বিশেষ সাক্ষাৎকার-আমাদের কোনো পরামর্শ নেওয়া হয় না by রাশেদ খান মেনন
রাশেদ খান মেননের জন্ম ১৮ মে ১৯৪৩ সালে, ফরিদপুরে। পৈতৃক বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলায়। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ষাটের দশকের ছাত্রনেতা, ডাকসুর সহসভাপতি ও ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। ১৯৬৪ সালে জেলখানা থেকে পরীক্ষা দিয়ে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন।
এরপর সার্বক্ষণিক বাম রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ছিলেন মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রচার সম্পাদক। বর্তমানে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি। ১৯৭৯, ১৯৯১ ও ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং ১৫ দলীয় জোট গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
প্রথম আলো আজ (শুক্রবার) আপনি কুষ্টিয়া থেকে এলেন। গ্রামের মানুষের অবস্থা কেমন?
রাশেদ খান মেনন এবার প্রচুর ধান হয়েছে। কৃষকেরা নতুন ধান রোপণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, তাঁরা ন্যায্য দাম পাবেন কি না। হয়তো খরচটা উঠবে, কিন্তু লাভ তেমন হবে না। রাস্তার পাশে দেখলাম, প্রচুর সবজি হয়েছে। এক মণ মুলা বিকোচ্ছে ৪০ টাকায়, অর্থাৎ এক কেজি এক টাকা দামে। কৃষকদের আরেকটি উদ্বেগ হলো জ্বালানি, বিশেষ করে ডিজেলের দাম বেড়ে গেছে। এতে বোরো চাষের খরচও বাড়বে।
প্রথম আলো গ্রামাঞ্চলে রাজনৈতিক তৎপরতা কেমন দেখলেন?
রাশেদ খান মেনন আমি যশোর থেকে কুষ্টিয়া যাওয়ার পথে ৯৭টি তোরণ দেখলাম—খালেদা জিয়ার লংমার্চ সামনে রেখে। এসব তোরণ নির্মাণে বিপুল টাকাপয়সা খরচ করা হয়েছে। প্রতিটিতে ডিজিটাল ব্যানার লাগানো।
তবে সাংগঠনিকভাবে জামায়াতে ইসলামী অনেক বেশি সক্রিয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পুরো কর্মসূচি জামায়াতই নিয়ন্ত্রণ করছে।
এবার বিএনপির সব প্রচারণার লক্ষ্য তারেক রহমান। এর মধ্য দিয়ে দুটি বিষয় সামনে এসেছে—এক. জামায়াতের ওপর বিএনপির নির্ভরতা; দুই. তারেক রহমানকে সামনে নিয়ে আসা। এবার ঢাকাসহ সারা দেশে বেশ ঘটা করে তারেক রহমানের জন্মদিন পালন করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা খরচ করে।
প্রথম আলো তাহলে কি আমরা ধরে নিতে পারি, বিএনপি যতটা বলছে, দেশের অবস্থা ততটা খারাপ নয়?
রাশেদ খান মেনন একটি অর্থনৈতিক দিক এবং আরেকটি রাজনৈতিক। বিএনপির দাবি অনুযায়ী তারেক রহমান যদি দেশের নেতৃত্বে চলে আসেন, তার চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে? বিএনপির পাঁচ বছরে যারা তাঁর কর্মকাণ্ড দেখেছে, তারা আবার খালেদা জিয়ার ভাষায় সেই ‘তরুণ নেতৃত্ব’ গ্রহণ করবে বলে মনে হয় না। যে কারণে বিএনপির রাজনীতি এগোবে না। জনগণের বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে না।
প্রথম আলো সরকারে না থাকলেও আপনারা তো মহাজোটের শরিক। মহাজোট সরকারের তিন বছর কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
রাশেদ খান মেনন আমরা মহাজোটের সরকার বলছি ঠিকই, কিন্তু মহাজোটের শরিক বা ১৪ দলের কোনো পরামর্শ নেওয়া হয় না। সরকার বা রাষ্ট্র পরিচালনায়ও আমাদের অংশগ্রহণ নেই। আমরা চিঠি দিয়ে বলেছিলাম, তৃণমূল পর্যায়ে ১৪ দলের সমন্বয় কমিটি করা হোক। সে চিঠির বিষয়বস্তু গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে আওয়ামী লীগ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়।
প্রথম আলো সরকার পরিচালনায় কি আপনাদের কোনো পরামর্শ নেওয়া হয়?
রাশেদ খান মেনন কোনো ধরনের পরামর্শ নেওয়া হয় না। আপনারা দেখেছেন, সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নে আমরা বিশেষ কমিটির সদস্য ছিলাম। আমরা আমাদের বক্তব্য রেখেছি। চূড়ান্ত খসড়ায় আমাদের বক্তব্য গুরুত্ব পায়নি। এ কারণেই আমরা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলাম। আমরা বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলাম। তা করা হয়েছে; কিন্তু এর সঙ্গে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এতে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি দুর্বল হয়েছে।
সংসদে যখন আমরা সারা দেশে রাস্তাঘাটের দুরবস্থা নিয়ে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের ব্যর্থতা তুলে ধরলাম, তখন প্রধানমন্ত্রী কিন্তু তা সহজভাবে নেননি। তিনি মন্ত্রীর পক্ষেই কথা বললেন।
শরিকদের মতামতের ভিত্তিতেই জোট সরকার পরিচালিত হওয়ার নিয়ম। প্রতিবেশী ভারতে দেখুন, ইউপিএ সরকার কীভাবে চলছে। কিন্তু আমাদের এখানে তা না করে সব ক্ষেত্রে ‘একলা চলো’ নীতি চলছে। ফলে একধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে। যখন ঐক্যের প্রয়োজনটা বেশি, তখন বাস্তবে তার উল্টোটাই ঘটছে।
প্রথম আলো সংসদে আপনাদের ভূমিকা কী?
রাশেদ খান মেনন সংসদে আমরা যা সত্য মনে করি, তা বলার চেষ্টা করি। তবে এখানেও সমস্যা হলো ৭০ বিধি। এটি পরিবর্তন না হওয়ায় সংসদকে প্রাণবন্ত করা কঠিন। তার পরও সংসদে কথা বলার সুযোগ আমরা নিচ্ছি। এবার কার্য-উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে ঠিক হয়েছিল, মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফর, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি।
প্রথম আলো মহাজোট সরকার ব্যর্থ হলে তার দায় তো আপনাদেরও নিতে হবে।
রাশেদ খান মেনন আমরা যেহেতু মহাজোটে আছি, সেহেতু এর দায় নিতে হবে বৈকি। এ কারণেই আমরা সরকারকে বলেছি, জনগণের ওপর চাপ পড়ে, এমন কোনো পদক্ষেপ নেবেন না। আমরা জ্বালানি তেলের দাম এভাবে না বাড়িয়ে বিকল্প উৎস খুঁজে বের করতে বলেছি।
আমরা বলেছি, রাস্তাঘাট ঠিক করুন। বৃহস্পতিবার সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা রাজশাহী থেকে এসেছেন। তিনি বললেন, ভেড়ামারা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত রাস্তাটি গাড়ি চলাচলের অনুপযোগী। বরিশালেও একই অবস্থা দেখেছি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সংসদে আমরা বিষয়টি তুলেছিলাম।
প্রথম আলো সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে বেশ সমালোচনা হচ্ছে। ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ঋণ নেওয়া থেকে শুরু করে শেয়ারবাজারের বিপর্যয় কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
রাশেদ খান মেনন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নাজুক অবস্থায় রয়েছে। আমাদের ম্যাক্রো ইকোনমির নিদের্শকগুলো বেশ দুর্বল। যদিও অর্থনীতি খারাপ চলছে, তা প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করতে চাইছেন না। কিন্তু বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার অভিঘাত আমাদের ওপরও পড়ছে। রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধিও শ্লথ হয়ে আসছে। তাই সমস্যা আড়াল না করে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করা উচিত।
প্রথম আলো শেয়ারবাজারে এ বিপর্যয় ঘটল কেন, কারা দায়ী?
রাশেদ খান মেনন সরকার বিষয়টি ঠিকমতো মোকাবিলা করতে পারেনি। দায়িত্বশীলদের মূর্খামিই এর কারণ। শেয়ারবাজারে সব সময় দর বাড়বে তা নয়, উত্থন-পতন আছে। কিন্তু যখন কেলেঙ্কারি ঘটল, তখন কিছু করা হলো না। কেলেঙ্কারির হোতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। ঠিকঠাক মামলাও হয়নি। আজ ৯-১০ মাস পর এসে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করবেন। এত দিন করলেন না কেন?
এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটির সুপারিশও বাস্তবায়িত হয়নি; বরং তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে যাঁরা অভিযুক্ত ছিলেন, তাঁদেরই দেখা যায় টেলিভিশনে শেয়ারবাজার সম্পর্কে সদুপদেশ দিতে। সরকারের সর্বশেষ পদক্ষেপে কিছু কাজ হয়তো হবে। তবে বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুরো ফিরে আসবে বলে মনে হয় না।
প্রথম আলো অভিযোগ আছে, শেয়ার কেলেঙ্কারির সঙ্গে দুই দলেরই কিছু নেতা ও আশীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তি জড়িত।
রাশেদ খান মেনন আসলে লুটপাটকারীদের কোনো দল নেই। সম্প্রতি যেসব বিনিয়োগ হয়েছে, তাতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, কখনো এক দলের চিহ্নিত ব্যক্তিরা একত্র হয়েছেন, কখনো দুই দলের চিহ্নিতরা মিলেমিশে কাজ করছেন। এটাকে বলা যায়, দ্বিদলীয় অশুভ আঁতাত।
প্রথম আলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিরোধী দল বর্তমানে আন্দোলন করছে। এ সম্পর্কে আপনার অভিমত?
রাশেদ খান মেনন বিরোধী দলের আন্দোলন যে গণজোয়ার সৃষ্টি করেছে, তা নয়। তবে সরকারের বেশ কিছু ব্যর্থতার কারণে তারা কিছু কিছু বিষয় সামনে নিয়ে আসতে পেরেছে। যেমন, জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি কিংবা নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি। কিন্তু তারা ব্যাপক জনসমর্থন পক্ষে নিতে পারছে বলে মনে হয় না।
প্রথম আলো বিরোধী দল বলেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত না হলে তারা নির্বাচন করবে না, হতেও দেবে না।
রাশেদ খান মেনন সংবিধান সংশোধন নিয়ে আলোচনাকালে আমরা আরও দুই মেয়াদের জন্য এটি রাখার পক্ষপাতী ছিলাম। কিন্তু যখন পঞ্চদশ সংশোধনের মাধ্যমে এটি বাতিল হয়ে গেছে, তখন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অস্তিত্ব নেই। একে পুনর্বহাল করারও সুযোগ নেই। তাহলে আমাদের কী করতে হবে? নির্বাচনের সময় যে সরকার থাকবে, তারা তো অন্তর্বর্তী সরকার হবে। সেই সরকারের কাঠামো ও করণীয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। নির্বাচনসংক্রান্ত সবকিছু তাদের এখতিয়ারে থাকবে। তারা যা যা চায়, দিতে হবে। যদি সেনাবাহিনী চায়, দিতে হবে। সে সময় অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রিসভার ভূমিকা কী হবে, সেসব নিয়ে তো আলোচনা হতে হবে। আমি মনে করি, সমস্যার সমাধান কঠিন কিছু নয়।
প্রথম আলো বিরোধী দল যদি তাদের অবস্থানে অনড় থাকে?
রাশেদ খান মেনন তাহলে তো দেশ সংঘাত-সংঘর্ষের দিকে যাবে। কিন্তু আমি মনে করি, বিরোধী দলের এ রকম অবস্থান নেওয়া যুক্তিসংগত হবে না। কেননা নির্বাচন না করে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো উপায় নেই। তারা যদি দেশে শান্তি চায়, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তাহলে নির্বাচনে আসতে হবে। নির্বাচন করব না—এ ধরনের জেদ ধরে থাকলে কাজ হবে না।
প্রথম আলো এ সরকারের যে দু-একটি মন্ত্রণালয় সফল হয়েছে, তার মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অগ্রগণ্য। এই মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে বলুন, এ ক্ষেত্রে আরও কী করণীয় আছে।
রাশেদ খান মেনন শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের বড় সাফল্য হলো, একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন। ছাত্রছাত্রীর কাছে যথাসময়ে বইপত্র পৌঁছানো গেছে। সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে আমরা আরও কিছু সুপারিশ করেছি। যেমন—শিক্ষকের আলাদা বেতন স্কেল, শিক্ষার মানোন্নয়ন, আমরা ভর্তি-প্রক্রিয়া সুষ্ঠু করার কথা বলেছি। এগুলোর মধ্যে কিছু কিছু বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু অন্যগুলো অর্থাভাবে আটকে গেছে। আমাদের শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অনেক কম। বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সরকারকে বুঝতে হবে, শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ালে তার দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়া যাবে।
প্রথম আলো মন্ত্রিসভা রদবদল নিয়ে নানা রকম গুজব রয়েছে।
রাশেদ খান মেনন মন্ত্রিসভায় রদবদলের প্রয়োজন আছে—এ কথা ঠিক। তবে সরকারের তিন বছরের মাথায় এসে যাঁরা নতুন করে দায়িত্ব নেবেন, তাঁরা বিরাট কিছু করে ফেলবেন, তা মনে করি না।
আমরা মন্ত্রিসভা রদবদলের চেয়েও ১৪ দলের কার্যক্রম জোরদার করতে চাই। তৃণমূল পর্যায়ে ১৪ দলের কোনো কার্যক্রম নেই। এ অবস্থায় একজন মন্ত্রী হয়ে কী লাভ হবে? ওয়ার্কার্স পার্টির একজন সাধারণ কর্মী তো কোনোভাবে উপলব্ধি করেন না যে তিনি এই সরকার বা জোটের অংশ।
প্রথম আলো যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিচার আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে।
রাশেদ খান মেনন বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার তো এবারই প্রথম হচ্ছে না। ১৯৭৩ সালেই এই বিচারকাজ শুরু হয়েছিল। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর তা বন্ধ হয়ে যায়। যে আইনবলে এই বিচার চলছে, সেটি কিন্তু সংবিধানে ছিল এবং আছে। কোনো সরকার তা বাদ দেয়নি। তাহলে আন্তর্জাতিক মানের প্রশ্ন উঠছে কেন? কাম্পুচিয়ায় যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে, বসনিয়া-হার্জেগোভেনিয়ায় বিচার হয়েছে। সেসব দেশে তো মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। বাংলাদেশে উঠবে কেন?
আরেকটি কথা বলব, একাত্তরের যুদ্ধের সময় গণহত্যা চালানো হয়েছে, সেটি কি আন্তর্জাতিক মানে হয়েছিল? লিবিয়ায় গাদ্দাফির ছেলে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার চেয়েছিলেন। কিন্তু ন্যাটো বাহিনী তো তাঁকে সেই দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছে। সেটি লিবিয়ার অধিকার হলে, আমরা কেন আমাদের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারব না?
প্রথম আলো কয়েকজন মন্ত্রীর ব্যর্থতা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে।
রাশেদ খান মেনন আমরা বলেছি, তাঁদের সরানো উচিত ছিল। দেশ ও জনগণের স্বার্থেই এটা হওয়া বাঞ্ছনীয়। অদক্ষতা ও অযোগ্যতার কারণে কাউকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিলে লজ্জার কিছু নেই। যোগাযোগমন্ত্রী সম্পর্কে যেসব অভিযোগ এসেছে, সেগুলো তো অমূলক নয়, যুক্তিযুক্তভাবেই এসেছে। আর বিশ্বব্যাংক বলেছে বলেই নয়, তারাও অনেক দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। প্রথম অভিযোগটা তো দেশের ভেতর থেকেই এসেছে। যোগাযোগ খাতে বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হলেও কোনোটাই শেষ করতে পারছেন না।
প্রথম আলো কোনো মন্ত্রণালয়ের কাজে উপদেষ্টাদের হস্তক্ষেপের অভিযোগ আছে।
রাশেদ খান মেনন মন্ত্রণালয়ের কাজে উপদেষ্টাদের খবরদারি গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষ করে, জ্বালানি খাতে আজ যে সমস্যা প্রকট হয়েছে, তার জন্য জ্বালানি উপদেষ্টাই দায়ী। অর্থ উপদেষ্টা শেয়ারবাজার ও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তাও সুবিবেচনাপ্রসূত নয়।
রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী উপদেষ্টারা মন্ত্রিসভার বৈঠকে বসতে পারেন না। তাঁরা তো গোপনীয়তার শপথ নেননি। কিন্তু তাঁরা বসছেন। সংসদেও এসব নিয়ে কথা হয়েছে। তাঁরা কেউ কেউ নিজেকে সুপার মিনিস্টার মনে করেন।
প্রথম আলো সরকার ঢাকা সিটি করপোরেশনকে ভাগ করার উদ্যোগ নিয়েছে। আপনার মত কী?
রাশেদ খান মেনন আমি ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তির বিরোধী। এটি সমাধান নয়। সরকারের উচিত ছিল লন্ডনের মতো ঢাকা শহরকে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করে দেওয়া। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি ছিল। বিভক্ত করে লাভবান হওয়া যাবে না। গত তিন বছরে ডিসিসির নির্বাচন না হওয়ায় অনেক সমস্যা হয়েছে। এলাকার মানুষ আমাদের প্রশ্ন করছে। সাংসদ হিসেবে জবাবদিহি করতে হচ্ছে আমাদের।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
রাশেদ খান মেনন ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
প্রথম আলো আজ (শুক্রবার) আপনি কুষ্টিয়া থেকে এলেন। গ্রামের মানুষের অবস্থা কেমন?
রাশেদ খান মেনন এবার প্রচুর ধান হয়েছে। কৃষকেরা নতুন ধান রোপণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, তাঁরা ন্যায্য দাম পাবেন কি না। হয়তো খরচটা উঠবে, কিন্তু লাভ তেমন হবে না। রাস্তার পাশে দেখলাম, প্রচুর সবজি হয়েছে। এক মণ মুলা বিকোচ্ছে ৪০ টাকায়, অর্থাৎ এক কেজি এক টাকা দামে। কৃষকদের আরেকটি উদ্বেগ হলো জ্বালানি, বিশেষ করে ডিজেলের দাম বেড়ে গেছে। এতে বোরো চাষের খরচও বাড়বে।
প্রথম আলো গ্রামাঞ্চলে রাজনৈতিক তৎপরতা কেমন দেখলেন?
রাশেদ খান মেনন আমি যশোর থেকে কুষ্টিয়া যাওয়ার পথে ৯৭টি তোরণ দেখলাম—খালেদা জিয়ার লংমার্চ সামনে রেখে। এসব তোরণ নির্মাণে বিপুল টাকাপয়সা খরচ করা হয়েছে। প্রতিটিতে ডিজিটাল ব্যানার লাগানো।
তবে সাংগঠনিকভাবে জামায়াতে ইসলামী অনেক বেশি সক্রিয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পুরো কর্মসূচি জামায়াতই নিয়ন্ত্রণ করছে।
এবার বিএনপির সব প্রচারণার লক্ষ্য তারেক রহমান। এর মধ্য দিয়ে দুটি বিষয় সামনে এসেছে—এক. জামায়াতের ওপর বিএনপির নির্ভরতা; দুই. তারেক রহমানকে সামনে নিয়ে আসা। এবার ঢাকাসহ সারা দেশে বেশ ঘটা করে তারেক রহমানের জন্মদিন পালন করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা খরচ করে।
প্রথম আলো তাহলে কি আমরা ধরে নিতে পারি, বিএনপি যতটা বলছে, দেশের অবস্থা ততটা খারাপ নয়?
রাশেদ খান মেনন একটি অর্থনৈতিক দিক এবং আরেকটি রাজনৈতিক। বিএনপির দাবি অনুযায়ী তারেক রহমান যদি দেশের নেতৃত্বে চলে আসেন, তার চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে? বিএনপির পাঁচ বছরে যারা তাঁর কর্মকাণ্ড দেখেছে, তারা আবার খালেদা জিয়ার ভাষায় সেই ‘তরুণ নেতৃত্ব’ গ্রহণ করবে বলে মনে হয় না। যে কারণে বিএনপির রাজনীতি এগোবে না। জনগণের বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে না।
প্রথম আলো সরকারে না থাকলেও আপনারা তো মহাজোটের শরিক। মহাজোট সরকারের তিন বছর কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
রাশেদ খান মেনন আমরা মহাজোটের সরকার বলছি ঠিকই, কিন্তু মহাজোটের শরিক বা ১৪ দলের কোনো পরামর্শ নেওয়া হয় না। সরকার বা রাষ্ট্র পরিচালনায়ও আমাদের অংশগ্রহণ নেই। আমরা চিঠি দিয়ে বলেছিলাম, তৃণমূল পর্যায়ে ১৪ দলের সমন্বয় কমিটি করা হোক। সে চিঠির বিষয়বস্তু গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে আওয়ামী লীগ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়।
প্রথম আলো সরকার পরিচালনায় কি আপনাদের কোনো পরামর্শ নেওয়া হয়?
রাশেদ খান মেনন কোনো ধরনের পরামর্শ নেওয়া হয় না। আপনারা দেখেছেন, সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নে আমরা বিশেষ কমিটির সদস্য ছিলাম। আমরা আমাদের বক্তব্য রেখেছি। চূড়ান্ত খসড়ায় আমাদের বক্তব্য গুরুত্ব পায়নি। এ কারণেই আমরা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলাম। আমরা বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলাম। তা করা হয়েছে; কিন্তু এর সঙ্গে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এতে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি দুর্বল হয়েছে।
সংসদে যখন আমরা সারা দেশে রাস্তাঘাটের দুরবস্থা নিয়ে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের ব্যর্থতা তুলে ধরলাম, তখন প্রধানমন্ত্রী কিন্তু তা সহজভাবে নেননি। তিনি মন্ত্রীর পক্ষেই কথা বললেন।
শরিকদের মতামতের ভিত্তিতেই জোট সরকার পরিচালিত হওয়ার নিয়ম। প্রতিবেশী ভারতে দেখুন, ইউপিএ সরকার কীভাবে চলছে। কিন্তু আমাদের এখানে তা না করে সব ক্ষেত্রে ‘একলা চলো’ নীতি চলছে। ফলে একধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে। যখন ঐক্যের প্রয়োজনটা বেশি, তখন বাস্তবে তার উল্টোটাই ঘটছে।
প্রথম আলো সংসদে আপনাদের ভূমিকা কী?
রাশেদ খান মেনন সংসদে আমরা যা সত্য মনে করি, তা বলার চেষ্টা করি। তবে এখানেও সমস্যা হলো ৭০ বিধি। এটি পরিবর্তন না হওয়ায় সংসদকে প্রাণবন্ত করা কঠিন। তার পরও সংসদে কথা বলার সুযোগ আমরা নিচ্ছি। এবার কার্য-উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে ঠিক হয়েছিল, মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফর, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি।
প্রথম আলো মহাজোট সরকার ব্যর্থ হলে তার দায় তো আপনাদেরও নিতে হবে।
রাশেদ খান মেনন আমরা যেহেতু মহাজোটে আছি, সেহেতু এর দায় নিতে হবে বৈকি। এ কারণেই আমরা সরকারকে বলেছি, জনগণের ওপর চাপ পড়ে, এমন কোনো পদক্ষেপ নেবেন না। আমরা জ্বালানি তেলের দাম এভাবে না বাড়িয়ে বিকল্প উৎস খুঁজে বের করতে বলেছি।
আমরা বলেছি, রাস্তাঘাট ঠিক করুন। বৃহস্পতিবার সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা রাজশাহী থেকে এসেছেন। তিনি বললেন, ভেড়ামারা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত রাস্তাটি গাড়ি চলাচলের অনুপযোগী। বরিশালেও একই অবস্থা দেখেছি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সংসদে আমরা বিষয়টি তুলেছিলাম।
প্রথম আলো সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে বেশ সমালোচনা হচ্ছে। ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ঋণ নেওয়া থেকে শুরু করে শেয়ারবাজারের বিপর্যয় কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
রাশেদ খান মেনন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নাজুক অবস্থায় রয়েছে। আমাদের ম্যাক্রো ইকোনমির নিদের্শকগুলো বেশ দুর্বল। যদিও অর্থনীতি খারাপ চলছে, তা প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করতে চাইছেন না। কিন্তু বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার অভিঘাত আমাদের ওপরও পড়ছে। রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধিও শ্লথ হয়ে আসছে। তাই সমস্যা আড়াল না করে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করা উচিত।
প্রথম আলো শেয়ারবাজারে এ বিপর্যয় ঘটল কেন, কারা দায়ী?
রাশেদ খান মেনন সরকার বিষয়টি ঠিকমতো মোকাবিলা করতে পারেনি। দায়িত্বশীলদের মূর্খামিই এর কারণ। শেয়ারবাজারে সব সময় দর বাড়বে তা নয়, উত্থন-পতন আছে। কিন্তু যখন কেলেঙ্কারি ঘটল, তখন কিছু করা হলো না। কেলেঙ্কারির হোতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। ঠিকঠাক মামলাও হয়নি। আজ ৯-১০ মাস পর এসে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করবেন। এত দিন করলেন না কেন?
এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটির সুপারিশও বাস্তবায়িত হয়নি; বরং তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে যাঁরা অভিযুক্ত ছিলেন, তাঁদেরই দেখা যায় টেলিভিশনে শেয়ারবাজার সম্পর্কে সদুপদেশ দিতে। সরকারের সর্বশেষ পদক্ষেপে কিছু কাজ হয়তো হবে। তবে বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুরো ফিরে আসবে বলে মনে হয় না।
প্রথম আলো অভিযোগ আছে, শেয়ার কেলেঙ্কারির সঙ্গে দুই দলেরই কিছু নেতা ও আশীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তি জড়িত।
রাশেদ খান মেনন আসলে লুটপাটকারীদের কোনো দল নেই। সম্প্রতি যেসব বিনিয়োগ হয়েছে, তাতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, কখনো এক দলের চিহ্নিত ব্যক্তিরা একত্র হয়েছেন, কখনো দুই দলের চিহ্নিতরা মিলেমিশে কাজ করছেন। এটাকে বলা যায়, দ্বিদলীয় অশুভ আঁতাত।
প্রথম আলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিরোধী দল বর্তমানে আন্দোলন করছে। এ সম্পর্কে আপনার অভিমত?
রাশেদ খান মেনন বিরোধী দলের আন্দোলন যে গণজোয়ার সৃষ্টি করেছে, তা নয়। তবে সরকারের বেশ কিছু ব্যর্থতার কারণে তারা কিছু কিছু বিষয় সামনে নিয়ে আসতে পেরেছে। যেমন, জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি কিংবা নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি। কিন্তু তারা ব্যাপক জনসমর্থন পক্ষে নিতে পারছে বলে মনে হয় না।
প্রথম আলো বিরোধী দল বলেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত না হলে তারা নির্বাচন করবে না, হতেও দেবে না।
রাশেদ খান মেনন সংবিধান সংশোধন নিয়ে আলোচনাকালে আমরা আরও দুই মেয়াদের জন্য এটি রাখার পক্ষপাতী ছিলাম। কিন্তু যখন পঞ্চদশ সংশোধনের মাধ্যমে এটি বাতিল হয়ে গেছে, তখন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অস্তিত্ব নেই। একে পুনর্বহাল করারও সুযোগ নেই। তাহলে আমাদের কী করতে হবে? নির্বাচনের সময় যে সরকার থাকবে, তারা তো অন্তর্বর্তী সরকার হবে। সেই সরকারের কাঠামো ও করণীয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। নির্বাচনসংক্রান্ত সবকিছু তাদের এখতিয়ারে থাকবে। তারা যা যা চায়, দিতে হবে। যদি সেনাবাহিনী চায়, দিতে হবে। সে সময় অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রিসভার ভূমিকা কী হবে, সেসব নিয়ে তো আলোচনা হতে হবে। আমি মনে করি, সমস্যার সমাধান কঠিন কিছু নয়।
প্রথম আলো বিরোধী দল যদি তাদের অবস্থানে অনড় থাকে?
রাশেদ খান মেনন তাহলে তো দেশ সংঘাত-সংঘর্ষের দিকে যাবে। কিন্তু আমি মনে করি, বিরোধী দলের এ রকম অবস্থান নেওয়া যুক্তিসংগত হবে না। কেননা নির্বাচন না করে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো উপায় নেই। তারা যদি দেশে শান্তি চায়, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তাহলে নির্বাচনে আসতে হবে। নির্বাচন করব না—এ ধরনের জেদ ধরে থাকলে কাজ হবে না।
প্রথম আলো এ সরকারের যে দু-একটি মন্ত্রণালয় সফল হয়েছে, তার মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অগ্রগণ্য। এই মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে বলুন, এ ক্ষেত্রে আরও কী করণীয় আছে।
রাশেদ খান মেনন শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের বড় সাফল্য হলো, একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন। ছাত্রছাত্রীর কাছে যথাসময়ে বইপত্র পৌঁছানো গেছে। সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে আমরা আরও কিছু সুপারিশ করেছি। যেমন—শিক্ষকের আলাদা বেতন স্কেল, শিক্ষার মানোন্নয়ন, আমরা ভর্তি-প্রক্রিয়া সুষ্ঠু করার কথা বলেছি। এগুলোর মধ্যে কিছু কিছু বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু অন্যগুলো অর্থাভাবে আটকে গেছে। আমাদের শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অনেক কম। বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সরকারকে বুঝতে হবে, শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ালে তার দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়া যাবে।
প্রথম আলো মন্ত্রিসভা রদবদল নিয়ে নানা রকম গুজব রয়েছে।
রাশেদ খান মেনন মন্ত্রিসভায় রদবদলের প্রয়োজন আছে—এ কথা ঠিক। তবে সরকারের তিন বছরের মাথায় এসে যাঁরা নতুন করে দায়িত্ব নেবেন, তাঁরা বিরাট কিছু করে ফেলবেন, তা মনে করি না।
আমরা মন্ত্রিসভা রদবদলের চেয়েও ১৪ দলের কার্যক্রম জোরদার করতে চাই। তৃণমূল পর্যায়ে ১৪ দলের কোনো কার্যক্রম নেই। এ অবস্থায় একজন মন্ত্রী হয়ে কী লাভ হবে? ওয়ার্কার্স পার্টির একজন সাধারণ কর্মী তো কোনোভাবে উপলব্ধি করেন না যে তিনি এই সরকার বা জোটের অংশ।
প্রথম আলো যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিচার আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে।
রাশেদ খান মেনন বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার তো এবারই প্রথম হচ্ছে না। ১৯৭৩ সালেই এই বিচারকাজ শুরু হয়েছিল। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর তা বন্ধ হয়ে যায়। যে আইনবলে এই বিচার চলছে, সেটি কিন্তু সংবিধানে ছিল এবং আছে। কোনো সরকার তা বাদ দেয়নি। তাহলে আন্তর্জাতিক মানের প্রশ্ন উঠছে কেন? কাম্পুচিয়ায় যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে, বসনিয়া-হার্জেগোভেনিয়ায় বিচার হয়েছে। সেসব দেশে তো মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। বাংলাদেশে উঠবে কেন?
আরেকটি কথা বলব, একাত্তরের যুদ্ধের সময় গণহত্যা চালানো হয়েছে, সেটি কি আন্তর্জাতিক মানে হয়েছিল? লিবিয়ায় গাদ্দাফির ছেলে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার চেয়েছিলেন। কিন্তু ন্যাটো বাহিনী তো তাঁকে সেই দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছে। সেটি লিবিয়ার অধিকার হলে, আমরা কেন আমাদের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারব না?
প্রথম আলো কয়েকজন মন্ত্রীর ব্যর্থতা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে।
রাশেদ খান মেনন আমরা বলেছি, তাঁদের সরানো উচিত ছিল। দেশ ও জনগণের স্বার্থেই এটা হওয়া বাঞ্ছনীয়। অদক্ষতা ও অযোগ্যতার কারণে কাউকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিলে লজ্জার কিছু নেই। যোগাযোগমন্ত্রী সম্পর্কে যেসব অভিযোগ এসেছে, সেগুলো তো অমূলক নয়, যুক্তিযুক্তভাবেই এসেছে। আর বিশ্বব্যাংক বলেছে বলেই নয়, তারাও অনেক দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। প্রথম অভিযোগটা তো দেশের ভেতর থেকেই এসেছে। যোগাযোগ খাতে বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হলেও কোনোটাই শেষ করতে পারছেন না।
প্রথম আলো কোনো মন্ত্রণালয়ের কাজে উপদেষ্টাদের হস্তক্ষেপের অভিযোগ আছে।
রাশেদ খান মেনন মন্ত্রণালয়ের কাজে উপদেষ্টাদের খবরদারি গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষ করে, জ্বালানি খাতে আজ যে সমস্যা প্রকট হয়েছে, তার জন্য জ্বালানি উপদেষ্টাই দায়ী। অর্থ উপদেষ্টা শেয়ারবাজার ও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তাও সুবিবেচনাপ্রসূত নয়।
রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী উপদেষ্টারা মন্ত্রিসভার বৈঠকে বসতে পারেন না। তাঁরা তো গোপনীয়তার শপথ নেননি। কিন্তু তাঁরা বসছেন। সংসদেও এসব নিয়ে কথা হয়েছে। তাঁরা কেউ কেউ নিজেকে সুপার মিনিস্টার মনে করেন।
প্রথম আলো সরকার ঢাকা সিটি করপোরেশনকে ভাগ করার উদ্যোগ নিয়েছে। আপনার মত কী?
রাশেদ খান মেনন আমি ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তির বিরোধী। এটি সমাধান নয়। সরকারের উচিত ছিল লন্ডনের মতো ঢাকা শহরকে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করে দেওয়া। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি ছিল। বিভক্ত করে লাভবান হওয়া যাবে না। গত তিন বছরে ডিসিসির নির্বাচন না হওয়ায় অনেক সমস্যা হয়েছে। এলাকার মানুষ আমাদের প্রশ্ন করছে। সাংসদ হিসেবে জবাবদিহি করতে হচ্ছে আমাদের।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
রাশেদ খান মেনন ধন্যবাদ।
No comments