এই দিনে-বক্তাবলী গণহত্যা ও প্রতিরোধ দিবস
বক্তাবলী গণহত্যার কথা কি মনে আছে? এবং প্রতিরোধের? একাত্তরে এই দেশে যে কটি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, বক্তাবলী তার মধ্যে অন্যতম। যদিও দেশে গণহত্যার সঠিক তথ্য স্বাধীনতার চল্লিশ বছরেও জাতির সামনে উত্থাপিত হয়নি। কোনো সরকারই তা করেনি। কোনো রাজনৈতিক দলও এ নিয়ে ভেবেছে বলে মনে হয় না। কারণ, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য হয়তো এর কোনো প্রয়োজন পড়ে না।
নারায়ণগঞ্জের পশ্চিমাঞ্চল ধলেশ্বরীর পাড় ধরে বক্তাবলীর ২২টি গ্রাম। বক্তাবলী ও আলীরটেক দুটি ইউনিয়নের সমন্বয়ে বক্তাবলী পরগনা। তখন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জের দিকে সরে যাওয়ার নিরাপদ যাত্রাপথটিও ছিল এই বক্তাবলী। বক্তাবলীর পূর্বে ও দক্ষিণে ধলেশ্বরী, আর উত্তরে বুড়িগঙ্গা নদী। দুই নদীর মাঝখানে বক্তাবলীর ২২টি গ্রাম যেন দুপুরের ঘাসের ওপর বিছিয়ে রাখা মায়ের ভেজা সবুজ কাপড়।
১৯৭১-এর ২৯ নভেম্বরের রাত। ঘন কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে বক্তাবলীর গ্রাম। নারায়ণগঞ্জ শহরের কয়েকজন রাজাকারের সহযোগিতায় এই ২৯ নভেম্বর রাত সাড়ে তিনটার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে পুরো বক্তাবলী। গানবোট নিয়ে ধলেশ্বরীর বুকে তারা অবস্থান নেয়। সুবেহ সাদেকের সময় বক্তাবলীর চরে গানবোট ভিড়িয়ে নদীর পাড়ে নামতে থাকে পাকিস্তানি সেনারা। কিন্তু ঘন কুয়াশার ফলে তারা গ্রামে অগ্রসর হতে সাহস করে না। তখন মুক্তারকান্দি প্রাইমারি স্কুল, কানাইনগর হাইস্কুলসহ বক্তাবলীতে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি ক্যাম্প ছিল। নদীর পাড়ে অবস্থিত ডিক্রিরচর মসজিদ ও বিভিন্ন বাড়িতে রাত কাটাতেন মুক্তিযোদ্ধারা। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের উপস্থিতি সঙ্গে সঙ্গেই টের পেয়ে যান এবং প্রতিরোধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। কুয়াশা একটু কাটতে থাকলে কুঁড়ের পাড় অঞ্চলের নদীর কাছ থেকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে প্রথমে গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে পাকিস্তানিরা। তখন মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ শুরু করেন। সকাল তখন প্রায় সাড়ে সাতটা। উল্লেখ্য, মাহফুজুর রহমান পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের প্রথম চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। প্রতিরোধের শুরুতেই পাঁচ পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেন মুক্তিযোদ্ধারা এবং আহত হয় বেশ কিছু পাকিস্তানি সেনা। পাকিস্তানি সেনারা পাঁচটি লাশ ও আহত দুজনকে কাঁধে নিয়ে পিছু হটে যায়। এখানে প্রায় দুই ঘণ্টা প্রতিরোধ যুদ্ধ চলে। এ দুই ঘণ্টা প্রতিরোধের কারণে বক্তাবলীর গ্রামগুলো থেকে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ মুন্সিগঞ্জ ও বিভিন্ন অঞ্চলে সরে যেতে সক্ষম হয়। এর পর পরই পাকিস্তানি বাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে গ্রামগুলোর ওপর। পাকিস্তানি হানাদারদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের মুখে মুক্তিবাহিনী বাধ্য হয়ে পিছু হটে। আর তখনই শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর তাণ্ডব। তারা ডিক্রিরচর নদীর পাড়ে সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে একসঙ্গে হত্যা করে ৪০ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে। লক্ষ্মীনগর কবরস্থানের কাছে খড়েরপাড়ার ভেতরে আশ্রয় নেওয়া দলবদ্ধ নিরীহ গ্রামবাসীকে আগুনে জ্বালিয়ে হত্যা করে। শীতের সকালে রাজাপুরের হলুদ সরিষাখেত লাল হয়ে ওঠে; পড়ে থাকে লাশের পর লাশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র শহীদুল্লাহ, মুনীরুজ্জামানসহ বহু ছাত্র আর সাধারণ কৃষককে হত্যা করে তারা। বক্তাবলীতে ১৩৯ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। বক্তাবলী পরগনার ২২টি গ্রামই গান পাউডার দিয়ে বিকেলের মধ্যে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দেয় ওরা।
মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যাগুলোর মধ্যে বক্তাবলীর গণহত্যা অন্যতম। এখানে প্রতিরোধ হয়েছে, পাকিস্তানি সেনাদের হত্যা করা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ হয়েছেন। অথচ কী নির্মম আমাদের বাস্তবতা, আজ চল্লিশ বছর পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ছাত্রদের তালিকায় যেমন এ বক্তাবলীর শহীদদের নাম নেই, স্থানীয় জেলা প্রশাসনের শহীদদের তালিকায়ও এই ১৩৯ জনের একজনেরও নাম নেই। অথচ এ অঞ্চলে কোনো একজনও রাজাকার বা স্বাধীনতাবিরোধী ছিল না। এ ২২টি গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস নিজেরা খেয়ে না-খেয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও আশ্রয় নেওয়া মানুষকে খাইয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন। এ গ্রামগুলোর ছাত্র, শিক্ষক, চাষাভুষা—প্রত্যেক মানুষই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা।
সন্তানহারা, পিতাহারা, স্বজনহারা সেই শহীদ পরিবারগুলোতে এখনো আহাজারি, বুকফাটা আর্তনাদ। আজ বেঁচে থাকার জন্য, টিকে থাকার জন্য প্রাণপণ লড়াই করেও মানবেতর জীবন যাপন করছে শহীদ পরিবারগুলো। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গণহত্যা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা, রাজাকার, আলবদর ও যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা ও এর সঠিক তথ্য সংগ্রহে বড় ভূমিকা রাখতে পারত। কিন্তু তা তারা করেনি। আমরা দেখে আসছি, বিএনপির শাসনামলে সংসদ কার্যালয়ে জিয়াউর রহমানের ছবি তুলে তাঁদের জিন্দাবাদ ধ্বনি দিতে, স্বৈরশাসক এরশাদের সময় এরশাদের ছবি তুলে তাঁর গুণগান করতে, আজ বঙ্গবন্ধুর ছবি তুলে জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে আত্মহারা হচ্ছেন। কত জায়গায় স্বাধীনতাবিরোধীরা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ঠাঁই করে নিচ্ছে। ইতিহাস বিকৃতির দায় বিএনপি, জামায়াত আর স্বাধীনতাবিরোধীরাই শুধু নেবে না—এ দায় তাঁরাও এড়াতে পারেন না। প্রতিদিন মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারগুলোর জন্য সরকারের এত প্রতিশ্রুতির জোয়ার উঠলেও জোয়ারের সে ঢেউ প্রায় চল্লিশ বছরেও বুড়িগঙ্গা-ধলেশ্বরীর পাড়ে শহীদদের গ্রাম বক্তাবলীতে এসে আঘাত করেনি।
আজ আমরা তাঁদের বিনম্রচিত্তে স্মরণ করি।
রফিউর রাব্বি: লেখক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক।
১৯৭১-এর ২৯ নভেম্বরের রাত। ঘন কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে বক্তাবলীর গ্রাম। নারায়ণগঞ্জ শহরের কয়েকজন রাজাকারের সহযোগিতায় এই ২৯ নভেম্বর রাত সাড়ে তিনটার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে পুরো বক্তাবলী। গানবোট নিয়ে ধলেশ্বরীর বুকে তারা অবস্থান নেয়। সুবেহ সাদেকের সময় বক্তাবলীর চরে গানবোট ভিড়িয়ে নদীর পাড়ে নামতে থাকে পাকিস্তানি সেনারা। কিন্তু ঘন কুয়াশার ফলে তারা গ্রামে অগ্রসর হতে সাহস করে না। তখন মুক্তারকান্দি প্রাইমারি স্কুল, কানাইনগর হাইস্কুলসহ বক্তাবলীতে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি ক্যাম্প ছিল। নদীর পাড়ে অবস্থিত ডিক্রিরচর মসজিদ ও বিভিন্ন বাড়িতে রাত কাটাতেন মুক্তিযোদ্ধারা। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের উপস্থিতি সঙ্গে সঙ্গেই টের পেয়ে যান এবং প্রতিরোধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। কুয়াশা একটু কাটতে থাকলে কুঁড়ের পাড় অঞ্চলের নদীর কাছ থেকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে প্রথমে গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে পাকিস্তানিরা। তখন মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ শুরু করেন। সকাল তখন প্রায় সাড়ে সাতটা। উল্লেখ্য, মাহফুজুর রহমান পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের প্রথম চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। প্রতিরোধের শুরুতেই পাঁচ পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেন মুক্তিযোদ্ধারা এবং আহত হয় বেশ কিছু পাকিস্তানি সেনা। পাকিস্তানি সেনারা পাঁচটি লাশ ও আহত দুজনকে কাঁধে নিয়ে পিছু হটে যায়। এখানে প্রায় দুই ঘণ্টা প্রতিরোধ যুদ্ধ চলে। এ দুই ঘণ্টা প্রতিরোধের কারণে বক্তাবলীর গ্রামগুলো থেকে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ মুন্সিগঞ্জ ও বিভিন্ন অঞ্চলে সরে যেতে সক্ষম হয়। এর পর পরই পাকিস্তানি বাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে গ্রামগুলোর ওপর। পাকিস্তানি হানাদারদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের মুখে মুক্তিবাহিনী বাধ্য হয়ে পিছু হটে। আর তখনই শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর তাণ্ডব। তারা ডিক্রিরচর নদীর পাড়ে সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে একসঙ্গে হত্যা করে ৪০ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে। লক্ষ্মীনগর কবরস্থানের কাছে খড়েরপাড়ার ভেতরে আশ্রয় নেওয়া দলবদ্ধ নিরীহ গ্রামবাসীকে আগুনে জ্বালিয়ে হত্যা করে। শীতের সকালে রাজাপুরের হলুদ সরিষাখেত লাল হয়ে ওঠে; পড়ে থাকে লাশের পর লাশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র শহীদুল্লাহ, মুনীরুজ্জামানসহ বহু ছাত্র আর সাধারণ কৃষককে হত্যা করে তারা। বক্তাবলীতে ১৩৯ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। বক্তাবলী পরগনার ২২টি গ্রামই গান পাউডার দিয়ে বিকেলের মধ্যে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দেয় ওরা।
মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যাগুলোর মধ্যে বক্তাবলীর গণহত্যা অন্যতম। এখানে প্রতিরোধ হয়েছে, পাকিস্তানি সেনাদের হত্যা করা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ হয়েছেন। অথচ কী নির্মম আমাদের বাস্তবতা, আজ চল্লিশ বছর পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ছাত্রদের তালিকায় যেমন এ বক্তাবলীর শহীদদের নাম নেই, স্থানীয় জেলা প্রশাসনের শহীদদের তালিকায়ও এই ১৩৯ জনের একজনেরও নাম নেই। অথচ এ অঞ্চলে কোনো একজনও রাজাকার বা স্বাধীনতাবিরোধী ছিল না। এ ২২টি গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস নিজেরা খেয়ে না-খেয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও আশ্রয় নেওয়া মানুষকে খাইয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন। এ গ্রামগুলোর ছাত্র, শিক্ষক, চাষাভুষা—প্রত্যেক মানুষই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা।
সন্তানহারা, পিতাহারা, স্বজনহারা সেই শহীদ পরিবারগুলোতে এখনো আহাজারি, বুকফাটা আর্তনাদ। আজ বেঁচে থাকার জন্য, টিকে থাকার জন্য প্রাণপণ লড়াই করেও মানবেতর জীবন যাপন করছে শহীদ পরিবারগুলো। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গণহত্যা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা, রাজাকার, আলবদর ও যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা ও এর সঠিক তথ্য সংগ্রহে বড় ভূমিকা রাখতে পারত। কিন্তু তা তারা করেনি। আমরা দেখে আসছি, বিএনপির শাসনামলে সংসদ কার্যালয়ে জিয়াউর রহমানের ছবি তুলে তাঁদের জিন্দাবাদ ধ্বনি দিতে, স্বৈরশাসক এরশাদের সময় এরশাদের ছবি তুলে তাঁর গুণগান করতে, আজ বঙ্গবন্ধুর ছবি তুলে জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে আত্মহারা হচ্ছেন। কত জায়গায় স্বাধীনতাবিরোধীরা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ঠাঁই করে নিচ্ছে। ইতিহাস বিকৃতির দায় বিএনপি, জামায়াত আর স্বাধীনতাবিরোধীরাই শুধু নেবে না—এ দায় তাঁরাও এড়াতে পারেন না। প্রতিদিন মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারগুলোর জন্য সরকারের এত প্রতিশ্রুতির জোয়ার উঠলেও জোয়ারের সে ঢেউ প্রায় চল্লিশ বছরেও বুড়িগঙ্গা-ধলেশ্বরীর পাড়ে শহীদদের গ্রাম বক্তাবলীতে এসে আঘাত করেনি।
আজ আমরা তাঁদের বিনম্রচিত্তে স্মরণ করি।
রফিউর রাব্বি: লেখক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক।
No comments