বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে শঙ্কা by ইফতেখার আহমেদ টিপু
কঠিন সংকটে দেশের অর্থনীতি। চলছে চরম অস্থিরতা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমছে আশঙ্কাজনকভাবে। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় বাধ্য হয়ে ব্যাংক থেকে দফায় দফায় টাকা ধার নিয়ে দেশ চালাতে হচ্ছে সরকারকে। ভর্তুকির চাপে বিপর্যস্ত দেশের অর্থনীতি।
চলতি বছর শুধু তেল-গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি ৩৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। আর ব্যাংক সে অর্থ জোগান দিতে ছাপাচ্ছে নতুন টাকা। ফলে মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতি গ্রাস করছে পুরো অর্থব্যবস্থাকে। অন্যদিকে দেউলিয়া হয়ে গেছে পুঁজিবাজার। প্রবৃদ্ধি নেই রপ্তানি ও রাজস্ব আয়ে। এতে সর্বগ্রাসী প্রভাব পড়ছে সাধারণ মানুষের জীবনমানে। তারা সঞ্চয় করা অর্থ খরচ করে জীবন বাঁচাচ্ছে।
কালের কণ্ঠের প্রতিবেদন মতে, জ্বালানি খাতের এ বিপুল ভর্তুকির অর্থ জোগাতে দেনার দায়ে সরকার ডুবতে বসেছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সরকারের খরচ চালাতে গিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণে এ ভর্তুকি দেওয়া হলেও তাতে লাভবান হচ্ছে মূলত সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণী। সরকার যেসব খাতে ভর্তুকি দিয়ে থাকে, তার মধ্যে জ্বালানি খাতের স্থান শীর্ষে। অথচ এ খাতের সুবিধা সিংহভাগই ভোগ করে সুবিধাভোগী শ্রেণী। কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তার জন্য সরকার যে ভর্তুকি দেয়, তার সুফল সমাজের সব অংশের মানুষ ভোগ করলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে ভর্তুকির সুবিধাভোগীদের সংখ্যা সীমিত। ব্যাংক ঋণ নিয়ে দেনার দায়ে আকণ্ঠ নিমগ্ন হয়ে যাওয়ার মূল কারণও হলো ভর্তুকিনির্ভর অর্থনীতি। শুধু জ্বালানি খাতে সরকারকে যেখানে ৩৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে চলতি অর্থবছরে সরকারের ব্যাংক ঋণ নেওয়ার টার্গেট ছিল ১৮ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। সোজা কথায়, ভর্তুকি বন্ধ করলে ব্যাংক ঋণ নিয়ে সরকারের ব্যয় নির্বাহের প্রয়োজন হতো না। চলতি বছর বিদ্যুৎ খাতে সাত হাজার কোটি, জ্বালানি তেলে ২৬ হাজার কোটি এবং গ্যাস বাবদ সরকারকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম আকাশচুম্বী হয়ে পড়ায় এ খাতে ব্যয় কল্পনাকেও হার মানাতে চলেছে। ভর্তুকি দিয়ে জ্বালানি খাতকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা দেশের সুবিধাভোগী শ্রেণীকেই শুধু লাভবান করছে। মূলত ১ শতাংশেরও কম মানুষ এ সুবিধার সিংহভাগ ভোগ করছে। ভর্তুকি কেবল যে খাতেই দেওয়া উচিত সে খাতের সুবিধা ১৬ কোটি মানুষ অথবা সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ ভোগ করতে পারে। কৃষি ও খাদ্য খাতের দাবি এদিক থেকে সবচেয়ে বেশি। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতও এদিক থেকে অগ্রাধিকারের দাবি রাখে। দেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে জ্বালানি খাতে ঢালাওভাবে ভর্তুকি দেওয়ার পথ থেকে সরে আসতে হবে। এ খাতে অপব্যয়কৃত টাকা শিল্পায়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের কল্যাণে ব্যয় করা হলে সেটিই হবে উত্তম। অর্থনৈতিক সংকট সামাল দিতে না পারলে সরকার অস্তিত্বের সংকটে পড়বে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিনিয়োগের চাকা সচল, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই। বিনিয়োগের বর্তমান অবস্থা প্রকৃত অর্থেই 'স্থবির'। জ্বালানি নিরাপত্তা অনিশ্চিত। দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানি সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপের চিন্তা করা তো দূরের কথা, সাময়িক সংকট নিরসনেও সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। যার ফলে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে না পারলে বিনিয়োগ, বিশেষত বিদেশি বিনিয়োগ দ্রুত কমে যাবে।
বিনিয়োগে স্থবিরতা, ঘাটতির চাপ এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধিতে দেশের অর্থনীতি সংকটে পড়েছে। অর্থনীতির ত্রিশঙ্কু অবস্থা নিশ্চিত করেছে ডলারের দাম ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাওয়া। দুনিয়াজুড়ে মার্কিন মুদ্রার দাম কমলেও বাংলাদেশে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দেশের সাধারণ মানুষ যখন সংকটাপন্ন, তখন অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতিবাচক অবস্থা ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার বিষয়টিও সমানভাবে উদ্বেগজনক। শেয়ারবাজারের দরপতনের ঘটনা ৩০ লাখেরও বেশি বিনিয়োগকারীকে সর্বস্বান্ত করেছে। জনমনে ধারণার সৃষ্টি হয়েছে, সরকার শেয়ারবাজারের লুটেরাদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। বাজার পুনর্গঠনে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তাতে সুফল পাওয়া যাচ্ছে না আস্থার সংকটের কারণে। বিদ্যমান সংকট মোচনে সরকারকে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে বন্ধ্যত্ব চলছে, তা ঘোচাতে যত্নবান হতে হবে। সৃষ্টি করতে হবে কর্মসংস্থানের সুযোগ। রাজনৈতিক সংঘাত এড়িয়ে সব দলকে আস্থায় নিয়ে সংকট মোকাবিলার কথা ভাবতে হবে। সংকট মোকাবিলায় সেটিই হবে সর্বোত্তম উপায়।
ভর্তুকির চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। বিদ্যুতের সমস্যা কিছু কমলেও গ্যাস সংকট এখনো প্রকট। নেই বেসরকারি বিনিয়োগ। বৈদেশিক সাহায্য-পরিস্থিতি এমনিতেই নাজুক। পদ্মা সেতু বিতর্ক পরিস্থিতি আরো প্রকট করে তুলেছে। শেয়ারবাজার সরকারের জন্য এখন গলার কাঁটা হয়ে রয়েছে। এসব কারণে সংকটে আছে সাধারণ মানুষ। নতুন চ্যালেঞ্জের মধ্যে আগামী দুই বছর কাটাতে হবে সরকারকে। দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, বিদেশনীতি ও প্রশাসনের গতি স্বাভাবিক রাখতে গিয়ে হিমশিম খেতে হবে সরকারকে। সার্বিক বিবেচনায় সরকারের জন্য সামনে অপেক্ষা করছে কঠিন চ্যালেঞ্জ।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক দৈনিক নবরাজ, চেয়ারম্যান ইফাদ গ্রুপ
chairman@ifadgroup.com
কালের কণ্ঠের প্রতিবেদন মতে, জ্বালানি খাতের এ বিপুল ভর্তুকির অর্থ জোগাতে দেনার দায়ে সরকার ডুবতে বসেছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সরকারের খরচ চালাতে গিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণে এ ভর্তুকি দেওয়া হলেও তাতে লাভবান হচ্ছে মূলত সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণী। সরকার যেসব খাতে ভর্তুকি দিয়ে থাকে, তার মধ্যে জ্বালানি খাতের স্থান শীর্ষে। অথচ এ খাতের সুবিধা সিংহভাগই ভোগ করে সুবিধাভোগী শ্রেণী। কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তার জন্য সরকার যে ভর্তুকি দেয়, তার সুফল সমাজের সব অংশের মানুষ ভোগ করলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে ভর্তুকির সুবিধাভোগীদের সংখ্যা সীমিত। ব্যাংক ঋণ নিয়ে দেনার দায়ে আকণ্ঠ নিমগ্ন হয়ে যাওয়ার মূল কারণও হলো ভর্তুকিনির্ভর অর্থনীতি। শুধু জ্বালানি খাতে সরকারকে যেখানে ৩৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে চলতি অর্থবছরে সরকারের ব্যাংক ঋণ নেওয়ার টার্গেট ছিল ১৮ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। সোজা কথায়, ভর্তুকি বন্ধ করলে ব্যাংক ঋণ নিয়ে সরকারের ব্যয় নির্বাহের প্রয়োজন হতো না। চলতি বছর বিদ্যুৎ খাতে সাত হাজার কোটি, জ্বালানি তেলে ২৬ হাজার কোটি এবং গ্যাস বাবদ সরকারকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম আকাশচুম্বী হয়ে পড়ায় এ খাতে ব্যয় কল্পনাকেও হার মানাতে চলেছে। ভর্তুকি দিয়ে জ্বালানি খাতকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা দেশের সুবিধাভোগী শ্রেণীকেই শুধু লাভবান করছে। মূলত ১ শতাংশেরও কম মানুষ এ সুবিধার সিংহভাগ ভোগ করছে। ভর্তুকি কেবল যে খাতেই দেওয়া উচিত সে খাতের সুবিধা ১৬ কোটি মানুষ অথবা সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ ভোগ করতে পারে। কৃষি ও খাদ্য খাতের দাবি এদিক থেকে সবচেয়ে বেশি। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতও এদিক থেকে অগ্রাধিকারের দাবি রাখে। দেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে জ্বালানি খাতে ঢালাওভাবে ভর্তুকি দেওয়ার পথ থেকে সরে আসতে হবে। এ খাতে অপব্যয়কৃত টাকা শিল্পায়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের কল্যাণে ব্যয় করা হলে সেটিই হবে উত্তম। অর্থনৈতিক সংকট সামাল দিতে না পারলে সরকার অস্তিত্বের সংকটে পড়বে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিনিয়োগের চাকা সচল, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই। বিনিয়োগের বর্তমান অবস্থা প্রকৃত অর্থেই 'স্থবির'। জ্বালানি নিরাপত্তা অনিশ্চিত। দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানি সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপের চিন্তা করা তো দূরের কথা, সাময়িক সংকট নিরসনেও সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। যার ফলে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে না পারলে বিনিয়োগ, বিশেষত বিদেশি বিনিয়োগ দ্রুত কমে যাবে।
বিনিয়োগে স্থবিরতা, ঘাটতির চাপ এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধিতে দেশের অর্থনীতি সংকটে পড়েছে। অর্থনীতির ত্রিশঙ্কু অবস্থা নিশ্চিত করেছে ডলারের দাম ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাওয়া। দুনিয়াজুড়ে মার্কিন মুদ্রার দাম কমলেও বাংলাদেশে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দেশের সাধারণ মানুষ যখন সংকটাপন্ন, তখন অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতিবাচক অবস্থা ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার বিষয়টিও সমানভাবে উদ্বেগজনক। শেয়ারবাজারের দরপতনের ঘটনা ৩০ লাখেরও বেশি বিনিয়োগকারীকে সর্বস্বান্ত করেছে। জনমনে ধারণার সৃষ্টি হয়েছে, সরকার শেয়ারবাজারের লুটেরাদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। বাজার পুনর্গঠনে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তাতে সুফল পাওয়া যাচ্ছে না আস্থার সংকটের কারণে। বিদ্যমান সংকট মোচনে সরকারকে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে বন্ধ্যত্ব চলছে, তা ঘোচাতে যত্নবান হতে হবে। সৃষ্টি করতে হবে কর্মসংস্থানের সুযোগ। রাজনৈতিক সংঘাত এড়িয়ে সব দলকে আস্থায় নিয়ে সংকট মোকাবিলার কথা ভাবতে হবে। সংকট মোকাবিলায় সেটিই হবে সর্বোত্তম উপায়।
ভর্তুকির চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। বিদ্যুতের সমস্যা কিছু কমলেও গ্যাস সংকট এখনো প্রকট। নেই বেসরকারি বিনিয়োগ। বৈদেশিক সাহায্য-পরিস্থিতি এমনিতেই নাজুক। পদ্মা সেতু বিতর্ক পরিস্থিতি আরো প্রকট করে তুলেছে। শেয়ারবাজার সরকারের জন্য এখন গলার কাঁটা হয়ে রয়েছে। এসব কারণে সংকটে আছে সাধারণ মানুষ। নতুন চ্যালেঞ্জের মধ্যে আগামী দুই বছর কাটাতে হবে সরকারকে। দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, বিদেশনীতি ও প্রশাসনের গতি স্বাভাবিক রাখতে গিয়ে হিমশিম খেতে হবে সরকারকে। সার্বিক বিবেচনায় সরকারের জন্য সামনে অপেক্ষা করছে কঠিন চ্যালেঞ্জ।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক দৈনিক নবরাজ, চেয়ারম্যান ইফাদ গ্রুপ
chairman@ifadgroup.com
No comments