রং চড়ানো ইতিহাস-২ by মাহমুদ শামসুল হক
ইতিহাসের নামে কল্পকাহিনী রচয়িতাদের মুখোশ খসে পড়ে এক সময়। কেউ ধরা পড়েন সমকালেই, কেউ বহু পরে, কেউ আবার হাজার বছর পরে। যারা নানা কারণে আড়ালে-আবডালে থেকে যান, তাদেরও খুঁজে বের করার কাজ বন্ধ থাকে না। কিন্তু এর ফাঁকে রং চড়ানো ইতিহাসের অনেক ভুল, খণ্ডিত-বিকৃত বার্তা পৌঁছে যায় পাঠকের কাছে।
দেখা গেছে, নির্জলা মিথ্যা ঘটনা তো বটেই, সত্য ঘটনাও সচেতনভাবে খণ্ডিত আকারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ‘ইতিহাস’-এ। খণ্ডিত ইতিহাস মিথ্যা না হলেও সত্যের তুল্য নয়। কাজেই মিথ্যা, অতিকথন, অপভ্রংশ জাতীয় ঐতিহাসিক তথ্যাদি অনিবার্য কারণেই যাচাই-বাছাই ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এ কাজটি মূলত ঐতিহাসিক ও গবেষকদের। নিষ্ঠাবান পাঠকও নিজ কাঁধে তুলে নিতে পারেন এই দায়।
ইতিহাস-গবেষকদের অনেকে এরই মধ্যে ভারতবর্ষের ইতিহাসে অনেক কল্পিত, রঞ্জিত এবং খণ্ডিত তথ্যের হদিস পেয়েছেন। এমনকি শত শত বছর ধরে প্রচলিত একাধিক বর্ণিত ঘটনা হাস্যকর ও অপাঠ্য হিসেবে শনাক্ত হয়েছে। যেসব ঐতিহাসিক হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ইত্যাদি পরিচয়ে আত্মমূল্যায়নে তত্পর—তারাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইতিহাস বিকৃতির কুশীলব। এখানে কুতুব মিনার নিয়ে কতিপয় তথাকথিত ঐতিহাসিক যে মিথ্যাচার করেছেন, সে ঘটনাটি দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে। এ কল্পকাহিনীর রচয়িতারা জানিয়েছেন, দিল্লিতে কুতুব মিনার বানিয়েছিলেন রাজা পৃথ্বিরাজ চৌহান। দূর থেকে যমুনা নদী দর্শনের আবদার করেছিলেন পৃথ্বিরাজের মেয়ে। রাজকন্যার এ শখ পূরণ করতেই রাজা এই সুউচ্চ টাওয়ারটি তৈরি করেন। সে কালেই এই মিথ্যা বানোয়াট তথ্য খারিজ করে দিয়েছিলেন অনেক ইতিহাসবিদ। তারপরও গল্পটি দিল্লির বিভিন্ন স্থানে জনশ্রুতিতে পরিণত হয়। পরবর্তী সময়েও হিন্দু-মুসলিম সংক্রান্ত বিভিন্ন বিতর্কে এটি স্থানবিশেষে উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। শুধু তর্কের খাতিরেই এই মিথ্যাচারের পুনরাবৃত্তি হতে থাকে ইতিহাসের নাম করে। যদিও সাধারণ মানুষ তা আস্থায় নেয়নি এজন্য যে, ‘কুতুব’ এবং ‘মিনার’ শব্দ দুটোই এই বিভ্রান্তিকর তথ্যটি নাকচ করার জন্য যথেষ্ট। কুতুব মিনারের সঙ্গে পৃথ্বিরাজ এবং তার মেয়েকে টেনে আনা অসত্ চিন্তাপ্রসূত একটি সচেতন ইয়ার্কি মাত্র। তবে মুশকিল হচ্ছে, একজন নিষ্ঠ ঐতিহাসিক এবং সচেতন পাঠক কোনো লিপিবদ্ধ বর্ণনাকে সুনির্দিষ্ট ও প্রামাণিক যুক্তি এবং তথ্য ছাড়া উড়িয়ে দেয়ার পক্ষপাতী নন। তা নৈতিকতার পরিপন্থীও বটে। তথ্য নির্দেশ করেই তাদের একটি ভ্রান্ত তথ্যকে খণ্ডন করতে হয়। ‘পৃথ্বিরাজের কুতুব মিনার’ প্রসঙ্গেও ঐতিহাসিকরা এই ন্যায্যতাকে আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্যের আশ্রয় নিয়েছেন। যেমন, ‘ইম্পেরিয়াল গেজেটার অব ইন্ডিয়া’য় বলা হয়েছে, But the conquering armies of Islam did not carry with them a crowd of masons and artificers and the new rulers of India were compelled to build their mosques and palaces by aid of Hindu workmen... The marks of Hindu workmanship are, indeed, so apparent that several writers long contended even for the Hindu origin of the famous Kutub Miner near Delhi. But Sir Alexander Cunningham due both as to origin and design. এছাড়া ভারতবর্ষের বিশ্রুত অনেক ঐতিহাসিক এবং একাধিক ইংরেজ ইতিহাসবিদ, পর্যটক একবাক্যে স্বীকার করেছেন, কুতুব মিনারের স্থপতি সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক। এ তথ্যের সবচেয়ে বড় সমর্থন এই মিনারের শরীরেই খোদিত রয়েছে। রক্তবর্ণ পাথরে কৃষ্ণ পাথরের তৈরি আরবি অক্ষরে অঙ্কিত তথ্য পাঠ করলেই বিষয়টির মীমাংসা হয়ে যায় এবং অলীক লেখকদের ধাপ্পাবাজি প্রমাণের জন্য সেটিই যথেষ্ট।
উল্লেখ প্রাসঙ্গিক যে, কুতুবমিনারের উচ্চতা দু’শ আটত্রিশ ফুট। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক (রাজত্বকাল ১২০৬-১২১০ খ্রি.) তার আধ্যাত্মিক গুরু হজরত খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকির (র.) স্মৃতির স্মারক হিসেবে চার মিনার সমন্বিত একটি মসজিদ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একটি মিনার অর্থাত্ বর্তমান মিনারটির কাজই শেষ করে যেতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে সুলতান ইলতুিমশ (আলতামাস) তার রাজত্বকালে নয় বছর সময় ধরে এর নির্মাণকাজ শেষ করেন ১২২০ খ্রিস্টাব্দে। জানা গেছে, এর কারিগররা সবাই ছিলেন হিন্দু।
অন্তত এই একটি ঘটনা থেকেই আঁচ করা যাচ্ছে যে, ইতিহাস নিয়ে মিথ্যাচার হয়েছে অনেক। এসব কল্পকাহিনীর লেখকরা মানুষের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছে দিয়ে মানবসভ্যতার তো বটেই, মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের যে ভিত্তিমূল তারও ক্ষতিসাধন করার প্রয়াস পেয়েছেন। ‘ঐতিহাসিক’ নামে কথিত এসব লেখকের দেয়া তথ্য সম্পর্কে সবার অবগতি অন্তত জরুরি। নইলে একটি বিভ্রান্তি থেকে তৈরি হতে পারে বিস্তর বিভ্রান্তি এবং এর জের ধরে ফায়দা লুটতে পারে মতলববাজ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও অন্যরা।
ইতিহাস পাঠকের জন্য আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে, ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রত্যক্ষদর্শী, পরিব্রাজক, দূত ছাড়াও রয়েছেন বিভিন্ন পেশার মানুষ। এমনকি রাজা-বাদশাহ, শাসক-প্রশাসকরাও আত্মজৈবনিক অনেক গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। সেগুলোও দলিল হিসেবে গ্রাহ্যের তালিকায় পড়ে। উপরন্তু ভাড়াটে ঐতিহাসিক এবং ইতিহাস ব্যবসায়ীদের অস্তিত্বও প্রমাণ করেছেন স্বয়ং ঐতিহাসিকরাই। ফলে একই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন তথ্য ও বিবরণ পাওয়া যায়। কাজেই সবটা বিশ্বাসযোগ্য নয় বা নাও হতে পারে। আর তখনই প্রকৃত সত্য উদঘাটনের কঠিন কাজটি করতে হয় সত্যানুসন্ধানীকে। অর্থাত্ ইতিহাসচর্চা, ইতিহাস থেকে উদ্ধৃতি দেয়ার বেলায় যতটা সম্ভব বিদ্যাবুদ্ধিকে জাগ্রত রাখার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
ইতিহাস-গবেষকদের অনেকে এরই মধ্যে ভারতবর্ষের ইতিহাসে অনেক কল্পিত, রঞ্জিত এবং খণ্ডিত তথ্যের হদিস পেয়েছেন। এমনকি শত শত বছর ধরে প্রচলিত একাধিক বর্ণিত ঘটনা হাস্যকর ও অপাঠ্য হিসেবে শনাক্ত হয়েছে। যেসব ঐতিহাসিক হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ইত্যাদি পরিচয়ে আত্মমূল্যায়নে তত্পর—তারাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইতিহাস বিকৃতির কুশীলব। এখানে কুতুব মিনার নিয়ে কতিপয় তথাকথিত ঐতিহাসিক যে মিথ্যাচার করেছেন, সে ঘটনাটি দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে। এ কল্পকাহিনীর রচয়িতারা জানিয়েছেন, দিল্লিতে কুতুব মিনার বানিয়েছিলেন রাজা পৃথ্বিরাজ চৌহান। দূর থেকে যমুনা নদী দর্শনের আবদার করেছিলেন পৃথ্বিরাজের মেয়ে। রাজকন্যার এ শখ পূরণ করতেই রাজা এই সুউচ্চ টাওয়ারটি তৈরি করেন। সে কালেই এই মিথ্যা বানোয়াট তথ্য খারিজ করে দিয়েছিলেন অনেক ইতিহাসবিদ। তারপরও গল্পটি দিল্লির বিভিন্ন স্থানে জনশ্রুতিতে পরিণত হয়। পরবর্তী সময়েও হিন্দু-মুসলিম সংক্রান্ত বিভিন্ন বিতর্কে এটি স্থানবিশেষে উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। শুধু তর্কের খাতিরেই এই মিথ্যাচারের পুনরাবৃত্তি হতে থাকে ইতিহাসের নাম করে। যদিও সাধারণ মানুষ তা আস্থায় নেয়নি এজন্য যে, ‘কুতুব’ এবং ‘মিনার’ শব্দ দুটোই এই বিভ্রান্তিকর তথ্যটি নাকচ করার জন্য যথেষ্ট। কুতুব মিনারের সঙ্গে পৃথ্বিরাজ এবং তার মেয়েকে টেনে আনা অসত্ চিন্তাপ্রসূত একটি সচেতন ইয়ার্কি মাত্র। তবে মুশকিল হচ্ছে, একজন নিষ্ঠ ঐতিহাসিক এবং সচেতন পাঠক কোনো লিপিবদ্ধ বর্ণনাকে সুনির্দিষ্ট ও প্রামাণিক যুক্তি এবং তথ্য ছাড়া উড়িয়ে দেয়ার পক্ষপাতী নন। তা নৈতিকতার পরিপন্থীও বটে। তথ্য নির্দেশ করেই তাদের একটি ভ্রান্ত তথ্যকে খণ্ডন করতে হয়। ‘পৃথ্বিরাজের কুতুব মিনার’ প্রসঙ্গেও ঐতিহাসিকরা এই ন্যায্যতাকে আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্যের আশ্রয় নিয়েছেন। যেমন, ‘ইম্পেরিয়াল গেজেটার অব ইন্ডিয়া’য় বলা হয়েছে, But the conquering armies of Islam did not carry with them a crowd of masons and artificers and the new rulers of India were compelled to build their mosques and palaces by aid of Hindu workmen... The marks of Hindu workmanship are, indeed, so apparent that several writers long contended even for the Hindu origin of the famous Kutub Miner near Delhi. But Sir Alexander Cunningham due both as to origin and design. এছাড়া ভারতবর্ষের বিশ্রুত অনেক ঐতিহাসিক এবং একাধিক ইংরেজ ইতিহাসবিদ, পর্যটক একবাক্যে স্বীকার করেছেন, কুতুব মিনারের স্থপতি সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক। এ তথ্যের সবচেয়ে বড় সমর্থন এই মিনারের শরীরেই খোদিত রয়েছে। রক্তবর্ণ পাথরে কৃষ্ণ পাথরের তৈরি আরবি অক্ষরে অঙ্কিত তথ্য পাঠ করলেই বিষয়টির মীমাংসা হয়ে যায় এবং অলীক লেখকদের ধাপ্পাবাজি প্রমাণের জন্য সেটিই যথেষ্ট।
উল্লেখ প্রাসঙ্গিক যে, কুতুবমিনারের উচ্চতা দু’শ আটত্রিশ ফুট। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক (রাজত্বকাল ১২০৬-১২১০ খ্রি.) তার আধ্যাত্মিক গুরু হজরত খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকির (র.) স্মৃতির স্মারক হিসেবে চার মিনার সমন্বিত একটি মসজিদ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একটি মিনার অর্থাত্ বর্তমান মিনারটির কাজই শেষ করে যেতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে সুলতান ইলতুিমশ (আলতামাস) তার রাজত্বকালে নয় বছর সময় ধরে এর নির্মাণকাজ শেষ করেন ১২২০ খ্রিস্টাব্দে। জানা গেছে, এর কারিগররা সবাই ছিলেন হিন্দু।
অন্তত এই একটি ঘটনা থেকেই আঁচ করা যাচ্ছে যে, ইতিহাস নিয়ে মিথ্যাচার হয়েছে অনেক। এসব কল্পকাহিনীর লেখকরা মানুষের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছে দিয়ে মানবসভ্যতার তো বটেই, মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের যে ভিত্তিমূল তারও ক্ষতিসাধন করার প্রয়াস পেয়েছেন। ‘ঐতিহাসিক’ নামে কথিত এসব লেখকের দেয়া তথ্য সম্পর্কে সবার অবগতি অন্তত জরুরি। নইলে একটি বিভ্রান্তি থেকে তৈরি হতে পারে বিস্তর বিভ্রান্তি এবং এর জের ধরে ফায়দা লুটতে পারে মতলববাজ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও অন্যরা।
ইতিহাস পাঠকের জন্য আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে, ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রত্যক্ষদর্শী, পরিব্রাজক, দূত ছাড়াও রয়েছেন বিভিন্ন পেশার মানুষ। এমনকি রাজা-বাদশাহ, শাসক-প্রশাসকরাও আত্মজৈবনিক অনেক গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। সেগুলোও দলিল হিসেবে গ্রাহ্যের তালিকায় পড়ে। উপরন্তু ভাড়াটে ঐতিহাসিক এবং ইতিহাস ব্যবসায়ীদের অস্তিত্বও প্রমাণ করেছেন স্বয়ং ঐতিহাসিকরাই। ফলে একই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন তথ্য ও বিবরণ পাওয়া যায়। কাজেই সবটা বিশ্বাসযোগ্য নয় বা নাও হতে পারে। আর তখনই প্রকৃত সত্য উদঘাটনের কঠিন কাজটি করতে হয় সত্যানুসন্ধানীকে। অর্থাত্ ইতিহাসচর্চা, ইতিহাস থেকে উদ্ধৃতি দেয়ার বেলায় যতটা সম্ভব বিদ্যাবুদ্ধিকে জাগ্রত রাখার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
No comments