দূরের দূরবীনে-বহির্বিশ্বের দূতাবাস, রাষ্ট্রদূত ও রাজনীতি by অজয় দাশগুপ্ত
রাষ্ট্রদূত পদটিকে বাঙালি কেন জানি গভীর সম্মানের সঙ্গে দেখতে ভালোবাসে। ভয়ে ভয়ে বলি, অনেক মন্ত্রী-মিনিস্টারের চেয়েও এ পদের মর্যাদা অধিক। এর কারণ হয়তো অনেক। তবে মনে হয় রাষ্ট্র ও দূত মিলিয়ে যে ভাবমূর্তি, সেটাই বেশি কার্যকর। আরেকটি হচ্ছে, এঁরা দেশে থাকেন না।
পৃথিবীর নানা প্রান্তে টিভির পর্দায় দেখা আশ্বর্য সব সুন্দর দেশে বাস করেন। ওই সব দেশের খলনায়ক ক্ষমতাবানদের সঙ্গে এঁদের থাকে নিবিড় যোগাযোগ_হোয়াইট হাউস, ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট, বাকিংহাম প্যালেস, রাজা-বাদশাহদের সুরম্য প্রতিটি ভবন বা দরবারকক্ষে যাতায়াত তাঁদের। হয়তো সে কারণেই একজাতীয় শ্রদ্ধা ও দূরত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আরো একটি জরুরি বিষয় এঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, চাকরিজীবনের সফল ইতিহাস, যদিও সে দিকটি এখন আর অক্ষত বা আগের মতো নেই। আমাদের স্মৃতি বা অতীতজুড়ে দাপটের সঙ্গে বিরাজমান রাষ্ট্রদূত বা অ্যামবাসাডরদের জীবন ছিল বর্ণাঢ্য ও ঘটনাবহুল। ৪০ বছর আগে বিদেশের রাষ্ট্রদূত ইংল্যান্ডের আবু সাঈদ চৌধুরী, কলকাতার হোসেন আলী এখনো ইতিহাসজুড়ে উজ্জ্বল। সেই দিন এখন পাল্টেছে, কূটনীতিক হতে হলে কূটনীতি নিয়ে জ্ঞান বা ডিগ্রি থাকার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই উচ্চশিক্ষা বা ডিগ্রিরও। ছোট দেশ আমাদের, শিক্ষিত মানুষের সংখ্যাও তেমন আহামরি কিছু নয়, অথচ দুনিয়া তো বড়। দুনিয়ায় কত দেশ, সব দেশে প্রতিনিধি বা দূত পাঠানো নিয়মেরই অঙ্গ। একজনকে খুব জোর দুই থেকে তিনটি দেশের দায়িত্ব দিলেও কত কত কূটনীতিকের প্রয়োজন! সে প্রয়োজন বা চাহিদা মেটাতে যোগ্যতার চেয়েও এখন বেশি দরকার তদ্বির অথবা লবিং। রাষ্ট্র, রাষ্ট্রদূত_এসব বিষয়ের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে রাজনীতি। রাজনীতি হচ্ছে সেই মেওয়া ফল, যা খেলে যেমন পস্তাতে হয়, না খেলেও তেমনই। আমাদের দেশে রাজনীতির অবস্থা আরো জটিল। রাষ্ট্রই যখন তাঁর কাছে পরাভূত, দূত তো কোন ছাড়।
তাই রাষ্ট্রদূত পদটিও এখন আর আগের মতো জেল্লা বা জৌলুসপূর্ণ নেই। এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে দল, দলবাজি, লবিং আর রাজনৈতিক যথেচ্ছাচার। বাংলাদেশ শাসন করার কাজে নিয়োজিত বড় দুটি দল_আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এ বিষয়ে সমান উৎসাহী; যে যখন ক্ষমতায় তখন তাদের খয়ের খাঁ বা মনোনীত মানুষজনই রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। এর পেছনের উদ্দেশ্যও পরিষ্কার, নেতা-নেত্রীরা বিদেশে যাবেন, ঘন ঘন সফর বা ভ্রমণ করবেন, ইচ্ছামতো বহর নিয়ে ট্যুর করে আসবেন; কিন্তু তাঁদের খেদমত, তদারকি ও দেখভালের জন্য নিজেদের লোক থাকবে না? বিদেশ ভ্রমণ বা সফর তো এখন এক ধরনের প্রমোদও বটে। রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রী, মন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের সঙ্গে রাষ্ট্রদূত বা কূটনীতিকদের সম্পর্কও এখন প্রভু-ভৃত্যের। হওয়ারই কথা, চোরাগোপ্তা বা লবিংয়ের জোরে পদ পেলে, বিদেশে দূত হলে তাঁদের মেরুদণ্ড কি আর সোজা থাকে? রাজনীতির এত ক্ষমতা রাষ্ট্রদূতের মতো উজ্জ্বল ও চমৎকার একটি পদকেও অমেরুদণ্ডী করে তুলতে পেরেছে। জানতাম চৌকস, বুদ্ধিময়, মেধাবী ও উৎসুক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বা রাজনীতিপ্রবণদেরই এ পদে যাওয়ার কথা। ওই যে পাল্টে যাওয়া নিয়ম-অনিয়মের সে ভেলায় চড়ে সাবেক আর্মি অফিসাররাই এ পদে সবচেয়ে বেশি অধিষ্ঠিত। একসময় গণতন্ত্রচর্চা বলে আসলেই কিছু ছিল না। আমরা জন্মেছি পাকিস্তানের পেট চিরে। ওই রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক তো দূরের কথা, জনশাসনেও বিশ্বাসী নয়। সে দেশে কয়েক বছর পর পর ক্ষমতাসীন প্রভুরা নাজেল হন। আবির্ভাব ঘটে কার্যত ত্রাণকর্তার। এই ত্রাণকর্তারা আসেন সেনাবাহিনী থেকে। বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস, চৈনিক বিপ্লবীরাও কেন জানি এ তথ্যে বিশ্বাস করতেন। ওই নল যার কাছে থাকে তারা ভাবে, আমরাই পারি। দেশ, রাষ্ট্র, জনগণ, প্রচলিত নিয়মের থোড়াই কেয়ার করেন তাঁরা। তাঁদের ধারণা, দেশপ্রেমের সোল এজেন্সিও তাঁদের। হম্বিতম্বি আর গর্জনের ভেতর ক্ষমতা দখল, দুর্নীতি-দুঃশাসন অবসানের নামে ইয়াং জেনারেশন ও সুধীসমাজের ওপর চোটপাট। যতবার তাঁরা ক্ষমতা নেন, রাস্তাঘাটে বন্দুক, কামান, স্টেনগান নিয়ে প্রহরারত সৈন্য-সামন্ত দেখে মনে হয় দেশে যুদ্ধ চলছে। ওই সব মন্ত্রী-সিপাহির অন্যান্য কাজের ভেতর একটি মূল কাজ তরুণদের চুল কাটাতে বাধ্য করা। মাথার চুলের সঙ্গে শান্তি ও শৃঙ্খলার কী সম্পর্ক তা আমি আজও খুঁজে পাইনি। আমার ধারণা, নিজেদের মাথায় চুল না থাকার কারণে অথবা রাখতে না পারার নিয়মে অতিষ্ঠ হয়েই এরা লম্বা চুল বা মাঝারি কেশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে ভালোবাসে। ওই পর্যন্তই, একসময় গণজাগরণ বা জন-ইচ্ছার দাপটে লেজ গুটিয়ে ব্যারাকে ফিরে যেতে হয় তাদের। সাধারণ সেনা বা নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা দাবার ঘুঁটি, তারা আমাদের স্বজন, ফলে তারা আসে আর যায়, কিন্তু কেউকেটা বা ত্রাণকর্তা নামে ক্ষমতা দখলের স্বপ্নবিভোর মাতবর ও তাঁর সহযোগীরা! তাঁরা তখন যেনতেন প্রকারে সমঝোতায় আসতে ব্যস্ত, ওই সমঝোতা অনুযায়ী তাঁদের পাঠানো হয় দেশের বাইরে, তাঁরাই বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, পাকিস্তান ভাঙলেও এ নিয়ম ভাঙেনি।
এ-জাতীয় প্রক্রিয়া এখনো সচল। আমাদের দেশটি পাকিস্তান নয় এবং তা কোনো দিন হওয়ারও নয়, তবু মাঝেমধ্যে গণতন্ত্রের খুঁটি ধরে টান দেওয়ার প্রবণতা দেখি, রাজনীতির উদগ্র আর মারমুখো অবস্থানকে পুঁজি করে পাকিস্তানি কায়দায় সেনাতন্ত্রের আবির্ভাব আর তার সুফলে রাষ্ট্রদূত পদটির বেশির ভাগই এদের দখলে। এতে রাজনীতিরও লাভ। ক্ষমতাসীনরা ভাবেন, এ বা ও, ইনি বা তিনি দেশে না থাকলেই মঙ্গল, ক্ষমতা নিরাপদ, অভ্যুত্থানের ভয় নেই। ভয় নেই অন্ধকারে গদি হারানোরও। অথচ গণতান্ত্রিক দেশগুলোর দিকে দেখুন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের রাষ্ট্রদূতদের তালিকা নিলে কজন আর্মি অফিসার খুঁজে পাওয়া যাবে? পাশাপাশি আমাদের চিত্রটি দেখে মনে হবে, দেশের সিভিল সোসাইটিতে কূটনীতিক হওয়ার মতো যোগ্য কোনো মানুষ নেই।
এ প্রক্রিয়া রাষ্ট্রদূত পদটির ঔজ্জ্বল্য ও বিস্তার বিঘি্নত করেছে। যোগ্যতাবলে যেকোনো পেশা বা শ্রেণীর মানুষই এ পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন। তার বদলে অপপ্রক্রিয়ায় নির্বাসন বা স্বার্থসংশ্লিষ্টতায় প্রেরিত দূত না পারেন দেশের পাশে দাঁড়াতে, না জাতির হিত সাধন করতে। অথচ বাংলাদেশ এখন অগ্রসরমান উন্নয়ন অভিযাত্রী একটি দেশ। তার প্রবৃদ্ধি, তার অর্জন, মানুষের পরিশ্রমলব্ধ কর্মকাণ্ডের সুফল তাকে দুনিয়াময় অন্যভাবে পরিচিত করতে সাহায্য করছে। একসময় শুধু শ্রমিক বা শ্রম রপ্তানি করার জন্য বেছে নেওয়া হলেও আজ শ্রম, মেধা, শ্রমিক, শিল্প, উৎপাদিত পণ্যসহ সেবার জন্যও বাংলাদেশের কথা বিবেচনায় আনতে হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার মতো কনজারভেটিভ বা সংরক্ষণবাদী সমাজ ও দেশে বাংলাদেশের পণ্য আজ দ্রুত জনপ্রিয় ও নিত্যব্যবহার্য হয়ে উঠছে। বিশ্বায়নের এই কালে রাষ্ট্রদূত বা দেশের রাজপ্রতিনিধির কাজ অনেক বড়, অনেক সুদূরপ্রসারী। সঠিক লবিং, ঠিক জায়গামতো পেঁৗছতে পারলে জনশক্তি ও সম্পদ রপ্তানি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নতুন এক জগৎ বা জগতের দুয়ার খোলা সম্ভব। বিদেশে বসে দেশের মানুষের কষ্টার্জিত আয় ও অর্জনের বেতন ভোগকারীদের দায়িত্ব প্রবাসী আওয়ামী লীগ বা বিএনপির সভা-সমিতি ও সেমিনার উদ্বোধন নয়। নয় প্রবাসী বাঙালির মেলা, খেলা বা গোষ্ঠীবদ্ধ সম্মেলন, পিঠা উৎসবের মতো লঘু বিষয়ের অতিথি হয়ে বক্তৃতা দেওয়া। আজকাল এটাই রেওয়াজ ও নিয়ম। এমন একটি দেশের নাম বলুন, যে দেশে নিয়োজিত আমাদের রাষ্ট্রদূত শ্রম, শ্রমিক ও রপ্তানিজাত অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা বা আদম ব্যবসার বিরুদ্ধে কোনো মতবিনিময় বা সর্বদলীয় সমাবেশ করেছেন। কোনো দেশের ক্ষমতাসীন বা বিরোধী নেতা-নেত্রীদের হয় বাধ্য অথবা বোঝাতে পেরেছেন এবং তাঁদের মাঠে নামিয়ে এসব বিষয়ের বিরোধিতা করাতে পেরেছেন?
অথচ এঁদের পূর্বসূরি আমাদের সাবেক রাষ্ট্রদূতরাই মহান মুক্তিযুদ্ধের মতো জটিল বিষয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রবল বৈশ্বিক জনমত গড়ে তুলেছিলেন। কোয়ালিটি বা গুণগত মানের ফারাকের জন্য দায়ী যে রাজনীতি ও ক্ষমতাবলয়, তার কাছেই এর প্রতিকার জমা। দফায় দফায় মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আমলা বা হোমরাচোমরাদের এয়ারপোর্টে রিসিভ করার রেওয়াজ বন্ধ করে প্রকৃত কাজে মন দিতে বাধ্য করলে রাষ্ট্রদূত, দূতাবাস ও প্রবাসী জনগণ এক ও অভিন্ন হয়ে দেশের কাজে লাগতে পারবে। এমন জরুরি বিষয় উপেক্ষিত না থাকাই মঙ্গল। নিশ্চয়ই তা পুনর্বার বলতে হবে না।
লেখক : সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
dasguptaajoy@hotmail.com
তাই রাষ্ট্রদূত পদটিও এখন আর আগের মতো জেল্লা বা জৌলুসপূর্ণ নেই। এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে দল, দলবাজি, লবিং আর রাজনৈতিক যথেচ্ছাচার। বাংলাদেশ শাসন করার কাজে নিয়োজিত বড় দুটি দল_আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এ বিষয়ে সমান উৎসাহী; যে যখন ক্ষমতায় তখন তাদের খয়ের খাঁ বা মনোনীত মানুষজনই রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। এর পেছনের উদ্দেশ্যও পরিষ্কার, নেতা-নেত্রীরা বিদেশে যাবেন, ঘন ঘন সফর বা ভ্রমণ করবেন, ইচ্ছামতো বহর নিয়ে ট্যুর করে আসবেন; কিন্তু তাঁদের খেদমত, তদারকি ও দেখভালের জন্য নিজেদের লোক থাকবে না? বিদেশ ভ্রমণ বা সফর তো এখন এক ধরনের প্রমোদও বটে। রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রী, মন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের সঙ্গে রাষ্ট্রদূত বা কূটনীতিকদের সম্পর্কও এখন প্রভু-ভৃত্যের। হওয়ারই কথা, চোরাগোপ্তা বা লবিংয়ের জোরে পদ পেলে, বিদেশে দূত হলে তাঁদের মেরুদণ্ড কি আর সোজা থাকে? রাজনীতির এত ক্ষমতা রাষ্ট্রদূতের মতো উজ্জ্বল ও চমৎকার একটি পদকেও অমেরুদণ্ডী করে তুলতে পেরেছে। জানতাম চৌকস, বুদ্ধিময়, মেধাবী ও উৎসুক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বা রাজনীতিপ্রবণদেরই এ পদে যাওয়ার কথা। ওই যে পাল্টে যাওয়া নিয়ম-অনিয়মের সে ভেলায় চড়ে সাবেক আর্মি অফিসাররাই এ পদে সবচেয়ে বেশি অধিষ্ঠিত। একসময় গণতন্ত্রচর্চা বলে আসলেই কিছু ছিল না। আমরা জন্মেছি পাকিস্তানের পেট চিরে। ওই রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক তো দূরের কথা, জনশাসনেও বিশ্বাসী নয়। সে দেশে কয়েক বছর পর পর ক্ষমতাসীন প্রভুরা নাজেল হন। আবির্ভাব ঘটে কার্যত ত্রাণকর্তার। এই ত্রাণকর্তারা আসেন সেনাবাহিনী থেকে। বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস, চৈনিক বিপ্লবীরাও কেন জানি এ তথ্যে বিশ্বাস করতেন। ওই নল যার কাছে থাকে তারা ভাবে, আমরাই পারি। দেশ, রাষ্ট্র, জনগণ, প্রচলিত নিয়মের থোড়াই কেয়ার করেন তাঁরা। তাঁদের ধারণা, দেশপ্রেমের সোল এজেন্সিও তাঁদের। হম্বিতম্বি আর গর্জনের ভেতর ক্ষমতা দখল, দুর্নীতি-দুঃশাসন অবসানের নামে ইয়াং জেনারেশন ও সুধীসমাজের ওপর চোটপাট। যতবার তাঁরা ক্ষমতা নেন, রাস্তাঘাটে বন্দুক, কামান, স্টেনগান নিয়ে প্রহরারত সৈন্য-সামন্ত দেখে মনে হয় দেশে যুদ্ধ চলছে। ওই সব মন্ত্রী-সিপাহির অন্যান্য কাজের ভেতর একটি মূল কাজ তরুণদের চুল কাটাতে বাধ্য করা। মাথার চুলের সঙ্গে শান্তি ও শৃঙ্খলার কী সম্পর্ক তা আমি আজও খুঁজে পাইনি। আমার ধারণা, নিজেদের মাথায় চুল না থাকার কারণে অথবা রাখতে না পারার নিয়মে অতিষ্ঠ হয়েই এরা লম্বা চুল বা মাঝারি কেশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে ভালোবাসে। ওই পর্যন্তই, একসময় গণজাগরণ বা জন-ইচ্ছার দাপটে লেজ গুটিয়ে ব্যারাকে ফিরে যেতে হয় তাদের। সাধারণ সেনা বা নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা দাবার ঘুঁটি, তারা আমাদের স্বজন, ফলে তারা আসে আর যায়, কিন্তু কেউকেটা বা ত্রাণকর্তা নামে ক্ষমতা দখলের স্বপ্নবিভোর মাতবর ও তাঁর সহযোগীরা! তাঁরা তখন যেনতেন প্রকারে সমঝোতায় আসতে ব্যস্ত, ওই সমঝোতা অনুযায়ী তাঁদের পাঠানো হয় দেশের বাইরে, তাঁরাই বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, পাকিস্তান ভাঙলেও এ নিয়ম ভাঙেনি।
এ-জাতীয় প্রক্রিয়া এখনো সচল। আমাদের দেশটি পাকিস্তান নয় এবং তা কোনো দিন হওয়ারও নয়, তবু মাঝেমধ্যে গণতন্ত্রের খুঁটি ধরে টান দেওয়ার প্রবণতা দেখি, রাজনীতির উদগ্র আর মারমুখো অবস্থানকে পুঁজি করে পাকিস্তানি কায়দায় সেনাতন্ত্রের আবির্ভাব আর তার সুফলে রাষ্ট্রদূত পদটির বেশির ভাগই এদের দখলে। এতে রাজনীতিরও লাভ। ক্ষমতাসীনরা ভাবেন, এ বা ও, ইনি বা তিনি দেশে না থাকলেই মঙ্গল, ক্ষমতা নিরাপদ, অভ্যুত্থানের ভয় নেই। ভয় নেই অন্ধকারে গদি হারানোরও। অথচ গণতান্ত্রিক দেশগুলোর দিকে দেখুন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের রাষ্ট্রদূতদের তালিকা নিলে কজন আর্মি অফিসার খুঁজে পাওয়া যাবে? পাশাপাশি আমাদের চিত্রটি দেখে মনে হবে, দেশের সিভিল সোসাইটিতে কূটনীতিক হওয়ার মতো যোগ্য কোনো মানুষ নেই।
এ প্রক্রিয়া রাষ্ট্রদূত পদটির ঔজ্জ্বল্য ও বিস্তার বিঘি্নত করেছে। যোগ্যতাবলে যেকোনো পেশা বা শ্রেণীর মানুষই এ পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন। তার বদলে অপপ্রক্রিয়ায় নির্বাসন বা স্বার্থসংশ্লিষ্টতায় প্রেরিত দূত না পারেন দেশের পাশে দাঁড়াতে, না জাতির হিত সাধন করতে। অথচ বাংলাদেশ এখন অগ্রসরমান উন্নয়ন অভিযাত্রী একটি দেশ। তার প্রবৃদ্ধি, তার অর্জন, মানুষের পরিশ্রমলব্ধ কর্মকাণ্ডের সুফল তাকে দুনিয়াময় অন্যভাবে পরিচিত করতে সাহায্য করছে। একসময় শুধু শ্রমিক বা শ্রম রপ্তানি করার জন্য বেছে নেওয়া হলেও আজ শ্রম, মেধা, শ্রমিক, শিল্প, উৎপাদিত পণ্যসহ সেবার জন্যও বাংলাদেশের কথা বিবেচনায় আনতে হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার মতো কনজারভেটিভ বা সংরক্ষণবাদী সমাজ ও দেশে বাংলাদেশের পণ্য আজ দ্রুত জনপ্রিয় ও নিত্যব্যবহার্য হয়ে উঠছে। বিশ্বায়নের এই কালে রাষ্ট্রদূত বা দেশের রাজপ্রতিনিধির কাজ অনেক বড়, অনেক সুদূরপ্রসারী। সঠিক লবিং, ঠিক জায়গামতো পেঁৗছতে পারলে জনশক্তি ও সম্পদ রপ্তানি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নতুন এক জগৎ বা জগতের দুয়ার খোলা সম্ভব। বিদেশে বসে দেশের মানুষের কষ্টার্জিত আয় ও অর্জনের বেতন ভোগকারীদের দায়িত্ব প্রবাসী আওয়ামী লীগ বা বিএনপির সভা-সমিতি ও সেমিনার উদ্বোধন নয়। নয় প্রবাসী বাঙালির মেলা, খেলা বা গোষ্ঠীবদ্ধ সম্মেলন, পিঠা উৎসবের মতো লঘু বিষয়ের অতিথি হয়ে বক্তৃতা দেওয়া। আজকাল এটাই রেওয়াজ ও নিয়ম। এমন একটি দেশের নাম বলুন, যে দেশে নিয়োজিত আমাদের রাষ্ট্রদূত শ্রম, শ্রমিক ও রপ্তানিজাত অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা বা আদম ব্যবসার বিরুদ্ধে কোনো মতবিনিময় বা সর্বদলীয় সমাবেশ করেছেন। কোনো দেশের ক্ষমতাসীন বা বিরোধী নেতা-নেত্রীদের হয় বাধ্য অথবা বোঝাতে পেরেছেন এবং তাঁদের মাঠে নামিয়ে এসব বিষয়ের বিরোধিতা করাতে পেরেছেন?
অথচ এঁদের পূর্বসূরি আমাদের সাবেক রাষ্ট্রদূতরাই মহান মুক্তিযুদ্ধের মতো জটিল বিষয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রবল বৈশ্বিক জনমত গড়ে তুলেছিলেন। কোয়ালিটি বা গুণগত মানের ফারাকের জন্য দায়ী যে রাজনীতি ও ক্ষমতাবলয়, তার কাছেই এর প্রতিকার জমা। দফায় দফায় মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আমলা বা হোমরাচোমরাদের এয়ারপোর্টে রিসিভ করার রেওয়াজ বন্ধ করে প্রকৃত কাজে মন দিতে বাধ্য করলে রাষ্ট্রদূত, দূতাবাস ও প্রবাসী জনগণ এক ও অভিন্ন হয়ে দেশের কাজে লাগতে পারবে। এমন জরুরি বিষয় উপেক্ষিত না থাকাই মঙ্গল। নিশ্চয়ই তা পুনর্বার বলতে হবে না।
লেখক : সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
dasguptaajoy@hotmail.com
No comments