কুমিল্লা সিটি করপোরেশন-নির্বাচনকে সামনে রেখে ত্রিশঙ্কু অবস্থা by তোফায়েল আহমেদ
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা-দুর্ঘটনার পাশাপাশি কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন বর্তমান সময়ে জাতীয় গণমাধ্যমের অন্যতম প্রধান আলোচিত বিষয়। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে গণমাধ্যমে যে বিষয়গুলো সবিস্তারে প্রতিফলিত হয়েছে এবং ব্যাপক পাঠক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, তা হচ্ছে সম্ভাব্য মেয়র ও কিছু কিছু কাউন্সিলার প্রার্থীর বিতর্কিত পরিচিতি। কুমিল্লার নাগরিক সমাজে একটি ব্যাপক হতাশা লক্ষ করা যাচ্ছে।
এ যেন বিরাজিত কাঠামো এবং প্রতিক্রিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ। এ অবস্থাটা এতই পাকাপোক্ত, কায়েমি এবং উচ্চপর্যায়ের সমর্থনপুষ্ট অথবা উদাসীনতার ফসল, এখানে ভেতর থেকে কিছু করার শক্তি, সাহস ও সমর্থন কুমিল্লা শহরের নাগরিক সমাজের নেই। বিষয়টির কঠিন বাস্তবতা মেনে নিয়েও পুরোপুরি একমত হওয়া যায় না।
কুমিল্লা বাংলাদেশের মধ্যে শিক্ষা, সংস্কৃতি, আর্থিক সফলতা, রাজনৈতিক নেতৃত্ব সবদিক দিয়ে একটি অগ্রণী জেলা। সে রকম সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের অধিকারী এ অঞ্চলের প্রথমতম নগর কুমিল্লা। ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীর বৌদ্ধ সমাজ ও সভ্যতার সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক নিদর্শন ছাড়াও রয়েছে বহু আধুনিক প্রতিষ্ঠান। মরহুম আশরাফউদ্দিন চৌধুরী, শহীদ ধীরেন দত্ত কিংবা অধ্যাপক অজিত গুহ ছাড়াও বহু জ্ঞানীগুণী, ত্যাগী মানুষের চারণভূমি এ কুমিল্লা। ষাটের দশকে ড. আখতার হামিদ খান গ্রামীণ-দরিদ্রের মুক্তির লক্ষ্যে গড়ে তোলেন বিখ্যাত ‘কুমিল্লা পদ্ধতির পল্লী উন্নয়ন মডেল’। বিশেষ করে সমবায়ের নবজাগরণে কুমিল্লা শুধু পাকিস্তান বা বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে নন্দিত হয়। তাই কুমিল্লাকে ‘সমবায় এবং খদ্দরের রাজধানী’ বললে অত্যুক্তি হবে না। কুমিল্লার হাল আমলে শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠেছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়। তা ছাড়া ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ, কৃষি গবেষণা, পশুসম্পদ গবেষণা, মৃত্তিকা গবেষণা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বার্ড তো রয়েছেই।
নগর এবং দক্ষ নগর প্রশাসন যেকোনো অঞ্চলের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির গতিপথ নির্ধারণ করে এবং এগিয়ে নিয়ে যায়। তাই বর্ধিষ্ণু নগর হিসেবে স্থানীয় ও জাতীয় উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধিতে কার্যকর অবদান রাখার জন্য কুমিল্লাকে সিটি করপোরেশন ঘোষণা একটি সুসংবাদ হিসেবে বিবেচিত হয়। আইন অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচনটি আয়োজনে সরকার ও নির্বাচন কমিশন একমত হয়েছে তাও অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু জাতিগতভাবে আমরা যেভাবে নির্বাচন ও গণতন্ত্রকে একাকার করে একটি নৈরাজ্যকর শাসন কাঠামোকে পাকাপোক্ত করার দিকে এগোচ্ছি তার পরিণতি শুভ হতে পারে না। নির্বাচন নিয়ে আমরা যেভাবে আত্মহারা হয়ে যাই, নির্বাচন কর্ম সারার পর এ নির্বাচন আদৌ কোনো সুশাসন দিতে পারবে কি না সে সম্পর্কে একধরনের উদাসীনতা রয়েছে। কুমিল্লাকে সিটি করপোরেশন ঘোষণা যে আশা ও আনন্দের বার্তা বয়ে নিয়ে এসেছিল, নির্বাচনে এসে তা যেন ধীরে ধীরে উবে যাচ্ছে।
করপোরেশন গঠন প্রক্রিয়া ও কাঠামো ত্রুটিপূর্ণ
কুমিল্লার পুরোনো পৌরসভা ও নবগঠিত কুমিল্লা দক্ষিণ পৌরসভা দুটিকে একত্র করে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন ঘোষিত হয়। বর্তমানে প্রায় ৫৩ বর্গকিলোমিটারের যে এলাকাকে সিটি করপোরেশন নামে অভিহিত করা হচ্ছে তার বেশির ভাগ গ্রাম এলাকা। মূল শহরে জনসংখ্যা বেশি, আর নতুন পৌরসভা (দক্ষিণ) আয়তনে বড়। মূল শহর পূর্ব-পশ্চিমে আয়তনে বেড়েছে, কিন্তু নগরের কেন্দ্রস্থলের অনেক এলাকা করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত নয়। যেমন মহাসড়কের সঙ্গে কুমিল্লা শহরের প্রবেশপথসহ শাসনগাছা, যেটি আন্তজেলা বাস টার্মিনাল (ঢাকা-কুমিল্লা), তা করপোরেশনের বাইরে রয়ে গেছে। এমনকি জেলা প্রশাসকের বাসভবন-সংলগ্ন এলাকাও নতুন মহানগরের আওতার বাইরে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, ময়নামতি জাদুঘর, ক্যানটনমেন্ট কলেজ, বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেমের প্রধান কার্যালয়সহ মূল শহরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান মহানগরের মধ্যে অবস্থান করেও করপোরেশনের অধিভুক্ত নয়। আবার দক্ষিণের অনেক গ্রাম এখন সিটি করপোরেশন এলাকা।
ভারত বিভক্তির সময় পাকিস্তানের মানচিত্রকে বলা হতো ‘পোকায় ধরা মানচিত্র’।
যার ফলে এখনো লাখো ছিটমহলবাসী বহু রকমের ভোগান্তির শিকার। নবগঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সীমানা নির্ধারণে সাংঘাতিক রকমের অমনোযোগিতা, উদাসীনতা, অদক্ষতা ও অদূরদর্শিত রয়েছে, যা নির্বাচনের আগে গণশুনানি করে নিষ্পত্তি করা উচিত ছিল। কুমিল্লা মহানগরের আগামী ৫০ বছরের একটি দৃশ্যপট সামনে রেখে যে সীমানা হওয়া উচিত ছিল, তা হচ্ছে উত্তর ও পূর্বে গোমতী নদীর বাঁধ, পশ্চিমে ক্যানটনমেন্টে বোর্ডের সীমানা এবং বার্ড, ক্যাডেট কলেজ, ময়নামতি জাদুঘর, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, দক্ষিণ-পূর্বে বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেমের কার্যালয়সহ দক্ষিণ কুমিল্লা পৌরসভার পুরো অংশ। ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের স্নাতক অংশ সিটি করপোরেশনের বাইরে, এটিকে অন্তর্ভুক্ত করতে নির্বাচনী সুবিধাকে মাথায় রেখে কুমিল্লা সদর উপজেলাকে ভেঙে ‘কুমিল্লা দক্ষিণ’ নামক যে উপজেলা সৃষ্টি করা হয়েছে, তাতে তিনজন জাতীয় সাংসদের নির্বাচনী এলাকা অন্তর্ভুক্ত। নবগঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন ও উত্তরাধিকার সূত্রে আপাতত চারজন জাতীয় সংসদ সদস্যের নির্বাচনী এলাকা। ভবিষ্যতে আরও একটি নির্বাচনী এলাকার অংশবিশেষ অন্তর্ভুক্ত করা ছাড়া উপায় থাকবে না। তাই বর্তমান করপোরেশনের পোকা খাওয়া মানচিত্রে এলাকা বা সীমানা কুমিল্লা করপোরেশনের জন্মকালীন সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েই থাকল। এ দায় একা সরকার বা কর্তৃপক্ষের নয়, কুমিল্লার রাজনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজকেও এ দায় সমানভাবে বহন করতে হবে। তাঁরা নির্বাচন নিয়ে যত উল্লসিত বা হতাশাগ্রস্ত—ভৌগোলিক ও জনমিতির দৃষ্টিকোণ থেকে একটি বিকলাঙ্গ সিটি করপোরেশন গঠন রোধ করা নিয়ে কেউ কার্যকর উচ্চবাচ্য করেননি।
দেউলিয়া ও নেতৃত্বশূন্য কুমিল্লা
কুমিল্লায় তিন দশক ধরে সর্বক্ষেত্রে একটি নেতৃত্ব শূন্যতা জাঁকিয়ে বসেছে। দলের অভ্যন্তরে এবং সহযোগ্য দলগুলোর ভেতর কোন্দল দীর্ঘদিনে একটি বিশেষ রূপ ও কাঠামো পেয়ে গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দখলবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও পরস্পরের চরিত্র হনন। সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির লেশমাত্র নেই দলসমূহে। একই অবস্থা কুমিল্লার সাংবাদিকতায়ও সংক্রমিত। সাংবাদিকদের একাধিক সংগঠন। আগে তৃণমূলে সমবায় থেকে যেভাবে কিছু আলোকিত ও নিবেদিত নেতৃত্ব বের হয়ে আসত, তাও ক্ষয়িষ্ণু। এখন শুধু ইতিহাসের অংশ।
নাগরিক সমস্যার সাতকাহন
কুমিল্লা একসময় এলজিইডির মাঝারি শহর প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হয়। ড্রেনেজ ব্যবস্থার ওপর অনেক কাজ হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু কাজের নামে অকাজ হয়েছে বেশি। আগের কাঁচা এবং স্বাভাবিক খাল বা নালাগুলোকে পাকা করতে গিয়ে সরু করে ফেলা হয়, যাতে জলাবদ্ধতা হ্রাস পাওয়ার স্থলে বৃদ্ধি পায়। শহরে রিকশা ও ব্যাটারি চালিত গাড়ির জঙ্গল সৃষ্টি হয়েছে। গাড়ি তো দূরের কথা, হেঁটে চলা দুষ্কর। যত্রতত্র বাস ও ট্যাক্সি স্টেশন, কাঁচা বাজার, ফুটপাতে হকার—এসব তো আছেই। সবকিছুর ঊর্ধ্বে যে সমস্যায় মানুষ বেশি আতঙ্কগ্রস্ত তা হচ্ছে সন্ত্রাস ও দখলবাজি, যার সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বের যোগাযোগ খুবই ঘনিষ্ঠ। কুমিল্লা এখন ডেভেলপারদের উ ৎপাতেও অনেকটা বেসামাল। পরিকল্পনাহীনভাবে যত্রতত্র সুউচ্চ দালান ও মার্কেট—এ এক নতুন উ ৎপাত।
সামনে চলার উপায় কী?
নারায়ণগঞ্জের সাম্প্রতিক নির্বাচন দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি নতুন আশার প্রদীপ জ্বালিয়েছিল। কুমিল্লার নিবেদিত রাজনৈতিক নেতারা, নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা এখনো নারায়ণগঞ্জের পথে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে পারেন। কুমিল্লায় কি একজন আকরাম, একজন আইভী কিংবা সুজন, সনাকের মতো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নেই? নিশ্চয় আছে। প্রয়োজন পারস্পরিক খোলাখুলি যোগাযোগ এবং সাহসী পদক্ষেপ।
ভারতবর্ষে আজকাল আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের ফলে নাগরিক সমাজে নব-উত্থান ঘটেছে। মুম্বাই মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন নির্বাচনে ‘সিভিল পলিটিশিয়ান’ এবং ‘আমজনতা’র ব্যানারে বিভিন্ন পেশার মানুষ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মুম্বাই অ্যাপোলো হাসপাতালের চিকি ৎসক ডা. পরাগ জাভেরি, আন্না আন্দোলনের কর্মী শিবানী যোশী, সুরেন্দ্র শ্রীবাস্তব, কনক গান্ধীসহ ২৫-৩০ জন প্রার্থী এভাবে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ। সিকিমের গ্যাংটক সিটি করপোরেশনের মেয়র একজন পেশাদার সিভিল ইঞ্জিনিয়ার (যিনি প্রায় ২০ বছর উচ্চপদে বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করেছেন)। কর্ণাটকের টুংকু জেলার কাডাবা গ্রাম পঞ্চায়েতের একজন সদস্যের সঙ্গে কথা হলো। তিনি নিজে বেঙ্গালুরুর একটি বিখ্যাত প্রকৌশল ইনস্টিটিউট থেকে প্রকৌশলে স্নাতক। তাঁর বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী। আজকাল অনেক পেশাজীবী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে একটি বিকল্প নেতৃত্ব হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন। নারায়ণগঞ্জের মেয়র আইভীও তো পেশাদার চিকি ৎসক ছিলেন। কুমিল্লায়ও একই রকমের সম্ভাবনা নেই, তা নয়। মেয়র ও কাউন্সিলর উভয় ক্ষেত্রে রাজনীতির বাইরে থেকে সমাজকর্মীরা এগিয়ে আসতে পারেন। এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি।
নির্বাচনের সফলতা-ব্যর্থতা
নির্বাচনে সফলতা-ব্যর্থতার বিভিন্ন মাপকাঠি বিভিন্ন সংস্থা ব্যবহার করবে। নির্বাচন কমিশন, স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক দলসমূহ, প্রার্থীরা এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষকেরা একটি মূল্যায়ন জাতির সামনে হাজির করবেন। সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং বিজয়ী প্রার্থী সবাই নির্ধারিত মাপকাঠিতে সংগত কারণে সফলতা দাবি করবেন। কিন্তু কুমিল্লার সাধারণ মানুষ এবং কুমিল্লায় গণতন্ত্র ও মানুষের শুভবোধ জয়ী হলো কি না সেটি হবে বড় প্রশ্ন। আশা করব, সবা বাধা ডিঙিয়ে কুমিল্লায় গণতন্ত্র ও মানুষের শুভকামনা একটি ভাষা পাবে।
নির্বাচন-পরবর্তী অগ্রাধিকার
ভালো-মন্দ মিলিয়ে একটি নির্বাচন হয়ে যাবে। নির্বাচনের পরে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যাতে নাগরিক সমাজের সঙ্গে যথাযথ প্রক্রিয়ায় আলাপ-আলোচনা করে প্রথমেই নগরের সঠিক সীমানা পুনর্নির্ধারণে মনোযোগী হন, সে বিষয়ে আগাম অনুরোধ থাকল। দ্বিতীয় যে কাজটি প্রচলিত করপোরেশন আইন অনুযায়ী করতে হবে, তা হবে একটি সুচিন্তিত ও অংশগ্রগহণমূলক মাস্টার প্ল্যান। সেখানে ১০০ বছরের কুমিল্লার দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় রেখে বস্তুগত অকাঠামো; সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, ক্রমবর্ধমান শিল্প ও ব্যবসাসহ সব সম্ভাবনা ইত্যাদি স্থান পাবে। স্থান পাবে প্রাচীন সব পুরাকীর্তিকে কেন্দ্র করে পর্যটনসহ জাতীয় ঐতিহ্যের সংরক্ষণ এবং সমবায়ের ঐতিহ্যকে নতুন আঙ্গিকে ফিরিয়ে এনে কুমিল্লাকে সত্যিকার অর্থে সমবায়ের রাজধানী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করার একটি রূপরেখা, যেখানে থাকতে পারে গোমতীর প্রশস্ত দুই পারে মনোরম বাগান, পার্ক, পর্যটন নিবাস, নৌবিহার কেন্দ্র ইত্যাদি।
তোফায়েল আহমেদ: স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সদস্য স্থানীয় সরকার কমিশন।
কুমিল্লা বাংলাদেশের মধ্যে শিক্ষা, সংস্কৃতি, আর্থিক সফলতা, রাজনৈতিক নেতৃত্ব সবদিক দিয়ে একটি অগ্রণী জেলা। সে রকম সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের অধিকারী এ অঞ্চলের প্রথমতম নগর কুমিল্লা। ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীর বৌদ্ধ সমাজ ও সভ্যতার সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক নিদর্শন ছাড়াও রয়েছে বহু আধুনিক প্রতিষ্ঠান। মরহুম আশরাফউদ্দিন চৌধুরী, শহীদ ধীরেন দত্ত কিংবা অধ্যাপক অজিত গুহ ছাড়াও বহু জ্ঞানীগুণী, ত্যাগী মানুষের চারণভূমি এ কুমিল্লা। ষাটের দশকে ড. আখতার হামিদ খান গ্রামীণ-দরিদ্রের মুক্তির লক্ষ্যে গড়ে তোলেন বিখ্যাত ‘কুমিল্লা পদ্ধতির পল্লী উন্নয়ন মডেল’। বিশেষ করে সমবায়ের নবজাগরণে কুমিল্লা শুধু পাকিস্তান বা বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে নন্দিত হয়। তাই কুমিল্লাকে ‘সমবায় এবং খদ্দরের রাজধানী’ বললে অত্যুক্তি হবে না। কুমিল্লার হাল আমলে শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠেছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়। তা ছাড়া ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ, কৃষি গবেষণা, পশুসম্পদ গবেষণা, মৃত্তিকা গবেষণা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বার্ড তো রয়েছেই।
নগর এবং দক্ষ নগর প্রশাসন যেকোনো অঞ্চলের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির গতিপথ নির্ধারণ করে এবং এগিয়ে নিয়ে যায়। তাই বর্ধিষ্ণু নগর হিসেবে স্থানীয় ও জাতীয় উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধিতে কার্যকর অবদান রাখার জন্য কুমিল্লাকে সিটি করপোরেশন ঘোষণা একটি সুসংবাদ হিসেবে বিবেচিত হয়। আইন অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচনটি আয়োজনে সরকার ও নির্বাচন কমিশন একমত হয়েছে তাও অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু জাতিগতভাবে আমরা যেভাবে নির্বাচন ও গণতন্ত্রকে একাকার করে একটি নৈরাজ্যকর শাসন কাঠামোকে পাকাপোক্ত করার দিকে এগোচ্ছি তার পরিণতি শুভ হতে পারে না। নির্বাচন নিয়ে আমরা যেভাবে আত্মহারা হয়ে যাই, নির্বাচন কর্ম সারার পর এ নির্বাচন আদৌ কোনো সুশাসন দিতে পারবে কি না সে সম্পর্কে একধরনের উদাসীনতা রয়েছে। কুমিল্লাকে সিটি করপোরেশন ঘোষণা যে আশা ও আনন্দের বার্তা বয়ে নিয়ে এসেছিল, নির্বাচনে এসে তা যেন ধীরে ধীরে উবে যাচ্ছে।
করপোরেশন গঠন প্রক্রিয়া ও কাঠামো ত্রুটিপূর্ণ
কুমিল্লার পুরোনো পৌরসভা ও নবগঠিত কুমিল্লা দক্ষিণ পৌরসভা দুটিকে একত্র করে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন ঘোষিত হয়। বর্তমানে প্রায় ৫৩ বর্গকিলোমিটারের যে এলাকাকে সিটি করপোরেশন নামে অভিহিত করা হচ্ছে তার বেশির ভাগ গ্রাম এলাকা। মূল শহরে জনসংখ্যা বেশি, আর নতুন পৌরসভা (দক্ষিণ) আয়তনে বড়। মূল শহর পূর্ব-পশ্চিমে আয়তনে বেড়েছে, কিন্তু নগরের কেন্দ্রস্থলের অনেক এলাকা করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত নয়। যেমন মহাসড়কের সঙ্গে কুমিল্লা শহরের প্রবেশপথসহ শাসনগাছা, যেটি আন্তজেলা বাস টার্মিনাল (ঢাকা-কুমিল্লা), তা করপোরেশনের বাইরে রয়ে গেছে। এমনকি জেলা প্রশাসকের বাসভবন-সংলগ্ন এলাকাও নতুন মহানগরের আওতার বাইরে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, ময়নামতি জাদুঘর, ক্যানটনমেন্ট কলেজ, বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেমের প্রধান কার্যালয়সহ মূল শহরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান মহানগরের মধ্যে অবস্থান করেও করপোরেশনের অধিভুক্ত নয়। আবার দক্ষিণের অনেক গ্রাম এখন সিটি করপোরেশন এলাকা।
ভারত বিভক্তির সময় পাকিস্তানের মানচিত্রকে বলা হতো ‘পোকায় ধরা মানচিত্র’।
যার ফলে এখনো লাখো ছিটমহলবাসী বহু রকমের ভোগান্তির শিকার। নবগঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সীমানা নির্ধারণে সাংঘাতিক রকমের অমনোযোগিতা, উদাসীনতা, অদক্ষতা ও অদূরদর্শিত রয়েছে, যা নির্বাচনের আগে গণশুনানি করে নিষ্পত্তি করা উচিত ছিল। কুমিল্লা মহানগরের আগামী ৫০ বছরের একটি দৃশ্যপট সামনে রেখে যে সীমানা হওয়া উচিত ছিল, তা হচ্ছে উত্তর ও পূর্বে গোমতী নদীর বাঁধ, পশ্চিমে ক্যানটনমেন্টে বোর্ডের সীমানা এবং বার্ড, ক্যাডেট কলেজ, ময়নামতি জাদুঘর, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, দক্ষিণ-পূর্বে বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেমের কার্যালয়সহ দক্ষিণ কুমিল্লা পৌরসভার পুরো অংশ। ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের স্নাতক অংশ সিটি করপোরেশনের বাইরে, এটিকে অন্তর্ভুক্ত করতে নির্বাচনী সুবিধাকে মাথায় রেখে কুমিল্লা সদর উপজেলাকে ভেঙে ‘কুমিল্লা দক্ষিণ’ নামক যে উপজেলা সৃষ্টি করা হয়েছে, তাতে তিনজন জাতীয় সাংসদের নির্বাচনী এলাকা অন্তর্ভুক্ত। নবগঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন ও উত্তরাধিকার সূত্রে আপাতত চারজন জাতীয় সংসদ সদস্যের নির্বাচনী এলাকা। ভবিষ্যতে আরও একটি নির্বাচনী এলাকার অংশবিশেষ অন্তর্ভুক্ত করা ছাড়া উপায় থাকবে না। তাই বর্তমান করপোরেশনের পোকা খাওয়া মানচিত্রে এলাকা বা সীমানা কুমিল্লা করপোরেশনের জন্মকালীন সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েই থাকল। এ দায় একা সরকার বা কর্তৃপক্ষের নয়, কুমিল্লার রাজনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজকেও এ দায় সমানভাবে বহন করতে হবে। তাঁরা নির্বাচন নিয়ে যত উল্লসিত বা হতাশাগ্রস্ত—ভৌগোলিক ও জনমিতির দৃষ্টিকোণ থেকে একটি বিকলাঙ্গ সিটি করপোরেশন গঠন রোধ করা নিয়ে কেউ কার্যকর উচ্চবাচ্য করেননি।
দেউলিয়া ও নেতৃত্বশূন্য কুমিল্লা
কুমিল্লায় তিন দশক ধরে সর্বক্ষেত্রে একটি নেতৃত্ব শূন্যতা জাঁকিয়ে বসেছে। দলের অভ্যন্তরে এবং সহযোগ্য দলগুলোর ভেতর কোন্দল দীর্ঘদিনে একটি বিশেষ রূপ ও কাঠামো পেয়ে গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দখলবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও পরস্পরের চরিত্র হনন। সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির লেশমাত্র নেই দলসমূহে। একই অবস্থা কুমিল্লার সাংবাদিকতায়ও সংক্রমিত। সাংবাদিকদের একাধিক সংগঠন। আগে তৃণমূলে সমবায় থেকে যেভাবে কিছু আলোকিত ও নিবেদিত নেতৃত্ব বের হয়ে আসত, তাও ক্ষয়িষ্ণু। এখন শুধু ইতিহাসের অংশ।
নাগরিক সমস্যার সাতকাহন
কুমিল্লা একসময় এলজিইডির মাঝারি শহর প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হয়। ড্রেনেজ ব্যবস্থার ওপর অনেক কাজ হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু কাজের নামে অকাজ হয়েছে বেশি। আগের কাঁচা এবং স্বাভাবিক খাল বা নালাগুলোকে পাকা করতে গিয়ে সরু করে ফেলা হয়, যাতে জলাবদ্ধতা হ্রাস পাওয়ার স্থলে বৃদ্ধি পায়। শহরে রিকশা ও ব্যাটারি চালিত গাড়ির জঙ্গল সৃষ্টি হয়েছে। গাড়ি তো দূরের কথা, হেঁটে চলা দুষ্কর। যত্রতত্র বাস ও ট্যাক্সি স্টেশন, কাঁচা বাজার, ফুটপাতে হকার—এসব তো আছেই। সবকিছুর ঊর্ধ্বে যে সমস্যায় মানুষ বেশি আতঙ্কগ্রস্ত তা হচ্ছে সন্ত্রাস ও দখলবাজি, যার সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বের যোগাযোগ খুবই ঘনিষ্ঠ। কুমিল্লা এখন ডেভেলপারদের উ ৎপাতেও অনেকটা বেসামাল। পরিকল্পনাহীনভাবে যত্রতত্র সুউচ্চ দালান ও মার্কেট—এ এক নতুন উ ৎপাত।
সামনে চলার উপায় কী?
নারায়ণগঞ্জের সাম্প্রতিক নির্বাচন দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি নতুন আশার প্রদীপ জ্বালিয়েছিল। কুমিল্লার নিবেদিত রাজনৈতিক নেতারা, নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা এখনো নারায়ণগঞ্জের পথে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে পারেন। কুমিল্লায় কি একজন আকরাম, একজন আইভী কিংবা সুজন, সনাকের মতো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নেই? নিশ্চয় আছে। প্রয়োজন পারস্পরিক খোলাখুলি যোগাযোগ এবং সাহসী পদক্ষেপ।
ভারতবর্ষে আজকাল আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের ফলে নাগরিক সমাজে নব-উত্থান ঘটেছে। মুম্বাই মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন নির্বাচনে ‘সিভিল পলিটিশিয়ান’ এবং ‘আমজনতা’র ব্যানারে বিভিন্ন পেশার মানুষ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মুম্বাই অ্যাপোলো হাসপাতালের চিকি ৎসক ডা. পরাগ জাভেরি, আন্না আন্দোলনের কর্মী শিবানী যোশী, সুরেন্দ্র শ্রীবাস্তব, কনক গান্ধীসহ ২৫-৩০ জন প্রার্থী এভাবে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ। সিকিমের গ্যাংটক সিটি করপোরেশনের মেয়র একজন পেশাদার সিভিল ইঞ্জিনিয়ার (যিনি প্রায় ২০ বছর উচ্চপদে বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করেছেন)। কর্ণাটকের টুংকু জেলার কাডাবা গ্রাম পঞ্চায়েতের একজন সদস্যের সঙ্গে কথা হলো। তিনি নিজে বেঙ্গালুরুর একটি বিখ্যাত প্রকৌশল ইনস্টিটিউট থেকে প্রকৌশলে স্নাতক। তাঁর বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী। আজকাল অনেক পেশাজীবী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে একটি বিকল্প নেতৃত্ব হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন। নারায়ণগঞ্জের মেয়র আইভীও তো পেশাদার চিকি ৎসক ছিলেন। কুমিল্লায়ও একই রকমের সম্ভাবনা নেই, তা নয়। মেয়র ও কাউন্সিলর উভয় ক্ষেত্রে রাজনীতির বাইরে থেকে সমাজকর্মীরা এগিয়ে আসতে পারেন। এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি।
নির্বাচনের সফলতা-ব্যর্থতা
নির্বাচনে সফলতা-ব্যর্থতার বিভিন্ন মাপকাঠি বিভিন্ন সংস্থা ব্যবহার করবে। নির্বাচন কমিশন, স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক দলসমূহ, প্রার্থীরা এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষকেরা একটি মূল্যায়ন জাতির সামনে হাজির করবেন। সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং বিজয়ী প্রার্থী সবাই নির্ধারিত মাপকাঠিতে সংগত কারণে সফলতা দাবি করবেন। কিন্তু কুমিল্লার সাধারণ মানুষ এবং কুমিল্লায় গণতন্ত্র ও মানুষের শুভবোধ জয়ী হলো কি না সেটি হবে বড় প্রশ্ন। আশা করব, সবা বাধা ডিঙিয়ে কুমিল্লায় গণতন্ত্র ও মানুষের শুভকামনা একটি ভাষা পাবে।
নির্বাচন-পরবর্তী অগ্রাধিকার
ভালো-মন্দ মিলিয়ে একটি নির্বাচন হয়ে যাবে। নির্বাচনের পরে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যাতে নাগরিক সমাজের সঙ্গে যথাযথ প্রক্রিয়ায় আলাপ-আলোচনা করে প্রথমেই নগরের সঠিক সীমানা পুনর্নির্ধারণে মনোযোগী হন, সে বিষয়ে আগাম অনুরোধ থাকল। দ্বিতীয় যে কাজটি প্রচলিত করপোরেশন আইন অনুযায়ী করতে হবে, তা হবে একটি সুচিন্তিত ও অংশগ্রগহণমূলক মাস্টার প্ল্যান। সেখানে ১০০ বছরের কুমিল্লার দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় রেখে বস্তুগত অকাঠামো; সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, ক্রমবর্ধমান শিল্প ও ব্যবসাসহ সব সম্ভাবনা ইত্যাদি স্থান পাবে। স্থান পাবে প্রাচীন সব পুরাকীর্তিকে কেন্দ্র করে পর্যটনসহ জাতীয় ঐতিহ্যের সংরক্ষণ এবং সমবায়ের ঐতিহ্যকে নতুন আঙ্গিকে ফিরিয়ে এনে কুমিল্লাকে সত্যিকার অর্থে সমবায়ের রাজধানী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করার একটি রূপরেখা, যেখানে থাকতে পারে গোমতীর প্রশস্ত দুই পারে মনোরম বাগান, পার্ক, পর্যটন নিবাস, নৌবিহার কেন্দ্র ইত্যাদি।
তোফায়েল আহমেদ: স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সদস্য স্থানীয় সরকার কমিশন।
No comments