আগাম তারিখে অটোগ্রাফ by মাহফুজা জেসমিন
ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার পাশাপাশি কবি, সাহিত্যিকদের কাছ থেকে দেখার জন্য আকণ্ঠ তৃষ্ণা। শৈশব ও কৈশোরে সেরকম সৌভাগ্য না হলেও যৌবনে লেখাপড়ার সুবাদে এবং পরে পেশাগত কারণে অনেকের সঙ্গেই কথা বলার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের ৬২তম জন্মদিনে হঠাৎ করে তার বাসায় হাজির না হলে হয়তো তার দেখা কোনোদিনই আর মিলত না।
ছোটবেলায় বিটিভিতে তার লেখা ধারাবাহিক নাটক এইসব দিনরাত্রি থেকে শুরু। তারপর অয়োময়। ঈদসংখ্যা ম্যাগাজিনে উপন্যাস পড়ে পড়ে বড় হওয়া। ১৯৯২ সালে যখন ঢাকায় আসি সে সময় হুমায়ূন আহমেদ জনপ্রিয় লেখক। প্রতিবছর একুশের বইমেলায় তার বইয়ের জন্য অন্যপ্রকাশের স্টলে অনেক ভিড়। ভয়ে দোকানের কাছেই যেতাম না।
তার লেখা পড়ে কখনও আপ্লুত হয়েছি। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প পড়তে পড়তে আকুল হয়ে কেঁদেছি। লাইন দিয়ে টিকিট কিনে সিনেমা হলে বসে তার ছবি দেখেছি; কিন্তু তার বই কেনা হতো না।
কারণ আমার প্রিয় লেখক সেলিনা হোসেন, জাফর ইকবাল। বইমেলা থেকে একটি বই কিনতে পারলে প্রথমে জাফর ইকবালের
বই কিনি।
২০১০ সালে পেশাগত দায়িত্ব পালনে প্রতিদিন বইমেলায় যাই। কোন লেখকের কতটি বই এলো তার খোঁজ নিই। অন্যপ্রকাশের ভিড় দেখি। মাঝে মধ্যে আমিও ভিড়ের অংশ হই হুমায়ূন আহমেদের নতুন বইয়ের খোঁজ নিতে। কখনও কিনতে। এ বছর সম্ভবত আমি তার নতুন সবগুলো বই-ই কিনে ফেলি।
কারণ, আমার ছেলে মোশাররফ। সে হুমায়ূন আহমেদের দারুণ ভক্ত। তার লেখা প্রতিটি বই সে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই হুমায়ূন আহমেদের সদ্যোজাত বইটি ছেলের হাতে তুলে দিতে আমার আনন্দ হয়। তারই আগ্রহে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু তাকে বিব্রত করতে চাইনি বলেই পেশাগত পরিচয়ে তার সঙ্গে দেখা করিনি।
২০১০-এর নভেম্বরের শুরুতে অন্যপ্রকাশের মাজহার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলি। তিনি বললেন, লেখকের জন্মদিনে তার বাসায় যেতে পারেন। সেদিন তিনি সবার সঙ্গে দেখা করেন। তার কথামতো ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর ভোরবেলা শাহবাগ থেকে একগোছা দোলনচাঁপা নিয়ে দেখা
করতে যাই।
দখিন হাওয়ার মূল ফটকে দারোয়ান পরিচয় জানতে চাইলে বললাম, হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা করতে চাই। দারোয়ান যাওয়ার পথ দেখিয়ে দিলেন। হয়তো হাতে ফুল দেখে তিনিও বুঝতে পেরেছিলেন লেখককে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতেই আসা।
মনে মনে লেখকের জন্মদিনের সকালবেলার একটি ছবি এঁকেছিলাম। হয়তো তিনি থাকবেন পাঠক ও ভক্ত পরিবেষ্টিত। আমাদের সঙ্গে বেশি কথা বলবেন না। অথবা সুযোগই হবে না তার অটোগ্রাফ নেওয়ার। কিন্তু তার দরজায় পেঁৗছাতেই অন্যরকম ছবি। শান্ত-সি্নগ্ধ সকাল। লেখক বসার ঘরের মেঝেতে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। ডান পাশে মোবাইল ফোনটি রাখা। পাশেই একটি ওষুধের ব্যাগ। পেছনে সোফার ওপর একটি বই 'কোরান দর্শন' (লেখকের নাম মনে নেই)। ঘরের এক কোণে রাখা ফুলের তোড়া।
আমরা বললাম, আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে এসেছি। তার চোখ দেখে মনে হলো তিনি যেন আমাদের অপেক্ষায়ই ছিলেন। আমাদের আসাটা একটি স্বাভাবিক ঘটনা। তিনি বসতে বললেন। তার অটোগ্রাফ চাইলাম। একটি নয়। কয়েকটি। ছেলের জন্য। আমার দুই বছর বয়সী মেয়ে বর্ণিল মূর্ছনার জন্য। আমার ভাইয়ের মেয়ে মনির জন্য। যার কোনোদিনই হুমায়ূন আহমেদকে দেখার সৌভাগ্য হবে না এবং আমার জন্য। এ ছাড়াও তার ছবি সংবলিত তিনটি বিশেষ খামে। ভয়ে ভয়ে তার অটোগ্রাফগুলো নিচ্ছিলাম। কিন্তু তিনি একটুও বিরক্ত না হয়ে অটোগ্রাফ দিলেন। তার সঙ্গে ছবি তুললাম। তার সঙ্গে কথা হয়েছিল খুবই কম। কারণ মনে হচ্ছিল, একটু বেশি কথা বললেই বুঝি পরিবেশের গাম্ভীর্য নষ্ট হয়ে যাবে।
প্রায় আধঘণ্টা সেখানে অবস্থান করেছিলাম। কিন্তু মনে হয় যেন কয়েক সেকেন্ড। তবে সময়টা জীবন্ত ও অমলিন। বাসায় ফিরে তার তারিখ সংবলিত অটোগ্রাফ দেখে চমকে উঠলাম। দুটি অটোগ্রাফে তারিখ দিয়েছেন ১৩.১১.২০১১ এবং একটি অটোগ্রাফে তারিখ দিয়েছেন ১৩.১১.২০১৩।
মনে হলো এটা কি ভুল? না রসিকতা? নাকি এই দিনগুলো তার জীবনে আর আসবে না বলেই তিনি চিহ্ন রেখে গেলেন? ইচ্ছা করলে হয়তো তার জীবদ্দশায় ভুল তারিখের ব্যাখ্যাটি পাওয়া যেত। কিন্তু কেন যেন মনে হয়েছিল থাক, আবার দেখা হলে জিজ্ঞাসা করা যাবে।
তার সঙ্গে আর দেখা হলো না, অবচেতনে ক্ষণিকের জন্য উঁকি দেওয়া আশঙ্কা যে সত্য হতে যাচ্ছে সেটি বুঝতে সময় লাগল না। তার ৬৩তম জন্মদিনের আগেই জানতে পারলাম ক্যান্সারের কথা। আর ৬৪তম সকাল তো দেখা হলো না তার। সেই তার সঙ্গে প্রথম এবং শেষ দেখা। ভুল তারিখ দিয়ে দেওয়া তার অটোগ্রাফটাই স্মৃতি
হয়ে রইল।
মাহফুজা জেসমিন : সাংবাদিক
তার লেখা পড়ে কখনও আপ্লুত হয়েছি। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প পড়তে পড়তে আকুল হয়ে কেঁদেছি। লাইন দিয়ে টিকিট কিনে সিনেমা হলে বসে তার ছবি দেখেছি; কিন্তু তার বই কেনা হতো না।
কারণ আমার প্রিয় লেখক সেলিনা হোসেন, জাফর ইকবাল। বইমেলা থেকে একটি বই কিনতে পারলে প্রথমে জাফর ইকবালের
বই কিনি।
২০১০ সালে পেশাগত দায়িত্ব পালনে প্রতিদিন বইমেলায় যাই। কোন লেখকের কতটি বই এলো তার খোঁজ নিই। অন্যপ্রকাশের ভিড় দেখি। মাঝে মধ্যে আমিও ভিড়ের অংশ হই হুমায়ূন আহমেদের নতুন বইয়ের খোঁজ নিতে। কখনও কিনতে। এ বছর সম্ভবত আমি তার নতুন সবগুলো বই-ই কিনে ফেলি।
কারণ, আমার ছেলে মোশাররফ। সে হুমায়ূন আহমেদের দারুণ ভক্ত। তার লেখা প্রতিটি বই সে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই হুমায়ূন আহমেদের সদ্যোজাত বইটি ছেলের হাতে তুলে দিতে আমার আনন্দ হয়। তারই আগ্রহে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু তাকে বিব্রত করতে চাইনি বলেই পেশাগত পরিচয়ে তার সঙ্গে দেখা করিনি।
২০১০-এর নভেম্বরের শুরুতে অন্যপ্রকাশের মাজহার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলি। তিনি বললেন, লেখকের জন্মদিনে তার বাসায় যেতে পারেন। সেদিন তিনি সবার সঙ্গে দেখা করেন। তার কথামতো ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর ভোরবেলা শাহবাগ থেকে একগোছা দোলনচাঁপা নিয়ে দেখা
করতে যাই।
দখিন হাওয়ার মূল ফটকে দারোয়ান পরিচয় জানতে চাইলে বললাম, হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা করতে চাই। দারোয়ান যাওয়ার পথ দেখিয়ে দিলেন। হয়তো হাতে ফুল দেখে তিনিও বুঝতে পেরেছিলেন লেখককে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতেই আসা।
মনে মনে লেখকের জন্মদিনের সকালবেলার একটি ছবি এঁকেছিলাম। হয়তো তিনি থাকবেন পাঠক ও ভক্ত পরিবেষ্টিত। আমাদের সঙ্গে বেশি কথা বলবেন না। অথবা সুযোগই হবে না তার অটোগ্রাফ নেওয়ার। কিন্তু তার দরজায় পেঁৗছাতেই অন্যরকম ছবি। শান্ত-সি্নগ্ধ সকাল। লেখক বসার ঘরের মেঝেতে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। ডান পাশে মোবাইল ফোনটি রাখা। পাশেই একটি ওষুধের ব্যাগ। পেছনে সোফার ওপর একটি বই 'কোরান দর্শন' (লেখকের নাম মনে নেই)। ঘরের এক কোণে রাখা ফুলের তোড়া।
আমরা বললাম, আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে এসেছি। তার চোখ দেখে মনে হলো তিনি যেন আমাদের অপেক্ষায়ই ছিলেন। আমাদের আসাটা একটি স্বাভাবিক ঘটনা। তিনি বসতে বললেন। তার অটোগ্রাফ চাইলাম। একটি নয়। কয়েকটি। ছেলের জন্য। আমার দুই বছর বয়সী মেয়ে বর্ণিল মূর্ছনার জন্য। আমার ভাইয়ের মেয়ে মনির জন্য। যার কোনোদিনই হুমায়ূন আহমেদকে দেখার সৌভাগ্য হবে না এবং আমার জন্য। এ ছাড়াও তার ছবি সংবলিত তিনটি বিশেষ খামে। ভয়ে ভয়ে তার অটোগ্রাফগুলো নিচ্ছিলাম। কিন্তু তিনি একটুও বিরক্ত না হয়ে অটোগ্রাফ দিলেন। তার সঙ্গে ছবি তুললাম। তার সঙ্গে কথা হয়েছিল খুবই কম। কারণ মনে হচ্ছিল, একটু বেশি কথা বললেই বুঝি পরিবেশের গাম্ভীর্য নষ্ট হয়ে যাবে।
প্রায় আধঘণ্টা সেখানে অবস্থান করেছিলাম। কিন্তু মনে হয় যেন কয়েক সেকেন্ড। তবে সময়টা জীবন্ত ও অমলিন। বাসায় ফিরে তার তারিখ সংবলিত অটোগ্রাফ দেখে চমকে উঠলাম। দুটি অটোগ্রাফে তারিখ দিয়েছেন ১৩.১১.২০১১ এবং একটি অটোগ্রাফে তারিখ দিয়েছেন ১৩.১১.২০১৩।
মনে হলো এটা কি ভুল? না রসিকতা? নাকি এই দিনগুলো তার জীবনে আর আসবে না বলেই তিনি চিহ্ন রেখে গেলেন? ইচ্ছা করলে হয়তো তার জীবদ্দশায় ভুল তারিখের ব্যাখ্যাটি পাওয়া যেত। কিন্তু কেন যেন মনে হয়েছিল থাক, আবার দেখা হলে জিজ্ঞাসা করা যাবে।
তার সঙ্গে আর দেখা হলো না, অবচেতনে ক্ষণিকের জন্য উঁকি দেওয়া আশঙ্কা যে সত্য হতে যাচ্ছে সেটি বুঝতে সময় লাগল না। তার ৬৩তম জন্মদিনের আগেই জানতে পারলাম ক্যান্সারের কথা। আর ৬৪তম সকাল তো দেখা হলো না তার। সেই তার সঙ্গে প্রথম এবং শেষ দেখা। ভুল তারিখ দিয়ে দেওয়া তার অটোগ্রাফটাই স্মৃতি
হয়ে রইল।
মাহফুজা জেসমিন : সাংবাদিক
No comments