নাগরিক সমাজ-নতুন দক্ষিণ এশিয়ার স্বপ্ন by কুলদীপ নায়ার
বিশাল, ব্যাপক, কলরবমুখর, কিন্তু শৃঙ্খলাপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে স্বেচ্ছাসেবী বেসরকারি সংস্থা ও নাগরিক সমাজের কর্মীরা জড়ো হয়েছিলেন ঢাকায়, সর্বমোট প্রায় ১৫ হাজার। পাকিস্তান ও ভারত থেকেও যোগ দিয়েছিলেন অনেকে। দক্ষিণ এশীয় সোশ্যাল ফোরামে মিলিত হয়েছিলেন সবাই।
একটি লক্ষ্যই তাঁদের ঐক্যবদ্ধ করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ যে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত পশ্চাৎপদতার মধ্যে বাস করছে, সেসব সম্পর্কে শাসকদের সচেতন করা।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছিল যথার্থ স্থানেই, ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। বাঙালিদের মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে যেসব ছাত্র পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিল তাদের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শহীদ মিনার। ব্রিটিশদের শাসনামলে বিপ্লবী ভগৎ সিং ভারতের সেন্ট্রাল অ্যাসেমব্লিতে ছোট একটি বোমা ছুড়ে যেভাবে শাসকদের কান খুলে দিয়েছিলেন, ঢাকার শহীদ মিনারে তেমনি করে শাসকদের কান খুলে দিতে সেদিন অবিরাম বেজেছিল ঢোল। বহু বছর আগে একজন ফরাসি বিপ্লবীও তাঁর দেশের শাসকদের জনগণের কথা শোনানোর জন্য একই কাজ করেছিলেন।
সোশ্যাল ফোরাম বস্তুত এই সংবাদ বয়ে এনেছে যে দক্ষিণ এশিয়ায় এক শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। শহীদ মিনারে বক্তাদের কথায়ও সেই চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। একজন বক্তা বললেন, দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থা এমন হয়েছে একটা আমূল পরিবর্তন ছাড়া কিছুতেই কিছু হবে না। যে অঞ্চলে পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একত্রবাস, সেখানে বামপন্থার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু তিনি গান্ধীজির শান্তিপূর্ণ পথে সমাধান চান; দক্ষিণ এশিয়ায় যে সহিংসতা সন্ত্রাসবাদের রূপ নিয়েছে, তার ধার ভোঁতা করে দিতে তিনি গান্ধীজির মতবাদ প্রয়োগ করার পক্ষপাতী। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, পন্থা যদি ভালো না হয়, তাহলে লক্ষ্যও ভালোভাবে অর্জিত হয় না।
দক্ষিণ এশীয় সোশ্যাল ফোরাম, যা সত্যিকার অর্থে জনগণের সার্ক, দক্ষিণ এশিয়ায় একটি সমতাভিত্তিক ন্যায্য সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে ঢাকায় মিলিত হয়েছিল। বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণকারীরা ছোট ছোট নানা গ্রুপে বিভক্ত হয়েছে আলোচনা করেছেন সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলো নিয়ে। সুশাসন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, তথ্য অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেছেন তাঁরা। তাঁদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশের নাগরিক যেন অন্য দেশ থেকে তথ্য পান। ঐতিহাসিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মিলনায়তনে ও সেমিনারকক্ষে অনুষ্ঠিত হয়েছে কয়েক ডজন সেশন। সব আলোচনারই সার কথা একটাই: দক্ষিণ এশিয়ার থাকবে এক স্বকীয় পরিচয়, যা অতিক্রম করে যাবে রাষ্ট্রীয় সীমান্ত, ধর্মীয়, ভাষাগত সমস্ত ভেদাভেদ। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা বলেছেন, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রেখেই একটি অভিন্ন অর্থনৈতিক ইউনিয়ন গড়ে তোলা যায়। অভিন্ন বাজার, অভিন্ন মুদ্রা ও একটা সাধারণ ভিসা ব্যবস্থা চালু করা যায়। চূড়ান্তভাবে একটা অভিন্ন পার্লামেন্টও প্রতিষ্ঠা করা যায়, তবে তার অর্থ এটা নয় যে দেশগুলোর নিজ নিজ পার্লামেন্ট থাকবে না। পুরো অঞ্চলের জন্য সাধারণ পার্লামেন্টে আলোচ্য বিষয়গুলো হবে এক রকম, আর দেশগুলোর নিজ নিজ পার্লামেন্টে আলোচ্য বিষয়গুলো হবে অন্য রকম।
সব দেশ তাদের সব সম্পদ একত্র করবে, যেন তারা সম্মিলিতভাবে দক্ষিণ এশিয়াকে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও পরিবেশগত দিক থেকে অগ্রসর করে নিয়ে যেতে পারে। সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিয়মটা হবে: প্রত্যেক দেশ তার সামর্থ্য অনুযায়ী দেবে, আর প্রয়োজন অনুযায়ী নেবে।
জাতীয়তাবাদী উচ্চম্মন্যতা বা জাত্যভিমান ও ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় পরিচয় থেকে এই অঞ্চলে যে পারস্পরিক ঘৃণা ছড়িয়েছে তা দূর করার উপায় কী? এটা ছিল মূল আলোচনার বিষয়বস্তু। অনেক বক্তা বলেছেন, ভারতীয়, পাকিস্তানি, বাংলাদেশি, বা হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিষ্টান—এসব পরিচয়ের চেয়ে তাঁরা নিজেকে দক্ষিণ এশীয় বলে পরিচয় দিতে বেশি গর্বিত বোধ করবেন। ধর্মনিরপেক্ষতা বা অসাম্প্রদায়িকতাই হবে তাঁদের বিশ্বাস এবং তাঁরা এই বিশ্বাস সব সময় মেনে চলবেন। আমার বক্তৃতায় আমি বলি যে এ ধরনের একটি ঐক্যবদ্ধ দক্ষিণ এশিয়া গড়ে তোলার পথে কট্টর জাতীয়তাবাদী মনোভাব ভালো নয়। আমি আরও বলি, দক্ষিণ এশিয়ার জন্য নিজস্ব আইনকাঠামো সৃষ্টির জন্য আমাদের একটি সাধারণ আইনসভা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হবে।
আমার মনে হয়, সোশ্যাল ফোরামে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ প্রতিনিধি আমার সঙ্গে একমত পোষণ করেন, কিন্তু তাঁরা একই সঙ্গে এ কথাও বলেন যে এটাকে একটা স্বপ্ন বলে মনে হয়। সুদূর ভবিষ্যতেও হয়তো সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না, কারণ দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশের সামরিক বাহিনীগুলো এমন ক্ষমতা ও প্রভাব ভোগ করে আসছে যা তারা সহজে ত্যাগ করতে চাইবে না। সংবাদমাধ্যমকেও একটা সমস্যা বলে বর্ণনা করা হয়। কারণ, একমাত্র বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো দেশের সংবাদমাধ্যমে সোশ্যাল ফোরাম সম্পর্কে কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয়নি।
আমি যে দুটি অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেছিলাম, তার একটি ছিল তথ্য অধিকার বিষয়ে, অন্যটি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ বিষয়ে। দুটো বিষয়েই অংশগ্রহণকারীদের সামনে ভারত উপস্থাপিত হয়েছে দৃষ্টান্ত হিসেবে। তথ্য অধিকারের ক্ষেত্রে অরুণা রায়ের ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে, কারণ ভারতে তথ্য অধিকার আইন পাসের ঘটনাটি যে সম্ভব হয়েছে, তার পেছনে অরুণা রায়ের অবদান ছিল বিরাট। আমি জেনে অবাক হয়েছি যে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশেই তথ্য জানার অধিকারের পক্ষে হয় আইন পাস করা হয়েছে, অথবা অধ্যাদেশ বলবৎ করা হয়েছে। বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধি বলেন, তথ্য অধিকার আইন গণতন্ত্রকে গভীরতা দান করেছে। ওড়িষার তথ্য কমিশনার বলেন, তথ্য অধিকার আইন সরকারের স্বচ্ছতা বাড়িয়েছে। আরেক বক্তা বলেন, তথ্য অধিকার আইন দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে কথা বলার ক্ষমতা দেবে, এ অঞ্চলের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য ক্ষমতায়িত করবে যেন তারা তাদের ন্যূনতম অধিকারগুলো ভোগ করতে পারে।
এক অভিন্ন দক্ষিণ এশিয়া প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয় সোশ্যাল ফোরামের প্লেনারি অধিবেশনে। তবে সবাই স্বীকার করেন যে সরকার ও কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীগুলো এই নতুন দক্ষিণ এশিয়া গড়ে তোলার পথে বাধা হিসেবে দেখা দেবে। আবার কেউ মনে করেন না যে লক্ষ্যটি অর্জন করা অসম্ভব। অভিন্ন ইতিহাস, ঐতিহ্য, জনগোষ্ঠী ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে তাঁরা এই উপলব্ধিতে পৌঁছেছেন যে একদিন এক ঐক্যবদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ায় তাঁরা মিলেমিশে সুখে-শান্তিতে বাস করবেন, বিদায় জানাবেন অস্ত্র ও সহিংসতাকে। নতুন দক্ষিণ এশিয়ার যে রূপরেখা তাঁদের মনে রয়েছে তা হবে একটি সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ। তাঁরা উপলব্ধি করেন যে এটি একটি অত্যন্ত দুরূহ কাজ, কিন্তু এই বিশ্বাসও তাঁরা বুকের গভীরে লালন করেন যে পাহাড়ের ওই পারে আছে এক রোদ ঝলমলে উপত্যকা।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মশিউল আলম
কুলদীপ নায়ার: ভারতের বিশিষ্ট সাংবাদিক।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছিল যথার্থ স্থানেই, ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। বাঙালিদের মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে যেসব ছাত্র পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিল তাদের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শহীদ মিনার। ব্রিটিশদের শাসনামলে বিপ্লবী ভগৎ সিং ভারতের সেন্ট্রাল অ্যাসেমব্লিতে ছোট একটি বোমা ছুড়ে যেভাবে শাসকদের কান খুলে দিয়েছিলেন, ঢাকার শহীদ মিনারে তেমনি করে শাসকদের কান খুলে দিতে সেদিন অবিরাম বেজেছিল ঢোল। বহু বছর আগে একজন ফরাসি বিপ্লবীও তাঁর দেশের শাসকদের জনগণের কথা শোনানোর জন্য একই কাজ করেছিলেন।
সোশ্যাল ফোরাম বস্তুত এই সংবাদ বয়ে এনেছে যে দক্ষিণ এশিয়ায় এক শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। শহীদ মিনারে বক্তাদের কথায়ও সেই চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। একজন বক্তা বললেন, দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থা এমন হয়েছে একটা আমূল পরিবর্তন ছাড়া কিছুতেই কিছু হবে না। যে অঞ্চলে পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একত্রবাস, সেখানে বামপন্থার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু তিনি গান্ধীজির শান্তিপূর্ণ পথে সমাধান চান; দক্ষিণ এশিয়ায় যে সহিংসতা সন্ত্রাসবাদের রূপ নিয়েছে, তার ধার ভোঁতা করে দিতে তিনি গান্ধীজির মতবাদ প্রয়োগ করার পক্ষপাতী। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, পন্থা যদি ভালো না হয়, তাহলে লক্ষ্যও ভালোভাবে অর্জিত হয় না।
দক্ষিণ এশীয় সোশ্যাল ফোরাম, যা সত্যিকার অর্থে জনগণের সার্ক, দক্ষিণ এশিয়ায় একটি সমতাভিত্তিক ন্যায্য সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে ঢাকায় মিলিত হয়েছিল। বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণকারীরা ছোট ছোট নানা গ্রুপে বিভক্ত হয়েছে আলোচনা করেছেন সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলো নিয়ে। সুশাসন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, তথ্য অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেছেন তাঁরা। তাঁদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশের নাগরিক যেন অন্য দেশ থেকে তথ্য পান। ঐতিহাসিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মিলনায়তনে ও সেমিনারকক্ষে অনুষ্ঠিত হয়েছে কয়েক ডজন সেশন। সব আলোচনারই সার কথা একটাই: দক্ষিণ এশিয়ার থাকবে এক স্বকীয় পরিচয়, যা অতিক্রম করে যাবে রাষ্ট্রীয় সীমান্ত, ধর্মীয়, ভাষাগত সমস্ত ভেদাভেদ। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা বলেছেন, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রেখেই একটি অভিন্ন অর্থনৈতিক ইউনিয়ন গড়ে তোলা যায়। অভিন্ন বাজার, অভিন্ন মুদ্রা ও একটা সাধারণ ভিসা ব্যবস্থা চালু করা যায়। চূড়ান্তভাবে একটা অভিন্ন পার্লামেন্টও প্রতিষ্ঠা করা যায়, তবে তার অর্থ এটা নয় যে দেশগুলোর নিজ নিজ পার্লামেন্ট থাকবে না। পুরো অঞ্চলের জন্য সাধারণ পার্লামেন্টে আলোচ্য বিষয়গুলো হবে এক রকম, আর দেশগুলোর নিজ নিজ পার্লামেন্টে আলোচ্য বিষয়গুলো হবে অন্য রকম।
সব দেশ তাদের সব সম্পদ একত্র করবে, যেন তারা সম্মিলিতভাবে দক্ষিণ এশিয়াকে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও পরিবেশগত দিক থেকে অগ্রসর করে নিয়ে যেতে পারে। সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিয়মটা হবে: প্রত্যেক দেশ তার সামর্থ্য অনুযায়ী দেবে, আর প্রয়োজন অনুযায়ী নেবে।
জাতীয়তাবাদী উচ্চম্মন্যতা বা জাত্যভিমান ও ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় পরিচয় থেকে এই অঞ্চলে যে পারস্পরিক ঘৃণা ছড়িয়েছে তা দূর করার উপায় কী? এটা ছিল মূল আলোচনার বিষয়বস্তু। অনেক বক্তা বলেছেন, ভারতীয়, পাকিস্তানি, বাংলাদেশি, বা হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিষ্টান—এসব পরিচয়ের চেয়ে তাঁরা নিজেকে দক্ষিণ এশীয় বলে পরিচয় দিতে বেশি গর্বিত বোধ করবেন। ধর্মনিরপেক্ষতা বা অসাম্প্রদায়িকতাই হবে তাঁদের বিশ্বাস এবং তাঁরা এই বিশ্বাস সব সময় মেনে চলবেন। আমার বক্তৃতায় আমি বলি যে এ ধরনের একটি ঐক্যবদ্ধ দক্ষিণ এশিয়া গড়ে তোলার পথে কট্টর জাতীয়তাবাদী মনোভাব ভালো নয়। আমি আরও বলি, দক্ষিণ এশিয়ার জন্য নিজস্ব আইনকাঠামো সৃষ্টির জন্য আমাদের একটি সাধারণ আইনসভা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হবে।
আমার মনে হয়, সোশ্যাল ফোরামে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ প্রতিনিধি আমার সঙ্গে একমত পোষণ করেন, কিন্তু তাঁরা একই সঙ্গে এ কথাও বলেন যে এটাকে একটা স্বপ্ন বলে মনে হয়। সুদূর ভবিষ্যতেও হয়তো সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না, কারণ দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশের সামরিক বাহিনীগুলো এমন ক্ষমতা ও প্রভাব ভোগ করে আসছে যা তারা সহজে ত্যাগ করতে চাইবে না। সংবাদমাধ্যমকেও একটা সমস্যা বলে বর্ণনা করা হয়। কারণ, একমাত্র বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো দেশের সংবাদমাধ্যমে সোশ্যাল ফোরাম সম্পর্কে কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয়নি।
আমি যে দুটি অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেছিলাম, তার একটি ছিল তথ্য অধিকার বিষয়ে, অন্যটি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ বিষয়ে। দুটো বিষয়েই অংশগ্রহণকারীদের সামনে ভারত উপস্থাপিত হয়েছে দৃষ্টান্ত হিসেবে। তথ্য অধিকারের ক্ষেত্রে অরুণা রায়ের ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে, কারণ ভারতে তথ্য অধিকার আইন পাসের ঘটনাটি যে সম্ভব হয়েছে, তার পেছনে অরুণা রায়ের অবদান ছিল বিরাট। আমি জেনে অবাক হয়েছি যে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশেই তথ্য জানার অধিকারের পক্ষে হয় আইন পাস করা হয়েছে, অথবা অধ্যাদেশ বলবৎ করা হয়েছে। বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধি বলেন, তথ্য অধিকার আইন গণতন্ত্রকে গভীরতা দান করেছে। ওড়িষার তথ্য কমিশনার বলেন, তথ্য অধিকার আইন সরকারের স্বচ্ছতা বাড়িয়েছে। আরেক বক্তা বলেন, তথ্য অধিকার আইন দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে কথা বলার ক্ষমতা দেবে, এ অঞ্চলের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য ক্ষমতায়িত করবে যেন তারা তাদের ন্যূনতম অধিকারগুলো ভোগ করতে পারে।
এক অভিন্ন দক্ষিণ এশিয়া প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয় সোশ্যাল ফোরামের প্লেনারি অধিবেশনে। তবে সবাই স্বীকার করেন যে সরকার ও কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীগুলো এই নতুন দক্ষিণ এশিয়া গড়ে তোলার পথে বাধা হিসেবে দেখা দেবে। আবার কেউ মনে করেন না যে লক্ষ্যটি অর্জন করা অসম্ভব। অভিন্ন ইতিহাস, ঐতিহ্য, জনগোষ্ঠী ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে তাঁরা এই উপলব্ধিতে পৌঁছেছেন যে একদিন এক ঐক্যবদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ায় তাঁরা মিলেমিশে সুখে-শান্তিতে বাস করবেন, বিদায় জানাবেন অস্ত্র ও সহিংসতাকে। নতুন দক্ষিণ এশিয়ার যে রূপরেখা তাঁদের মনে রয়েছে তা হবে একটি সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ। তাঁরা উপলব্ধি করেন যে এটি একটি অত্যন্ত দুরূহ কাজ, কিন্তু এই বিশ্বাসও তাঁরা বুকের গভীরে লালন করেন যে পাহাড়ের ওই পারে আছে এক রোদ ঝলমলে উপত্যকা।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মশিউল আলম
কুলদীপ নায়ার: ভারতের বিশিষ্ট সাংবাদিক।
No comments