চারদিক-শতবর্ষে চট্টগ্রাম সমিতি ও মেজবান
বছরজুড়েই তো ছিল নানা অনুষ্ঠান। চট্টগ্রাম সমিতি, ঢাকা তাদের ১০০ বছর পূর্ণ করল এ বছর। সমিতির জন্য এটি একটি বিরাট সাফল্য তো বটেই, চট্টগ্রামের মানুষের জন্যও এটি একটি বড় আনন্দের ব্যাপার। চট্টগ্রাম সমিতি চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে বছরজুড়ে শতবর্ষ উদ্যাপন করে।
২ ও ৩ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা ও মেজবানের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এই আয়োজন। ধানমন্ডি সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে দুই দিনের আয়োজনে রয়েছে চট্টগ্রাম সমিতির ইতিহাস গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন, মহেশখালীর পানের দোকান, শুঁটকির দোকান, বলীখেলা, কবির লড়াই, মাইজভান্ডারী গান, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান, নাটকসহ নানা কিছু। চট্টগ্রাম সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় গান করবে এলআরবি, সোলস, রেনেসাঁ, শাকিলা জাফর, রবি চৌধুরী ও রন্টি।
বছরজুড়ে আয়োজনের মধ্যে ছিল, মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামবিষয়ক সেমিনার, অগ্নিযুগে চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহবিষয়ক আলোচনা সভা। এ ছাড়া সেমিনার হয়েছে ‘জাতীয় সমৃদ্ধির স্বার্থে চট্টগ্রামের উন্নয়ন অপরিহার্য’, ‘সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতায় চট্টগ্রাম’, ‘চট্টগ্রামের সমাজজীবনে সুফিবাদের প্রভাব’ বিষয়ে। ক্রেস্ট ও সম্মাননা দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম সমিতির দাতাদের। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল চট্টল লেখক সম্মেলন। এতে চট্টগ্রামের প্রায় ২০০ কবি ও লেখকের লেখা বই প্রদর্শিত হয় এবং তাঁরা আমন্ত্রিত হন। শতবর্ষ উৎসব উদ্যাপন পরিষদের আহ্বায়ক রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক বলেন, মোসলেম ছাত্র সমিতি কালের বিবর্তনে শতবর্ষ পূর্ণ করছে। স্বাভাবিকভাবে যা কিছু আয়োজন, তার সব কিছুতেই রয়েছে কিছুটা বাড়তি জাঁকজমকের ছোঁয়া। সবকিছুই অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি উজ্জ্বল অথচ ভাবগম্ভীর ও মর্যাদাপূর্ণ।
প্রতিবছরের মতো এবারো মেজবানের আয়োজন করেছে চট্টগ্রাম সমিতি। ৩ ডিসেম্বর এই মেজবানে আমন্ত্রিত অতিথির সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। ১৬০ মণ গরুর মাংস ও ১০ মণ ছাগলের মাংস থাকছে মেজবানে। চাল, তেল ও নুনের হিসাব না-ই বা বললাম! চট্টগ্রামের মেজবানের একটা আলাদা ঐতিহ্য রয়েছে। কেন এই ঐতিহ্য বা আকর্ষণ ? আসলে মেজবান হচ্ছে ইচ্ছেমতো খাওয়া। শুধু ভাত আর মাংসের আকর্ষণ যেকোনো খাবারের চেয়ে যে বেশি হতে পারে, সেটা মেজবান না দেখলে বোঝা যাবে না। মেজবান মূলত গরুর মাংসের সমাহার। মাংসের নানা পদ দিয়ে খাওয়ানো হয় আমন্ত্রিতদের। মেজবানের জন্য চট্টগ্রামবাসী ভোজনরসিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। সে অর্থে চট্টগ্রাম সমিতির মেজবানের আলাদা ঐতিহ্য তো রয়েছেই, এ ছাড়া চট্টগ্রাম অঞ্চলে নানা উৎসবে মেজবান হয়। মেজবানের সঙ্গে মূলত মুসলমান সম্প্রদায়ের সংযোগ থাকলেও এখন তা সব সম্প্রদায়ের কাছেই আকর্ষণীয়। চট্টগ্রামে আকিকা, খতনা বা চল্লিশার সময় মেজবানের আয়োজন বেশি দেখা যায়। এ ছাড়া অনেকে নিজের বিত্তের পরিচয় দিতেও মেজবানের আয়োজন করে থাকেন। চট্টগ্রাম সমিতির এই মেজবান আকর্ষণীয় করতে চট্টগ্রাম থেকে বাবুর্চি আনা হয়। চট্টগ্রামের বাইরে অনেক অতিথির মুখেও মেজবানের প্রশংসা শোনা যায়।
চট্টগ্রাম সমিতি গত ১০০ বছরে নানা কাজ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়া, চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মাননা, ঢাকায় থাকা চট্টগ্রামবাসীর নানা প্রয়োজনে বাড়িয়ে দিয়েছে সহায়তার হাত। এ ছাড়া চট্টগ্রামবাসীর নানা দাবি জাতীয়ভাবে তুলে ধরেছে নানা সময়। সমিতির প্রথম সভাপতি ছিলেন আমানত খান। বর্তমান সভাপতি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ নুরুল ইসলাম। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে অবিভক্ত বাংলার প্রশাসনিক কাঠামো ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক। চট্টগ্রামের অনেক লোক ব্যবসা, চাকরি ও পড়ালেখার কারণে কলকাতায় থাকতেন। কারণ রাজধানী কলকাতা ছিল উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। তাই উচ্চশিক্ষার জন্য যাঁরা কলকাতা যেতেন, তাঁদের ভর্তি, থাকা-খাওয়া ইত্যাদির জন্য নানা সমস্যা হতো। সে সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট ছিলেন অনেকে। সে সময় শিক্ষাদরদী ও সমাজসচেতন ব্যক্তি খান বাহাদুর মুহাম্মদ ইব্রাহিম ও তাঁর সহযোগীদের উদ্যোগে চট্টগ্রাম মোসলেম ছাত্র সমিতি গড়ে ওঠে। এই সমিতির পক্ষ থেকে কলকাতায় যাঁরা যেতেন, তাঁদের নানাভাবে সহায়তা করা হতো। ১৯৩৮ সালে সমিতি সম্প্রসারিত হলে এর নাম হয় চট্টগ্রাম মোসলেম ছাত্র জনসমিতি। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর সমিতি ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। দেশ ভাগ হওয়ার পর ১৯৫৪ সালে সমিতির নিয়মাবলি সংশোধনের ফলে এর নতুন নাম হয় ইসলামাবাদ সমিতি, ঢাকা। ১৯৬৩ সালে আবারও সংশোধন হয়। নতুন নাম হয় চট্টগ্রাম সমিতি, ঢাকা। সমিতির মূল স্লোগান হচ্ছে, ‘জাতীয় সমৃদ্ধির স্বার্থেই চট্টগ্রামের উন্নয়ন অপরিহার্য’। এখন ঢাকার তোপখানা রোডে ১০ তলাবিশিষ্ট সমিতির নিজস্ব ভবন রয়েছে। হাজার বছরের ধারাবাহিকতায় আপন মহিমায় উজ্জ্বল চট্টগ্রাম। এখানকার বিপ্লবী সন্তানেরা যূথবদ্ধভাবে ঠেকিয়ে দিয়েছে সমাজ তথা রাষ্ট্রের অনেক অপচেষ্টা। তাই তো মলয় ঘোষ দস্তিদার লিখেছেন, ‘আঁরা চাঁটগাইয়া নওজোয়ান, দইয্যার কূলত বসত ঘরি-শিনা দি ঠেগায় ঝড় তুয়ান।’
শান্তনু চৌধুরী
shantanu.reporter@gmail.com
বছরজুড়ে আয়োজনের মধ্যে ছিল, মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামবিষয়ক সেমিনার, অগ্নিযুগে চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহবিষয়ক আলোচনা সভা। এ ছাড়া সেমিনার হয়েছে ‘জাতীয় সমৃদ্ধির স্বার্থে চট্টগ্রামের উন্নয়ন অপরিহার্য’, ‘সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতায় চট্টগ্রাম’, ‘চট্টগ্রামের সমাজজীবনে সুফিবাদের প্রভাব’ বিষয়ে। ক্রেস্ট ও সম্মাননা দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম সমিতির দাতাদের। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল চট্টল লেখক সম্মেলন। এতে চট্টগ্রামের প্রায় ২০০ কবি ও লেখকের লেখা বই প্রদর্শিত হয় এবং তাঁরা আমন্ত্রিত হন। শতবর্ষ উৎসব উদ্যাপন পরিষদের আহ্বায়ক রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক বলেন, মোসলেম ছাত্র সমিতি কালের বিবর্তনে শতবর্ষ পূর্ণ করছে। স্বাভাবিকভাবে যা কিছু আয়োজন, তার সব কিছুতেই রয়েছে কিছুটা বাড়তি জাঁকজমকের ছোঁয়া। সবকিছুই অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি উজ্জ্বল অথচ ভাবগম্ভীর ও মর্যাদাপূর্ণ।
প্রতিবছরের মতো এবারো মেজবানের আয়োজন করেছে চট্টগ্রাম সমিতি। ৩ ডিসেম্বর এই মেজবানে আমন্ত্রিত অতিথির সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। ১৬০ মণ গরুর মাংস ও ১০ মণ ছাগলের মাংস থাকছে মেজবানে। চাল, তেল ও নুনের হিসাব না-ই বা বললাম! চট্টগ্রামের মেজবানের একটা আলাদা ঐতিহ্য রয়েছে। কেন এই ঐতিহ্য বা আকর্ষণ ? আসলে মেজবান হচ্ছে ইচ্ছেমতো খাওয়া। শুধু ভাত আর মাংসের আকর্ষণ যেকোনো খাবারের চেয়ে যে বেশি হতে পারে, সেটা মেজবান না দেখলে বোঝা যাবে না। মেজবান মূলত গরুর মাংসের সমাহার। মাংসের নানা পদ দিয়ে খাওয়ানো হয় আমন্ত্রিতদের। মেজবানের জন্য চট্টগ্রামবাসী ভোজনরসিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। সে অর্থে চট্টগ্রাম সমিতির মেজবানের আলাদা ঐতিহ্য তো রয়েছেই, এ ছাড়া চট্টগ্রাম অঞ্চলে নানা উৎসবে মেজবান হয়। মেজবানের সঙ্গে মূলত মুসলমান সম্প্রদায়ের সংযোগ থাকলেও এখন তা সব সম্প্রদায়ের কাছেই আকর্ষণীয়। চট্টগ্রামে আকিকা, খতনা বা চল্লিশার সময় মেজবানের আয়োজন বেশি দেখা যায়। এ ছাড়া অনেকে নিজের বিত্তের পরিচয় দিতেও মেজবানের আয়োজন করে থাকেন। চট্টগ্রাম সমিতির এই মেজবান আকর্ষণীয় করতে চট্টগ্রাম থেকে বাবুর্চি আনা হয়। চট্টগ্রামের বাইরে অনেক অতিথির মুখেও মেজবানের প্রশংসা শোনা যায়।
চট্টগ্রাম সমিতি গত ১০০ বছরে নানা কাজ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়া, চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মাননা, ঢাকায় থাকা চট্টগ্রামবাসীর নানা প্রয়োজনে বাড়িয়ে দিয়েছে সহায়তার হাত। এ ছাড়া চট্টগ্রামবাসীর নানা দাবি জাতীয়ভাবে তুলে ধরেছে নানা সময়। সমিতির প্রথম সভাপতি ছিলেন আমানত খান। বর্তমান সভাপতি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ নুরুল ইসলাম। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে অবিভক্ত বাংলার প্রশাসনিক কাঠামো ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক। চট্টগ্রামের অনেক লোক ব্যবসা, চাকরি ও পড়ালেখার কারণে কলকাতায় থাকতেন। কারণ রাজধানী কলকাতা ছিল উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। তাই উচ্চশিক্ষার জন্য যাঁরা কলকাতা যেতেন, তাঁদের ভর্তি, থাকা-খাওয়া ইত্যাদির জন্য নানা সমস্যা হতো। সে সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট ছিলেন অনেকে। সে সময় শিক্ষাদরদী ও সমাজসচেতন ব্যক্তি খান বাহাদুর মুহাম্মদ ইব্রাহিম ও তাঁর সহযোগীদের উদ্যোগে চট্টগ্রাম মোসলেম ছাত্র সমিতি গড়ে ওঠে। এই সমিতির পক্ষ থেকে কলকাতায় যাঁরা যেতেন, তাঁদের নানাভাবে সহায়তা করা হতো। ১৯৩৮ সালে সমিতি সম্প্রসারিত হলে এর নাম হয় চট্টগ্রাম মোসলেম ছাত্র জনসমিতি। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর সমিতি ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। দেশ ভাগ হওয়ার পর ১৯৫৪ সালে সমিতির নিয়মাবলি সংশোধনের ফলে এর নতুন নাম হয় ইসলামাবাদ সমিতি, ঢাকা। ১৯৬৩ সালে আবারও সংশোধন হয়। নতুন নাম হয় চট্টগ্রাম সমিতি, ঢাকা। সমিতির মূল স্লোগান হচ্ছে, ‘জাতীয় সমৃদ্ধির স্বার্থেই চট্টগ্রামের উন্নয়ন অপরিহার্য’। এখন ঢাকার তোপখানা রোডে ১০ তলাবিশিষ্ট সমিতির নিজস্ব ভবন রয়েছে। হাজার বছরের ধারাবাহিকতায় আপন মহিমায় উজ্জ্বল চট্টগ্রাম। এখানকার বিপ্লবী সন্তানেরা যূথবদ্ধভাবে ঠেকিয়ে দিয়েছে সমাজ তথা রাষ্ট্রের অনেক অপচেষ্টা। তাই তো মলয় ঘোষ দস্তিদার লিখেছেন, ‘আঁরা চাঁটগাইয়া নওজোয়ান, দইয্যার কূলত বসত ঘরি-শিনা দি ঠেগায় ঝড় তুয়ান।’
শান্তনু চৌধুরী
shantanu.reporter@gmail.com
No comments