ছিটমহল : রাষ্ট্রহীন নাগরিকের দুর্ভোগচিত্র by এস এম আব্রাহাম লিংকন

আমাদের দেশ সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে পাকিস্তানের করতলগত হয়ে ছিল প্রায় সাড়ে ছয় দশক। সাড়ে ছয় দশক আগে পূর্ব বাংলার নাগরিকরা পূর্ব পাকিস্তান নামে অধীনতা লাভ করি। আমরা ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাকিস্তানের অন্তর্গত হলেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের অধিবাসীরা নিজেদের ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।


ভৌগোলিক অবস্থান এমন পর্যায়ে, যেন প্রাচীর ছাড়া জেলখানা। প্রাচীরবেষ্টিত জেলখানায় অনেক মানবিক সুবিধা আছে, ছিটমহলে সেটুকুও নেই। বিচার নেই, চিকিৎসা নেই, শিক্ষা নেই, যোগাযোগ নেই। সেখানে শুধুই নেই আর নেই। ১৯৪৭ সালে র‌্যাডক্লিফ যখন স্কেল দিয়ে ম্যাপকে পরিভাগ করে ভারত বিভক্ত করেন, তখনো কোচবিহারের মহারাজা শ্রীশ্রী নারায়ণ ভপবাহাদুর ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দেননি। তাঁর কোচবিহার ছিল ব্রিটিশের অধীন করদমিত্র রাজ্য। ১৯৪৭-এর ভারত ভাগে তিনি সরাসরি ব্রিটিশের অধীনে থাকতে ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। তিনি ভারতীয় ইউনিয়নে বা পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ না দেওয়ায় ভারত ও পাকিস্তানের উভয় অংশে কিছু মৌজায় নিজস্ব দখলাধীন (রাজার খাস খতিয়ানভুক্ত) জমি কোচবিহারের রাজ্যের অধীন থেকে যায়। এলাকাগুলো কোচবিহার রাজার হলেও ভূখণ্ড বিভক্তির ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধীন বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলের আওতাভুক্ত হয়। ফলে এই জমি বা ভূখণ্ডগুলো কোচবিহারের অন্তর্গত হলে জলবেষ্টিত নদীর চরের মতো ভূখণ্ডগুলো পূর্ব পাকিস্তানের দ্বারা সীমান্তবেষ্টিত হয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধান চন্দ্র রায় কূটনৈতিক বিজয়ের মাধ্যমে কোচবিহার রাজ্যকে ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করলে স্বাভাবিক কারণেই মহারাজার অধীন জমিজিরাত প্রজাকুল ভারতীয় ইউনিয়নে যুক্ত হয়। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরের ১১১টি ছিটমহল ভারতের অংশ হয়ে যায়। অনুরূপ অবস্থা বাংলাদেশের ৫৭টি ছিটমহলের। ময়মনসিংহের কাশিমবাজার স্টেটের মহারাজা শ্রীশ চন্দ্র নন্দী, কুড়িগ্রামের পাঙ্গারাজা, দিনাজপুরের রাজা এবং রংপুর ও নীলফামারীর রাজারা সাতচলি্লশে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হলে ভারতীয় ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে তাদের নিজস্ব খাস খতিয়ানভুক্ত বিভিন্ন মৌজার জমিজিরাত ও তাদের প্রজারা ভারতীয় সীমান্তবেষ্টিত হয়ে পড়ে। এই সীমান্তবেষ্টিত ছিটেফোঁটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকাই উভয় দেশের ছিটমহল।
ড. মনমোহন সিংয়ের আসন্ন সফর উপলক্ষে বিভিন্ন পত্রিকায় নিবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে। আমরা মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির বাস্তবায়নে যাচ্ছি। আবার কেউ কেউ বেরুবাড়ী ছিটমহলটি ফিরিয়ে নিতে চাপ দিচ্ছি। ছিটমহল সমস্যা মেটানোর চেষ্টা বঙ্গবন্ধু করেছিলেন, কিন্তু তাঁর মৃত্যুতে সেসব হিমঘরে চলে গেছে। অগণতান্ত্রিক বা সামরিক সরকারগুলো বা তাদের বংশধররা বিষয়টিকে জিইয়ে রেখেছেন ভারতবিরোধী রাজনীতির নামে ফায়দা লোটার জন্য। এ পর্যন্ত যত বিচারপতি এটি পরিদর্শন করেছেন, তাঁরা অন্তত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির অগ্রগতির একটি প্রতিবেদন চেয়ে রুল ইস্যু করতে পারতেন। সেসব কিছুই হয়নি।
আমাদের দেশের মালিকানাধীন ৫১টি ছিটমহলের অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলায়। ৫১টি ছিটমহলের জমির পরিমাণ হচ্ছে ৭১১০.২ একর। এই জমিগুলো একেকটি পৃথক মৌজায়, আবার সেই মৌজার ভেতর এক বা একাধিক এলাকায় ছোট ছোট ছিট আছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের মালিকানাধীন ছিটমহলের সংখ্যা ১১১টি তাদের জমির পরিমাণ ১৭১৫৮.১৩ একর। উভয় দেশে ছিটমহলের মোট জমির পরিমাণ ২৪২৬৮.১৫ একর। সর্বশেষ জনগণনা (জুলাই ২০১১) অনুযায়ী, ১৫৮টি ছিটমহলে লোকসংখ্যা ৫১ হাজার।
চেহলামের বাড়িতে হাজিরা দিয়েই প্রথমে গেলাম পঞ্চায়েত প্রধান নজরুল ইসলামের বাড়িতে, যদিও স্থানীয়রা তাঁকে বাংলাদেশের আদলে চেয়ারম্যান বলতে অভ্যস্ত। তিনি জানান, দাসিয়ারছড়ায় ২০০৯ সালের পর পঞ্চায়েতের মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে তিনি আর পঞ্চায়েত প্রধান নন। তাঁর কাছ থেকে ছিটমহলবাসীর দুঃখকষ্টের কথাগুলো লিপিবদ্ধ করলাম। সেখান থেকে আমার প্রতিবেশী ও রাজনৈতিক অগ্রজ মীর্জা রোকনুজ্জামান রাজু, জসিমউদ্দিন সরকারসহ কালীরহাট বাজারে গেলাম ছিটমহল সংগ্রাম কমিটির অফিসে। সেখানে দেখি পাঁচ-দশটি দোকান। কোনো দোকানেই ভারতীয় পণ্য নেই। সবাই ভারতীয়, কিন্তু জীবন যাপন করছেন বাংলাদেশের পণ্যে। বাজারে একটি মঞ্চ দেখলাম। জিজ্ঞেস করতেই স্থানীয়রা জানালেন, সেখানে রাতে যাত্রার নামে জুয়া, মদ এবং নারীর অশ্লীল নৃত্যসহ নানা অপরাধকর্ম চলে। এসব দেখার কেউ নেই। যেকোনো অপরাধী অপরাধ করে ছিটমহলে অবস্থান নেয়। বড় বড় ছিটমহল ট্রাফিকিং বা পাচারের ট্রানজিট রুট হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। এ কর্মগুলো দু-চারজন দুর্বৃত্তের কারণে হয়, কিন্তু সাধারণ নাগরিকরা এসব অপরাধকর্মের সঙ্গে যুক্ত নয়। প্রতিবাদ হয় কি না জানতে চাইলে তাঁরা জানান, সেখানে অপরাধীরাই রাজা। প্রতিবাদ করলে মৃত্যু, এখানে হত্যা হলে বিচার নেই, এখানে পুলিশ নেই, আইন নেই, আদালত নেই, হয়তো পঞ্চায়েত প্রধান একজন খুনিকে খুনের সাজা হিসেবে ১০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করলে সেটিই বিচার, কতক ক্ষেত্রে অপরাধীরা বিচারকের চেয়ে শক্তিশালী হলে সেটিও সম্ভব হয় না। এসব অপরাধী আবার বাংলাদেশ-ভারত উভয় জায়গায়ই সমাদৃত। কিন্তু যাঁরা সাধারণ নাগরিক, তাঁদের অবস্থা কী? তাঁদের জীবনে কোনো স্বাধীনতা নেই। তাঁদের সন্তানরা কোনো রাষ্ট্রেরই আর্থিক ও সামাজিক আনুকূল্যের আওতায় নেই। এখানে কোনো এনজিও নেই, সরকার নেই, হাসপাতাল নেই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই, কোনো হাসপাতাল নেই, ডাক্তার নেই, বৈদ্য নেই, এমনকি একটি ফার্মেসি পর্যন্ত নেই। পাঠক বুঝতে পারছেন কি না জানি না, ছিটমহলবাসী যে অবস্থায় আছে তা ভারতীয় সমাজে ব্রিটিশ শাসনের প্রাথমিক যুগে আন্দামান-নিকোবর দীপপুঞ্জে সমুদ্রবন্দি ভারতীয়রা যে রকম কষ্টে জীবন যাপন করত, ছিটমহলবাসীর অবস্থা তাদের চেয়ে খারাপ। জাতীয় পরিপচয়পত্র নেই। রেশন নেই, রেশন কার্ড নেই। ১৫৮টি ছিটমহলের কোথাও কলেজ নেই, হাসপাতাল নেই, হাই স্কুল নেই, বিদ্যুৎ নেই। প্রাক-সভ্যতার ন্যায় পিদিম জ্বালিয়ে চলে ছিটমহলবাসীর জীবন। আমি তথ্য সংগ্রহের জন্য ভারতীয় ছিটমহল দাসিয়ারছড়া ছাড়াও ছোট গারলজোড়া ১ ও ২ দীঘলটারী ১ ও ২, গাওচুলকা ১ ও ২ এবং বড় গাওচুলকা, শিউটি কুরশা, সাহেবগঞ্জ কালামাটিয়া এবং ডাকুরহাট ডাকিনীর কুঠি যাই। এই ১১টি ছিটমহলের মোট লোকসংখ্যা মাত্র এক হাজার ২৪৫ জন, তন্মধ্যে দীঘলটারী ১, গাওচুলকা ১ এবং বড় গাওচুলকা ছিটমহলে মাত্র ২০ জন করে লোকের বসবাস। এই ১১টি ছিটমহলের মধ্যে বেশি জমি শিউটি কুরশা ৪৫.৬৩ শতক এবং সর্বনিম্ন জমি গাওচুলকায় মাত্র ০.৯০ শতক। এ ছাড়াও নটাকটোকা ০.২৬ শতক, উপনচৌকি কুচলিবাড়ী ০.৩২ শতক, পানিশালা ০.২৭ শতক। এই জমির পরিমাণ উল্লেখ করার কারণ, ক্ষুদ্র ছিটমহলের আয়তনকে অনুধাবন করার জন্য। এই ছিটমহলগুলোর বাংলাদেশি অংশের অধিবাসীরা মুসলিম এবং ভারতীয় অংশের অধিবাসীরা ৯৫ শতাংশই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। যাঁরা যে দেশের সীমানা দিয়ে বন্দি, তাঁরা সেই দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে অভ্যস্ত। ছিটমহলবাসী ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির প্রতিষ্ঠাতা স্বর্গীয় দীপক সেনগুপ্তের নেতৃত্বে দীর্ঘকাল লড়াই-সংগ্রাম করেন, তিনি প্রয়াত হওয়ার পর তাঁর পুত্র দীপ্তিমান সেনগুপ্তের নেতৃত্বে এই আন্দোলন চলছে। এই বছরে উভয় দেশের ছিটমহলের অধিবাসীরা রংপুরে ১৫ ফেব্রুয়ারি একত্র হয়েছিলেন। সেখানে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ, ভারতীয় পক্ষ থেকে দীপ্তিমান সেনগুপ্ত এবং ভারতীয় আইনজীবী আহসান হাবিব উপস্থিত থেকে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির বাস্তবায়ন দাবি করেন।
ছিটমহলের নাগরিকরা জীবন্ত নরক থেকে মুক্তির জন্য বিদ্রোহ করেছে। দাসিয়ারছড়ার পঞ্চায়েত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি বাংলাদেশ ইউনিট ফুলবাড়ী, কুড়িগ্রামের সভাপতি আলতাফ হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা জানান, ২০০৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ছিটমহলবাসী বাংলাদেশের জাতীয় দিবস পালন করে আসছেন। তাঁরা ২৬ মার্চকে এখন নিজেদের স্বাধীনতা দিবস মনে করছেন। একই অবস্থা ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত বাংলাদেশের মালিকানাধীন ছিটমহলবাসীর। তাঁরা ভারতের প্রতি অনুগত জীবনযাপন করছেন। ছিটমহলগুলোর নাগরিকরা মানসিক ও শারীরিকভাবে বাংলাদেশ ও ভারতীয় অংশের সঙ্গে একীভূত। আইনগত বাধার কারণে কাগুজে সম্পর্কটুকু ছিন্ন করতে না পারায় তাঁদের বন্দিত্বের অবসান হচ্ছে না। ছিটমহলবাসী চাইলেও তাঁদের প্রতি সহযোগিতার হাত এগিয়ে দেয়নি রাষ্ট্রীয় প্রশাসন। কোনো রাষ্ট্রই ছিটমহলগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেনি। এর পেছনে কারণ যেহেতু ছেড়েই দিতে হবে, তাহলে বিনিয়োগ করে লাভ কী। এ নিম্নমানের মানসিকতার কারণেই ছিটমহলগুলো প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। ১৯৮২ সালে ইন্দিরা-এরশাদ চুক্তির পর ১৫ অক্টোবর রংপুরের জেলা প্রশাসক এম রহমতউল্লাহ এবং কোচবিহারের জেলা শাসক ই কে জইনের মধ্যে ছিটমহলবাসীর সুবিধার কথা বিবেচনা করে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন, সেখানে বলা ছিল_বাংলাদেশের মালিকানাধীন ছিটমহলবাসী ভারতের হাটবাজার, স্কুল-কলেজে যাতায়াত করতে পারবেন এবং পড়াশোনা করতে পারবেন। ভারতের ডাক্তার, নার্স, রেডক্রস টিম ছিটমহলে যাতায়াত করতে পারবে। ছিটমহলবাসী বাংলাদেশে যেতে পারলেও কোনো বাংলাদেশি ছিটমহলে যেতে পারবে না। সেখানে আরো বলা ছিল, কোনো ভারতীয় ছিটমহলে অপরাধ করলে তারা ভারতীয় আদালতের এখতিয়ারে থাকবে। এসব কাগজে থেকেছে, বাস্তবে প্রয়োগ নেই। ছিটমহলের মানুষ নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে ভিন্ন দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেন। যাঁরা চিকিৎসা নেন, তাঁরা নিজেদের ভারতীয় বা বাংলাদেশের ছিটমহলের অধিবাসী সেটি লুকিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। ছিটমহল বিনিময়ে লাভ-লোকসান বিবেচনা করলে ভোগান্তির অবসান হবে না। বিনিময়ে হয়তো ভারতের ১০১৭৪.৭২ একর জমি লোকসান হবে, কিন্তু সেখানে বিজয় হবে মানবতার। ডক্টর মনমোহন সিং মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির বাস্তবায়ন করে মানবতার সেই স্মারক গড়বেন কি?

লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা,
আইনজীবী ও কলামিস্ট
lincoln_bd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.