পুঁজিবাজার কারসাজি-ডা. ইকবাল, নূর আলী ফালুসহ ১৪ জনের নামে মামলা হচ্ছে by তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

পুঁজিবাজার থেকে কারসাজির মাধ্যমে ৪৩৬ কোটি টাকা তুলে নেওয়ার অভিযোগে ডা. এইচ বি এম ইকবাল ও মোসাদ্দেক আলী ফালুসহ ১৩ ব্যক্তি এবং নূর আলীর মালিকানাধীন ইউনিক হোটেলসহ দুই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)।


তাঁদের বিরুদ্ধে ২০০৯ ও ২০১০ সালে অমনিবাস বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্টে অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়েছে। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী অধিকতর তদন্তের পর গতকাল বুধবার অনুষ্ঠিত কমিশন সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় কমিশনের এনফোর্সমেন্ট বিভাগকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। এসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
অভিযুক্ত বাকি ১১ জন ব্যক্তি হলেন : লুৎফুর রহমান বাদল ও তাঁর স্ত্রী সোমা আলম রহমান, বাদলের স্ত্রীর বড় ভাই আহসান ইমাম ও তাঁর স্ত্রী মেহজাবীন মোস্তফা ইমাম, ইয়াকুব আলী খন্দকার ও তাঁর মেয়ে সারাহ খন্দকার, গোলাম মোস্তফা ও তাঁর স্ত্রী নাসিমা আক্তার, আমজাদ হোসেন ফকির ও তাঁর স্ত্রী রোকসানা আমজাদ এবং মনির উদ্দিন আহমেদ নামের একজন বিনিয়োগকারী। ইউনিক হোটেল ছাড়াও অভিযুক্ত অন্য প্রতিষ্ঠানটি হলো লুৎফুর রহমান বাদলের মালিকানাধীন নিউ ইংল্যান্ড ইক্যুইটি।
জানা গেছে, ইব্রাহিম খালেদ তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে অমনিবাস বিও হিসাবে অনিয়মের মাধ্যমে ৪৩৬ কোটি টাকা তুলে নেওয়ার অভিযোগে উলি্লখিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে অধিকতর তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে কমিটি। এর ভিত্তিতে ২০১১ সালের ২০ জুন অমনিবাস হিসাবের আওতায় পরিচালিত কিছু বিও হিসাবের অস্বাভাবিক লেনদেন অধিকতর তদন্তের জন্য কমিশনের পরিচালক মাহমুদুল হক ও সহকারী পরিচালক অহিদুল ইসলামের সমন্বয়ে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। প্রায় ছয় মাস আগে তাঁদের তদন্ত শেষ হলেও এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়নি এসইসি। মূলত বাজারে চরম মন্দা পরিস্থিতির কারণেই বিষয়টি নিয়ে ধীরে চলে কমিশন। গতকাল অনুষ্ঠিত কমিশন সভায় অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদনটি নিয়ে আলোচনা হয়। প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এতে কমিশন সভার কার্যবিবরণীর জন্য অপেক্ষা না করে অবিলম্বে এই ব্যবস্থা নেয়ার জন্যও নির্দেশ দেওয়া হয়। বৈঠক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
কমিটির তদন্তে এইচএবি ইনভেস্টমেন্ট, প্রাইম ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট ও সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেস লিমিটেডের ১৯টি অমনিবাস বিও হিসাবের মাধ্যমে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া যায়। অনিয়মের মাধ্যমে তারা শেয়ারবাজার থেকে প্রায় ৪৩৬ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। এসব হিসাবে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩৫০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে শেয়ারবাজার থেকে এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আয় করেছে ৬৮৬ কোটি টাকা। তদন্ত প্রতিবেদনে মোসাদ্দেক আলী ফালু, লুৎফর রহমান বাদল, ইয়াকুব আলী খোন্দকারসহ বেশ কয়েকজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে ধরা হয়। এ ক্ষেত্রে কেউ কেউ নতুন তালিকাভুক্ত কম্পানির লেনদেনের প্রথম দিনেই ঋণ সুবিধা গ্রহণ করেছেন। অথচ আইন অনুসারে এই সুবিধা পাওয়ার কথা নয়। একইভাবে কেউ কেউ নির্ধারিত মূল্য-আয় (পিই) অনুপাত ছাড়িয়ে অতিমূল্যায়িত শেয়ারে ঋণ সুবিধা নিয়েছেন। বেআইনিভাবে এই বাড়তি সুবিধা নিয়ে তাঁরা কারসাজি করেছেন। এর মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স ১৯৬৯-এর ১৭(ই) ধারা লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১১ সালের ১৫ জুন সময়কালের মধ্যে এসব কারসাজি ও আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। এর বাইরে বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালুর বিও হিসাবে কারসাজির ঘটনা খুঁজে পাওয়া গেলেও ওই হিসাব থেকে টাকা তুলে নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগ : তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, লুৎফর রহমান বাদল ও তাঁর স্ত্রী সোমার নামে পরিচালিত তিনটি বিও হিসাব থেকে প্রায় ৯২ কোটি ৩৮ লাখ, বাদলের নিউ ইংল্যান্ড ইক্যুইটির হিসাব থেকে প্রায় ৪৮ কোটি, আহসান ইমাম ও মেহজাবীন মোস্তফা ইমামের তিনটি হিসাব থেকে ৫২ কোটি ২৮ লাখ, ইয়াকুব খোন্দকার ও সারাহর তিনটি হিসাব থেকে ৬৪ কোটি ৮১ লাখ, গোলাম মোস্তফা ও নাসিমা আক্তারের দুটি হিসাব থেকে ১০৫ কোটি ৭৭ লাখ এবং আমজাদ হোসেন ফকির ও রোকসানা আমজাদের দুটি হিসাব থেকে প্রায় ছয় কোটি এবং আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান ডা. ইকবাল তাঁর একটি বিও হিসাব থেকে প্রায় ১০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা কারসাজির মাধ্যমে তুলে নেন। আর মনির উদ্দিন আহমেদ নামের একজন বিনিয়োগকারী তাঁর দুটি হিসাব থেকে তুলে নেন প্রায় পৌনে চার কোটি টাকা। এ ছাড়া নূর আলীর মালিকানাধীন ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টসের নামে থাকা বিও হিসাব থেকে তুলে নেওয়া হয় ৫৩ কোটি ৪৬ লাখ টাকারও বেশি।
অভিযুক্তদের মধ্যে রোকসানা আমজাদ, লুৎফর রহমান, আহসান ইমাম, মেহজাবীন মোস্তফা ইমাম, ইয়াকুব আলী খোন্দকার ও এইচ বি এম ইকবালের বিরুদ্ধে ঋণ সুবিধাবহির্ভূত শেয়ারে বেআইনিভাবে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করে কারসাজির অভিযোগ আনা হয়। আর গোলাম মোস্তফা, নাসিমা আক্তার এবং মোসাদ্দেক আলীর বিরুদ্ধে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স ১৯৬৯-এর ১৭(ই) ধারা লঙ্ঘনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.