সালতামামির উপাদান by আতাউস সামাদ
ক্যালেন্ডারে ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ বলতে গেলে শেষ হলো। বছরটির আর মাত্র তিন দিন অবশিষ্ট আছে। বর্তমান মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ সরকারও এ যাত্রায় ক্ষমতায় তাদের প্রথম বছর পুরো করবে আর সপ্তাহখানেক পর। কাজেই প্রায় সমাপ্ত বছরটি সালতামামির সঙ্গে সরকার ও দেশের রাজনীতির এক বছরের অর্জন-বিসর্জনের হিসাবও করছেন আগ্রহী এবং কৌতূহলী নাগরিকরা।
গত প্রায় বছরটির হিসাব-নিকাশের যে প্রেক্ষিত তার বেশকিছু বৈশিষ্ট্য আছে এবং সেগুলোর প্রভাব বিবেচনায় নিতেই হবে। প্রথমত, গায়ের জোরে চেপে বসা একটি অসাংবিধানিক, অনিয়মতান্ত্রিক ও অনৈতিক আধাসামরিক সরকারের জোয়ালে আমরা বাঁধা পড়ে দুই বছর ঘানি টানার পর অতিকষ্টে বেরিয়ে এসে এক বছর কাটালাম একটি নির্বাচিত সরকারের শাসনের আওতায়। ফলে এবছরটাতে আশা-আকাঙ্ক্ষার জোয়ার তো ছিলই। সে ক্ষেত্রে একটা বড় প্রশ্ন হলো, গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথে আমরা অগ্রসর হতে পেরেছি কিনা, পেরে থাকলে তা কতটুকু? ২০০৯ সাল জুড়েই বাংলাদেশের গণতন্ত্রে দৃশ্যত প্রত্যাবর্তন ও দেশটিতে বাস্তবিকভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটি উঠেছে বার বার। এখনও একটি জীবন্ত প্রশ্ন এটি। কারণ, দেশজুড়ে শাসক দলের লোকেরা আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছে বার বার, দলীয়করণ হয়েছে নগ্নভাবে, বিরোধী দল ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ক্ষমতাসীনরা হুমকি দিয়েছে অবিরত, জাতীয় সংসদে জাতীয় সমস্যা আলোচনা করা হয়েছে কমই এবং সংসদের স্থায়ী কমিটিগুলো সরকারের জবাবদিহি নেয়ার চেয়ে বিরোধী দলের চরিত্র হননে ব্যস্ত ছিল বেশি।
দ্বিতীয়ত, মইন-ফখরুদ্দীনের কথিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে আমরা দুর্নীতি দমন নিয়ে অনেক কথা শুনেছি। ফখরুদ্দীন সাহেব গদিতে বসে তার প্রথম বক্তৃতাতেই বললেন, দুর্নীতির জন্য থাকবে ‘জিরো টলারেন্স’। আমরা প্রথমে ভাবলাম যে, তিনি বোধহয় বলতে চাইছেন, তার প্রশাসনে কেউ দুর্নীতি করলে সেটা সহ্য করা হবে না। একই সঙ্গে মনে প্রশ্ন জেগেছিল, যে সরকার এসেছে একটা সঠিক ভোটার লিস্ট তৈরি করে শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে, তারা হঠাত্ করে দুর্নীতি দমন বিষয়টিকে তাদের একনম্বর কাজ বলে প্রচার করছে কেন? এটা যে ছিল কোনো নির্বাচন না দিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার অজুহাত এবং সেই সঙ্গে দেশে বিরাজনীতিকরণের কাজটি সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে, তা অবশ্য খুব তাড়াতাড়িই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ওই বিতর্কিত সরকার রাজনীতিবিদদের মাথার ওপর দুর্নীতির অভিযোগের পাহাড় চাপাতে থাকে, বিশেষত বিএনপির নেতাদের ওপর তা করা হয় প্রায় পাইকারি হারে। একই সঙ্গে চলতে থাকে বিচারিক আদালতগুলোকে পরিহাসের বস্তুতে পরিণত করা এবং জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তের নামে মানবাধিকার হরণ। তারা তাদের এই প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষায় ‘দুর্নীতিপরায়ণ’ শব্দটিকে নতুন শব্দ ‘দুর্নীতিবাজ’ দ্বারা প্রতিস্থাপন করে। এই সময় একশ্রেণীর সম্পাদক ও সাংবাদিক নিজেদের ডিজিএফআই’র হুকুম তামিলকারীতে পরিণত করেন এবং ‘ওইরকম সহযোগিতা প্রদানের জন্য’ প্রকাশ্যে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তবে কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল শক্তি, যা ছিল সামরিক বাহিনীর একাংশ, স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির ফলে আসল দুর্নীতি দমন প্রক্রিয়া ধ্বংস হয়ে যায়। যার দরুন দুর্নীতির অভিযোগে আনা প্রায় সব মামলা এখন উচ্চ আদালতে থমকে গেছে। আর দুর্নীতি দমন কমিশন ডুবেছে হতাশায়। ফলে প্রকৃত দুর্নীতিপরায়ণরা এখন সক্রিয় হয়েছে পূর্ণ উদ্যমে। বর্তমানে দেশে দ্রব্যমূল্যের যে অবাধ ঊর্ধ্বগতি তার মূল কারণ যে ব্যাপকহারে দুর্নীতি, একথা অনেকেই স্পষ্টভাবে বলছেন আজকাল। তাদের অভিযোগের পক্ষে যুক্তি আছে যথেষ্ট।
তৃতীয়ত, সাবেক ক্ষমতাসীন দল বিএনপি কথিত তত্ত্বাবধায়কদের হাতে তছনছ হওয়ার পর গত নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। একই সঙ্গে ওই দলটির বিপক্ষে নির্বাচনী মাঠে ‘ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর আলামত দেখা যাচ্ছিল। তবুও বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয় এবং এমন এক বিস্ময়কর ফলাফলের সম্মুখীন হয় যাতে জাতীয় সংসদে তার আসনসংখ্যা নগণ্য হয়ে যায়। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, বিএনপি এ ধাক্কাগুলো সামলে উঠতে পারবে কিনা, আর তা যদি না পারে তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতি কতখানি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে? তবে বিএনপি সেভাবে ভেঙে পড়েনি। অবশ্য বর্তমানে দলটি ক্ষমতাসীনদের দ্বারা পরিচালিত মামলা-হামলার শিকার হচ্ছে আকসার। একই সঙ্গে চলছে জাতীয় সংসদে ও বাইরে চরিত্র হননের খেলা। প্রকৃতপক্ষে, ১/১১-র আক্রমণের ধারা বিএনপির বিরুদ্ধে এখনও অব্যাহত আছে।
চতুর্থত, মইন-ফখরুদ্দীনরা রাজনৈতিক সংস্কার করার নামে দল ভাঙার যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন তার ফলে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দু’দলেরই নেতৃত্বে কিছু পরিবর্তন আসা অবধারিত হয়ে পড়ে। গত বছর এবং এ বছর এ নিয়ে টানাপড়েন ও তিক্ততা হয়েছে। অতঃপর কিছু মুখ পেছন থেকে সামনে চলে এসেছে। শেখ হাসিনা বেশিরভাগ নতুনদের নিয়ে মন্ত্রিসভা করেছেন। দলেও অনেক পুরনো মুখ পেছনে পড়ে গেছেন। বিএনপিতেও বেগম খালেদা জিয়া দলের স্থায়ী কমিটিতে ও সাংগঠনিক পদে নতুন-পুরাতনের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। আর একই সঙ্গে তার জ্যেষ্ঠপুত্র ও দলে আগে থেকেই প্রভাবশালী নেতা তারেক রহমানকে দ্বিতীয় উচ্চতম পদে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, বিএনপিতে পরিবারতন্ত্র বহাল থাকল। আবার পাল্টা যুক্তি আছে, কোনো কারণে দলের ভেতর যারা অসন্তুষ্ট বা যারা হালুয়ারুটি দেখলে প্রলুব্ধ হন তারা বিএনপি পরিত্যাগ করার হুজুগ তুললে দলের প্রতি অনুগতরা কাউকে কেন্দ্র করে যাতে একসঙ্গে থাকতে পারেন, সেজন্য এ ব্যবস্থা ভবিষ্যতে উপযোগী প্রমাণিত হতে পারে। এসব মিলিয়ে দেখলে অনুমান করা যায় যে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে নেতৃত্বের উত্তরাধিকারী খোঁজার বা প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, এতে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো গুণগত উন্নতি এমনকি কিছুটাও ইতিবাচক পরিবর্তন হবে কিনা?
পঞ্চমত, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বেশ বিপর্যস্ত অবস্থায় রেখে গেছে তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অর্থনীতির উন্নতি সাধনের জন্য সরকার, বিনিয়োগকারী মহল, উত্পাদক ও ব্যবসায়ী মহলে যে ‘ডায়নামিজম’ দরকার, তা ধ্বংস হয়েছে ওই সরকারের উত্পীড়ন, অবৈধ কার্যকলাপ এবং ভীতি প্রদর্শনের ফলে। ভয়ঙ্কররকম দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বিনিয়োগে স্থবিরতা ও নতুন লেবাসে দুর্নীতি আমদানি— এসবই ঘটেছে সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন দুই বছরে। কাজেই নির্বাচিত সরকারের প্রথম বছরে দেশের মানুষ সেই দুরবস্থা থেকে পরিত্রাণ চেয়েছে এবং আগামীতে দেশকে উন্নয়নের রাজপথ ধরে চলতে দেখতে চেয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সেই হতাশা এখনও বিদ্যমান, যদিও এবছর আমন ধানের উত্পাদন সরকারি লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে।
ষষ্ঠত, ১/১১ ওয়ালাদের শাসনামলে বাংলাদেশ দুটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে। একটা ছিল বন্যা, অপরটি প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোন ‘সিডর’। ‘সিডর’-এ বিপর্যস্ত এলাকায় পুনর্বাসন এবং ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় বাঁধের মেরামতের জন্য খুব কিছু একটা করেনি বা করতে পারেনি ১/১১-এর ক্ষমতাধররা। তার ওপর এই বছর আবার আরেক সাইক্লোন ‘আইলা’ নতুন ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে। উপকূলীয় এলাকার বহু অংশে এখনও মানবিক বিপর্যয় চলছে। একই সঙ্গে পানিশূন্যতার দুঃসংবাদ আসছে গঙ্গা (আমাদের পদ্মা) অববাহিকা ও বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে। দেশের মানুষ এসব চলমান দুর্যোগ ও বিপর্যয় নিয়ে বিপন্ন ও স্বাভাবিকভাবে দুশ্চিন্তিত আছে।
সপ্তম বিবেচ্য বিষয় হলো, ১/১১-এর আসল নেতারা পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে বৃহত্ প্রতিবেশী ভারতের অনুগত ছিল এবং এখন শেখ হাসিনার মহাজোট বা আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে কিছু রাজনৈতিক সুবিধা ও ট্রানজিট দিতে যে বদ্ধপরিকর, তা প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন। মন্ত্রীরাও তার প্রতিধ্বনি করে গেছেন বিগত বছর জুড়ে। এ পরিবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি সফরে ভারত যাচ্ছেন। সেখানে তিনি কোন অসম চুক্তি করে বসেন তা নিয়ে অনেকেই যুক্তিসঙ্গত কারণে ভীত আছেন।
শেষ হয়ে আসা ২০০৯ সালের হিসাব-নিকাশে উল্লিখিত প্রসঙ্গগুলো আসছে এবং আসবেই। কথা হলো, এসব ঘটনার রেশ ২০১০ এবং তার পরের বছরগুলোয় কতখানি থাকবে, থাকলে তা আমাদের কতটা ভোগাবে?
লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক এখন
No comments