সময়ের প্রতিধ্বনি-এখন প্রয়োজন মন্ত্রিসভার পুনর্গঠন by মোস্তফা কামাল
বতর্মান মন্ত্রিসভায় কয়জন মন্ত্রী আছেন, যাঁদের কোনো দুর্নাম নেই? মন্ত্রণালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে যাঁরা সফল, তাঁদের সংখ্যাও কিন্তু হাতে গোনা। অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এখন পর্যন্ত সফল এবং তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো দুর্নাম নেই। তবে অর্থমন্ত্রীর কিছু বেফাঁস কথায় মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য বয়সের কারণে তাঁকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে চান।
অন্য মন্ত্রীদের ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে কেউ কি বলতে পারবেন, অমুক মন্ত্রী সব দিক থেকে সফল? হয়তো অনেকের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির কোনো অভিযোগ নেই। সে বিবেচনায় মন্ত্রিসভা ঠিক থাকতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগের আগের আমলের মন্ত্রিসভার তুলনায় এবারের মন্ত্রিসভা অনেক বেশি দুর্বল বলেই মনে হয়। যোগ্যতা-দক্ষতা অথবা রাজনৈতিক পরিপক্বতার অভাব স্পষ্টই বোঝা যায়। সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো সাধারণত শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। আওয়ামী লীগের আগের আমলে তেমনই দেখেছি। যেমন_পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সামাদ আজাদ। এবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন বয়স এবং রাজনীতিতেও নবীন ডা. দীপু মনি। তাঁর রাজনৈতিক পরিপক্বতার অভাব রয়েছে। সে কারণেই তিনি কূটনৈতিক কৌশলগুলো যথাযথভাবে রপ্ত করতে পারেননি। তা ছাড়া বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন প্রথমে তোফায়েল আহমেদ এবং পরে আবদুল জলিল। এবার ফারুক খান। তাঁর বেফাঁস কথায় সরকার শুধু বিব্রতই হয়নি, রীতিমতো বিপদে আছে।
গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় মন্ত্রীদের জবাবদিহিতা এবং জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা থাকে। তা ছাড়া বিরোধী দলের সঙ্গে মন্ত্রিসভার সদস্যদের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত ভালো সম্পর্ক থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমান মন্ত্রিসভার সদস্যদের সে ধরনের কোনো সম্পর্ক নেই বলেই মনে হয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সরকার ও বিরোধী দলের সম্পর্ক শত্রুভাবাপন্ন। এটা কারো কাম্য নয়। মন্ত্রিসভার সদস্যদের ভালো কাজের জন্য দলের জনপ্রিয়তা বাড়ে। আবার মন্ত্রীদের কারণেই জনপ্রিয়তা কমে। বর্তমানে সরকারের জনপ্রিয়তা নিশ্চয়ই আগের অবস্থানে নেই। কেন নেই সেই বিচার-বিশ্লেষণ কি সরকার করছে?
কেন জানি মনে হয়, মন্ত্রিসভার কোথায় যেন ছন্দঃপতন ঘটছে। জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের ব্যাপারে বর্তমান মন্ত্রিসভার সব সদস্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নন। কখনো কখনো মনে হয়, সরকার অতিমাত্রায় আমলানির্ভর হয়ে পড়েছে। আমলানির্ভরতার মূল কারণ মন্ত্রিসভার সদস্যদের অদক্ষতা এবং কাজে শৈথিল্যপূর্ণ মনোভাব। আমার জানা মতে, কোনো কোনো মন্ত্রীর মন্ত্রণালয়ে যেতেই অনীহা রয়েছে। কেউ কেউ সপ্তাহে এক-দুই দিন সচিবালয়ে অফিস করেন। আবার কেউ একান্ত সচিবদের সাহায্য নিয়ে কিছু কাজ করার চেষ্টা করেন।
গণতান্ত্রিক দেশের মন্ত্রিসভাকে জনগণের পাল্স বুঝতে হয়। জনগণের মূল সমস্যা কী, তাদের আকাঙ্ক্ষা কী, কিভাবে সেসব সমস্যার সমাধান করা যায়, কোন কাজে জনগণ বেশি খুশি থাকবে, কোন কাজে জনগণের দুর্ভোগ বাড়বে_সেগুলো যদি মন্ত্রীরা আঁচ করতেই না পারেন তাহলে আর জনপ্রতিনিধি হয়ে লাভ কী? সম্ভবত এ কারণে মন্ত্রীদের কথা ও কাজে কোনো মিল নেই। মন্ত্রীদের মধ্যে সমন্বয়ের বড় অভাব। মন্ত্রীদের লাগামছাড়া কথাবার্তায় অনেক সময়ই সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে। অনেক সময় বিপাকেও পড়তে হয়। জনগণ মন্ত্রীদের কথায় ভরসা পাচ্ছে না, বরং বিরক্ত হচ্ছে।
তাইতো সবাই বলছেন, আরো আগেই মন্ত্রিসভার পুনর্গঠন দরকার ছিল। সবাই উপলব্ধিও করছেন যে বর্তমান মন্ত্রিসভা দিয়ে হচ্ছে না। বর্তমান বাস্তবতায় দক্ষ রাজনীতিকদের মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া দরকার। কিন্তু যিনি কাজটি করবেন, তিনি মনে করছেন, মন্ত্রিসভা ভালো করছে। কাজেই এ নিয়ে হাজার লেখালেখি হলেও কোনো কাজ হবে না। মানুষের দৃষ্টি ফেরানোর জন্য হলেও এই মন্ত্রিসভার একটা পরিবর্তন দরকার। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রধানমন্ত্রীর উচিত বিজ্ঞ রাজনীতিকদের পরামর্শ নেওয়া। আমলাদের পরামর্শে দেশ চালালে দেশ ঠিকমতো চলবে না।
মনে রাখতে হবে, বর্তমান মহাজোট সরকারের হাতে খুব একটা সময় নেই। অর্ধেকের বেশি সময় চলে গেছে। বিগত আড়াই বছরে সরকার দেশ পরিচালনায় কতটা সফল হয়েছে, তার হিসাব কষছে সাধারণ মানুষ। মানুষ যে অস্বস্তিতে আছে, তা সরকার টের না পেলেও আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই পাচ্ছে। দেশের বেশির ভাগ মানুষের আয় সীমিত এবং তার মধ্যে অনেকেই কম মজুরি পায়। কিন্তু ব্যয় বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। প্রতিবছর যে হারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, সে হারে যদি বেতন বাড়ত তাহলে কোনো কথা ছিল না। আয়ের তুলনায় ব্যয় কয়েক গুণ বেশি। আর বেশি বলেই মানুষের ত্রাহি অবস্থা। জীবন-জীবিকার কষ্ট সবচেয়ে বড়। মা কিংবা বাবার সামনে তাঁদের সন্তান যখন আহারের জন্য চোখের পানি ফেলে তখন তাঁরা কী করে তা সহ্য করেন!
তৃণমূল থেকে উঠে আসা নেতারা নিশ্চয়ই মানুষের মর্মবেদনা আঁচ করতে পারেন। অবশ্য খাই খাই নেতা-কর্মীদের সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট টের পাওয়ার কথা নয়। তারা ওসব নিয়ে ভাবেও না। তারা নিজেদের আখের গুছিয়ে চলেছে। গ্রাম থেকে শহর_সর্বত্র পেটুক নেতা-কর্মীদের বাড়বাড়ন্ত আওয়ামী লীগকেই লজ্জায় ফেলে দিচ্ছে। এসব না হয় আওয়ামী লীগ সম্ভব হলে সামাল দেবে, কিন্তু সরকারের ব্যর্থতার দায় কে নেবে? নিশ্চয়ই সরকারের ব্যর্থতার দায়ও আওয়ামী লীগের ওপরই বর্তাবে। আবার ভালো করলেও তার সুফল পাবে আওয়ামী লীগ।
নির্বাচনের আগে দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন কতটা হয়েছে? না হয়ে থাকলে কেন হয়নি তার বিচার-বিশ্লেষণ নিশ্চয়ই সরকারকে করতে হবে। বাজার পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার প্রাথমিক দায়িত্ব বাণিজ্যমন্ত্রীর। অথচ বাজার তদারকির ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। শুরু থেকেই তিনি বেফাঁস কথা বলে সরকারকে বিব্রত করছেন। বেফাঁস বলার ক্ষেত্রে এখনো তাঁর জুড়ি নেই। তিনি ব্যবসায়ীদের ধমক দিয়ে বশ করতে চান। আর তাতে ফল হয় উল্টো। ব্যবসায়ীরা তাঁকে সহযোগিতার পরিবর্তে অসহযোগিতাই বেশি করছেন।
কয়েক দিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছিল, দেশের পণ্যবাজার নিয়ন্ত্রণ করে পাঁচটি ব্যবসায়ী গ্রুপ। এগুলো হচ্ছে সিটি, মেঘনা, টিকে, এস আলম ও নূরজাহান গ্রুপ। যদি তা-ই হয়, তাহলে কেন এই পাঁচটি গ্রুপকে সরকার আস্থায় নিতে পারছে না। বাণিজ্যমন্ত্রী যদি এই দায়িত্ব পালনেও ব্যর্থ হন তাহলে তাঁর ক্ষমতায় থাকার কী দরকার? তিনি তো দায়দায়িত্ব স্বীকার করে পদত্যাগ করতে পারেন! অবস্থাটা এমন, যেন প্রধানমন্ত্রী না বললে তিনি কিছুই করবেন না। প্রধানমন্ত্রীকেই বলে দিতে হবে, 'আপনি পারছেন না, দয়া করে পদত্যাগ করুন!'
যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসাইনের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। তিনি দেশের সামগ্রিক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছেন না। অনেক প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও সেগুলো কবে নাগাদ শেষ হবে, তা কেউ বলতে পারছেন না। আবার অনেক প্রকল্পের নামে লুটপাটের অভিযোগ উঠছে। তিনি মন্ত্রীর দায়িত্বে থেকে নিজের কম্পানিকে কাজ পাইয়ে দিতে নানা কারসাজি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে লেখালেখি হলেও তদন্ত পর্যন্ত হয়নি। অনেকে বলেন, তাঁর খুঁটি নাকি অনেক শক্ত।
আরেকজন মন্ত্রী আছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। তিনি নিজের দায়িত্ব সম্পর্কেও সচেতন নন। অথচ একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় তিনি দেখভাল করছেন। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা আবদুর রাজ্জাক। বর্তমানে যিনি আছেন তিনি রমেশ চন্দ্র সেন, থানা পর্যায়ের একজন নেতা। ভারতের সঙ্গে পানি ভাগাভাগির আলোচনায় তিনি বড়ই বেমানান।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন রেজাউল করিম হীরা। তাঁর অবস্থাও পানিসম্পদমন্ত্রীর মতোই। শুরুতে তিনি তাঁর ছেলের সহযোগিতায় কিছু কাজ করার চেষ্টা করেছিলেন। এখন তাও করছেন না। এখন তিনি পুরোপুরি আমলানির্ভর হয়ে পড়েছেন। নিজে উদ্যোগী হয়ে যে কিছু একটা করবেন, তা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। ভূমি ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক কিছু করার আছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশের ৮০ শতাংশ মামলা হয় ভূমি বিরোধ নিয়ে। তহশিল অফিসে গিয়ে মানুষ নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়, প্রতারিত হয়। এসব নিয়ে মন্ত্রী কাজ করতে পারতেন। অথচ তিনি নির্বিকার।
বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের বিষয়েও আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সুস্পষ্ট ঘোষণা ছিল। বলা হয়েছিল, সরকারে যেতে পারলে বিদ্যুৎ সমস্যার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। সেই পরিকল্পনা কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে, কত দিনে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হবে_এ বিষয়ে এখনই জনগণকে জানাতে হবে। বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে বিনিয়োগ ব্যাহত হচ্ছে। সামগ্রিক উন্নয়নপ্রক্রিয়া দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখন আর পূর্ববর্তী সরকার কিছুই করেনি বলে পার পাওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু দায়িত্ব পালনে কতটা আন্তরিক, তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালোমন্দ মিলিয়ে একটা জায়গায় রয়েছে। কিন্তু পুলিশ বিভাগের কিছু ঘটনায় সরকারকেও বিব্রত হতে হয়েছে। মেধাবী ছাত্র কাদেরকে নিয়ে গল্প বানানো কিংবা নোয়াখালীতে সাজানো গণপিটুনির ঘটনাটি পুরো পুলিশ বিভাগকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার বন্ধ না হলে এ ধরনের সাজানো নাটক আমরা আরো দেখতে থাকব। এ সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাহেরের মতো ইস্যুকে জিইয়ে রেখে কিংবা একজন ফাঁসির আসামিকে রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা যাবে না।
গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় মন্ত্রীদের জবাবদিহিতা এবং জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা থাকে। তা ছাড়া বিরোধী দলের সঙ্গে মন্ত্রিসভার সদস্যদের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত ভালো সম্পর্ক থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমান মন্ত্রিসভার সদস্যদের সে ধরনের কোনো সম্পর্ক নেই বলেই মনে হয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সরকার ও বিরোধী দলের সম্পর্ক শত্রুভাবাপন্ন। এটা কারো কাম্য নয়। মন্ত্রিসভার সদস্যদের ভালো কাজের জন্য দলের জনপ্রিয়তা বাড়ে। আবার মন্ত্রীদের কারণেই জনপ্রিয়তা কমে। বর্তমানে সরকারের জনপ্রিয়তা নিশ্চয়ই আগের অবস্থানে নেই। কেন নেই সেই বিচার-বিশ্লেষণ কি সরকার করছে?
কেন জানি মনে হয়, মন্ত্রিসভার কোথায় যেন ছন্দঃপতন ঘটছে। জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের ব্যাপারে বর্তমান মন্ত্রিসভার সব সদস্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নন। কখনো কখনো মনে হয়, সরকার অতিমাত্রায় আমলানির্ভর হয়ে পড়েছে। আমলানির্ভরতার মূল কারণ মন্ত্রিসভার সদস্যদের অদক্ষতা এবং কাজে শৈথিল্যপূর্ণ মনোভাব। আমার জানা মতে, কোনো কোনো মন্ত্রীর মন্ত্রণালয়ে যেতেই অনীহা রয়েছে। কেউ কেউ সপ্তাহে এক-দুই দিন সচিবালয়ে অফিস করেন। আবার কেউ একান্ত সচিবদের সাহায্য নিয়ে কিছু কাজ করার চেষ্টা করেন।
গণতান্ত্রিক দেশের মন্ত্রিসভাকে জনগণের পাল্স বুঝতে হয়। জনগণের মূল সমস্যা কী, তাদের আকাঙ্ক্ষা কী, কিভাবে সেসব সমস্যার সমাধান করা যায়, কোন কাজে জনগণ বেশি খুশি থাকবে, কোন কাজে জনগণের দুর্ভোগ বাড়বে_সেগুলো যদি মন্ত্রীরা আঁচ করতেই না পারেন তাহলে আর জনপ্রতিনিধি হয়ে লাভ কী? সম্ভবত এ কারণে মন্ত্রীদের কথা ও কাজে কোনো মিল নেই। মন্ত্রীদের মধ্যে সমন্বয়ের বড় অভাব। মন্ত্রীদের লাগামছাড়া কথাবার্তায় অনেক সময়ই সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে। অনেক সময় বিপাকেও পড়তে হয়। জনগণ মন্ত্রীদের কথায় ভরসা পাচ্ছে না, বরং বিরক্ত হচ্ছে।
তাইতো সবাই বলছেন, আরো আগেই মন্ত্রিসভার পুনর্গঠন দরকার ছিল। সবাই উপলব্ধিও করছেন যে বর্তমান মন্ত্রিসভা দিয়ে হচ্ছে না। বর্তমান বাস্তবতায় দক্ষ রাজনীতিকদের মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া দরকার। কিন্তু যিনি কাজটি করবেন, তিনি মনে করছেন, মন্ত্রিসভা ভালো করছে। কাজেই এ নিয়ে হাজার লেখালেখি হলেও কোনো কাজ হবে না। মানুষের দৃষ্টি ফেরানোর জন্য হলেও এই মন্ত্রিসভার একটা পরিবর্তন দরকার। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রধানমন্ত্রীর উচিত বিজ্ঞ রাজনীতিকদের পরামর্শ নেওয়া। আমলাদের পরামর্শে দেশ চালালে দেশ ঠিকমতো চলবে না।
মনে রাখতে হবে, বর্তমান মহাজোট সরকারের হাতে খুব একটা সময় নেই। অর্ধেকের বেশি সময় চলে গেছে। বিগত আড়াই বছরে সরকার দেশ পরিচালনায় কতটা সফল হয়েছে, তার হিসাব কষছে সাধারণ মানুষ। মানুষ যে অস্বস্তিতে আছে, তা সরকার টের না পেলেও আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই পাচ্ছে। দেশের বেশির ভাগ মানুষের আয় সীমিত এবং তার মধ্যে অনেকেই কম মজুরি পায়। কিন্তু ব্যয় বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। প্রতিবছর যে হারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, সে হারে যদি বেতন বাড়ত তাহলে কোনো কথা ছিল না। আয়ের তুলনায় ব্যয় কয়েক গুণ বেশি। আর বেশি বলেই মানুষের ত্রাহি অবস্থা। জীবন-জীবিকার কষ্ট সবচেয়ে বড়। মা কিংবা বাবার সামনে তাঁদের সন্তান যখন আহারের জন্য চোখের পানি ফেলে তখন তাঁরা কী করে তা সহ্য করেন!
তৃণমূল থেকে উঠে আসা নেতারা নিশ্চয়ই মানুষের মর্মবেদনা আঁচ করতে পারেন। অবশ্য খাই খাই নেতা-কর্মীদের সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট টের পাওয়ার কথা নয়। তারা ওসব নিয়ে ভাবেও না। তারা নিজেদের আখের গুছিয়ে চলেছে। গ্রাম থেকে শহর_সর্বত্র পেটুক নেতা-কর্মীদের বাড়বাড়ন্ত আওয়ামী লীগকেই লজ্জায় ফেলে দিচ্ছে। এসব না হয় আওয়ামী লীগ সম্ভব হলে সামাল দেবে, কিন্তু সরকারের ব্যর্থতার দায় কে নেবে? নিশ্চয়ই সরকারের ব্যর্থতার দায়ও আওয়ামী লীগের ওপরই বর্তাবে। আবার ভালো করলেও তার সুফল পাবে আওয়ামী লীগ।
নির্বাচনের আগে দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন কতটা হয়েছে? না হয়ে থাকলে কেন হয়নি তার বিচার-বিশ্লেষণ নিশ্চয়ই সরকারকে করতে হবে। বাজার পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার প্রাথমিক দায়িত্ব বাণিজ্যমন্ত্রীর। অথচ বাজার তদারকির ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। শুরু থেকেই তিনি বেফাঁস কথা বলে সরকারকে বিব্রত করছেন। বেফাঁস বলার ক্ষেত্রে এখনো তাঁর জুড়ি নেই। তিনি ব্যবসায়ীদের ধমক দিয়ে বশ করতে চান। আর তাতে ফল হয় উল্টো। ব্যবসায়ীরা তাঁকে সহযোগিতার পরিবর্তে অসহযোগিতাই বেশি করছেন।
কয়েক দিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছিল, দেশের পণ্যবাজার নিয়ন্ত্রণ করে পাঁচটি ব্যবসায়ী গ্রুপ। এগুলো হচ্ছে সিটি, মেঘনা, টিকে, এস আলম ও নূরজাহান গ্রুপ। যদি তা-ই হয়, তাহলে কেন এই পাঁচটি গ্রুপকে সরকার আস্থায় নিতে পারছে না। বাণিজ্যমন্ত্রী যদি এই দায়িত্ব পালনেও ব্যর্থ হন তাহলে তাঁর ক্ষমতায় থাকার কী দরকার? তিনি তো দায়দায়িত্ব স্বীকার করে পদত্যাগ করতে পারেন! অবস্থাটা এমন, যেন প্রধানমন্ত্রী না বললে তিনি কিছুই করবেন না। প্রধানমন্ত্রীকেই বলে দিতে হবে, 'আপনি পারছেন না, দয়া করে পদত্যাগ করুন!'
যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসাইনের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। তিনি দেশের সামগ্রিক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছেন না। অনেক প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও সেগুলো কবে নাগাদ শেষ হবে, তা কেউ বলতে পারছেন না। আবার অনেক প্রকল্পের নামে লুটপাটের অভিযোগ উঠছে। তিনি মন্ত্রীর দায়িত্বে থেকে নিজের কম্পানিকে কাজ পাইয়ে দিতে নানা কারসাজি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে লেখালেখি হলেও তদন্ত পর্যন্ত হয়নি। অনেকে বলেন, তাঁর খুঁটি নাকি অনেক শক্ত।
আরেকজন মন্ত্রী আছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। তিনি নিজের দায়িত্ব সম্পর্কেও সচেতন নন। অথচ একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় তিনি দেখভাল করছেন। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা আবদুর রাজ্জাক। বর্তমানে যিনি আছেন তিনি রমেশ চন্দ্র সেন, থানা পর্যায়ের একজন নেতা। ভারতের সঙ্গে পানি ভাগাভাগির আলোচনায় তিনি বড়ই বেমানান।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন রেজাউল করিম হীরা। তাঁর অবস্থাও পানিসম্পদমন্ত্রীর মতোই। শুরুতে তিনি তাঁর ছেলের সহযোগিতায় কিছু কাজ করার চেষ্টা করেছিলেন। এখন তাও করছেন না। এখন তিনি পুরোপুরি আমলানির্ভর হয়ে পড়েছেন। নিজে উদ্যোগী হয়ে যে কিছু একটা করবেন, তা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। ভূমি ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক কিছু করার আছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশের ৮০ শতাংশ মামলা হয় ভূমি বিরোধ নিয়ে। তহশিল অফিসে গিয়ে মানুষ নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়, প্রতারিত হয়। এসব নিয়ে মন্ত্রী কাজ করতে পারতেন। অথচ তিনি নির্বিকার।
বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের বিষয়েও আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সুস্পষ্ট ঘোষণা ছিল। বলা হয়েছিল, সরকারে যেতে পারলে বিদ্যুৎ সমস্যার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। সেই পরিকল্পনা কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে, কত দিনে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হবে_এ বিষয়ে এখনই জনগণকে জানাতে হবে। বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে বিনিয়োগ ব্যাহত হচ্ছে। সামগ্রিক উন্নয়নপ্রক্রিয়া দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখন আর পূর্ববর্তী সরকার কিছুই করেনি বলে পার পাওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু দায়িত্ব পালনে কতটা আন্তরিক, তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালোমন্দ মিলিয়ে একটা জায়গায় রয়েছে। কিন্তু পুলিশ বিভাগের কিছু ঘটনায় সরকারকেও বিব্রত হতে হয়েছে। মেধাবী ছাত্র কাদেরকে নিয়ে গল্প বানানো কিংবা নোয়াখালীতে সাজানো গণপিটুনির ঘটনাটি পুরো পুলিশ বিভাগকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার বন্ধ না হলে এ ধরনের সাজানো নাটক আমরা আরো দেখতে থাকব। এ সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাহেরের মতো ইস্যুকে জিইয়ে রেখে কিংবা একজন ফাঁসির আসামিকে রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা যাবে না।
No comments