সংবাদ মাধ্যম, সরকার এবং নিজের পায়ে কুড়াল মারার প্রবাদ by শাহ আহমদ রেজা
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বলা হয়, সরকার, পার্লামেন্ট বা সংসদ এবং বিচার বিভাগের পাশাপাশি সংবাদপত্রও রাষ্ট্রের একটি প্রধান স্তম্ভ। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বছর না পেরোতেই আওয়ামী লীগ সরকার সম্প্রতি সে স্তম্ভটিকে আক্রমণ করে বসেছে। ‘আদা-জল’ খেয়ে নেমে পড়েছে সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে।
শুধু সংবাদপত্র নয়, সরকার একই সঙ্গে বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশনেরও কণ্ঠরোধ করার পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। এমনটাই অবশ্য ধারণা করা হয়েছিল। কারণ, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীন ভূমিকার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের ন্যক্কারজনক নীতি ও মনোভাবের প্রমাণ অতীতেও পাওয়া গেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর সাপ্তাহিক ‘হক-কথা’ থেকে শুরু করে তত্কালীন বিরোধী দল জাসদের মুখপত্র দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’সহ অসংখ্য সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। একাধিক সম্পাদক এবং বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে তখন কারাগারে যেতে হয়েছিল। এতেও ‘বাগে’ আনতে না পেরে বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েমের মধ্য দিয়ে চারটি ছাড়া সব সংবাদপত্রকেই কবর দিয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার।
মূলত সে নীতি অনুসরণ করছে বলে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্নে গণতন্ত্রসম্মত অবস্থান নিতে পারেনি। পার্থক্য হলো, তখন ছিল ‘এক নেতার এক দেশ’। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের সুফল হিসেবে সংবাদ মাধ্যম অনেকাংশে সাংবিধানিক নিরাপত্তা অর্জন করেছে। এখন আর কথায় কথায় সংবাদপত্রের প্রকাশনা ও টিভির প্রচার নিষিদ্ধ করা যায় না। এজন্যই স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী-বাকশাল আমলের মতো নিষিদ্ধ করার ‘সোজা পথে’ না হেঁটে বর্তমান সরকার নিয়েছে ‘বাঁকা পথে’ পা বাড়ানোর কৌশল। মামলা আর সাংবাদিক নির্যাতনের ভয়ঙ্কর পথে এগোচ্ছে সরকার। এবার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সরকার একদিকে পুলিশ ও দলীয় গুণ্ডা-সন্ত্রাসীদের দিয়ে সাংবাদিকদের ওপর হামলা এবং শারীরিক নির্যাতন চালাচ্ছে, অন্যদিকে একে-ওকে দিয়ে মামলার পর মামলা চাপিয়ে চেষ্টা করছে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করার।
সম্প্রতি সরকারের এই নীতি-কৌশলের শিকার হয়েছে দৈনিক আমার দেশ। দৈনিকটি সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এবং জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী সম্পর্কে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। এতে বলা হয়েছিল, সজীব ওয়াজেদ জয় এবং তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী পাঁচ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘুষ খেয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে এবং বিষয়টি নিয়ে বিভাগীয় তদন্ত চলছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, রিপোর্টে কিন্তু বলা হয়নি যে দু’জন সত্যি সত্যি ঘুষ খেয়েছেন। বরং এটুকুই শুধু বলা হয়েছিল যে, তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ খাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে যে বিভাগীয় তদন্ত চলছে সে কথাও ছিল রিপোর্টে।
কিন্তু এতেই একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছেন ক্ষমতাসীনরা। প্রথমে এসেছে হুমকি দেয়ার পালা। পিলখানা হত্যাকাণ্ডে বিশেষ ভূমিকা পালনের জন্য ‘বিখ্যাত’ হয়ে ওঠা প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির নানক আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে নাম ধরে হুমকি দিয়েছেন। প্রতিবাদ ও সমালোচনার মুখে পরে বলেছেন, হুমকি নয়, তিনি নাকি ‘জানান’ দিয়েছেন! এই ‘জানান’-এর ইঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার এম আবদুল্লাহ। তার ওপর পরপর দু’বার আক্রমণ চালিয়েছে হেলমেট পরা মোটরসাইকেল আরোহীরা। তারা আসলে কারা সে কথা জানতে সময় লাগেনি। হেলমেটধারীদের পরিচিতি সম্পর্কে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি শওকত মাহমুদের বক্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে। সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতিবাদে ২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সমাবেশে তিনি বলেছেন, বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনই সাংবাদিক এম আবদুল্লাহর ওপর হামলা চালিয়েছে। কথাটা অযথা বলেননি শওকত মাহমুদ। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক নামের আড়ালে ক্ষমতা দখলকারী উদ্দিন সাহেবদের সময়ও ওই গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন একই স্টাইলে এবং প্রধানত একই এলাকায় এর-ওর ওপর হামলা চালিয়ে ‘খ্যাতি’ অর্জন করেছিল।
এই অভিযোগ সত্য হলে বিষয়টিকে গুরুতর এবং ভয়াবহ না বলে উপায় থাকে না। কারণ, মাঝারি মানের সাবেক ব্যাংকার ফখরুদ্দীন আহমদকে সামন রেখে এবং ‘সেনা সমর্থিত’ সরকারের আড়াল নিয়ে সে সময় দেশ আসলে চালিয়েছেন জেনারেল মইন উ আহমেদ। তার নির্দেশে ওই গোয়েন্দা সংস্থা রাজনীতিক থেকে ব্যবসায়ী পর্যন্ত সবার ওপর বিনাবিচারে নির্যাতন চালিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সাংবাদিকরাও রেহাই পাননি। সে একই গোয়েন্দা সংস্থাকে এখনও, ‘নির্বাচিত’ গণতান্ত্রিক সরকারের সময়ও ব্যবহার করা হলে বুঝতে হবে, এ সরকারও পরোক্ষ সামরিক শাসনই চালাতে চাচ্ছে। কারণ, সত্যিকার কোনো গণতান্ত্রিক সরকার কখনও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাকে কাজে লাগায় না। বিশেষ করে সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে তো বটেই। বলা হচ্ছে, শেখ রেহানার দেবর এবং আগেই অবসরে যাওয়া সত্ত্বেও হালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে নতুন করে ‘পদোন্নতিপ্রাপ্ত’ তারেক সিদ্দিকীর মাধ্যমে সরকার শুধু সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাকে নয়, অন্য সব গোয়েন্দা সংস্থাকেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করছে। গণতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি নিঃসন্দেহে ভয়াবহ।
এদিকে হুমকি ও হামলার পাশাপাশি একযোগে শুরু হয়েছে মামলা চাপানোর প্রতিযোগিতা। আওয়ামী পরিবারের লোকজন দেশের নানা স্থানে আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, প্রকাশক এবং রিপোর্টারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। এখনও মামলা দায়ের করার কার্যক্রম চলছে। এ যেন ‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার’ মতো ব্যাপার-স্যাপার! মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ডজন দেড়েকে। এই প্রক্রিয়ায় হাস্যরসেরও সৃষ্টি করেছেন ক্ষমতাসীনরা। যেমন নাটোরের এক কীর্তিমান নেতা ১০ হাজার কোটি ডলারের ক্ষতিপূরণ দাবি করে বসেছেন। তিনি লক্ষ্যই করেননি যে, টাকার দেশ বাংলাদেশে ডলারে ক্ষতিপূরণ চাওয়া যায় না। সেই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, অংকে ১০ হাজার কোটি লিখতে হলে এবং ডলারকে টাকায় রূপান্তরিত করতে হলে ১০-এর পর ক’টি শূন্য বসাতে হবে সে সম্পর্কে ওই কীর্তিমানের কোনো ধারণা আছে কি-না? তাছাড়া তিনি সম্ভবত জানেনই না যে, ডলারের ক্ষেত্রে লাখ বা কোটির হিসাব চলে না। বলতে হয় মিলিয়ন, বিলিয়ন বা ট্রিলিয়ন হিসেবে।
বিষয়টিকে হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ, এখানেও বিশেষ করে বিচার বিভাগের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকারের নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটেছে। এর আগে রিমান্ড সংক্রান্ত বিভিন্ন রিপোর্টে এ অভিযোগ সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, রিমান্ড মঞ্জুর করা না করা সম্পূর্ণরূপে বিচারকের এখতিয়ার হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিচারকরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। এ বিষয়ে অভিযোগ উঠেছে অনেক উপলক্ষেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিচারকদের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক মামলায় বিচারকদের ওপর ‘চাপ’ থাকে। এই ‘চাপ’ নিশ্চয়ই রাস্তার লোকজন দেয় না। ক্ষমতাসীনদের চাপে নিম্ন আদালতের বিচারকরা কতটা অসহায় হয়ে পড়েছেন, তার আরও একটি প্রমাণ পাওয়া গেছে নাটোরের ঘটনায়। ১০ হাজার কোটি ডলারের ক্ষতিপূরণ দেয়ার মতো বাস্তবতা বিবর্জিত ও রাজনৈতিক উদ্দেশে দায়ের করা মামলায়ও একজন বিচারককে সমন জারি করতে হয়েছে। অথচ স্বাভাবিক অবস্থায় কোনো বিচারকেরই সমন জারি করার কথা নয়। করলেও বিচারক মামলাকারীকে অবশ্যই টাকার অংকে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার নির্দেশ দিতেন। জানতে চাইতেন, ১০ হাজার কোটি ডলারে কত টাকা হয় এবং এত বিপুল পরিমাণ টাকা কেউ ক্ষতিপূরণের জন্য দাবি করতে পারে কি-না? কিন্তু নাটোরের ওই বিচারকের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হয়নি। কারণ, আওয়ামী লীগ সরকার আসলেও বিচারকদের ‘চাপে’ রেখেছে। উল্লেখ্য, ক্ষমতাসীনরা আজকাল মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল সর্বোচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠতেও দ্বিধা করছেন না (সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী সম্পর্কে আইনমন্ত্রী ও আইন প্রতিমন্ত্রীর সাম্প্রতিক কটূক্তি স্মরণ করা যেতে পারে)। অর্থাত্ সব মিলিয়েই সরকার দেশের বিচার বিভাগকে তছনছ করে ফেলেছে। এর ফলে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, জনগণও হারাচ্ছে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার। সরকার একথাও বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, পুলিশ ও আদালতকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে। স্বাধীন থাকতে দেয়া হবে না। সে উদ্দেশ্য থেকেই সরকার আমার দেশসহ সংবাদপত্রকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে।
এভাবেই সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের অভিযান এগিয়ে চলেছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, দৈনিক আমার দেশ আক্রান্ত হয়েছে আসলে সজীব ওয়াজেদ জয় সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করায়। বিষয়টি বিচারাধীন থাকায় এ নিয়ে কথা বাড়ানোর পরিবর্তে এখানে সংক্ষেপে একটি তথ্য জানিয়ে রাখা দরকার। তথ্যটি হলো, ক্ষমতাসীনরা কিন্তু বিভাগীয় তদন্তের ব্যাপারটি অস্বীকার করতে পারেননি। না পারার কারণ, আসলেও বিভাগীয় তদন্ত চলছে। অর্থাত্ প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এবং জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ঘুষ খেয়েছেন বলে সত্যি সত্যি অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ না উঠে থাকলে বিভাগীয় তদন্ত হচ্ছে কেন?
শুধু সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে নয়, সরকার বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভিগুলোর পেছনেও শক্তভাবেই নেমেছে। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, গাইডলাইন বা পরামর্শের আড়াল নিয়ে স্যাটেলাইট টিভিগুলোর ওপর সম্প্রতি কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার। এ ব্যাপারে সবার ওপর রয়েছে উদ্দিন সাহেবদের আমলে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা টকশো। নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গাইডলাইনে বলা হয়েছে, টকশোগুলো নাকি অপরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে প্রচারিত হচ্ছে এবং এর ফলে নাকি দেশের আর্থ-সামজিক অবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে! এজন্যই নির্দেশনা এসেছে, ভিন্নমতের অর্থাত্ সরকারবিরোধী কাউকে টকশোতে আনা যাবে না। গাইডলাইনে বলা হয়েছে, কোনো ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য, অন্ধ ও পক্ষপাতদুষ্ট মতামত এবং নির্বাচিত সরকারের প্রতি অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে—এমন কোনো বক্তব্য প্রচার করা থেকে টিভিগুলোকে বিরত থাকতে হবে। কোনো বিশেষ লক্ষ্যে বক্তব্য দেয়ার জন্য অতিথিকে ‘ধাবিত’ করা চলবে না। অতিথি নির্বাচনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, একই অতিথিকে বারবার আমন্ত্রণ জানানো যাবে না, টকশো অবশ্যই সঙ্কলিত অর্থাত্ আগে থেকে রেকর্ডেড হতে হবে, একদিনে একাধিক টকশো করা চলবে না এবং টকশোতে এসএমএস বা লাইভ টেলিফোন কল সংযোজন করা যাবে না।
পরামর্শের আড়ালে আওয়ামী লীগ সরকারের নির্দেশনায় সচেতন সব মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, এসবের মধ্য দিয়ে সরকার প্রত্যক্ষভাবেই টকশোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ভিন্নমতের বা সরকারবিরোধী কাউকে আনা যাবে না থেকে এসএমএস ও টেলিফোন কল নেয়া যাবে না পর্যন্ত প্রতিটি নির্দেশনাই আসলে নিষেধাজ্ঞার নামান্তর মাত্র। এর ফলে টিভি প্রতিষ্ঠানগুলো তো বটেই, জনগণও সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। অথচ সংবিধান ও গণতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে সরকার এ ধরনের কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে না। কাকে বা কাদের অতিথি করা হবে এবং তিনি বা তারা ঠিক কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন—এ সবই টিভি কর্তৃপক্ষ ও অতিথি-আলোচকদের ব্যাপার। সংবিধান তাদের সে অধিকার দিয়ে রেখেছে। তাছাড়া ‘নির্বাচিত’ হলেই কোনো সরকার সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না এবং গণতন্ত্রসম্মত সমালোচনাকে ‘উস্কানিমূলক’ বা ‘অসন্তোষ সৃষ্টিকারী’ বলা যায় না। কোনো আলোচনা বা কারও বক্তব্য গণতন্ত্র নির্ধারিত সীমানা অতিক্রম করে যায় কি-না এবং তার মধ্য দিয়ে সশস্ত্র বিদ্রোহ বা বিপ্লবের উস্কানি দেয়া হয় কি-না, সেটাই আসলে লক্ষ্য করা দরকার। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার গণতন্ত্রসম্মত সমালোচনাও সহ্য করতে রাজি নয়। সমালোচনা মাত্রকেই সরকার ‘উস্কানিমূলক’ বা ‘অসন্তোষ সৃষ্টিকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ফলে না মেনে উপায় থাকে না যে, নামে নির্বাচিত ও গণতান্ত্রিক সরকার হলেও আওয়ামী লীগ সরকারও ‘সেনা সমর্থিত’ উদ্দিন সাহেবদের মতোই সংবাদ মাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চাচ্ছে। তখন কিছু ব্যক্তিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল, অনেকে হুমকির শিকার হয়েছিলেন। এখন সরকারের যে কোনো সমালোচনাকেই নিষিদ্ধ করার চেষ্টা চলছে। এ ধরনের মনোভাব সাধারণত এমন কোনো সরকারই দেখিয়ে থাকে, যে সরকার নিজের অঙ্গীকার পূরণ করে না বা করতে পারে না এবং ঘোষিত উদ্দেশ্যের বাইরেও যে সরকারের থাকে গোপন এজেন্ডা। থাকে বাইরের কোনো শক্তি বা রাষ্ট্রের কাছে দায়বদ্ধতা।
এ পর্যন্ত এসেই যে কারও নিজের পায়ে কুড়াল মারার প্রবাদ মনে পড়ে যাবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনেক চিন্তা-ভাবনা করেই সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের প্রধান চার স্তম্ভের একটি বানানো হয়েছে। বস্তুত গঠনমূলক সমালোচনা করার এবং দিকনির্দেশনা দেয়ার মাধ্যমে সংবাদপত্র ও টিভিসহ সংবাদ মাধ্যম সব সময় সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষী ও সহযোগীর ভূমিকা পালন করে থাকে। সে সংবাদ মাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা আসলে নিজের পায়ে কুড়াল মারার নামান্তর মাত্র।
লেখক : সাংবাদিক
ই-মেইল : shahahmadreza@yahoo.com
মূলত সে নীতি অনুসরণ করছে বলে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্নে গণতন্ত্রসম্মত অবস্থান নিতে পারেনি। পার্থক্য হলো, তখন ছিল ‘এক নেতার এক দেশ’। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের সুফল হিসেবে সংবাদ মাধ্যম অনেকাংশে সাংবিধানিক নিরাপত্তা অর্জন করেছে। এখন আর কথায় কথায় সংবাদপত্রের প্রকাশনা ও টিভির প্রচার নিষিদ্ধ করা যায় না। এজন্যই স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী-বাকশাল আমলের মতো নিষিদ্ধ করার ‘সোজা পথে’ না হেঁটে বর্তমান সরকার নিয়েছে ‘বাঁকা পথে’ পা বাড়ানোর কৌশল। মামলা আর সাংবাদিক নির্যাতনের ভয়ঙ্কর পথে এগোচ্ছে সরকার। এবার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সরকার একদিকে পুলিশ ও দলীয় গুণ্ডা-সন্ত্রাসীদের দিয়ে সাংবাদিকদের ওপর হামলা এবং শারীরিক নির্যাতন চালাচ্ছে, অন্যদিকে একে-ওকে দিয়ে মামলার পর মামলা চাপিয়ে চেষ্টা করছে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করার।
সম্প্রতি সরকারের এই নীতি-কৌশলের শিকার হয়েছে দৈনিক আমার দেশ। দৈনিকটি সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এবং জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী সম্পর্কে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। এতে বলা হয়েছিল, সজীব ওয়াজেদ জয় এবং তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী পাঁচ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘুষ খেয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে এবং বিষয়টি নিয়ে বিভাগীয় তদন্ত চলছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, রিপোর্টে কিন্তু বলা হয়নি যে দু’জন সত্যি সত্যি ঘুষ খেয়েছেন। বরং এটুকুই শুধু বলা হয়েছিল যে, তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ খাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে যে বিভাগীয় তদন্ত চলছে সে কথাও ছিল রিপোর্টে।
কিন্তু এতেই একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছেন ক্ষমতাসীনরা। প্রথমে এসেছে হুমকি দেয়ার পালা। পিলখানা হত্যাকাণ্ডে বিশেষ ভূমিকা পালনের জন্য ‘বিখ্যাত’ হয়ে ওঠা প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির নানক আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে নাম ধরে হুমকি দিয়েছেন। প্রতিবাদ ও সমালোচনার মুখে পরে বলেছেন, হুমকি নয়, তিনি নাকি ‘জানান’ দিয়েছেন! এই ‘জানান’-এর ইঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার এম আবদুল্লাহ। তার ওপর পরপর দু’বার আক্রমণ চালিয়েছে হেলমেট পরা মোটরসাইকেল আরোহীরা। তারা আসলে কারা সে কথা জানতে সময় লাগেনি। হেলমেটধারীদের পরিচিতি সম্পর্কে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি শওকত মাহমুদের বক্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে। সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতিবাদে ২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সমাবেশে তিনি বলেছেন, বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনই সাংবাদিক এম আবদুল্লাহর ওপর হামলা চালিয়েছে। কথাটা অযথা বলেননি শওকত মাহমুদ। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক নামের আড়ালে ক্ষমতা দখলকারী উদ্দিন সাহেবদের সময়ও ওই গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন একই স্টাইলে এবং প্রধানত একই এলাকায় এর-ওর ওপর হামলা চালিয়ে ‘খ্যাতি’ অর্জন করেছিল।
এই অভিযোগ সত্য হলে বিষয়টিকে গুরুতর এবং ভয়াবহ না বলে উপায় থাকে না। কারণ, মাঝারি মানের সাবেক ব্যাংকার ফখরুদ্দীন আহমদকে সামন রেখে এবং ‘সেনা সমর্থিত’ সরকারের আড়াল নিয়ে সে সময় দেশ আসলে চালিয়েছেন জেনারেল মইন উ আহমেদ। তার নির্দেশে ওই গোয়েন্দা সংস্থা রাজনীতিক থেকে ব্যবসায়ী পর্যন্ত সবার ওপর বিনাবিচারে নির্যাতন চালিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সাংবাদিকরাও রেহাই পাননি। সে একই গোয়েন্দা সংস্থাকে এখনও, ‘নির্বাচিত’ গণতান্ত্রিক সরকারের সময়ও ব্যবহার করা হলে বুঝতে হবে, এ সরকারও পরোক্ষ সামরিক শাসনই চালাতে চাচ্ছে। কারণ, সত্যিকার কোনো গণতান্ত্রিক সরকার কখনও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাকে কাজে লাগায় না। বিশেষ করে সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে তো বটেই। বলা হচ্ছে, শেখ রেহানার দেবর এবং আগেই অবসরে যাওয়া সত্ত্বেও হালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে নতুন করে ‘পদোন্নতিপ্রাপ্ত’ তারেক সিদ্দিকীর মাধ্যমে সরকার শুধু সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাকে নয়, অন্য সব গোয়েন্দা সংস্থাকেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করছে। গণতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি নিঃসন্দেহে ভয়াবহ।
এদিকে হুমকি ও হামলার পাশাপাশি একযোগে শুরু হয়েছে মামলা চাপানোর প্রতিযোগিতা। আওয়ামী পরিবারের লোকজন দেশের নানা স্থানে আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, প্রকাশক এবং রিপোর্টারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। এখনও মামলা দায়ের করার কার্যক্রম চলছে। এ যেন ‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার’ মতো ব্যাপার-স্যাপার! মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ডজন দেড়েকে। এই প্রক্রিয়ায় হাস্যরসেরও সৃষ্টি করেছেন ক্ষমতাসীনরা। যেমন নাটোরের এক কীর্তিমান নেতা ১০ হাজার কোটি ডলারের ক্ষতিপূরণ দাবি করে বসেছেন। তিনি লক্ষ্যই করেননি যে, টাকার দেশ বাংলাদেশে ডলারে ক্ষতিপূরণ চাওয়া যায় না। সেই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, অংকে ১০ হাজার কোটি লিখতে হলে এবং ডলারকে টাকায় রূপান্তরিত করতে হলে ১০-এর পর ক’টি শূন্য বসাতে হবে সে সম্পর্কে ওই কীর্তিমানের কোনো ধারণা আছে কি-না? তাছাড়া তিনি সম্ভবত জানেনই না যে, ডলারের ক্ষেত্রে লাখ বা কোটির হিসাব চলে না। বলতে হয় মিলিয়ন, বিলিয়ন বা ট্রিলিয়ন হিসেবে।
বিষয়টিকে হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ, এখানেও বিশেষ করে বিচার বিভাগের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকারের নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটেছে। এর আগে রিমান্ড সংক্রান্ত বিভিন্ন রিপোর্টে এ অভিযোগ সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, রিমান্ড মঞ্জুর করা না করা সম্পূর্ণরূপে বিচারকের এখতিয়ার হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিচারকরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। এ বিষয়ে অভিযোগ উঠেছে অনেক উপলক্ষেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিচারকদের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক মামলায় বিচারকদের ওপর ‘চাপ’ থাকে। এই ‘চাপ’ নিশ্চয়ই রাস্তার লোকজন দেয় না। ক্ষমতাসীনদের চাপে নিম্ন আদালতের বিচারকরা কতটা অসহায় হয়ে পড়েছেন, তার আরও একটি প্রমাণ পাওয়া গেছে নাটোরের ঘটনায়। ১০ হাজার কোটি ডলারের ক্ষতিপূরণ দেয়ার মতো বাস্তবতা বিবর্জিত ও রাজনৈতিক উদ্দেশে দায়ের করা মামলায়ও একজন বিচারককে সমন জারি করতে হয়েছে। অথচ স্বাভাবিক অবস্থায় কোনো বিচারকেরই সমন জারি করার কথা নয়। করলেও বিচারক মামলাকারীকে অবশ্যই টাকার অংকে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার নির্দেশ দিতেন। জানতে চাইতেন, ১০ হাজার কোটি ডলারে কত টাকা হয় এবং এত বিপুল পরিমাণ টাকা কেউ ক্ষতিপূরণের জন্য দাবি করতে পারে কি-না? কিন্তু নাটোরের ওই বিচারকের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হয়নি। কারণ, আওয়ামী লীগ সরকার আসলেও বিচারকদের ‘চাপে’ রেখেছে। উল্লেখ্য, ক্ষমতাসীনরা আজকাল মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল সর্বোচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠতেও দ্বিধা করছেন না (সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী সম্পর্কে আইনমন্ত্রী ও আইন প্রতিমন্ত্রীর সাম্প্রতিক কটূক্তি স্মরণ করা যেতে পারে)। অর্থাত্ সব মিলিয়েই সরকার দেশের বিচার বিভাগকে তছনছ করে ফেলেছে। এর ফলে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, জনগণও হারাচ্ছে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার। সরকার একথাও বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, পুলিশ ও আদালতকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে। স্বাধীন থাকতে দেয়া হবে না। সে উদ্দেশ্য থেকেই সরকার আমার দেশসহ সংবাদপত্রকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে।
এভাবেই সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের অভিযান এগিয়ে চলেছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, দৈনিক আমার দেশ আক্রান্ত হয়েছে আসলে সজীব ওয়াজেদ জয় সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করায়। বিষয়টি বিচারাধীন থাকায় এ নিয়ে কথা বাড়ানোর পরিবর্তে এখানে সংক্ষেপে একটি তথ্য জানিয়ে রাখা দরকার। তথ্যটি হলো, ক্ষমতাসীনরা কিন্তু বিভাগীয় তদন্তের ব্যাপারটি অস্বীকার করতে পারেননি। না পারার কারণ, আসলেও বিভাগীয় তদন্ত চলছে। অর্থাত্ প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এবং জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ঘুষ খেয়েছেন বলে সত্যি সত্যি অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ না উঠে থাকলে বিভাগীয় তদন্ত হচ্ছে কেন?
শুধু সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে নয়, সরকার বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভিগুলোর পেছনেও শক্তভাবেই নেমেছে। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, গাইডলাইন বা পরামর্শের আড়াল নিয়ে স্যাটেলাইট টিভিগুলোর ওপর সম্প্রতি কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার। এ ব্যাপারে সবার ওপর রয়েছে উদ্দিন সাহেবদের আমলে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা টকশো। নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গাইডলাইনে বলা হয়েছে, টকশোগুলো নাকি অপরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে প্রচারিত হচ্ছে এবং এর ফলে নাকি দেশের আর্থ-সামজিক অবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে! এজন্যই নির্দেশনা এসেছে, ভিন্নমতের অর্থাত্ সরকারবিরোধী কাউকে টকশোতে আনা যাবে না। গাইডলাইনে বলা হয়েছে, কোনো ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য, অন্ধ ও পক্ষপাতদুষ্ট মতামত এবং নির্বাচিত সরকারের প্রতি অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে—এমন কোনো বক্তব্য প্রচার করা থেকে টিভিগুলোকে বিরত থাকতে হবে। কোনো বিশেষ লক্ষ্যে বক্তব্য দেয়ার জন্য অতিথিকে ‘ধাবিত’ করা চলবে না। অতিথি নির্বাচনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, একই অতিথিকে বারবার আমন্ত্রণ জানানো যাবে না, টকশো অবশ্যই সঙ্কলিত অর্থাত্ আগে থেকে রেকর্ডেড হতে হবে, একদিনে একাধিক টকশো করা চলবে না এবং টকশোতে এসএমএস বা লাইভ টেলিফোন কল সংযোজন করা যাবে না।
পরামর্শের আড়ালে আওয়ামী লীগ সরকারের নির্দেশনায় সচেতন সব মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, এসবের মধ্য দিয়ে সরকার প্রত্যক্ষভাবেই টকশোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ভিন্নমতের বা সরকারবিরোধী কাউকে আনা যাবে না থেকে এসএমএস ও টেলিফোন কল নেয়া যাবে না পর্যন্ত প্রতিটি নির্দেশনাই আসলে নিষেধাজ্ঞার নামান্তর মাত্র। এর ফলে টিভি প্রতিষ্ঠানগুলো তো বটেই, জনগণও সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। অথচ সংবিধান ও গণতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে সরকার এ ধরনের কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে না। কাকে বা কাদের অতিথি করা হবে এবং তিনি বা তারা ঠিক কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন—এ সবই টিভি কর্তৃপক্ষ ও অতিথি-আলোচকদের ব্যাপার। সংবিধান তাদের সে অধিকার দিয়ে রেখেছে। তাছাড়া ‘নির্বাচিত’ হলেই কোনো সরকার সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না এবং গণতন্ত্রসম্মত সমালোচনাকে ‘উস্কানিমূলক’ বা ‘অসন্তোষ সৃষ্টিকারী’ বলা যায় না। কোনো আলোচনা বা কারও বক্তব্য গণতন্ত্র নির্ধারিত সীমানা অতিক্রম করে যায় কি-না এবং তার মধ্য দিয়ে সশস্ত্র বিদ্রোহ বা বিপ্লবের উস্কানি দেয়া হয় কি-না, সেটাই আসলে লক্ষ্য করা দরকার। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার গণতন্ত্রসম্মত সমালোচনাও সহ্য করতে রাজি নয়। সমালোচনা মাত্রকেই সরকার ‘উস্কানিমূলক’ বা ‘অসন্তোষ সৃষ্টিকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ফলে না মেনে উপায় থাকে না যে, নামে নির্বাচিত ও গণতান্ত্রিক সরকার হলেও আওয়ামী লীগ সরকারও ‘সেনা সমর্থিত’ উদ্দিন সাহেবদের মতোই সংবাদ মাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চাচ্ছে। তখন কিছু ব্যক্তিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল, অনেকে হুমকির শিকার হয়েছিলেন। এখন সরকারের যে কোনো সমালোচনাকেই নিষিদ্ধ করার চেষ্টা চলছে। এ ধরনের মনোভাব সাধারণত এমন কোনো সরকারই দেখিয়ে থাকে, যে সরকার নিজের অঙ্গীকার পূরণ করে না বা করতে পারে না এবং ঘোষিত উদ্দেশ্যের বাইরেও যে সরকারের থাকে গোপন এজেন্ডা। থাকে বাইরের কোনো শক্তি বা রাষ্ট্রের কাছে দায়বদ্ধতা।
এ পর্যন্ত এসেই যে কারও নিজের পায়ে কুড়াল মারার প্রবাদ মনে পড়ে যাবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনেক চিন্তা-ভাবনা করেই সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের প্রধান চার স্তম্ভের একটি বানানো হয়েছে। বস্তুত গঠনমূলক সমালোচনা করার এবং দিকনির্দেশনা দেয়ার মাধ্যমে সংবাদপত্র ও টিভিসহ সংবাদ মাধ্যম সব সময় সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষী ও সহযোগীর ভূমিকা পালন করে থাকে। সে সংবাদ মাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা আসলে নিজের পায়ে কুড়াল মারার নামান্তর মাত্র।
লেখক : সাংবাদিক
ই-মেইল : shahahmadreza@yahoo.com
No comments