পরিবেশগত সাম্রাজ্যবাদ by ফাহমিদ উর রহমান

দুনিয়াজুড়ে এখন বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের অনভিপ্রেত কাজকর্ম ভূপৃষ্ঠ ও সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে চলেছে। এ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির (এষড়নধষ ডধত্সরহম) প্রতিক্রিয়ায় সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে, বিভিন্ন স্থানে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

পর্বত ও সমুদ্রের হিমবাহ গলতে শুরু করেছে এবং আবহাওয়ার মধ্যে চরম ভাবাপন্নতা দৃশ্যমান হচ্ছে। এর ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান তলিয়ে যাবে। খরা, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, ঝড় ও বন্যায় বিপর্যস্ত হবে আমাদের গ্রহ। ফসল উত্পাদন বিঘ্নিত হবে। পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের সঙ্কটগুলো সম্ভাবনা হিসেবে হাজির হবে।
এসব কিছুই হচ্ছে গ্রিন হাউস এফেক্টের জন্য। গ্রিন হাউস এফেক্টের ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাইঅক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, ক্লোরোফ্লুরো কার্বন প্রভৃতি গ্যাসের নিঃসরণ বেশি মাত্রায় হয়, যা কিনা আবহাওয়ার পরিবর্তন ও ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরের ক্ষতির জন্য দায়ী। এই ওজোন স্তর আবার ভূ-পৃষ্ঠকে মহাকাশের বহু রকমের ক্ষতিকর রশ্মি ও কণা থেকে পৃথিবীকে ছাতার মতো রক্ষা করছে। অন্যথায় প্রাণের অস্তিত্ব সঙ্কটাপন্ন হয়ে উঠত।
জাতিসংঘের ওহঃবত্মড়াবত্হসবহঃধষ চধহবষ ড়হ ঈষরসধঃব ঈযধহমব স্বীকার করেছে এ গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের জন্য দায়ী মূলত জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানি (ঋড়ংংরষ ঋঁবষ) তেল, গ্যাস ও কয়লার মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার এবং নির্বিচারে বনজঙ্গল খতম (উবভড়ত্বংঃধঃরড়হ)। বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন শিল্প বিপ্লবের আগে প্রায় দু’হাজার বছর ধরে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। আজকের পশ্চিমা দেশগুলোকে কেন্দ্র করে যে শিল্পসভ্যতার পত্তন হয়েছে তার মূলে আছে এ জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানি। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে এবং গত শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে এ তাপমাত্রা বৃদ্ধি বিজ্ঞানীদের চোখে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে।
পরিবেশের উপরে হাত দিলে কিংবা পরিবেশের প্রাকৃতিক নিয়মের কোনো ব্যতিক্রম ঘটলে মানুষের অস্তিত্ব যে সঙ্কটাপন্ন হয়ে উঠতে পারে এসব কথা প্রথম আন্দাজ করেছিলেন মধ্যযুগের মুসলিম বিজ্ঞানীরা। আল কিন্দি, কুসতা ইবনে লুকা, মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া রাজি, ইবন আল জাজ্জার, আল তামিমি, ইবনে সিনা, ইবন আল নাফিস প্রমুখের লেখালেখি থেকে স্পষ্ট হয়েছে পরিবেশের বিপর্যয় মানে মানবজাতির বিপর্যয়। তাই তারা বাতাস, মাটি, পানি এমনকি শব্দদূষণ যাতে না হয়, তার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। মুশকিল হচ্ছে, আল্লাহর ওপর খোদকারি করে প্রকৃতির ওপর হানাদারি ও দখলদারি হচ্ছে আজকের জীবাশ্মভিত্তিক আধুনিক শিল্পসভ্যতার ধর্ম। ইউরোপের শিল্প বিপ্লব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমাদের আধুনিক শিক্ষিত প্রগতিশীল শ্রেণীর কথা ফুরোয় না।
এই পুঁজিতান্ত্রিক শিল্পসভ্যতার আবির্ভাব ঘটেছিল ইউরোপের বিখ্যাত রেনেসাঁর ঘটনার ভেতর দিয়ে। তখন বলা হয়েছিল রেনেসাঁর ভেতর দিয়ে মানুষ আরও যুক্তিশীল, বিজ্ঞানমনস্ক ও সংস্কারমুক্ত হয়ে উঠবে। পশ্চিমের সেই সংস্কারমুক্ত মানুষের কর্মকাণ্ড আজ পৃথিবীকে এক মহাবিপর্যয়ের দিকে টেনে নিয়ে এসেছে। পুঁজিতান্ত্রিক শিল্পসভ্যতার কাছে লাভ ও লোভই হচ্ছে শেষ কথা। এদের মুনাফার তাগিদ এত বেশি যে তাদের কাছে আপাত বর্তমানই চূড়ান্ত। এরা ভবিষ্যত্ দেখতে পায় না। মানবজাতি যদি ধ্বংস হয়ে যায় তাতেও এদের কিছু আসে যায় না। বহুজাতিক পুঁজিপতিরা তাদের মুনাফার প্রয়োজনে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। এ কারণেই তারা তেল, গ্যাস ও কয়লার নির্বিচার ব্যবহার করে প্রকৃতিতে যেমন মহাবিপর্যয় ডেকে আনছে, তেমনি তেল ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর দখলদারি নিয়ে দুনিয়াজুড়ে যুদ্ধ-বিগ্রহ-হিংসা-রক্তপাতের মহড়া দিয়ে যাচ্ছে।
মানুষ হচ্ছে পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা। খলিফা হিসেবে সৃষ্টি জগতের রক্ষা ও বিকাশের দায়িত্ব মানুষের। সেই রক্ষা ও বিকাশের দায় না নিয়ে একে ধ্বংস ও বিনাশ করার সঙ্গে যে বিরোধ আজ ঘটছে, সেখানে এসে মানবজাতির তাবত্ নীতি-নৈতিকতা এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। জীবাশ্মভিত্তিক এ হানাদারি পশ্চিমা সভ্যতা টিকিয়ে রেখে মানুষ ও প্রকৃতির মুক্তি আদৌ সম্ভব নয়। প্রাণ ও পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে মানুষের দায় অপরিসীম। সে কারণে জীবাশ্মভিত্তিক পুঁজিতান্ত্রিক শিল্পসভ্যতার বিপরীতে নতুন এক প্রাণবান সভ্যতার উত্থান এ মুহূর্তে জরুরি হয়ে উঠেছে।
দুই.
জীবাশ্মভিত্তিক শিল্পসভ্যতা জেগে উঠেছে তেল, গ্যাস ও কয়লার বিভিন্ন রকম ব্যবহারের ভেতর দিয়ে। তেল, গ্যাস, কয়লার ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে বড়-বড় পাওয়ার প্ল্যান্ট, কেমিক্যাল প্ল্যান্ট, তেল শোধনাগার, পিভিসি ফ্যাক্টরি, প্লাসটিক ফ্যাক্টরি ও নানা রকম মেটাল ফ্যাক্টরি। এসব শিল্প স্থাপনাগুলো আজ বিশ্বজুড়ে একত্রে বাতাস, পানি, মাটি দূষণের জন্য দায়ী। এ ছাড়া মোটরগাড়ি থেকে নিঃসরিত গ্যাস অবিরত বায়ু দূষণ করছে। শিল্প কলকারখানা থেকে নিঃসরিত হচ্ছে কার্বন ডাইঅক্সাইড, সালফার-ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, ক্লোরোফ্লুরো কার্বনের মতো বিষাক্ত গ্যাস। এসব গ্যাস যেমন গ্রিন হাউস এফেক্টের জন্য দায়ী, তেমনি দায়ী এসিড রেনের জন্য। বিষাক্ত গ্যাসগুলো বাতাসের জলীয়বাষ্পের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে অম্লজাত পদার্থ তৈরি করে, যা ভূপৃষ্ঠে নেমে এসে বৃক্ষ, জলজ প্রাণী ও মানুষের নানা অবকাঠামোর অস্তিত্ব সঙ্কটাপন্ন করে তোলার ক্ষমতা রাখে। অন্যদিকে শিল্প কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্যগুলো পানি ও মাটিকে দূষিত করে দিচ্ছে। এর ফলেও জলজ প্রাণী ও মাটির উর্বরতা হুমকির মুখে পড়ছে। এ মুহূর্তে পৃথিবীতে ৪০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন শিল্প বর্জ্য উত্পাদিত হয়। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একাই তৈরি করে ২৫০ মিলিয়ন মেট্রিক টন। তেমনিভাবে পৃথিবীতে যতো কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ হচ্ছে তার এক-চতুর্থাংশের জন্য দায়ী যুক্তরাষ্ট্র, যার জনসংখ্যা পৃথিবীর জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশের বেশি হবে না। আবার এর সঙ্গে যদি অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা দেশগুলোকে যুক্ত করি তাহলে দেখা যাবে উত্পাদিত বর্জ্য পদার্থ ও নিঃসরিত কার্বন ডাইঅক্সাইডের দুই-তৃতীয়াংশের জন্য এরাই দায়ী। অন্যদিকে সবচেয়ে গরিব এক-পঞ্চমাংশ জনসংখ্যা যাদের আছে তাদের কাজের জন্য বাতাসে ছড়াচ্ছে মাত্র দুই-শতাংশ গ্যাস। সুতরাং পুঁজিবাদী দেশগুলোকেই এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দায় নিতে হবে এবং শিল্প কলকারখানার নিঃসরিত বর্জ্য ও গ্যাসের পরিমাণ কমাতে হবে।
কিন্তু শিল্পসভ্যতার অধিপতিরা তাতে রাজি নয়। কারণ কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে মানবজাতির কল্যাণে পরিবেশ দূষণ থেকে পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য তাদের একটুও আগ্রহ নেই। কারণ শিল্পসভ্যতা যে অবাধ কনজুমারিজমকে উস্কে দিচ্ছে, তাতে সেখানকার মানুষ এক উদ্দেশ্যবিহীন, নিষ্ঠুর ও অমানবিক ভোগবাদী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এ ভোগবাদের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসার মানসিক বলটুকু আজ তাদের অবশিষ্ট নেই। এ আরামদায়ক জীবনের উপকরণ সরবরাহকারী শিল্পকারখানা যেমন তারাও বন্ধ হতে দিতে রাজি নয়, তেমনি পুঁজিপতিরাও তাদের উত্পাদন ও বিক্রি বন্ধ করতে রাজি হবে না। মনে রাখতে হবে, শিল্পসভ্যতার সুবিধা ভোগকারী সংখ্যালঘু মানুষের আরাম-আয়েসের জন্য সংখ্যাগুরু মানুষের বাসস্থান, পৃথিবীর পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য আমরা নষ্ট হতে দিতে পারি না। কর্পোরেট পুঁজির পাহারাদার আজকের সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থা হচ্ছে গোটা মানবজাতির শত্রু। এ শত্রুকে পরাস্ত করা ছাড়া মানবজাতির কোনো বিকল্প নেই।
কর্পোরেট পুঁজির অধিপতিদের নিষ্ঠুরতার এসব কথা আলোচনা করে শেষ করা যাবে না। মুনাফার লালসায় এরা ইন্দোনেশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকার আমাজান ও আফ্রিকার বনাঞ্চল ধ্বংস করে কাঠ বিক্রি করছে এবং পরিবেশের ওপর আঘাত হানছে। এসব এলাকার রেন ফরেস্টগুলো পৃথিবীর আবহাওয়া স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। মুনাফার জন্য এরা শুধু বনাঞ্চল ধ্বংস করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, পৃথিবীর প্রাণবৈচিত্র্যের মধ্যেও ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করে ফেলেছে।
উচ্চফলনশীলতার নামে পুঁজিপতিরা এখন হাইব্রিড বীজ ও বিষাক্ত সার উদ্ভাবন করেছে। আগে আমাদের দেশেই প্রায় পনেরো হাজার রকমের ধান ছিল। এখন সেটা কমতে কমতে সাত/আটটায় এসে দাঁড়িয়েছে। এর ফল হয়েছে দুটো। হাইব্রিড দিয়ে মুনাফাখোর কোম্পানিগুলো যেমন একদিকে প্রচুর বাণিজ্য করে নিচ্ছে, তেমনি কৃষককে পুরোপুরি কোম্পানিনির্ভর করে তুলেছে। আবার অন্যদিকে হাইব্রিড ও বিষাক্ত সার প্রয়োগে জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। এভাবে পুঁজিবাদীরা এমন এক টেকনোলজি নিয়ে এসেছে যেখানে আমাদের কৃষক, জনগণ ও রাষ্ট্রের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অন্যদিকে এ টেকনোলজি আমাদের পরিবেশ নষ্ট করছে, স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বাড়াচ্ছে এবং বিষাক্ত সার প্রয়োগে মাছ মরে যাচ্ছে। তাই আমাদের প্রাণবৈচিত্র্যভিত্তিক এমন উত্পাদন ব্যবস্থার বিকাশ ঘটাতে হবে, যার ফলে সত্যিকারের ফলন বাড়বে। মাছও মরবে না, আবার কৃষকও পুঁজিপতিদের কৃপাধন্য হয়ে থাকবে না। পরিবেশ দূষণের অন্যতম আরেকটি কারণ হচ্ছে পরমাণু বর্জ্য। চেরনোবিল ও থ্রি-আইল্যান্ডের পারমাণবিক দুর্ঘটনা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে এর প্রতিক্রিয়া কত ভয়ানক হতে পারে। হিরোশিমা ও নাগাসাকির উদাহরণ তো আমাদের চোখের সামনেই আছে। ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময় পরাশক্তিগুলো প্রতিযোগিতামূলকভাবে পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছে। ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসানের পরও পুঁজিবাদী বিশ্ব পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা তো কমায়ইনি, বরং উত্তরোত্তর এর প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটিয়ে চলেছে। এর একটাই উদ্দেশ্য, পারমাণবিক অস্ত্রকে নিজেদের একচ্ছত্র অধিকারে রেখে সারা পৃথিবীর মানুষের ওপর ছড়ি ঘুরানো, অন্যদিকে পৃথিবীর সম্পদ নির্বিচারে লুণ্ঠন। এদের অপরাধের মাত্রা এতদূর গড়িয়েছে ইদানীংকালের সব যুদ্ধে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র ও গুলিগোলায় নিঃশেষিত ইউরোনিয়ামের (উবঢ়ষবঃবফ টত্ধহরঁস) ব্যবহার করছে। এর সুদূরপ্রসারি প্রভাব হলো বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র, গুলিগোলা যেখানে পড়েছে সেখানকার পরিবেশ বিপর্যয় তো ঘটছেই, আবার সেখানে বসবাসকারী মানুষ ভবিষ্যতে তেজষ্ক্রিয়তাজনিত দূরারোগ্য ব্যাধিতেও ভুগবে। আজকে ইরাকের সাধারণ মানুষ এরই প্রভাবে নানা রকম ক্যান্সারে ভুগতে শুরু করেছে। ভাবটা এমন—মিসাইলে মরো বা ক্যান্সারে তাতে কিছু আসে যায় না। এই হচ্ছে পশ্চিমা সভ্যতা, আধুনিক সভ্যতা, যুক্তিবাদী সভ্যতার আসল চেহারা।
তিন.
পুঁজিতান্ত্রিক শিল্পসভ্যতার আগ্রাসী ক্ষুধা মেটাতে আজ পৃথিবীর মানুষ নতুন এক কেয়ামতের মুখোমুখি হয়েছে। এ সভ্যতার মহারথীরাই আজ পৃথিবীকে চালাচ্ছে। তাদের কারণেই আজ পৃথিবীর পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। এই দূষণ জৈবিক ও নৈতিক উভয় অর্থেই। একদিকে নিজেদের অপকর্মের কারণে পশ্চিমের মহারথীরা পৃথিবীর পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের গুরুতর সংকট তৈরি করে ফেলেছে, অন্যদিকে সব রকমের নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বর্জনকারী প্রকট মিথ্যুক এ সভ্যতা মানুষের এতকালের সব অর্জনকে পণ্ড করে দেয়ার জন্য উন্মাদের মতো হামলে পড়েছে। এদের কাণ্ডজ্ঞানহীনতা ও স্বার্থপরতার জন্য পৃথিবীর মানুষ যেমন ডুবতে বসেছে, তেমনি তাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মও অরক্ষিত হয়ে পড়েছে।
পশ্চিমের এক গভীর ধর্ম বিশ্বাসী কবি টি এস এলিয়ট এ পুঁজিতান্ত্রিক শিল্পসভ্যতার সঙ্কটের দিকে ইঙ্গিত করে তার কবিতায় একে নামাঙ্কিত করেছিলেন ডধংঃব খধহফ-নিষম্ফলা জমি। তার কাছে মনে হয়েছিল, এ সভ্যতা অন্তঃসারশূন্য হয়ে যাচ্ছে। এর ভেতরে কিছু থাকছে না। এর থেকে উত্তরণের জন্য তিনি ধর্মের শাশ্বত মূল্যবোধগুলোর পুনরুজ্জীবনের ওপর জোর দিয়েছিলেন।
পশ্চিমের যুক্তিশীল মানুষ এসব কথাবার্তাকে এতকাল হেঁয়ালি বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও আজ তার মূল্যকে অস্বীকার করা যাচ্ছে না। পরিবেশ রক্ষার্থে, মানবজাতিকে বাঁচাতে, সভ্যতাকে ধরে রাখতে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদকে প্রতিহত করার কোনো বিকল্প নেই। এই ভোগবাদী, আত্মস্বার্থপর সভ্যতার বদলে এক ত্যাগশীল, সহানুভূতিপ্রবণ, মানবিক সভ্যতার উত্থানের প্রয়োজন। ধর্মের শাশ্বত মূল্যবোধগুলোকে মানুষের জীবনে ফিরিয়ে আনা গেলে সেটা সম্ভব হতে পারে। পশ্চিমের যুক্তিবাদী মানুষ ধর্মের শাশ্বত সত্যের চেয়ে আপাত সত্যের ওপর নজর দিতে গিয়ে মানবজাতিকে ধ্বংসের কিনারে এনে ঠেকিয়েছেন। মানবজাতির স্বার্থে আজ তাই পৃথিবীর তাবত্ শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদকে উত্খাত করার লড়াইয়ে শরিক হতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.