জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতাই সমাধান by মোহাম্মদ মতিন উদ্দিন
সম্প্রতি সাংবাদিক এম আবদুল্লাহ বর্তমান জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই এলাহী চৌধুরীসহ জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তা ও প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে ৩৫ কোটি টাকার সমপরিমাণ ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘুষ গ্রহণের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে বলে আমার দেশ পত্রিকায় ১৭ ডিসেম্বর একটি রিপোর্ট প্রদান করেন।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, মার্কিন তেল কোম্পানি শেভরনকে বিনা টেন্ডারে ৩৭০ কোটি টাকায় একটি কম্প্রেসার স্টেশন বসানোর কাজ দেয়ার বিনিময়ে এ উেকাচ গ্রহণ করা হয়েছে বলে অভিযোগপত্রে তথ্য দেয়া হয়েছে। পেট্রোবাংলার প্যাডে প্রধানমন্ত্রী বরাবর এ অভিযোগপত্র পেশ করা হয়েছে। অভিযুক্তদের পারস্পরিক যোগসাজশে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি শেভরনকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে প্রায় ৩৭০ কোটি টাকার সমান ৫২.৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে মুচাইতে কম্প্রেসার স্থাপনের কাজ দেয়া হয়েছে। নতুন আবরণে পুরনো কম্প্রেসার বসানোর এ কাজ বিনা দরপত্রে একক প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নেয়া হয়েছে।
অভিযোগে আরও বলা হয়, বর্তমানে এ কম্প্রেসার স্থাপনের কোনো প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও অনৈতিকভাবে আর্থিক সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যে জ্বালানি উপদেষ্টা মার্কিন কোম্পানি শেভরনকে কাজটি পাইয়ে দেন। এ কাজ পাইয়ে দিতে জ্বালানি উপদেষ্টা শেভরনের কাছ থেকে ৫ মিলিয়ন ডলার উেকাচ গ্রহণ করে তার নেতৃত্বে ওই অর্থ ভাগ-বাটোয়ারা করেন।
প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের বিগত সরকারের আমলেও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সে সময় বিদ্যুত্ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করেছিলেন বর্তমান জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই এলাহী চৌধুরী। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়েরকৃত বহুল আলোচিত নাইকো দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘদিন কারা বরণ করেন তৌফিক-ই এলাহী। নাইকো মামলায়ও প্রধান অভিযোগ ছিল বিনা টেন্ডারে নাইকোকে গ্যাসক্ষেত্র বরাদ্দ দেয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিপুল ক্ষতি। বর্তমান সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত এই জ্বালানি উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুত্ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি সংবাদ সম্মেলনও করেছে এ সরকারের আমলেই।
অভিযোগপত্রের মূল বিষয় হচ্ছে তিনটি : ১. গ্যাসের চাপ বৃদ্ধির জন্য মুচাইতে বর্তমানে কম্প্রেসার স্টেশন বসানোর প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও এ কাজ করা হচ্ছে ২. বিনা টেন্ডারে ৩৭০ কোটি টাকার এ কাজ শেভরনকে দেয়া হয়েছে ৩. উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এ কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য শেভরনের কাছ থেকে ৫ মিলিয়ন ডলার ঘুষ গ্রহণ ও সেটা নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়া হয়েছে।
সাংবাদিক হিসেবে এ ধরনের রিপোর্ট প্রকাশ করে এম আবদুল্লাহ রাষ্ট্রীয় কাজে অনিয়মের বিষয়টিই তুলে ধরেছেন। সাংবাদিক হিসেবে তিনি এ কাজটি করতেই পারেন। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরা বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সভায় (১৭ ডিসেম্বর, ২০০৯) আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদককে হুমকি প্রদর্শন করেন। হুমকির ভাষা হচ্ছে, একটা কাগজ বানিয়ে যাচ্ছেতাই লিখে আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙবেন না। মানুষ প্রতিহত করলে আপনি রাস্তায় বের হতে পারবেন না। আমরা আপনাকে চলতে দেব না। জয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ না হলে মাহমুদুর রহমানকে বিচারের কাঠগড়ার দাঁড় করানো হবে বলেও আওয়ামী লীগ নেতারা হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। ১৯ ডিসেম্বর আক্রান্ত হলেন সাংবাদিক এম আবদুল্লাহ। হামলাকারীরা ভেঙে দিয়েছে তার গাড়ি। পিছু ধাওয়া করে ইট দিয়ে আঘাত করা হয়েছে তাকে। গণতন্ত্রের প্রশ্নে শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল এ ধরনের ভাষার ব্যবহারকে অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবেই গণ্য করবেন—এটাই স্বাভাবিক। হুমকি প্রদর্শন করেই ক্ষান্ত হলেন না তারা, শারীরিকভাবে আঘাত করার পথে এগিয়ে গেলেন। এ যেন মগের মুল্লুক। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসে যা খুশি তাই করবেন, যা খুশি তাই বলবেন, কিন্তু এর প্রতিবাদ করা যাবে না—এ মানসিকতা গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীলদের কাম্য নয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসে ক্ষমতার দাপট দেখানো গণতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় নয় বরং বলা চলে এ মানসিকতা ফ্যাসিবাদের পরিচয়। এই যদি হয় অবস্থা, তবে সংবিধানে একটা বাক্য সন্নিবেশ করে নিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। যারাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসুক না কেন তাদের কার্যকলাপ নিয়ে কোনো ধরনের সমালোচনা চলবে না—সমালোচনা করা হবে দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ধরনের একটা বাক্য সংবিধানে সন্নিবেশিত করে নিজেদের সব কার্যকলাপকে দায়মুক্ত করার ঘোষণা দিলেই তো আর কোনো সমস্যা থাকে না। এম আবদুল্লাহর মতো সাংবাদিকও তখন ভুল করেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীনদের সমালোচনা করে কোনো রিপোর্ট প্রদান করবেন না।
গণতন্ত্রের কথা বললে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের সব সময় এই মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে। সমালোচনার উত্তর যৌক্তিকভাবে হাজির করতে হবে। পত্রিকায় প্রকাশিত কোনো রিপোর্ট বা সমালোচনা তাদের মানহানি করলে, হুমকি প্রদান না করে আইনের আশ্রয় গ্রহণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। গণতন্ত্রের প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের কাছ থেকে এটাই দেশবাসী আশা করে।
গণতন্ত্রের প্রশ্নে দেশবাসীর এ কামনাকে শুরুতেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংবিধানে স্ববিরোধিতাপূর্ণ করে তোলা হয়েছে। আমাদের দেশের সংবিধানে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী কে এ বিষয়টা স্পষ্ট নয়। সংবিধানের প্রথম ভাগে ৭নং অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে! ৭।(১) প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতা প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।
এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ এ অর্থে বলা যায় জনগণই হচ্ছে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। স্বভাবতই জনগণের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষাকে এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন হয়ে যায় সংবিধানের কর্তব্য। অথবা বলা যায় জনগণের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষাকে লিখিত রূপ দিয়ে তা যথার্থ হয়েছে কিনা এ প্রশ্নে গণভোটের মাধ্যমে যাচাই করে তাকে রাষ্ট্রীয় সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করাটাই হচ্ছে যথাযথ পদক্ষেপ। আমাদের দেশে সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে এ কাজটি করা হয়নি এটাই হচ্ছে রূঢ় বাস্তবতা। গণভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সংবিধানের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে আমরা সক্ষম হলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধররা জনস্বার্থ বিরোধী বা জাতীয় স্বার্থবিরোধী কাজ করে পার পেয়ে যাওয়ার রাস্তা পেত না। এ কাজটা হয়নি বলেই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধররা আইনের ঊর্ধ্বে থাকার ব্যবস্থা করে নিতে পারছেন। মিথ্যা মামলার অজুহাতে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগকে কেন্দ্র করে আইনি প্রক্রিয়ায় যথাযথ মীমাংসার পথকে এড়িয়ে মামলা প্রত্যাহারের সুযোগ করে নিতে পারছেন। এটা গণতন্ত্রসম্মত নয়। সংবিধান প্রণয়নের যথাযথ পথ অনুসরণ না করে সংবিধান প্রণয়নের ফলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা সাংবিধানিক নীতি কাঠামো অমান্য করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন অর্থাত্ সংবিধানে যা লিখা আছে সেটা মান্য করা বা না করা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধরদের ইচ্ছার অধীন। এই অর্থে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধররা হয়ে যায় পরোক্ষভাবে সার্ভভৌম ক্ষমতার অধিকারী। সংবিধানের ক্ষেত্রে সার্বভৌম ক্ষমতার প্রশ্নে এই অস্বচ্ছ অবস্থান বহাল রেখে ’৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়া বা না যাওয়া নিয়ে এখন যে বিতর্ক চলছে তা নিতান্তই হাস্যকর। সত্যিকার অর্থেই এদেশে যারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান তাদের মূল প্রশ্নে অর্থাত্ জনগণের সার্থভৌমত্বের প্রশ্নে সংবিধানে যে অস্বচ্ছ এবং স্ববিরোধী অবস্থান গ্রহণ করা হয়েছে তার অবসান ঘটানোর প্রশ্নে সোচ্চার হতে হবে।
এক্ষেত্রে একটা উদাহরণ দেখানো দরকার। যেমন—সংবিধানের একাদশ ভাগে আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পর্কিত বিধানে বলা হয়েছে, বিদেশের সহিত সম্পাদিত সকল চুক্তি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হইবে এবং রাষ্ট্রপতি তাহা সংসদে পেশ করিবার ব্যবস্থা করিবেন :
তবে শর্ত থাকে যে, জাতীয় নিরাপত্তার সহিত সংশ্লিষ্ট অনুরূপ কোনো চুক্তি কেবল সংসদের গোপন বৈঠকে পেশ করা হইবে।
আমার জানা মতে, তেল-গ্যাস-কয়লা অনুসন্ধান ও উত্তোলন সম্পর্কিত যেসব চুক্তি বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে করা হয়েছে তার কোনোটিই সংসদে আলোচিত হয়নি অর্থাত্ এসব চুক্তির শর্তাদি গোপনেই রাখা হয়েছে। ঘটনাক্রমে কোনো কোনো চুক্তির শর্ত প্রকাশ্যে এসেছে, কিন্তু এসব চুক্তির শর্ত নিয়েও জাতীয় সংসদে কোনো আলোচনা হয়নি। গোপনে সংগঠিত এসব চুক্তির শর্তগুলো জাতীয় স্বার্থের পক্ষে না বিপক্ষে এটা জানার অধিকার থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি। এই যখন অবস্থা তখন এসব চুক্তিকে কেন্দ্র করে অনিয়ম হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। এসব চুক্তিকে কেন্দ্র করে আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয়নি, সেটা পরে আমরা জানতে পেরেছি। জাতীয় স্বার্থের বিপক্ষে এসব চুক্তি যারা করেছেন তারা যে গোপনে আর্থিকভাবে লাভবান হননি সেটা কে বলতে পারে? ঘুষ গ্রহণকালে কেউ রশিদ কেটে ঘুষ খায় না—এটা গোপনেই সংগঠিত হয়।
এক্ষেত্রে পেছনের একটু ইতিহাস আলোচনা করা দরকার। আমরা জানি ১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন তেল-গ্যাস সম্পদের ২৩টি ব্লকের মধ্যে ৭টি ব্লক অসম উত্পাদন বণ্টন চুক্তির মাধ্যমে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে লিজ দিয়েছিল। বাংলাদেশের তেল-গ্যাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদকে ২৩টি ব্লকে ভাগ করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছে উন্মুক্ত করে দেয়ার নীতি এরশাদের শাসনামলের সময় গ্রহণ করা হয়েছিল। ১৯৯১-৯৬ সালে যারা ক্ষমতায় ছিলেন, তারা ৫টি ব্লক এবং ১৯৯৬-২০০১ সালে যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারা ৭টি ব্লক অসম উত্পাদন বণ্টন চুক্তির মাধ্যমে অক্সিডেন্টাল, এনরন, ইউনিকল, শোল, কেয়ার্ন, তাল্লো, টেক্সাকো প্রভৃতি বহুজাতিক কোম্পানিকে তেল-গ্যাস ব্লকগুলো লিজ প্রদান করে। উত্পাদন বণ্টন চুক্তির (পিএসসি) সবচেয়ে খারাপ এবং ভয়ঙ্কর দিক হলো, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ক্ষেত্রে কী পরিমাণ খরচ করছে, সেটা মনিটরিং করার ক্ষমতা বাংলাদেশের জাতীয় সংস্থা পেট্রোবাংলার নেই। ফলে বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলো অনুসন্ধান খরচ, রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত খরচ এবং পরিচালনা খরচ ইচ্ছেমাফিক বাড়িয়ে দেখালে আমাদের কিছু করার থাকে না। যে ব্লকে ৯.২ কোটি ডলার খরচ হওয়ার কথা, সেই ব্লকে যদি তারা খরচ দেখায় ৩৬ কোটি ডলার তাহলেও সেটা আমাদের মানতে হবে। সাঙ্গু গ্যাস ক্ষেত্রে এমনটাই করেছিল শেল নামক কোম্পানিটি। অন্য একটি কোম্পানি কেয়ার্ন এনার্জি ১৬ নং ব্লকে ৭ বছরে ১ কোটি ২১ লাখ ডলার বিনিয়োগ করবে বলেছিল, কিন্তু পরে বলেছিল তারা বিনিয়োগ করেছে ২৩ কোটি ডলার। এক্ষেত্রে তাদের হিসাবটাই মানতে হয়েছে উত্পাদন বণ্টন চুক্তি অনুযায়ী। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের খরচ ইচ্ছেমাফিক বাড়িয়ে কী পরিমাণ মুনাফা করছে, তা বোঝার কোনো উপায় নেই। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে এভাবে মুনাফা অর্জনে যারা উত্পাদন বণ্টন চুক্তিতে ছাড় দিয়েছে, তারা কি বিনা স্বার্থে এসব করেছে? এক্ষেত্রে অবৈধ লেনদেন হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমাদের জাতীয় সংসদ কি এসব বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করেছে? যারা এসব পিএসসি সম্পাদনে ভূমিকা রেখেছে তারা কি কোনো জবাবদিহিতার সম্মুখীন হয়েছেন? কোনোটাই হয়নি। এই যখন অবস্থা তখন আমাদের সে প্রশ্নেই ফিরে যেতে হবে অর্থাত্ যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিসহ আমলাতন্ত্রের ওপর জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। নির্বাচিত প্রতিনিধিসহ আমলাতন্ত্রকে জনগণের কাছে জবাবদিহিতায় বাধ্য করার মতো সাংবিধানিক নীতি আরোপ করা ছাড়া অবৈধ লেনদেন তথা দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। তাই যারা দুর্নীতি বন্ধ করতে আগ্রহী তাদের সোচ্চার হতে হবে রাষ্ট্রীয় সংবিধানে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগ যেভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব তা বাস্তবায়নের জন্য সচেষ্ট হতে। এটা ছাড়া দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। এক সরকার যাবে, আরেক সরকার আসবে, কিন্তু দুর্নীতি চলবে। তাই বলছি, শুধু ব্যক্তির দুর্নীতি নিয়ে কথা বলা যথেষ্ট নয়, রাষ্ট্রীয় সংবিধানের ক্ষেত্রে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগকে নিশ্চিত করতে হবে। যে কাজটি আমরা এখনও করতে সক্ষম হইনি। অর্থাত্ সংবিধানের গোড়ায় গলদ থেকে গেছে। এই গলদ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিসহ আমলাতন্ত্রের ওপর জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই এবং সাংবিধানিকভাবে তা নিশ্চিত করতে হবে।
অভিযোগে আরও বলা হয়, বর্তমানে এ কম্প্রেসার স্থাপনের কোনো প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও অনৈতিকভাবে আর্থিক সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যে জ্বালানি উপদেষ্টা মার্কিন কোম্পানি শেভরনকে কাজটি পাইয়ে দেন। এ কাজ পাইয়ে দিতে জ্বালানি উপদেষ্টা শেভরনের কাছ থেকে ৫ মিলিয়ন ডলার উেকাচ গ্রহণ করে তার নেতৃত্বে ওই অর্থ ভাগ-বাটোয়ারা করেন।
প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের বিগত সরকারের আমলেও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সে সময় বিদ্যুত্ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করেছিলেন বর্তমান জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই এলাহী চৌধুরী। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়েরকৃত বহুল আলোচিত নাইকো দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘদিন কারা বরণ করেন তৌফিক-ই এলাহী। নাইকো মামলায়ও প্রধান অভিযোগ ছিল বিনা টেন্ডারে নাইকোকে গ্যাসক্ষেত্র বরাদ্দ দেয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিপুল ক্ষতি। বর্তমান সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত এই জ্বালানি উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুত্ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি সংবাদ সম্মেলনও করেছে এ সরকারের আমলেই।
অভিযোগপত্রের মূল বিষয় হচ্ছে তিনটি : ১. গ্যাসের চাপ বৃদ্ধির জন্য মুচাইতে বর্তমানে কম্প্রেসার স্টেশন বসানোর প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও এ কাজ করা হচ্ছে ২. বিনা টেন্ডারে ৩৭০ কোটি টাকার এ কাজ শেভরনকে দেয়া হয়েছে ৩. উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এ কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য শেভরনের কাছ থেকে ৫ মিলিয়ন ডলার ঘুষ গ্রহণ ও সেটা নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়া হয়েছে।
সাংবাদিক হিসেবে এ ধরনের রিপোর্ট প্রকাশ করে এম আবদুল্লাহ রাষ্ট্রীয় কাজে অনিয়মের বিষয়টিই তুলে ধরেছেন। সাংবাদিক হিসেবে তিনি এ কাজটি করতেই পারেন। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরা বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সভায় (১৭ ডিসেম্বর, ২০০৯) আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদককে হুমকি প্রদর্শন করেন। হুমকির ভাষা হচ্ছে, একটা কাগজ বানিয়ে যাচ্ছেতাই লিখে আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙবেন না। মানুষ প্রতিহত করলে আপনি রাস্তায় বের হতে পারবেন না। আমরা আপনাকে চলতে দেব না। জয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ না হলে মাহমুদুর রহমানকে বিচারের কাঠগড়ার দাঁড় করানো হবে বলেও আওয়ামী লীগ নেতারা হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। ১৯ ডিসেম্বর আক্রান্ত হলেন সাংবাদিক এম আবদুল্লাহ। হামলাকারীরা ভেঙে দিয়েছে তার গাড়ি। পিছু ধাওয়া করে ইট দিয়ে আঘাত করা হয়েছে তাকে। গণতন্ত্রের প্রশ্নে শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল এ ধরনের ভাষার ব্যবহারকে অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবেই গণ্য করবেন—এটাই স্বাভাবিক। হুমকি প্রদর্শন করেই ক্ষান্ত হলেন না তারা, শারীরিকভাবে আঘাত করার পথে এগিয়ে গেলেন। এ যেন মগের মুল্লুক। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসে যা খুশি তাই করবেন, যা খুশি তাই বলবেন, কিন্তু এর প্রতিবাদ করা যাবে না—এ মানসিকতা গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীলদের কাম্য নয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসে ক্ষমতার দাপট দেখানো গণতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় নয় বরং বলা চলে এ মানসিকতা ফ্যাসিবাদের পরিচয়। এই যদি হয় অবস্থা, তবে সংবিধানে একটা বাক্য সন্নিবেশ করে নিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। যারাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসুক না কেন তাদের কার্যকলাপ নিয়ে কোনো ধরনের সমালোচনা চলবে না—সমালোচনা করা হবে দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ধরনের একটা বাক্য সংবিধানে সন্নিবেশিত করে নিজেদের সব কার্যকলাপকে দায়মুক্ত করার ঘোষণা দিলেই তো আর কোনো সমস্যা থাকে না। এম আবদুল্লাহর মতো সাংবাদিকও তখন ভুল করেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীনদের সমালোচনা করে কোনো রিপোর্ট প্রদান করবেন না।
গণতন্ত্রের কথা বললে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের সব সময় এই মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে। সমালোচনার উত্তর যৌক্তিকভাবে হাজির করতে হবে। পত্রিকায় প্রকাশিত কোনো রিপোর্ট বা সমালোচনা তাদের মানহানি করলে, হুমকি প্রদান না করে আইনের আশ্রয় গ্রহণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। গণতন্ত্রের প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের কাছ থেকে এটাই দেশবাসী আশা করে।
গণতন্ত্রের প্রশ্নে দেশবাসীর এ কামনাকে শুরুতেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংবিধানে স্ববিরোধিতাপূর্ণ করে তোলা হয়েছে। আমাদের দেশের সংবিধানে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী কে এ বিষয়টা স্পষ্ট নয়। সংবিধানের প্রথম ভাগে ৭নং অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে! ৭।(১) প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতা প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।
এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ এ অর্থে বলা যায় জনগণই হচ্ছে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। স্বভাবতই জনগণের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষাকে এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন হয়ে যায় সংবিধানের কর্তব্য। অথবা বলা যায় জনগণের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষাকে লিখিত রূপ দিয়ে তা যথার্থ হয়েছে কিনা এ প্রশ্নে গণভোটের মাধ্যমে যাচাই করে তাকে রাষ্ট্রীয় সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করাটাই হচ্ছে যথাযথ পদক্ষেপ। আমাদের দেশে সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে এ কাজটি করা হয়নি এটাই হচ্ছে রূঢ় বাস্তবতা। গণভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সংবিধানের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে আমরা সক্ষম হলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধররা জনস্বার্থ বিরোধী বা জাতীয় স্বার্থবিরোধী কাজ করে পার পেয়ে যাওয়ার রাস্তা পেত না। এ কাজটা হয়নি বলেই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধররা আইনের ঊর্ধ্বে থাকার ব্যবস্থা করে নিতে পারছেন। মিথ্যা মামলার অজুহাতে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগকে কেন্দ্র করে আইনি প্রক্রিয়ায় যথাযথ মীমাংসার পথকে এড়িয়ে মামলা প্রত্যাহারের সুযোগ করে নিতে পারছেন। এটা গণতন্ত্রসম্মত নয়। সংবিধান প্রণয়নের যথাযথ পথ অনুসরণ না করে সংবিধান প্রণয়নের ফলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা সাংবিধানিক নীতি কাঠামো অমান্য করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন অর্থাত্ সংবিধানে যা লিখা আছে সেটা মান্য করা বা না করা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধরদের ইচ্ছার অধীন। এই অর্থে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধররা হয়ে যায় পরোক্ষভাবে সার্ভভৌম ক্ষমতার অধিকারী। সংবিধানের ক্ষেত্রে সার্বভৌম ক্ষমতার প্রশ্নে এই অস্বচ্ছ অবস্থান বহাল রেখে ’৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়া বা না যাওয়া নিয়ে এখন যে বিতর্ক চলছে তা নিতান্তই হাস্যকর। সত্যিকার অর্থেই এদেশে যারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান তাদের মূল প্রশ্নে অর্থাত্ জনগণের সার্থভৌমত্বের প্রশ্নে সংবিধানে যে অস্বচ্ছ এবং স্ববিরোধী অবস্থান গ্রহণ করা হয়েছে তার অবসান ঘটানোর প্রশ্নে সোচ্চার হতে হবে।
এক্ষেত্রে একটা উদাহরণ দেখানো দরকার। যেমন—সংবিধানের একাদশ ভাগে আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পর্কিত বিধানে বলা হয়েছে, বিদেশের সহিত সম্পাদিত সকল চুক্তি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হইবে এবং রাষ্ট্রপতি তাহা সংসদে পেশ করিবার ব্যবস্থা করিবেন :
তবে শর্ত থাকে যে, জাতীয় নিরাপত্তার সহিত সংশ্লিষ্ট অনুরূপ কোনো চুক্তি কেবল সংসদের গোপন বৈঠকে পেশ করা হইবে।
আমার জানা মতে, তেল-গ্যাস-কয়লা অনুসন্ধান ও উত্তোলন সম্পর্কিত যেসব চুক্তি বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে করা হয়েছে তার কোনোটিই সংসদে আলোচিত হয়নি অর্থাত্ এসব চুক্তির শর্তাদি গোপনেই রাখা হয়েছে। ঘটনাক্রমে কোনো কোনো চুক্তির শর্ত প্রকাশ্যে এসেছে, কিন্তু এসব চুক্তির শর্ত নিয়েও জাতীয় সংসদে কোনো আলোচনা হয়নি। গোপনে সংগঠিত এসব চুক্তির শর্তগুলো জাতীয় স্বার্থের পক্ষে না বিপক্ষে এটা জানার অধিকার থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি। এই যখন অবস্থা তখন এসব চুক্তিকে কেন্দ্র করে অনিয়ম হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। এসব চুক্তিকে কেন্দ্র করে আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয়নি, সেটা পরে আমরা জানতে পেরেছি। জাতীয় স্বার্থের বিপক্ষে এসব চুক্তি যারা করেছেন তারা যে গোপনে আর্থিকভাবে লাভবান হননি সেটা কে বলতে পারে? ঘুষ গ্রহণকালে কেউ রশিদ কেটে ঘুষ খায় না—এটা গোপনেই সংগঠিত হয়।
এক্ষেত্রে পেছনের একটু ইতিহাস আলোচনা করা দরকার। আমরা জানি ১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন তেল-গ্যাস সম্পদের ২৩টি ব্লকের মধ্যে ৭টি ব্লক অসম উত্পাদন বণ্টন চুক্তির মাধ্যমে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে লিজ দিয়েছিল। বাংলাদেশের তেল-গ্যাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদকে ২৩টি ব্লকে ভাগ করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছে উন্মুক্ত করে দেয়ার নীতি এরশাদের শাসনামলের সময় গ্রহণ করা হয়েছিল। ১৯৯১-৯৬ সালে যারা ক্ষমতায় ছিলেন, তারা ৫টি ব্লক এবং ১৯৯৬-২০০১ সালে যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারা ৭টি ব্লক অসম উত্পাদন বণ্টন চুক্তির মাধ্যমে অক্সিডেন্টাল, এনরন, ইউনিকল, শোল, কেয়ার্ন, তাল্লো, টেক্সাকো প্রভৃতি বহুজাতিক কোম্পানিকে তেল-গ্যাস ব্লকগুলো লিজ প্রদান করে। উত্পাদন বণ্টন চুক্তির (পিএসসি) সবচেয়ে খারাপ এবং ভয়ঙ্কর দিক হলো, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ক্ষেত্রে কী পরিমাণ খরচ করছে, সেটা মনিটরিং করার ক্ষমতা বাংলাদেশের জাতীয় সংস্থা পেট্রোবাংলার নেই। ফলে বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলো অনুসন্ধান খরচ, রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত খরচ এবং পরিচালনা খরচ ইচ্ছেমাফিক বাড়িয়ে দেখালে আমাদের কিছু করার থাকে না। যে ব্লকে ৯.২ কোটি ডলার খরচ হওয়ার কথা, সেই ব্লকে যদি তারা খরচ দেখায় ৩৬ কোটি ডলার তাহলেও সেটা আমাদের মানতে হবে। সাঙ্গু গ্যাস ক্ষেত্রে এমনটাই করেছিল শেল নামক কোম্পানিটি। অন্য একটি কোম্পানি কেয়ার্ন এনার্জি ১৬ নং ব্লকে ৭ বছরে ১ কোটি ২১ লাখ ডলার বিনিয়োগ করবে বলেছিল, কিন্তু পরে বলেছিল তারা বিনিয়োগ করেছে ২৩ কোটি ডলার। এক্ষেত্রে তাদের হিসাবটাই মানতে হয়েছে উত্পাদন বণ্টন চুক্তি অনুযায়ী। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের খরচ ইচ্ছেমাফিক বাড়িয়ে কী পরিমাণ মুনাফা করছে, তা বোঝার কোনো উপায় নেই। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে এভাবে মুনাফা অর্জনে যারা উত্পাদন বণ্টন চুক্তিতে ছাড় দিয়েছে, তারা কি বিনা স্বার্থে এসব করেছে? এক্ষেত্রে অবৈধ লেনদেন হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমাদের জাতীয় সংসদ কি এসব বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করেছে? যারা এসব পিএসসি সম্পাদনে ভূমিকা রেখেছে তারা কি কোনো জবাবদিহিতার সম্মুখীন হয়েছেন? কোনোটাই হয়নি। এই যখন অবস্থা তখন আমাদের সে প্রশ্নেই ফিরে যেতে হবে অর্থাত্ যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিসহ আমলাতন্ত্রের ওপর জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। নির্বাচিত প্রতিনিধিসহ আমলাতন্ত্রকে জনগণের কাছে জবাবদিহিতায় বাধ্য করার মতো সাংবিধানিক নীতি আরোপ করা ছাড়া অবৈধ লেনদেন তথা দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। তাই যারা দুর্নীতি বন্ধ করতে আগ্রহী তাদের সোচ্চার হতে হবে রাষ্ট্রীয় সংবিধানে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগ যেভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব তা বাস্তবায়নের জন্য সচেষ্ট হতে। এটা ছাড়া দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। এক সরকার যাবে, আরেক সরকার আসবে, কিন্তু দুর্নীতি চলবে। তাই বলছি, শুধু ব্যক্তির দুর্নীতি নিয়ে কথা বলা যথেষ্ট নয়, রাষ্ট্রীয় সংবিধানের ক্ষেত্রে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগকে নিশ্চিত করতে হবে। যে কাজটি আমরা এখনও করতে সক্ষম হইনি। অর্থাত্ সংবিধানের গোড়ায় গলদ থেকে গেছে। এই গলদ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিসহ আমলাতন্ত্রের ওপর জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই এবং সাংবিধানিকভাবে তা নিশ্চিত করতে হবে।
No comments