জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি-এস এম সুলতান : কীর্তিমানের মুখচ্ছবি
যশোরের নড়াইলের মাসিমদিয়া গ্রামে এক কৃষক পরিবারে শেখ মুহাম্মদ সুলতান ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। দারিদ্র্যের মধ্যে পাঁচ বছর পার হওয়ার পর তাঁকে নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করানো হয়। কিছুদিনের মধ্যে তাঁকে স্কুল ছেড়ে বাবার সঙ্গে শুরু করতে হয় রাজমিস্ত্রির কাজ।
এর পেছনের কারণ ছিল আর্থিক অসচ্ছলতা। অভাব-অনটনের কারণে প্রতিদিন ঠিকমতো খাওয়ার চাহিদাও পূরণ হতো না তাঁদের পরিবারে। শেষ পর্যন্ত পরিবারের এমন পরিস্থিতিতে তিনি বাবার সঙ্গে পুরোদমে রাজমিস্ত্রির কাজ শুরু করে দেন। রাজমিস্ত্রির কারিগরি শিল্প থেকেই একসময় বাল্য বয়সে তাঁর মনে চিত্রশিল্পের প্রতি নিখুঁত আগ্রহের জন্ম নেয়। কাঠ-কয়লা, কাঁচা হলুদ, পুঁইগাছের পাকা ফলের রসই ছিল তাঁর আঁকাআঁকির একমাত্র উপকরণ। পরিবারের দেওয়া ডাকনাম 'লাল মিয়া'র ছবি আঁকার আগ্রহ দেখে এগিয়ে আসেন তৎকালীন স্থানীয় জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়। জমিদারবাবু লাল মিয়াকে প্রায়ই ডেকে পাঠাতেন এবং পুরস্কারস্বরূপ দিতেন ছবি আঁকার রংতুলি। পরে জমিদারবাবুই তাঁকে ভর্তি করিয়ে দেন স্কুলে। কিন্তু লাল মিয়ার স্কুলে পড়ালেখা ভালো লাগত না। স্কুলে গিয়ে ছবি আঁকতেন। সেকালের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিক শ্যামাপ্রাসাদ মুখোপাধ্যায়ের প্রতিকৃতি এঁকে কিশোর লাল মিয়া খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ছবি আঁকার প্রতি অত্যধিক ঝোঁক থাকার কারণে একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে পাড়ি জমান কলকাতার পথে। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বড় ভাই শাহেদ সোহরাওয়ার্দী লাল মিয়ার ছবি দেখে খুব খুশি হন। লাল মিয়ার কলকাতায় কোনো থাকার জায়গা ছিল না বলে তিনি তাঁকে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দেন এবং আর্ট স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। তখন তিনি স্কুলে তাঁর নাম রাখেন শেখ মুহাম্মদ সুলতান_সংক্ষেপে এস এম সুলতান। কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পর এখানেও তাঁর মন টিকল না। বছর তিনেকের মধ্যে তিনি স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন কলকাতার পথে। শুরু হয় ভবঘুরে জীবন। এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। তখন তিনি পাঁচ-দশ টাকার বিনিময়ে সেনাদের ছবি এঁকে দিতেন। ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পরপরই সুলতান চলে যান পাকিস্তানে। ১৯৫১ সালে তিনি করাচি যান। সেখানে স্বনামধন্য এক শিল্পীর সঙ্গে ছবি আঁকার কাজ শুরু করেন। তখনই তিনি দেশ-বিদেশে চিত্রশিল্পী হিসেবে সুনাম অর্জন করতে শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়। পরে তিনি একে একে নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, শিকাগো, বোস্টন এবং পরে লন্ডন ঘুরে ফিরে আসেন তাঁর জন্মভূমি এই বাংলাদেশের নড়াইলে। চিত্রা নদীর তীরে শিশুদের জন্য তিনি একটি স্কুল নির্মাণ করেন। পোষা প্রাণী প্রদর্শনীর জন্য একটি মিনি চিড়িয়াখানাও গড়ে তোলেন। চিরকুমার এস এম সুলতান গ্রামের মানুষের জীবন-জীবিকা, সংগ্রাম-সমস্যা, আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি তাঁর ক্যানভাসে মূর্ত করে তোলেন। ১৯৭৬ সালে ঢাকায় প্রথম তাঁর চিত্র প্রদর্শনী হয়। ১৯৮২ সালে একুশে পদক, ১৯৮৬ সালে চারুশিল্পী সংসদ অ্যাওয়ার্ড এবং ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার অর্জন করেন। প্রতিভাবান এই মহান শিল্পী ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সৃষ্টি আমাদের সম্পদ, গর্ব ও গৌরবের উপকরণ। তাঁর কৃতিত্বের সীমানা অনেক বিস্তৃত। গভীর শ্রদ্ধায় তাঁকে স্মরণ করি।
-শ্রেষ্ঠা
-শ্রেষ্ঠা
No comments