেকে গণতান্ত্রিক শক্তির ক্ষমতা গ্রহণ ইত্যাদির ওপর। কিন্তু যখন অর্থনৈতিক শক্তি গণতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে বা এর দুর্বৃত্তায়ন করে তখন তা সম্ভব নয়। তারা জনগণের বাড়িঘর কেড়ে নিচ্ছে পূর্ব অঙ্গীকারের সূত্র ধরে। অবশ্য প্রকৃত দায়বদ্ধতার কথা আগে আসেনি। তারা দেউলিয়া কোম্পানি জনগণের করের অর্থে বাঁচিয়ে দিয়ে নির্বাহীদের বিপুল অঙ্কে বেতন দেয়। কিন্তু কর্মীদের মধ্যে বর্ণ, লিঙ্গ ইত্যাদির কারণে বৈষম্য ও বাছবিচার করে। তারা খাদ্য সরবরাহ বিষাক্ত করেছে এবং কৃষি ভূমিতে একচেটিয়া কর্তৃত্ব করে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করেছে। তারা ছাত্রদের কাঁধে হাজার হাজার ডলার ঋণ চাপিয়ে জিম্মি করেছে, শ্রম নিয়োগ বাজারের দরদামের বিষয় করে শ্রমিকের মজুরি কমিয়েছে, স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দ কমিয়েছে। তারা আদালত প্রভাবিত করে জনগণের অধিকার খর্ব করেছে, জনগণের ব্যক্তিগত বিষয়ও পণ্য করেছে। তারা পুলিশ ও মিলিটারি দিয়ে স্বাধীনতা হরণ করেছে, বিকল্প শক্তি না দিয়ে জনজীবন তেলনির্ভর করে রেখেছে। তারা ওষুধনীতিতে শুধুই মুনাফা দেখে, তেল উত্তোলনে দুর্ঘটনা ও দূষণ চেপে যায়, জনগণকে বিকৃত তথ্য দেয়, নিরপরাধ বন্দিদের হত্যার জন্য লোক ভাড়া করে। তারা দেশ-বিদেশে উপনিবেশ সৃষ্টি করে, বিদেশে নিরপরাধ মানুষকে হত্যার জন্য মদদ দেয়। তারা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে ব্যাপক ক্ষতির মারণাস্ত্র তৈরি করতেই থাকে।
উপস্থিত জনতার সাধারণ সভা তাদের ঘোষণায় উপরোক্ত বিষয়গুলো তুলে ধরে পৃথিবীর জনগণের প্রতি এই বলে আহ্বান জানায়, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ প্রত্যেকের অধিকার। জনগণের এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ নাও। আমাদের সমস্যাগুলো দূর করার জন্য সবার অনুধাবনযোগ্য পদক্ষেপ নাও। সব জনপদে সরাসরি গণতন্ত্র প্রয়োগের লক্ষ্যে সংঘবদ্ধ হও। আমাদের তরফ থেকে সম্ভব আমরা সব সহযোগিতা করব। আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে সবার কথা শোনো।
ওয়ালস্ট্রিট প্রতিবাদের একটি বিশেষ দিক হলো, এটি ৯৯% মানুষের আন্দোলন ও প্রতিবাদ। এটি কোনো নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠীর নয়। তাই এ প্রতিবাদে একটিই মাত্র স্লোগান। তা হলো, 'আমরা ৯৯%'। ওয়ালস্ট্রিট প্রতিবাদকারীরা আরেকটি কাজ করে। তা হলো, তারা জুকোটি পার্ককে 'লিবার্টি স্কয়ার' নাম দেয়। নিউইয়র্কের ধ্বংসপ্রাপ্ত টুইন টাওয়ারের পাশে অবস্থিত এ স্থানটির আদি নাম ছিল লিবার্টি প্লাজা পার্ক। ৯ সেপ্টেম্বর ২০০১ টুইন টাওয়ার বিধ্বস্ত হলে এ পার্কটি ২০০৬ সালে পুনর্নির্মাণ করে নতুন নাম দেওয়া হয়। এভাবে মার্কিন সরকার জনগণের এলাকা এক ব্যক্তির নামে নামকরণ করে। তা ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলনকারীরা তার আগের নামে ফিরিয়ে দেয়।
বাংলাদেশে আমরা ওয়ালস্ট্রিটের প্রতিবাদ সমর্থন করি। কারণ বাংলাদেশেও ১% লুটপাটকারী রাজনীতিবিদ, দুর্নীতিবাজ আমলা, ঋণখেলাপি শিল্পপতিরা দেশের সস্পদ দখল করে নিয়েছে। আমরা ৯৯% জনগণ এর প্রতিকার চাই এবং জনগণের রাষ্ট্র চাই।
আমরা ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন আরও একটি বিশেষ কারণে সমর্থন করি। তা হলো, এ আন্দোলনের মাধ্যমে পৃথিবীর বঞ্চিত মানুষের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। আমাদের দেশের বাস্তুচ্যুত, ছিন্নমূল মানুষ সরকারি প্রকল্প বা ভূমিদস্যুদের আগ্রাসনে নিঃস্ব হয়েছে। দেশের সাধারণ গরিব শ্রেণীর মানুষ জনসেবক নামধারী দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মচারী ও লুটপাটকারী রাজনীতিবিদদের হাতে নাজেহাল হচ্ছে। তাদের ছেলেমেয়েরা যথাযথ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা পাচ্ছে না। আমরা এসব বঞ্চিত মানুষের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
বলা হয়ে থাকে, আরবে বসন্ত জাগানো গণপ্রতিবাদ লিবার্টি স্কয়ারের আন্দোলনকারীদের পথ দেখিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে বঞ্চিত মানুষের প্রতিবাদ একেবারেই ভিন্নধারায় প্রবাহিত হচ্ছে এবং সারাবিশ্বে তা ছড়িয়ে যাচ্ছে। আরব বিশ্বের দেশগুলোতে জনগণের প্রতিবাদ অহিংসধারায় শুরু হলেও তাদের ওপর সরকারি হামলা হয়েছে এবং হাজার হাজার মানুষ মরেছে। ওই আন্দোলনের ফলে আরব অনেক দেশেই শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তন হয়েছে। সেখানে যে নতুন শাসক ক্ষমতায় বসেছে তারা গণতন্ত্র তথা জনগণের শাসনের নিশ্চয়তা দেন না। গ্রিস, ইংল্যান্ড, রাশিয়া ইত্যাদি দেশের জনগণও সমাবেশ ও মিছিলের মাধ্যমে তাদের দেশের অপশাসনের প্রতিবাদ করছে। তবে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে গণপ্রতিবাদের সহিংস পরিণতি হওয়া বা আন্দোলনের কারণে সরকার পরিবর্তনের কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশে কয়েকজন ছাত্র-যুবার উদ্যোগে 'অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট' বা 'আমরা ৯৯%' আন্দোলনের সমর্থনে প্রথম প্রতিবাদ সমাবেশ হয় ২২ অক্টোবর ২০১১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসটির সামনে। ওইদিন বলা হয়, আমাদের এখানেও প্রতিদিন এ সমাবেশ হবে। সঙ্গত কারণে সারাদিন ২৪ ঘণ্টা প্রতিবাদ করার পরিবর্তে প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে ৬টা প্রতিবাদ করা হবে। তা পরদিন থেকে বাস্তবায়ন হয়নি। ১ নভেম্বর ২০১১ থেকে এ প্রতিবাদ সমাবেশ করার পুনরায় উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওইদিন টিএসসির সামনে চারটি রাস্তার পুরো এলাকা 'মুক্তি চত্বর' নামকরণ করা হয়। এ চত্বরেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মিছিল হয়। এখানেই 'স্বোপার্জিত স্বাধীনতা', 'রাজু ভাস্কর্য', 'ডা. মিলন স্মৃতিফলক' এবং 'হুমায়ুন আজাদ স্মৃতিফলক' আছে। শুধু 'আমরা ৯৯%'_ এ ব্যানারে আমরা প্রতিবাদটি আয়োজন করছি। প্রতিবাদটি যেহেতু সবার সেহেতু আমাদের তরফ থেকে এখন শুধু প্রতি শনিবার এ অবস্থান প্রতিবাদ করার দায়িত্ব নেওয়া হয়েছে।
আমরা ওয়ালস্ট্রিটের প্রতিবাদ সর্বতোভাবে সমর্থন করি। কারণ এ প্রতিবাদ বিশ্বের ৯৯% মানুষের ন্যায়সঙ্গত ক্ষোভের প্রকাশ। বাংলার মাটিতে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ব্রিটিশ আমল থেকে বঞ্চিত মানুষকে নিয়ে যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন তার সঙ্গে এ আন্দোলন আবেদনের মিল আছে। মওলানা ভাসানী তার আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করতেন। 'আমরা ৯৯%' আন্দোলনও সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদ এবং তার সহোদর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সচেতন জনগণের প্রতিবাদ। এ প্রতিবাদ তথাকথিত 'সন্ত্রাসবাদ'-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত খোদ যুক্তরাষ্ট্র থেকেই উত্থিত। তাই একে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বলার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের মতো দেশে 'আমরা ৯৯%' আন্দোলনের গুরুত্ব অত্যধিক। ২০১২ সালে এ আন্দোলন ধনী-গরিব_ সর্বস্তরের জনগণের আন্দোলনে রূপ নিতে পারে এবং বাংলাদেশে একটি বিকল্প রাজনৈতিক ধারার সূচনা করতে পারে।
প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক: সাবেক মহাপরিচালক, পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা ও কলাম লেখক, আমরা ৯৯ ভাগ আন্দোলনের বাংলাদেশি সংগঠকদের অন্যতম
minamul@gmail.com
এবং বাংলাদেশে একটি বিকল্প রাজনৈতিক ধারার সূচনা
করতে পারে
কানাডার এডবাস্টার একটি অলাভকারী, ভোগবিরুদ্ধ, পরিবেশবাদী সংগঠন। গত বছর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি নিউইয়র্কের ওয়ালস্ট্রিটের জুকোটি পার্কে যে প্রতিবাদ কর্মসূচির সূচনা করেছিল, তা এখন ছড়িয়ে গেছে। প্রতিবাদকারীরা প্রধানত সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, করপোরেট শোষণ, দুর্নীতি এবং সরকার ও রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যবস্থার ওপর তদবিরকারীদের প্রভাবের বিরুদ্ধে মত কথা তুলে ধরেন। তাদের মূল স্লোগান ছিল, 'আমরা ৯৯ শতাংশ'। এর অর্থ হলো, যারা ধনসম্পদ কুক্ষিগত করেছে তারা ১% আর বাকি জনগণ ৯৯%। ডিসেম্বর ২০১১ নাগাদ ওয়ালস্ট্রিটের প্রতিবাদ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে গেছে ও সারাবিশ্বে আলোড়ন তুলেছে।
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১১ সন্ধ্যায় উপস্থিত জনতার সাধারণ সভা এক ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে। তাতে যা বলা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে, ভবিষ্যৎ বিশ্বে মানবজাতির রক্ষা নির্ভর করে পরস্পর সহযোগিতা, রাষ্ট্র কাঠামো কর্তৃক ব্যক্তির মৌলিক অধিকার রক্ষা, জনগণের কাছ থেকে গণতান্ত্রিক শক্তির ক্ষমতা গ্রহণ ইত্যাদির ওপর। কিন্তু যখন অর্থনৈতিক শক্তি গণতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে বা এর দুর্বৃত্তায়ন করে তখন তা সম্ভব নয়। তারা জনগণের বাড়িঘর কেড়ে নিচ্ছে পূর্ব অঙ্গীকারের সূত্র ধরে। অবশ্য প্রকৃত দায়বদ্ধতার কথা আগে আসেনি। তারা দেউলিয়া কোম্পানি জনগণের করের অর্থে বাঁচিয়ে দিয়ে নির্বাহীদের বিপুল অঙ্কে বেতন দেয়। কিন্তু কর্মীদের মধ্যে বর্ণ, লিঙ্গ ইত্যাদির কারণে বৈষম্য ও বাছবিচার করে। তারা খাদ্য সরবরাহ বিষাক্ত করেছে এবং কৃষি ভূমিতে একচেটিয়া কর্তৃত্ব করে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করেছে। তারা ছাত্রদের কাঁধে হাজার হাজার ডলার ঋণ চাপিয়ে জিম্মি করেছে, শ্রম নিয়োগ বাজারের দরদামের বিষয় করে শ্রমিকের মজুরি কমিয়েছে, স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দ কমিয়েছে। তারা আদালত প্রভাবিত করে জনগণের অধিকার খর্ব করেছে, জনগণের ব্যক্তিগত বিষয়ও পণ্য করেছে। তারা পুলিশ ও মিলিটারি দিয়ে স্বাধীনতা হরণ করেছে, বিকল্প শক্তি না দিয়ে জনজীবন তেলনির্ভর করে রেখেছে। তারা ওষুধনীতিতে শুধুই মুনাফা দেখে, তেল উত্তোলনে দুর্ঘটনা ও দূষণ চেপে যায়, জনগণকে বিকৃত তথ্য দেয়, নিরপরাধ বন্দিদের হত্যার জন্য লোক ভাড়া করে। তারা দেশ-বিদেশে উপনিবেশ সৃষ্টি করে, বিদেশে নিরপরাধ মানুষকে হত্যার জন্য মদদ দেয়। তারা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে ব্যাপক ক্ষতির মারণাস্ত্র তৈরি করতেই থাকে।
উপস্থিত জনতার সাধারণ সভা তাদের ঘোষণায় উপরোক্ত বিষয়গুলো তুলে ধরে পৃথিবীর জনগণের প্রতি এই বলে আহ্বান জানায়, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ প্রত্যেকের অধিকার। জনগণের এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ নাও। আমাদের সমস্যাগুলো দূর করার জন্য সবার অনুধাবনযোগ্য পদক্ষেপ নাও। সব জনপদে সরাসরি গণতন্ত্র প্রয়োগের লক্ষ্যে সংঘবদ্ধ হও। আমাদের তরফ থেকে সম্ভব আমরা সব সহযোগিতা করব। আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে সবার কথা শোনো।
ওয়ালস্ট্রিট প্রতিবাদের একটি বিশেষ দিক হলো, এটি ৯৯% মানুষের আন্দোলন ও প্রতিবাদ। এটি কোনো নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠীর নয়। তাই এ প্রতিবাদে একটিই মাত্র স্লোগান। তা হলো, 'আমরা ৯৯%'। ওয়ালস্ট্রিট প্রতিবাদকারীরা আরেকটি কাজ করে। তা হলো, তারা জুকোটি পার্ককে 'লিবার্টি স্কয়ার' নাম দেয়। নিউইয়র্কের ধ্বংসপ্রাপ্ত টুইন টাওয়ারের পাশে অবস্থিত এ স্থানটির আদি নাম ছিল লিবার্টি প্লাজা পার্ক। ৯ সেপ্টেম্বর ২০০১ টুইন টাওয়ার বিধ্বস্ত হলে এ পার্কটি ২০০৬ সালে পুনর্নির্মাণ করে নতুন নাম দেওয়া হয়। এভাবে মার্কিন সরকার জনগণের এলাকা এক ব্যক্তির নামে নামকরণ করে। তা ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলনকারীরা তার আগের নামে ফিরিয়ে দেয়।
বাংলাদেশে আমরা ওয়ালস্ট্রিটের প্রতিবাদ সমর্থন করি। কারণ বাংলাদেশেও ১% লুটপাটকারী রাজনীতিবিদ, দুর্নীতিবাজ আমলা, ঋণখেলাপি শিল্পপতিরা দেশের সস্পদ দখল করে নিয়েছে। আমরা ৯৯% জনগণ এর প্রতিকার চাই এবং জনগণের রাষ্ট্র চাই।
আমরা ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন আরও একটি বিশেষ কারণে সমর্থন করি। তা হলো, এ আন্দোলনের মাধ্যমে পৃথিবীর বঞ্চিত মানুষের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। আমাদের দেশের বাস্তুচ্যুত, ছিন্নমূল মানুষ সরকারি প্রকল্প বা ভূমিদস্যুদের আগ্রাসনে নিঃস্ব হয়েছে। দেশের সাধারণ গরিব শ্রেণীর মানুষ জনসেবক নামধারী দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মচারী ও লুটপাটকারী রাজনীতিবিদদের হাতে নাজেহাল হচ্ছে। তাদের ছেলেমেয়েরা যথাযথ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা পাচ্ছে না। আমরা এসব বঞ্চিত মানুষের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
বলা হয়ে থাকে, আরবে বসন্ত জাগানো গণপ্রতিবাদ লিবার্টি স্কয়ারের আন্দোলনকারীদের পথ দেখিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে বঞ্চিত মানুষের প্রতিবাদ একেবারেই ভিন্নধারায় প্রবাহিত হচ্ছে এবং সারাবিশ্বে তা ছড়িয়ে যাচ্ছে। আরব বিশ্বের দেশগুলোতে জনগণের প্রতিবাদ অহিংসধারায় শুরু হলেও তাদের ওপর সরকারি হামলা হয়েছে এবং হাজার হাজার মানুষ মরেছে। ওই আন্দোলনের ফলে আরব অনেক দেশেই শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তন হয়েছে। সেখানে যে নতুন শাসক ক্ষমতায় বসেছে তারা গণতন্ত্র তথা জনগণের শাসনের নিশ্চয়তা দেন না। গ্রিস, ইংল্যান্ড, রাশিয়া ইত্যাদি দেশের জনগণও সমাবেশ ও মিছিলের মাধ্যমে তাদের দেশের অপশাসনের প্রতিবাদ করছে। তবে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে গণপ্রতিবাদের সহিংস পরিণতি হওয়া বা আন্দোলনের কারণে সরকার পরিবর্তনের কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশে কয়েকজন ছাত্র-যুবার উদ্যোগে 'অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট' বা 'আমরা ৯৯%' আন্দোলনের সমর্থনে প্রথম প্রতিবাদ সমাবেশ হয় ২২ অক্টোবর ২০১১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসটির সামনে। ওইদিন বলা হয়, আমাদের এখানেও প্রতিদিন এ সমাবেশ হবে। সঙ্গত কারণে সারাদিন ২৪ ঘণ্টা প্রতিবাদ করার পরিবর্তে প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে ৬টা প্রতিবাদ করা হবে। তা পরদিন থেকে বাস্তবায়ন হয়নি। ১ নভেম্বর ২০১১ থেকে এ প্রতিবাদ সমাবেশ করার পুনরায় উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওইদিন টিএসসির সামনে চারটি রাস্তার পুরো এলাকা 'মুক্তি চত্বর' নামকরণ করা হয়। এ চত্বরেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মিছিল হয়। এখানেই 'স্বোপার্জিত স্বাধীনতা', 'রাজু ভাস্কর্য', 'ডা. মিলন স্মৃতিফলক' এবং 'হুমায়ুন আজাদ স্মৃতিফলক' আছে। শুধু 'আমরা ৯৯%'_ এ ব্যানারে আমরা প্রতিবাদটি আয়োজন করছি। প্রতিবাদটি যেহেতু সবার সেহেতু আমাদের তরফ থেকে এখন শুধু প্রতি শনিবার এ অবস্থান প্রতিবাদ করার দায়িত্ব নেওয়া হয়েছে।
আমরা ওয়ালস্ট্রিটের প্রতিবাদ সর্বতোভাবে সমর্থন করি। কারণ এ প্রতিবাদ বিশ্বের ৯৯% মানুষের ন্যায়সঙ্গত ক্ষোভের প্রকাশ। বাংলার মাটিতে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ব্রিটিশ আমল থেকে বঞ্চিত মানুষকে নিয়ে যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন তার সঙ্গে এ আন্দোলন আবেদনের মিল আছে। মওলানা ভাসানী তার আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করতেন। 'আমরা ৯৯%' আন্দোলনও সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদ এবং তার সহোদর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সচেতন জনগণের প্রতিবাদ। এ প্রতিবাদ তথাকথিত 'সন্ত্রাসবাদ'-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত খোদ যুক্তরাষ্ট্র থেকেই উত্থিত। তাই একে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বলার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের মতো দেশে 'আমরা ৯৯%' আন্দোলনের গুরুত্ব অত্যধিক। ২০১২ সালে এ আন্দোলন ধনী-গরিব_ সর্বস্তরের জনগণের আন্দোলনে রূপ নিতে পারে এবং বাংলাদেশে একটি বিকল্প রাজনৈতিক ধারার সূচনা করতে পারে।
প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক: সাবেক মহাপরিচালক, পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা ও কলাম লেখক, আমরা ৯৯ ভাগ আন্দোলনের বাংলাদেশি সংগঠকদের অন্যতম
minamul@gmail.com
No comments