নাম নিয়ে যত কথা by আলী কবীর
নামে কী বা আসে যায়? অনেকে বলেন এ কথা। কিন্তু তাঁরাও সুন্দর নাম পছন্দ করেন, তা মানুষের হোক কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু নামকরণের ক্ষেত্রে আমরা অনেক বিচিত্র ও দুর্বোধ্য, এমনকি ভুল ধারণাও পোষণ করি। যেমন- আমাদের দেশে অধুনা বাচ্চাদের ভালো নাম বা আসল নাম রাখতে গিয়ে যেসব জটিল ও অশ্রুতপূর্ব নাম রাখা হয়, তার প্রায় কোনোটাই আরবি নয়।
এগুলোর বেশির ভাগই হিন্দি, উর্দু (অর্থাৎ হিন্দুস্তানি), ফার্সি এমনকি পশতু। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে হিন্দির মতো উর্দুও একটি ভারতীয় ভাষা। দেশ বিভাগের আগে এ দুটিকে পৃথক ভাষা হিসেবে গণ্য করা হতো না। দুটি ভাষাকে একসঙ্গে বলা হতো হিন্দুস্তানি অর্থাৎ উত্তর ভারত বা আর্যাবর্তের ভাষা।
উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হলেও এটি সেখানকার জনগণের নিজস্ব ভাষা নয়। পাকিস্তানের একেক প্রদেশের মানুষের একেক মাতৃভাষা। যেমন- সিন্ধু প্রদেশ, যার রাজধানী করাচির (পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় রাজধানী ও বৃহত্তম বন্দরনগরী) ভাষা সিন্ধি। এটি উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ভাষা। পাঞ্জাবের ভাষা পাঞ্জাবি। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের (যার বর্তমান নাম খাইবার পাখতুনখোয়া) ভাষা পশতু। পশতু এই অঞ্চলের অত্যন্ত প্রাচীন ও সমৃদ্ধ একটি ভাষা এবং ব্রাহুই আফগানিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। বেলুচিস্তান প্রদেশে নানা ভাষা প্রচলিত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে বালুচ, ব্রাহুই, পশতু প্রভৃতি। এখানে উল্লেখ করা যায়, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের পড়শি দেশ ইরানেও বেলুচিস্তান নামে একটি প্রদেশ রয়েছে। এটি পাক বেলুচিস্তানের লাগোয়া এবং এর ভাষাবৈচিত্র্য প্রায় একই ধরনের। ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেই একটি করে পাঞ্জাবি ভাষাভাষী প্রদেশ বা রাজ্য রয়েছে। উভয়ের নাম পাঞ্জাব।
পাকিস্তানি কাশ্মীরের মানুষের ভাষা ভারতীয় রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের অধিকাংশ মানুষের মতো কাশ্মীরি ভাষা। এটি ভারতের অন্যতম সরকারি ভাষা। উল্লেখ্য, ভারতে সর্বমোট ১৫টি সরকারি ভাষা রয়েছে। ভারতের সব কাগুজে কারেন্সি নোটে এ সব কয়টি ভাষায় নোটের মূল্যমান লেখা থাকে। সম্প্রতি হিন্দিবলয়ের বিশাল অংশের কথ্য ভাষা ভোজপুরীকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়ার প্রয়াস শুরু হয়েছে। লক্ষণীয় যে ভারতের ১৫টি সরকারি ভাষার মধ্যে ইংরেজি ও নেপালি ভাষাও রয়েছে। এর মানে হচ্ছে, দুটি ভাষায়ই ভারতের অনেক মানুষ কথা বলে। তাই এগুলোকেও ভারতীয় ভাষা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
আমার এক বন্ধু জেনে মর্মাহত হলেন যে ইরাকের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও উপ-প্রধানমন্ত্রী তারেক আজিজ একজন খ্রিস্টান। তিনি তাঁকে মুসলিম বলে ভেবেছিলেন। আমি তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, নামের জন্য। তাঁর নামটা তো মুসলমান নাম। আমি তাঁকে জানালাম, ওটা মুসলমান নাম নয়, আরবি নাম। ভদ্রলোকের মাতৃভাষা আরবি। তাই তাঁর মা-বাবা ওই ভাষায়ই ছেলের নামকরণ করেছিলেন। আমি তাঁকে আরো বললাম, কে তাঁকে নিষেধ করেছে মাতৃভাষায় নিজের নাম রাখতে? তিনি যেন তাঁর ছেলে-মেয়ের নামকরণের বেলায় বিষয়টি খেয়াল রাখেন ইত্যাদি।
ভদ্রলোক আমার কথায় কতটুকু গুরুত্ব দিলেন জানি না। কিন্তু আমাদের দেশেও অনেকে মাতৃভাষায় শিশুদের নামকরণ করেন, বিশেষ করে ডাকনাম। অনেকেই ছেলে-মেয়ের সুন্দর ও অর্থবহ বাংলা ডাকনাম রাখেন। কিন্তু এই বাংলা ডাকনামকে হিন্দু নাম বলে ভুল করা বা বিদ্রূপ করার মতো লোকেরও অভাব নেই। ভাষা নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করার শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত পানি বা জল। আমরা অনেকেই খাঁটি বাংলা শব্দ জলকে একটি ধর্ম-সম্প্রদায়ের সঙ্গে এক করে দেখি এবং খাঁটি হিন্দি শব্দ পানিকে আপন মনে করি। পানি শুধু হিন্দি শব্দ নয়, এটি সংস্কৃত ভাষা থেকে উদ্ভূত।
নাম ও পরিধেয় পোশাকের যে কোনো ধর্ম বা জাত নেই, তা বহু আগে বলে গেছেন আধুনিক তুরস্কের জনক মুস্তাফা কামাল পাশা, যাঁকে তুর্কিরা শ্রদ্ধা ভরে আতাতুর্ক বা তুরস্কের জনক বলে থাকেন। মূলত তাঁর সময় থেকেই নতুন করে তুর্কি জনগণ মান্ধাতা আমলের আলখেল্লা পরিত্যাগ করে আধুনিক পোশাক-আশাক পরিধান করতে শুরু করে। এর আগে তুর্কিরা হাস্যকর এক জাব্বা-জোব্বা পরত, যাকে তাদের অনেকেই ইসলামী পোশাক বলে মনে করত। তুরস্কের মানুষকে আধুনিক পোশাক পরিধানে উদ্বুদ্ধ করতে কামালকে এই বিষয়ের ওপর জাতির উদ্দেশে একটা বেতার ভাষণ পর্যন্ত দিতে হয়েছিল।
কেউ কেউ আবার মানুষের নাম খানিকটা পরিবর্তন করে বলতে পছন্দ করেন। ইন্দোনেশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ড. সুকর্ণকে আজাদ পত্রিকায় শোকরানা লেখা হতো এবং অনেকেই তাঁকে আহমেদ শোকরানা নামে পরিচিত করতে চাইত। কিন্তু তাঁর নাম নিয়ে বিভ্রান্তির অবসানে তিনি নিজেই ব্যবস্থা নিলেন। তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনী My Story বা আমার কথার প্রথম কিস্তিতে তাঁর নিজের নামকরণ সম্পর্কে তিনি বললেন, মহাভারতের বীর কর্ণের নাম অনুসারে আমার মা আমার নাম রাখেন সুকর্ণ। বলাই বাহুল্য, তাঁর নামটি রাখা হয়েছিল মাতৃভাষা বাহাসা ইন্দোনেশিয়া অর্থাৎ ইন্দোনেশীয় ভাষায়। স্বাভাবিকভাবেই এই রাষ্ট্রনায়ক তাঁর কন্যার নামও নিজ ভাষায় রাখেন 'মেঘাওয়াতি সুকর্ণপুত্রী'। অর্থাৎ সুকর্ণের কন্যা মেঘবতী। তিনি পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম অধ্যুষিত দেশ ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন।
আরেকটি বিষয় ভেবে আমি অবাক হই। আমার এক বন্ধু বলেছিলেন, তাঁর পরিচিত একটি পরিবারের চার কন্যার নাম এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের চারটি রাজধানী বা বৃহৎ নগরীর নামে রাখা হয়েছে। এই চার কন্যার নাম হংকং, সিডনি, ম্যানিলা ও টোকিও। এ ধরনের বিচিত্র নামকরণ নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আমরা এসব নিয়ে কিছু বলি না। কিন্তু এক শ্রেণীর লোকের মাথাব্যথা শুরু হয় যখন তাঁদের পরিচিত কেউ বা কোনো আত্মীয় বাংলা ভাষায় ছেলে-মেয়ের নামকরণ করেন। তাঁরা এ নিয়ে আপত্তি তোলেন এবং বিচিত্র ও উৎকট সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলেন।
এক শ্রেণীর মানুষ আবার নিজেদের নাম নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালোবাসেন। স্পষ্টতই তাঁরা মা-বাবার দেওয়া নাম নিয়ে সন্তুষ্ট নন। তাঁদের জীবনে বিত্ত-বৈভব ও পদ-পদবি পরিবর্তনজনিত উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা নিজ নামে কিংবা নামের বানানে পরিবর্তন সাধন করে নামকে যুগোপযোগী বা লাগসই করার চেষ্টা করেন। এর ধারাবাহিকতায় হোসেন হয়ে যান হুসাইন, কামাল হয়ে যান কেমাল (Kemal), আহাম্মদ হয়ে যান আহমাদ, রহমান হয়ে যান রাহমান ইত্যাদি।
তবে সবার ওপরে টেক্কা দিয়েছিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপিতা জিন্নাহ। তিনি তাঁর জীবনের একপর্যায়ে শুধু নিজের নামের পরিবর্তন করে ক্ষান্ত হননি। তাঁর পিতার নামও পরিবর্তন করেছিলেন। তাঁর মূল নাম ছিল মোহামেদ আলী ঝিনাভাই খোজাভী। সেটাকে পরিবর্তন করে তিনি করলেন মুহম্মদ আলী জিন্নাহ্। একইভাবে তাঁর পিতার মূল নাম ঝিনাভাই পুনজা খোজাভী পরিবর্তন করে নাম রাখা হলো জিন্নাহ্ পুনজা।
এই ভদ্রলোক পরবর্তী সময়ে তাঁর পৃষ্ঠপোষক ইংরেজ শাসকের সহায়তায় উপমহাদেশের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের নাম পাল্টে ডিকশনারি দেখে রাখলেন পাকিস্তান। পৃথিবীতে বোধ করি এই একটি মাত্র রাষ্ট্র, যার নাম ডিকশনারি দেখে রাখা হয়েছে। ফলে সব ভাষায়ই এর একই নাম, আরবি ভাষা ছাড়া। কারণ আরবিতে ইংরেজি P বা বাংলা প-এর মতো কোনো অক্ষর নেই। জিন্নাহ সাহেবের এই সাধের পাকিস্তান থেকে ১৯৭১ সালে সাবেক পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তান রক্তক্ষয়ী এক স্বাধীনতাসংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নাম ধারণ করে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু তার পরও পাকিস্তানে বহুমাত্রিক সংঘাত ও রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি। অর্থাৎ পাকিস্তানিরা এখনো একক ও ঐক্যবদ্ধ একটি জাতিতে পরিণত হতে পারেনি। হয়তো কোনো দিন পারবেও না। পাকিস্তানের ঘটনাবলি প্রমাণ করে, পাকিস্তান কোনো ঐতিহ্যবাহী দেশ নয়। তাই তার কোনো ঐতিহ্যবাহী নাম নেই। ভারতবর্ষ একটি ঐতিহ্যবাহী দেশ। ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় এর ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে। আমাদের দেশও একটি ঐতিহ্যবাহী বৃহত্তর ভূখণ্ডের অংশ। এরও ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে, এমনকি একই ভাষায় একাধিক নাম রয়েছে। যেমন- বাংলা, বাঙ্গালা, বঙ্গ, বাংলাদেশ, বঙ্গভূমি ইত্যাদি। এসব নামের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। এগুলো একই ভূখণ্ডকে বোঝায়। বাংলা ও হিন্দি ভাষায় ভারত, ইংরেজিতে ইন্ডিয়া (India)), উর্দুতে হিন্দুস্তান এবং আরবি ভাষায় হিন্দ্ একই দেশকে বোঝায়। এগুলোর মধ্যেও কোনো বিরোধ নেই। একটি ঐতিহ্যবাহী দেশ একেক ভাষায় একেক নামে পরিচিতি লাভ করে থাকে এবং সেটা খুবই স্বাভাবিক। ভারতের নাম ইংরেজিতে Republic of India লেখা হয়। এটি আসলে তার আন্তর্জাতিক নাম। বিশ্ব সম্প্রদায় এই নামে তাকে সহজে এবং ভালোভাবে চেনে। যেমন- চীন দেশকে ইংরেজিতে লেখা হয় চায়না (China), তুরস্ককে টার্কি (Turkey), মিসরকে ইজিপ্ট (Egypt) ইত্যাদি।
বেঙ্গল টাইগার বা বঙ্গ ব্যাঘ্র বাঘের একটি বিশেষ প্রজাতির নাম, যা বাংলার বাদাবন বা সুন্দরবনের বাইরেও ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল এবং নেপালে পাওয়া যায়। অনেকে ভুল করে বাঘের এই প্রজাতিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাঘ বলে মনে করেন। আসলে এটি ঠিক নয়। আকৃতিতে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাঘ হচ্ছে সাইবেরিয়ার টাইগা বনাঞ্চলের বাঘ, যাকে অনেকে মাঞ্চুরিয়ান টাইগারও বলে থাকেন। কিন্তু সুন্দরবনের বাঘ বা বেঙ্গল টাইগার শুধু আকৃতির কারণে বিখ্যাত নয়। এটি বিখ্যাত তার সৌন্দর্য, শক্তি, ক্ষিপ্রতা, বুদ্ধিমত্তা ও রাজসিক চালচলন বা Body Language-এর কারণে। এই বাঘটির কারণে বাংলা বা Bengal নামক ভূখণ্ড পৃথিবীতে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। বস্তুত Bengal শব্দটি এখন বাঘের অপর নাম বা Synonym-এ পরিণত হয়েছে। যেমন- আমি নিজে কোরিয়ার রাজধানী Soul Zoo-তে গিয়ে অবাক হয়ে দেখেছি যে বাঘের খাঁচার সামনে প্রাণীটির নাম বড় করে লেখা রয়েছে Bengals. এ রকম আরেকটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সিনসিনাটি শহরের নামকরা এক বাস্কেটবল দলের নাম। ওই দলটির নাম সিনসিনাটি বেঙ্গলস, যার মানে হলো Cincinnati Tigers.
এসব কারণে অন্যান্য দেশের সাধারণ মানুষ বেঙ্গল (Bengal) শব্দটির সঙ্গে যতটা পরিচিত, Bangladesh-এর সঙ্গে ততটা নয়, এটি বুঝতে তাদের সময় লাগে। আসলে 'বাংলাদেশ' আমাদের ভাষায় আমাদের দেশের নিজস্ব নাম।
লেখক : সাবেক সচিব, কবি ও প্রবন্ধকার
উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হলেও এটি সেখানকার জনগণের নিজস্ব ভাষা নয়। পাকিস্তানের একেক প্রদেশের মানুষের একেক মাতৃভাষা। যেমন- সিন্ধু প্রদেশ, যার রাজধানী করাচির (পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় রাজধানী ও বৃহত্তম বন্দরনগরী) ভাষা সিন্ধি। এটি উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ভাষা। পাঞ্জাবের ভাষা পাঞ্জাবি। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের (যার বর্তমান নাম খাইবার পাখতুনখোয়া) ভাষা পশতু। পশতু এই অঞ্চলের অত্যন্ত প্রাচীন ও সমৃদ্ধ একটি ভাষা এবং ব্রাহুই আফগানিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। বেলুচিস্তান প্রদেশে নানা ভাষা প্রচলিত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে বালুচ, ব্রাহুই, পশতু প্রভৃতি। এখানে উল্লেখ করা যায়, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের পড়শি দেশ ইরানেও বেলুচিস্তান নামে একটি প্রদেশ রয়েছে। এটি পাক বেলুচিস্তানের লাগোয়া এবং এর ভাষাবৈচিত্র্য প্রায় একই ধরনের। ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেই একটি করে পাঞ্জাবি ভাষাভাষী প্রদেশ বা রাজ্য রয়েছে। উভয়ের নাম পাঞ্জাব।
পাকিস্তানি কাশ্মীরের মানুষের ভাষা ভারতীয় রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের অধিকাংশ মানুষের মতো কাশ্মীরি ভাষা। এটি ভারতের অন্যতম সরকারি ভাষা। উল্লেখ্য, ভারতে সর্বমোট ১৫টি সরকারি ভাষা রয়েছে। ভারতের সব কাগুজে কারেন্সি নোটে এ সব কয়টি ভাষায় নোটের মূল্যমান লেখা থাকে। সম্প্রতি হিন্দিবলয়ের বিশাল অংশের কথ্য ভাষা ভোজপুরীকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়ার প্রয়াস শুরু হয়েছে। লক্ষণীয় যে ভারতের ১৫টি সরকারি ভাষার মধ্যে ইংরেজি ও নেপালি ভাষাও রয়েছে। এর মানে হচ্ছে, দুটি ভাষায়ই ভারতের অনেক মানুষ কথা বলে। তাই এগুলোকেও ভারতীয় ভাষা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
আমার এক বন্ধু জেনে মর্মাহত হলেন যে ইরাকের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও উপ-প্রধানমন্ত্রী তারেক আজিজ একজন খ্রিস্টান। তিনি তাঁকে মুসলিম বলে ভেবেছিলেন। আমি তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, নামের জন্য। তাঁর নামটা তো মুসলমান নাম। আমি তাঁকে জানালাম, ওটা মুসলমান নাম নয়, আরবি নাম। ভদ্রলোকের মাতৃভাষা আরবি। তাই তাঁর মা-বাবা ওই ভাষায়ই ছেলের নামকরণ করেছিলেন। আমি তাঁকে আরো বললাম, কে তাঁকে নিষেধ করেছে মাতৃভাষায় নিজের নাম রাখতে? তিনি যেন তাঁর ছেলে-মেয়ের নামকরণের বেলায় বিষয়টি খেয়াল রাখেন ইত্যাদি।
ভদ্রলোক আমার কথায় কতটুকু গুরুত্ব দিলেন জানি না। কিন্তু আমাদের দেশেও অনেকে মাতৃভাষায় শিশুদের নামকরণ করেন, বিশেষ করে ডাকনাম। অনেকেই ছেলে-মেয়ের সুন্দর ও অর্থবহ বাংলা ডাকনাম রাখেন। কিন্তু এই বাংলা ডাকনামকে হিন্দু নাম বলে ভুল করা বা বিদ্রূপ করার মতো লোকেরও অভাব নেই। ভাষা নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করার শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত পানি বা জল। আমরা অনেকেই খাঁটি বাংলা শব্দ জলকে একটি ধর্ম-সম্প্রদায়ের সঙ্গে এক করে দেখি এবং খাঁটি হিন্দি শব্দ পানিকে আপন মনে করি। পানি শুধু হিন্দি শব্দ নয়, এটি সংস্কৃত ভাষা থেকে উদ্ভূত।
নাম ও পরিধেয় পোশাকের যে কোনো ধর্ম বা জাত নেই, তা বহু আগে বলে গেছেন আধুনিক তুরস্কের জনক মুস্তাফা কামাল পাশা, যাঁকে তুর্কিরা শ্রদ্ধা ভরে আতাতুর্ক বা তুরস্কের জনক বলে থাকেন। মূলত তাঁর সময় থেকেই নতুন করে তুর্কি জনগণ মান্ধাতা আমলের আলখেল্লা পরিত্যাগ করে আধুনিক পোশাক-আশাক পরিধান করতে শুরু করে। এর আগে তুর্কিরা হাস্যকর এক জাব্বা-জোব্বা পরত, যাকে তাদের অনেকেই ইসলামী পোশাক বলে মনে করত। তুরস্কের মানুষকে আধুনিক পোশাক পরিধানে উদ্বুদ্ধ করতে কামালকে এই বিষয়ের ওপর জাতির উদ্দেশে একটা বেতার ভাষণ পর্যন্ত দিতে হয়েছিল।
কেউ কেউ আবার মানুষের নাম খানিকটা পরিবর্তন করে বলতে পছন্দ করেন। ইন্দোনেশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ড. সুকর্ণকে আজাদ পত্রিকায় শোকরানা লেখা হতো এবং অনেকেই তাঁকে আহমেদ শোকরানা নামে পরিচিত করতে চাইত। কিন্তু তাঁর নাম নিয়ে বিভ্রান্তির অবসানে তিনি নিজেই ব্যবস্থা নিলেন। তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনী My Story বা আমার কথার প্রথম কিস্তিতে তাঁর নিজের নামকরণ সম্পর্কে তিনি বললেন, মহাভারতের বীর কর্ণের নাম অনুসারে আমার মা আমার নাম রাখেন সুকর্ণ। বলাই বাহুল্য, তাঁর নামটি রাখা হয়েছিল মাতৃভাষা বাহাসা ইন্দোনেশিয়া অর্থাৎ ইন্দোনেশীয় ভাষায়। স্বাভাবিকভাবেই এই রাষ্ট্রনায়ক তাঁর কন্যার নামও নিজ ভাষায় রাখেন 'মেঘাওয়াতি সুকর্ণপুত্রী'। অর্থাৎ সুকর্ণের কন্যা মেঘবতী। তিনি পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম অধ্যুষিত দেশ ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন।
আরেকটি বিষয় ভেবে আমি অবাক হই। আমার এক বন্ধু বলেছিলেন, তাঁর পরিচিত একটি পরিবারের চার কন্যার নাম এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের চারটি রাজধানী বা বৃহৎ নগরীর নামে রাখা হয়েছে। এই চার কন্যার নাম হংকং, সিডনি, ম্যানিলা ও টোকিও। এ ধরনের বিচিত্র নামকরণ নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আমরা এসব নিয়ে কিছু বলি না। কিন্তু এক শ্রেণীর লোকের মাথাব্যথা শুরু হয় যখন তাঁদের পরিচিত কেউ বা কোনো আত্মীয় বাংলা ভাষায় ছেলে-মেয়ের নামকরণ করেন। তাঁরা এ নিয়ে আপত্তি তোলেন এবং বিচিত্র ও উৎকট সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলেন।
এক শ্রেণীর মানুষ আবার নিজেদের নাম নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালোবাসেন। স্পষ্টতই তাঁরা মা-বাবার দেওয়া নাম নিয়ে সন্তুষ্ট নন। তাঁদের জীবনে বিত্ত-বৈভব ও পদ-পদবি পরিবর্তনজনিত উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা নিজ নামে কিংবা নামের বানানে পরিবর্তন সাধন করে নামকে যুগোপযোগী বা লাগসই করার চেষ্টা করেন। এর ধারাবাহিকতায় হোসেন হয়ে যান হুসাইন, কামাল হয়ে যান কেমাল (Kemal), আহাম্মদ হয়ে যান আহমাদ, রহমান হয়ে যান রাহমান ইত্যাদি।
তবে সবার ওপরে টেক্কা দিয়েছিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপিতা জিন্নাহ। তিনি তাঁর জীবনের একপর্যায়ে শুধু নিজের নামের পরিবর্তন করে ক্ষান্ত হননি। তাঁর পিতার নামও পরিবর্তন করেছিলেন। তাঁর মূল নাম ছিল মোহামেদ আলী ঝিনাভাই খোজাভী। সেটাকে পরিবর্তন করে তিনি করলেন মুহম্মদ আলী জিন্নাহ্। একইভাবে তাঁর পিতার মূল নাম ঝিনাভাই পুনজা খোজাভী পরিবর্তন করে নাম রাখা হলো জিন্নাহ্ পুনজা।
এই ভদ্রলোক পরবর্তী সময়ে তাঁর পৃষ্ঠপোষক ইংরেজ শাসকের সহায়তায় উপমহাদেশের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের নাম পাল্টে ডিকশনারি দেখে রাখলেন পাকিস্তান। পৃথিবীতে বোধ করি এই একটি মাত্র রাষ্ট্র, যার নাম ডিকশনারি দেখে রাখা হয়েছে। ফলে সব ভাষায়ই এর একই নাম, আরবি ভাষা ছাড়া। কারণ আরবিতে ইংরেজি P বা বাংলা প-এর মতো কোনো অক্ষর নেই। জিন্নাহ সাহেবের এই সাধের পাকিস্তান থেকে ১৯৭১ সালে সাবেক পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তান রক্তক্ষয়ী এক স্বাধীনতাসংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নাম ধারণ করে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু তার পরও পাকিস্তানে বহুমাত্রিক সংঘাত ও রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি। অর্থাৎ পাকিস্তানিরা এখনো একক ও ঐক্যবদ্ধ একটি জাতিতে পরিণত হতে পারেনি। হয়তো কোনো দিন পারবেও না। পাকিস্তানের ঘটনাবলি প্রমাণ করে, পাকিস্তান কোনো ঐতিহ্যবাহী দেশ নয়। তাই তার কোনো ঐতিহ্যবাহী নাম নেই। ভারতবর্ষ একটি ঐতিহ্যবাহী দেশ। ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় এর ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে। আমাদের দেশও একটি ঐতিহ্যবাহী বৃহত্তর ভূখণ্ডের অংশ। এরও ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে, এমনকি একই ভাষায় একাধিক নাম রয়েছে। যেমন- বাংলা, বাঙ্গালা, বঙ্গ, বাংলাদেশ, বঙ্গভূমি ইত্যাদি। এসব নামের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। এগুলো একই ভূখণ্ডকে বোঝায়। বাংলা ও হিন্দি ভাষায় ভারত, ইংরেজিতে ইন্ডিয়া (India)), উর্দুতে হিন্দুস্তান এবং আরবি ভাষায় হিন্দ্ একই দেশকে বোঝায়। এগুলোর মধ্যেও কোনো বিরোধ নেই। একটি ঐতিহ্যবাহী দেশ একেক ভাষায় একেক নামে পরিচিতি লাভ করে থাকে এবং সেটা খুবই স্বাভাবিক। ভারতের নাম ইংরেজিতে Republic of India লেখা হয়। এটি আসলে তার আন্তর্জাতিক নাম। বিশ্ব সম্প্রদায় এই নামে তাকে সহজে এবং ভালোভাবে চেনে। যেমন- চীন দেশকে ইংরেজিতে লেখা হয় চায়না (China), তুরস্ককে টার্কি (Turkey), মিসরকে ইজিপ্ট (Egypt) ইত্যাদি।
বেঙ্গল টাইগার বা বঙ্গ ব্যাঘ্র বাঘের একটি বিশেষ প্রজাতির নাম, যা বাংলার বাদাবন বা সুন্দরবনের বাইরেও ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল এবং নেপালে পাওয়া যায়। অনেকে ভুল করে বাঘের এই প্রজাতিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাঘ বলে মনে করেন। আসলে এটি ঠিক নয়। আকৃতিতে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাঘ হচ্ছে সাইবেরিয়ার টাইগা বনাঞ্চলের বাঘ, যাকে অনেকে মাঞ্চুরিয়ান টাইগারও বলে থাকেন। কিন্তু সুন্দরবনের বাঘ বা বেঙ্গল টাইগার শুধু আকৃতির কারণে বিখ্যাত নয়। এটি বিখ্যাত তার সৌন্দর্য, শক্তি, ক্ষিপ্রতা, বুদ্ধিমত্তা ও রাজসিক চালচলন বা Body Language-এর কারণে। এই বাঘটির কারণে বাংলা বা Bengal নামক ভূখণ্ড পৃথিবীতে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। বস্তুত Bengal শব্দটি এখন বাঘের অপর নাম বা Synonym-এ পরিণত হয়েছে। যেমন- আমি নিজে কোরিয়ার রাজধানী Soul Zoo-তে গিয়ে অবাক হয়ে দেখেছি যে বাঘের খাঁচার সামনে প্রাণীটির নাম বড় করে লেখা রয়েছে Bengals. এ রকম আরেকটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সিনসিনাটি শহরের নামকরা এক বাস্কেটবল দলের নাম। ওই দলটির নাম সিনসিনাটি বেঙ্গলস, যার মানে হলো Cincinnati Tigers.
এসব কারণে অন্যান্য দেশের সাধারণ মানুষ বেঙ্গল (Bengal) শব্দটির সঙ্গে যতটা পরিচিত, Bangladesh-এর সঙ্গে ততটা নয়, এটি বুঝতে তাদের সময় লাগে। আসলে 'বাংলাদেশ' আমাদের ভাষায় আমাদের দেশের নিজস্ব নাম।
লেখক : সাবেক সচিব, কবি ও প্রবন্ধকার
No comments