চারদিক-সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর
তুই কোথায় যাবি? তোর পেটে বাচ্চা, তুই গর্ভবতী কুকুর। তোর কোনো ভয় নেই। তুই তো মানুষ না যে তুই প্রাণের ভয় করবি। উঁচু জাত, বর্ণের বিভেদ—এসব তো সভ্যতার উপকরণ। এই তলোয়ার বানানো হয়েছে সভ্যতা রক্ষার জন্য। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দে যে এই অস্ত্র দিয়ে তোর গলা কাটা হবে না। কারণ, তুই তো সর্বশ্রেষ্ঠ জীব না। মাজহাব কী, তুই জানিস না। তুই সন্ধ্যা আহ্নিক করিস না। তুই স্বাধীনতার প্রয়োজন বুঝিস না।
তোকে নেতার বক্তৃতা শুনতে হয় না। তুই ধন্যবাদ দে ঈশ্বরকে, তুই মানুষ না। তুই চলে যা, আসিস না আমার সাথে। আমি মানুষ। আর মানুষের হাত থেকে বাঁচার জন্য পালাচ্ছি।
কৃষণ চন্দরের উপন্যাসের নায়ক বৈজনাথ তাঁর সঙ্গের কুকুরকে দাঙ্গায় বিধ্বস্ত মানুষের ও নিজের দুর্দশার কথা এভাবেই বলছিলেন। এই দাঙ্গার দুই দশক পর আরেক যুদ্ধে বিপর্যস্ত জনতার দুর্দশার পঙিক্ত রচনা করেন পাশ্চাত্যের কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ তাঁর ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতায়:
লক্ষ শিশু দেখছে আকাশ অন্ধকার
উদর স্ফীত, বিস্ফোরিত চোখের ধার
যশোর রোডে বিষণ্ন সব বাঁশের ঘর
ধুঁকছে শুধু, কঠিন মাটি নিরুত্তর।
(অনুবাদ: খান মোহাম্মদ ফারাবী)
দাঙ্গা কিংবা যুদ্ধ—প্রেক্ষাপট যা-ই হোক না, এসব বিপর্যয়ের অনিবার্য শিকার সাধারণ মানুষ, যার সাক্ষী ১৯৪৭-এ ভারত উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলিম আর ১৯৭১-এর বাংলার বাঙালি। আর এসব চরম অমানবিকতার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে কৃষণ চন্দরের গাদ্দার কিংবা অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’।
যুদ্ধ একাধারে যেমন অমানবিকতার গল্প, অন্যধারে মানবিকতারও পরম প্রকাশের গল্প। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচার, হত্যালীলা থেকে বাঁচতে ভিটেমাটি ছেড়ে লাখো মানুষ পা বাড়িয়েছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। যশোর রোড ধরে কলকাতার পথে। হাজারো ক্ষুধার্ত, অসুস্থ ও পঙ্গু মানুষ গাদাগাদি করে কোনোমতে জীবন কাটাচ্ছে শরণার্থী শিবিরগুলোতে। আন্তর্জাতিক অনেক গণমাধ্যম তখন যথাযথ দায়িত্বের সঙ্গে প্রচার করে সেসব দুঃখগাথা। মার্কিন প্রশাসন যখন বাঙালিদের দমনের জন্য পাকিস্তান সরকারকে সাহায্য করছিল, তখন ওই দেশেরই মানবতাবাদী জনগণ সহানুভূতিশীল হয় অত্যাচারিতদের প্রতি। তাদেরই প্রতিনিধি হয়ে শরণার্থীদের দুর্দশা নিজ চোখে দেখার জন্য ভারতে আসেন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ। রোলিং স্টোনের কিথ রিচার্ডস কিছু ডলার তুলে গিন্সবার্গকে পাঠান শরণার্থীদের কষ্ট বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে গিন্সবার্গ দেখলেন, যশোর রোডের দুই ধারে ঘরহীন সব মানুষের নিদারুণ যন্ত্রণা আর হাহাকার।
অ্যালেন গিন্সবার্গ বিট জেনারেশনের অন্যতম আলোচিত কবি। যে কবিগোষ্ঠী যাবতীয় প্রাতিষ্ঠানিকতা সমাজ-সংসারের চাপিয়ে দেওয়া অনুশাসনের বিরোধী, হিচহাইকিং (অন্যের টাকায় খাওয়া এবং অন্যের সঙ্গে চলা) যাঁদের জীবনদর্শন, অতীন্দ্রিয়বাদ যাঁদের নিত্যসঙ্গী, সেই গোষ্ঠীরই একজন গিন্সবার্গ মেনে নিতে পারেননি মানবতার লুণ্ঠনকে। ঘরহীন মানুষের করুণ কান্না আর ক্ষুধার্ত শিশুর আর্তনাদ কাঁপিয়ে দিল বিট-কবির অন্তরাত্মা। সেপ্টেম্বর মাসে যশোর রোডের পাশে শরণার্থী শিবির দেখে অভিজ্ঞতাগুলো টুকে নেন। এরপর নভেম্বরের ১৪-১৬ তারিখে রচনা করেন সেই অমোঘ কবিতাখানি। তথ্যটি পাওয়া যায় কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘গিন্সবার্গের সঙ্গে’ লেখাটিতে।
নিউইয়র্ক ফিরে গিয়ে গিন্সবার্গ সোজা চলে যান জন লেননকে কবিতাটি পড়ে শোনাতে। গিন্সবার্গ যখন অন্তমিলযুক্ত ১৫২ পঙিক্তর দীর্ঘ কবিতাটি আবৃত্তি করছিলেন, তখন ছলছল চোখে কবির কষ্টের সঙ্গী হন লেননও। বব ডিলানও কবিতাটি পড়ে না কেঁদে পারেননি। গিন্সবার্গ যেমনটা বলেন, ডিলানকে চমকে দিয়ে একটা গান লিখব। উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামসের ‘স্যাড-আইড লেডি অব দ্য লো ল্যান্ডস’-এর আদলে কোনো লম্বা গান, যাতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা ও মানবিক আকুতির কথা থাকবে। ডিলান কবিতাটি পড়ে যখন ফেরত দেন, তখন বলেন, ‘আমি না কেঁদে পারিনি। এরপর ডিলান তুলে নেয় গিটার, আর আমার হাত হারমোনিয়ামে...
সদ্য প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ মুক্তির গান ছবিতে এ গানটি ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। সে জন্য গিন্সবার্গের অনুমতিও নিয়েছিলেন। তবে তখন সেটি ব্যবহার করা হয়নি। পরে মুক্তির কথা প্রামাণ্যচিত্রে ব্যবহার করেন গানটি। তারেক মাসুদের অনুরোধে কবিতাটির ভাবানুবাদে সুরারোপ করেন আরেক মানবতাবাদী শিল্পী মৌসুমি ভৌমিক। বর্তমান প্রজন্ম এ কবিতা ও গানটি গ্রহণ করেছে দারুণভাবে।
যুদ্ধ চিনিয়ে দেয় কে শত্রু আর কে বন্ধু। যুদ্ধ আমাদের দিয়েছে গিন্সবার্গের মতো বন্ধুকে, যিনি এই কবিতার মধ্য দিয়ে একাত্তরে বাঙালির জীবনের অসহ্য কয়টি মাসের একটি পরাভূমে সেপ্টেম্বরকে ধ্রুপদি রূপে শব্দকথায় তুলে ধরেছেন পরম মমতায়।
এম এম খালেকুজ্জামান
কৃষণ চন্দরের উপন্যাসের নায়ক বৈজনাথ তাঁর সঙ্গের কুকুরকে দাঙ্গায় বিধ্বস্ত মানুষের ও নিজের দুর্দশার কথা এভাবেই বলছিলেন। এই দাঙ্গার দুই দশক পর আরেক যুদ্ধে বিপর্যস্ত জনতার দুর্দশার পঙিক্ত রচনা করেন পাশ্চাত্যের কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ তাঁর ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতায়:
লক্ষ শিশু দেখছে আকাশ অন্ধকার
উদর স্ফীত, বিস্ফোরিত চোখের ধার
যশোর রোডে বিষণ্ন সব বাঁশের ঘর
ধুঁকছে শুধু, কঠিন মাটি নিরুত্তর।
(অনুবাদ: খান মোহাম্মদ ফারাবী)
দাঙ্গা কিংবা যুদ্ধ—প্রেক্ষাপট যা-ই হোক না, এসব বিপর্যয়ের অনিবার্য শিকার সাধারণ মানুষ, যার সাক্ষী ১৯৪৭-এ ভারত উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলিম আর ১৯৭১-এর বাংলার বাঙালি। আর এসব চরম অমানবিকতার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে কৃষণ চন্দরের গাদ্দার কিংবা অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’।
যুদ্ধ একাধারে যেমন অমানবিকতার গল্প, অন্যধারে মানবিকতারও পরম প্রকাশের গল্প। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচার, হত্যালীলা থেকে বাঁচতে ভিটেমাটি ছেড়ে লাখো মানুষ পা বাড়িয়েছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। যশোর রোড ধরে কলকাতার পথে। হাজারো ক্ষুধার্ত, অসুস্থ ও পঙ্গু মানুষ গাদাগাদি করে কোনোমতে জীবন কাটাচ্ছে শরণার্থী শিবিরগুলোতে। আন্তর্জাতিক অনেক গণমাধ্যম তখন যথাযথ দায়িত্বের সঙ্গে প্রচার করে সেসব দুঃখগাথা। মার্কিন প্রশাসন যখন বাঙালিদের দমনের জন্য পাকিস্তান সরকারকে সাহায্য করছিল, তখন ওই দেশেরই মানবতাবাদী জনগণ সহানুভূতিশীল হয় অত্যাচারিতদের প্রতি। তাদেরই প্রতিনিধি হয়ে শরণার্থীদের দুর্দশা নিজ চোখে দেখার জন্য ভারতে আসেন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ। রোলিং স্টোনের কিথ রিচার্ডস কিছু ডলার তুলে গিন্সবার্গকে পাঠান শরণার্থীদের কষ্ট বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে গিন্সবার্গ দেখলেন, যশোর রোডের দুই ধারে ঘরহীন সব মানুষের নিদারুণ যন্ত্রণা আর হাহাকার।
অ্যালেন গিন্সবার্গ বিট জেনারেশনের অন্যতম আলোচিত কবি। যে কবিগোষ্ঠী যাবতীয় প্রাতিষ্ঠানিকতা সমাজ-সংসারের চাপিয়ে দেওয়া অনুশাসনের বিরোধী, হিচহাইকিং (অন্যের টাকায় খাওয়া এবং অন্যের সঙ্গে চলা) যাঁদের জীবনদর্শন, অতীন্দ্রিয়বাদ যাঁদের নিত্যসঙ্গী, সেই গোষ্ঠীরই একজন গিন্সবার্গ মেনে নিতে পারেননি মানবতার লুণ্ঠনকে। ঘরহীন মানুষের করুণ কান্না আর ক্ষুধার্ত শিশুর আর্তনাদ কাঁপিয়ে দিল বিট-কবির অন্তরাত্মা। সেপ্টেম্বর মাসে যশোর রোডের পাশে শরণার্থী শিবির দেখে অভিজ্ঞতাগুলো টুকে নেন। এরপর নভেম্বরের ১৪-১৬ তারিখে রচনা করেন সেই অমোঘ কবিতাখানি। তথ্যটি পাওয়া যায় কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘গিন্সবার্গের সঙ্গে’ লেখাটিতে।
নিউইয়র্ক ফিরে গিয়ে গিন্সবার্গ সোজা চলে যান জন লেননকে কবিতাটি পড়ে শোনাতে। গিন্সবার্গ যখন অন্তমিলযুক্ত ১৫২ পঙিক্তর দীর্ঘ কবিতাটি আবৃত্তি করছিলেন, তখন ছলছল চোখে কবির কষ্টের সঙ্গী হন লেননও। বব ডিলানও কবিতাটি পড়ে না কেঁদে পারেননি। গিন্সবার্গ যেমনটা বলেন, ডিলানকে চমকে দিয়ে একটা গান লিখব। উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামসের ‘স্যাড-আইড লেডি অব দ্য লো ল্যান্ডস’-এর আদলে কোনো লম্বা গান, যাতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা ও মানবিক আকুতির কথা থাকবে। ডিলান কবিতাটি পড়ে যখন ফেরত দেন, তখন বলেন, ‘আমি না কেঁদে পারিনি। এরপর ডিলান তুলে নেয় গিটার, আর আমার হাত হারমোনিয়ামে...
সদ্য প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ মুক্তির গান ছবিতে এ গানটি ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। সে জন্য গিন্সবার্গের অনুমতিও নিয়েছিলেন। তবে তখন সেটি ব্যবহার করা হয়নি। পরে মুক্তির কথা প্রামাণ্যচিত্রে ব্যবহার করেন গানটি। তারেক মাসুদের অনুরোধে কবিতাটির ভাবানুবাদে সুরারোপ করেন আরেক মানবতাবাদী শিল্পী মৌসুমি ভৌমিক। বর্তমান প্রজন্ম এ কবিতা ও গানটি গ্রহণ করেছে দারুণভাবে।
যুদ্ধ চিনিয়ে দেয় কে শত্রু আর কে বন্ধু। যুদ্ধ আমাদের দিয়েছে গিন্সবার্গের মতো বন্ধুকে, যিনি এই কবিতার মধ্য দিয়ে একাত্তরে বাঙালির জীবনের অসহ্য কয়টি মাসের একটি পরাভূমে সেপ্টেম্বরকে ধ্রুপদি রূপে শব্দকথায় তুলে ধরেছেন পরম মমতায়।
এম এম খালেকুজ্জামান
No comments