যুক্তরাষ্ট্র- ওবামার নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাংলাদেশ by মিজানুর রহমান খান
নতুন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ বাংলাদেশসহ বহির্বিশ্বের দেশগুলোর জন্য তো বটেই, মার্কিন জনগণের জন্যও যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক। জন কেরি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হলে তাঁর সিনেট আসনটি হাতছাড়া হওয়ার বিপদ কম নয়। তবে কেরিকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী করা হলে বিশ্ব চার বছরের জন্য যুদ্ধমুক্ত থাকতে পারে বলে অনেকে ভাবতে পারেন।
এবারের নির্বাচনে মার্কিন জনগণ যুদ্ধবিরোধী বিদেশনীতির সমর্থনে ভোট দিয়েছে। আগে শোনা গিয়েছিল কেরিই হবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এখন শোনা যাচ্ছে সুসান রাইসের নাম। কেরির ভাবমূর্তি যুদ্ধবিরোধী।
ওবামার নতুন মন্ত্রিসভার জন্য পথ করে দিতে শুধু হিলারিই নন, প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওন প্যানেট্টা, অ্যাটর্নি জেনারেল এরিক হোল্ডার, অর্থমন্ত্রী টিমোথি যাই-যাই করছেন। ওবামা যাঁকেই মনোনীত করুন, তাঁকে সিনেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।
পারমাণবিক অস্ত্র যাতে করায়ত্ত না করতে পারে সে জন্য আপনি কি ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ চান? রমনির উত্তর ছিল: ‘ওবামা ইরান প্রশ্নে সম্পূর্ণ ভ্রান্তিতে আছেন। ওবামাকে পুনর্নির্বাচিত করলে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র পাবে। রমনিকে করলে পাবে না।’ শুধু তা-ই নয়, ‘রাসায়নিক অস্ত্র বিস্তার রোধে আমি প্রয়োজনে সিরিয়ায় সেনা পাঠাব।’ ‘জেনারেলরা যখন বলবে তখনই আফগানিস্তান থেকে সেনা সরানো ঠিক হবে।’ ‘মুখে না বলে পাকিস্তানের আল-কায়েদার সঙ্গে যুদ্ধের বিকল্প খোলা রাখতে হবে।’ এসবই ছিল রমনির উক্তি।
কেরি ভিয়েতনামের বীর যোদ্ধা। যুদ্ধ পদক তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ইরাক ব্যতিরেকে (যদিও তিনি এর প্রক্রিয়া নিয়ে বুশদের সঙ্গে বিরোধেই আছেন) জীবনে তিনি অন্য কোনো যুদ্ধকেই সমর্থন দেননি। তাই মনে করা হয় তাঁকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী করা হলে বিশ্বের কাছে বার্তা যাবে শান্তির, যুদ্ধের নয়। অন্যদিকে সুসান রাইস বহুপক্ষীয় কূটনীতিতে কুশলী। তিনি মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে সিদ্ধহস্ত। কিন্তু পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও সার্বিকভাবে দক্ষিণ এশিয়া জন কেরির নখদর্পণে। এমনকি পাকিস্তানের অলিগলিও তাঁর অচেনা নয়। তাই তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলে বাংলাদেশের জন্য ভালোই হতো। ওয়াশিংটনের এসব খবর যাঁরা রাখেন, তাঁদের মুখে এমন কথা শুনে অনেকে অবশ্য ভাবতে পারেন, বাংলাদেশের লাভ সেটা আবার কী বস্তু। ওবামা-হিলারি তাঁদের জাতীয় স্বার্থে এমন একটি সময়ে মিয়ানমারে যাচ্ছেন, বাংলাদেশ যখন রোহিঙ্গা ইস্যুতে এক বড় ধরনের সংকটের মুখোমুখি।
১৯ নভেম্বরে মিয়ানমারে যাবেন ওবামা। তাঁর এই ঐতিহাসিক সফরে বাংলাদেশের মানুষের সুপরিচিত মিত্র হিলারি ক্লিনটন থাকছেন। তাঁকে দিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কিছু একটা বলানোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় তো আদাজল খেয়ে নেমে পড়ার কথা ঢাকার। কিন্তু সেটা কই? এই সফরকে বাংলাদেশের অনুকূলে কতটা আনা সম্ভব, সেই চেষ্টা তেমন আছে বলে মনে হয় না।
আবার দিল্লির সঙ্গে আমাদের বর্তমানের যে সদ্ভাব, তাকে কাজে লাগাতে পারলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে অং সান সু চিকে দিয়ে কিছু বলানো সম্ভব ছিল। অন্তত সে রকমের একটি জোর চেষ্টা বা উদ্যোগ নেওয়া বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বিদেশনীতিতে এ মুহূর্তে প্রবল থাকাটাই স্বাভাবিক।
ভারতের খ্যাতনামা দৈনিক দ্য হিন্দু পড়ে মনে হলো, সু চি মনে করেন রোহিঙ্গা-বৌদ্ধ সংঘাত ‘একটা সাম্প্রদায়িক সমস্যা।’ কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যু অনেক জটিলতর সমস্যা। মিয়ানমারের কাছে তারা ‘রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠী’ অথবা যেন বাংলাদেশই তাদের রাষ্ট্র। অথচ এই অপবাদের স্বীকৃতি নেই গণতন্ত্রের কন্যার কথায়। দুঃখজনকভাবে স্বীকৃতি নেই ওবামার বিদেশনীতিতেও।
অং সান সু চি আরাকান সংকটকে যেভাবে নিতান্ত ‘আইনের শাসনের’ বিষয় হিসেবে দেখেছেন, তা মূল সমস্যা থেকে অনেক দূরে। তিনি যদিও বলছেন, ‘রাখাইনে বহু দশক ধরে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বর্মি সরকার আনাড়ির মতো কারবার করেছে।’ কিন্তু তাতেও তাঁর পাশ কাটানোর চেষ্টা স্পষ্ট। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের বিদেশনীতিতে, বিশেষ করে ওবামার নতুন মন্ত্রিসভার সঙ্গে আলোচনায় এই বিষয়টিকে একেবারেই গেঁথে ফেলতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে আরেকটি ইসরায়েলি-ফিলিস্তিন সংকট সৃষ্টি চূড়ান্ত পরিণামে মার্কিন এশীয় নীতির জন্য আত্মঘাতী হতে বাধ্য।
যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনকে দিয়ে সু চিকে বোঝাতে হবে তিনি যে কারণে আরাকানের ‘দুই সম্প্রদায়কে নিন্দা না করার অবস্থান’ নিয়েছেন, তা এক জিনিস আর খোদ রোহিঙ্গাদের পদ্ধতিগতভাবে বিতাড়ন করার বর্মি সামরিক নীতি আরেক জিনিস।
তবে কথা হলো, ভারতে নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আরও নতুন মুখ আসছে, তাতে বাংলাদেশের তরফে কী কী নতুন প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে বা দেখা যাবে? বরং ওয়াশিংটনে বাংলাদেশি সরকারি হাওয়া বইছে এ রকম, ওবামা প্রশাসন নিশ্চয়ই এবার ‘ব্যক্তির চেয়ে সরকার টু সরকারের’ সম্পর্কের মাহাত্ম্য বুঝবে। হিলারির বিদায়ে সেই উপলব্ধির মওকা আসন্ন। তা এমনটা তাঁরা বিলক্ষণ বুঝুন। তবে ওবামা প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত কূটনৈতিক মহল থেকে এটুকু ইঙ্গিত মিলছে যে ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ মিশন পেশাদারির কূটনীতি থেকে দূরে।
বাংলাদেশে অধুনা যে কারণে বড় বড় মার্কিন সেনা অধিনায়ক পদচারণ করছেন, সেই একই কারণে মিয়ানমারে যাচ্ছেন বারাক ওবামা। আমি ওবামার একজন সমর্থক এবং এটা বলতে পারি, এই নবতর মার্কিন সক্রিয়তার কারণে চীন, ভারত বা কারোরই উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলটি এখন মার্কিন বিদেশনীতিতে কৌশলগত ‘পিভোট’ বা আবর্তনকীলক হিসেবেই গণ্য হচ্ছে। লেখকের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় এই মন্তব্য করেন দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ ও জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ অধ্যাপক হাওয়ার্ড বি শেফার। বাংলাদেশে তিনি রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
ওবামা তাঁর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে সুসান রাইসের পক্ষে যতই দৃঢ় অবস্থান নিন না কেন, রাইসকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করতে চাইলে তাঁকে ঝকমারি সামলাতেই হবে। বেনগাজি রাইসের জন্য মনে হচ্ছে বেন গেট। তিনি পরিকল্পিত সন্ত্রাসী হামলার পরিবর্তে প্রতিবাদ মিছিল হঠাৎ সহিংসতায় রূপ নেয় বলে মন্তব্য করে বিড়ম্বনার শিকার। বিদেশমন্ত্রী করতে ওবামার হাতে অবশ্য আরও একটি কার্ড আছে। তিনি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা টম ডনিলন। এ পদে থেকে আগে হেনরি কিসিঞ্জার ও কন্ডোলিৎসা রাইস পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন।
এর আগে হিলারি তাঁর সরে দাঁড়ানো প্রশ্নে যা বলেছেন তা ঠিকঠাক থাকলে তিনি ২০১৩ সালের প্রথমার্ধে চলে যাবেন। এর অর্থ দাঁড়ায় বাংলাদেশ যদি আগাম নির্বাচনে না যায়, মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে গেলে নির্বাচন হয়, তত দিনে যুক্তরাষ্ট্র একজন নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেয়ে যেতে পারে। তবে হিলারি যতই বলুন, তিনি ব্যক্তিগত জীবন কাটাবেন, কিন্তু যাঁরা আমাকে এখানে বলেছেন যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁর প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা উবে যায়নি, তাঁদের কথা ফেলনা নয়।
সিনেট ফরেন রিলেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান জন কেরি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী। ওয়াশিংটন পোস্ট -এ গত বুধবার আল ক্যামেন লিখেছেন, ‘এটা কি তাঁর জন্য আকর্ষণীয় সান্ত্বনা পুরস্কার? প্রতিরক্ষামন্ত্রী হতে তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতে অধীর অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলেন।’ বাংলাদেশি ‘জনতার মঞ্চ’ নয়, সত্যিই যাঁরা ওবামার জন্য গণতান্ত্রিক মঞ্চ গড়েছেন, কেরি তাঁদের অন্যতম। কিন্তু তাই বলে যেকোনো মূল্যে মন্ত্রিত্বের বা পুরস্কারের জন্য গোঁ ধরা কিংবা তা বিলানোর অবস্থায় মার্কিন রাজনীতি নেই। সিনেটের পদ হারানোর ঝুঁকি নিতে না পারলে কেরি যেমন আছেন তেমনই থাকতে পারেন।
তদুপরি নিউইয়র্ক টাইমস-এর বেস্টসেলিং লেখক জেমস ম্যানের বই দি ওবামিয়ানস পড়ে একটু অবাকই হলাম। তিনি লিখেছেন, ২০০৮ সালে ওবামা তাঁর প্রচারণা টিমের মধ্য থেকে একজনকেই উঁচু আসন (জাতিসংঘে রাষ্ট্রদূত) দিয়েছিলেন। তিনি সুসান রাইস। ২০০৮ সালে নিউ হ্যাম্পশায়ার প্রাইমারিতে ওবামা হিলারি ক্লিনটনের কাছে হেরে গিয়েছিলেন। সেই দুঃসময়ে ওবামার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন কেরি। কিন্তু নির্বাচনে জয়ের পর তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতে চাইলেও ওবামা তাঁকে নেননি।
এবারও কেরিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদটি না দেওয়ার কথা ওঠায় বিশেষজ্ঞরা বিস্মিত। ১৯৭১ সালে ভিয়েতনাম থেকে ফিরে কেরি যুদ্ধাপরাধ সংঘটনে নিক্সনকে অভিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর ভাবমূর্তি যুদ্ধবিরোধী, এটা সান্ত্বনা। সত্যিই যুদ্ধভীতি তাড়াতে কেরিকে বেছে নেওয়া হলে সেটি হবে ওবামার সাহসী পদক্ষেপ। তবে রাইস বা কেরি যে-ই আসুন, আগামী চার বছরে মার্কিনরা অনেক নতুন উদ্যোগ নেবে এশিয়ায়, তাদের ওই পিভোট বা আবর্তনকীলককে গতিশীল করতে। এক দিকে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান, অন্য দিকে চীনকে সামলাতে ওবামা টিমের দৌড়ঝাঁপের মধ্যে বাংলাদেশ নিজেকে কীভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, সেটা হবে দেখার বিষয়।
ওয়াশিংটন থেকে
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
ওবামার নতুন মন্ত্রিসভার জন্য পথ করে দিতে শুধু হিলারিই নন, প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওন প্যানেট্টা, অ্যাটর্নি জেনারেল এরিক হোল্ডার, অর্থমন্ত্রী টিমোথি যাই-যাই করছেন। ওবামা যাঁকেই মনোনীত করুন, তাঁকে সিনেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।
পারমাণবিক অস্ত্র যাতে করায়ত্ত না করতে পারে সে জন্য আপনি কি ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ চান? রমনির উত্তর ছিল: ‘ওবামা ইরান প্রশ্নে সম্পূর্ণ ভ্রান্তিতে আছেন। ওবামাকে পুনর্নির্বাচিত করলে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র পাবে। রমনিকে করলে পাবে না।’ শুধু তা-ই নয়, ‘রাসায়নিক অস্ত্র বিস্তার রোধে আমি প্রয়োজনে সিরিয়ায় সেনা পাঠাব।’ ‘জেনারেলরা যখন বলবে তখনই আফগানিস্তান থেকে সেনা সরানো ঠিক হবে।’ ‘মুখে না বলে পাকিস্তানের আল-কায়েদার সঙ্গে যুদ্ধের বিকল্প খোলা রাখতে হবে।’ এসবই ছিল রমনির উক্তি।
কেরি ভিয়েতনামের বীর যোদ্ধা। যুদ্ধ পদক তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ইরাক ব্যতিরেকে (যদিও তিনি এর প্রক্রিয়া নিয়ে বুশদের সঙ্গে বিরোধেই আছেন) জীবনে তিনি অন্য কোনো যুদ্ধকেই সমর্থন দেননি। তাই মনে করা হয় তাঁকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী করা হলে বিশ্বের কাছে বার্তা যাবে শান্তির, যুদ্ধের নয়। অন্যদিকে সুসান রাইস বহুপক্ষীয় কূটনীতিতে কুশলী। তিনি মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে সিদ্ধহস্ত। কিন্তু পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও সার্বিকভাবে দক্ষিণ এশিয়া জন কেরির নখদর্পণে। এমনকি পাকিস্তানের অলিগলিও তাঁর অচেনা নয়। তাই তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলে বাংলাদেশের জন্য ভালোই হতো। ওয়াশিংটনের এসব খবর যাঁরা রাখেন, তাঁদের মুখে এমন কথা শুনে অনেকে অবশ্য ভাবতে পারেন, বাংলাদেশের লাভ সেটা আবার কী বস্তু। ওবামা-হিলারি তাঁদের জাতীয় স্বার্থে এমন একটি সময়ে মিয়ানমারে যাচ্ছেন, বাংলাদেশ যখন রোহিঙ্গা ইস্যুতে এক বড় ধরনের সংকটের মুখোমুখি।
১৯ নভেম্বরে মিয়ানমারে যাবেন ওবামা। তাঁর এই ঐতিহাসিক সফরে বাংলাদেশের মানুষের সুপরিচিত মিত্র হিলারি ক্লিনটন থাকছেন। তাঁকে দিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কিছু একটা বলানোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় তো আদাজল খেয়ে নেমে পড়ার কথা ঢাকার। কিন্তু সেটা কই? এই সফরকে বাংলাদেশের অনুকূলে কতটা আনা সম্ভব, সেই চেষ্টা তেমন আছে বলে মনে হয় না।
আবার দিল্লির সঙ্গে আমাদের বর্তমানের যে সদ্ভাব, তাকে কাজে লাগাতে পারলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে অং সান সু চিকে দিয়ে কিছু বলানো সম্ভব ছিল। অন্তত সে রকমের একটি জোর চেষ্টা বা উদ্যোগ নেওয়া বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বিদেশনীতিতে এ মুহূর্তে প্রবল থাকাটাই স্বাভাবিক।
ভারতের খ্যাতনামা দৈনিক দ্য হিন্দু পড়ে মনে হলো, সু চি মনে করেন রোহিঙ্গা-বৌদ্ধ সংঘাত ‘একটা সাম্প্রদায়িক সমস্যা।’ কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যু অনেক জটিলতর সমস্যা। মিয়ানমারের কাছে তারা ‘রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠী’ অথবা যেন বাংলাদেশই তাদের রাষ্ট্র। অথচ এই অপবাদের স্বীকৃতি নেই গণতন্ত্রের কন্যার কথায়। দুঃখজনকভাবে স্বীকৃতি নেই ওবামার বিদেশনীতিতেও।
অং সান সু চি আরাকান সংকটকে যেভাবে নিতান্ত ‘আইনের শাসনের’ বিষয় হিসেবে দেখেছেন, তা মূল সমস্যা থেকে অনেক দূরে। তিনি যদিও বলছেন, ‘রাখাইনে বহু দশক ধরে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বর্মি সরকার আনাড়ির মতো কারবার করেছে।’ কিন্তু তাতেও তাঁর পাশ কাটানোর চেষ্টা স্পষ্ট। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের বিদেশনীতিতে, বিশেষ করে ওবামার নতুন মন্ত্রিসভার সঙ্গে আলোচনায় এই বিষয়টিকে একেবারেই গেঁথে ফেলতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে আরেকটি ইসরায়েলি-ফিলিস্তিন সংকট সৃষ্টি চূড়ান্ত পরিণামে মার্কিন এশীয় নীতির জন্য আত্মঘাতী হতে বাধ্য।
যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনকে দিয়ে সু চিকে বোঝাতে হবে তিনি যে কারণে আরাকানের ‘দুই সম্প্রদায়কে নিন্দা না করার অবস্থান’ নিয়েছেন, তা এক জিনিস আর খোদ রোহিঙ্গাদের পদ্ধতিগতভাবে বিতাড়ন করার বর্মি সামরিক নীতি আরেক জিনিস।
তবে কথা হলো, ভারতে নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আরও নতুন মুখ আসছে, তাতে বাংলাদেশের তরফে কী কী নতুন প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে বা দেখা যাবে? বরং ওয়াশিংটনে বাংলাদেশি সরকারি হাওয়া বইছে এ রকম, ওবামা প্রশাসন নিশ্চয়ই এবার ‘ব্যক্তির চেয়ে সরকার টু সরকারের’ সম্পর্কের মাহাত্ম্য বুঝবে। হিলারির বিদায়ে সেই উপলব্ধির মওকা আসন্ন। তা এমনটা তাঁরা বিলক্ষণ বুঝুন। তবে ওবামা প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত কূটনৈতিক মহল থেকে এটুকু ইঙ্গিত মিলছে যে ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ মিশন পেশাদারির কূটনীতি থেকে দূরে।
বাংলাদেশে অধুনা যে কারণে বড় বড় মার্কিন সেনা অধিনায়ক পদচারণ করছেন, সেই একই কারণে মিয়ানমারে যাচ্ছেন বারাক ওবামা। আমি ওবামার একজন সমর্থক এবং এটা বলতে পারি, এই নবতর মার্কিন সক্রিয়তার কারণে চীন, ভারত বা কারোরই উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলটি এখন মার্কিন বিদেশনীতিতে কৌশলগত ‘পিভোট’ বা আবর্তনকীলক হিসেবেই গণ্য হচ্ছে। লেখকের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় এই মন্তব্য করেন দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ ও জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ অধ্যাপক হাওয়ার্ড বি শেফার। বাংলাদেশে তিনি রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
ওবামা তাঁর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে সুসান রাইসের পক্ষে যতই দৃঢ় অবস্থান নিন না কেন, রাইসকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করতে চাইলে তাঁকে ঝকমারি সামলাতেই হবে। বেনগাজি রাইসের জন্য মনে হচ্ছে বেন গেট। তিনি পরিকল্পিত সন্ত্রাসী হামলার পরিবর্তে প্রতিবাদ মিছিল হঠাৎ সহিংসতায় রূপ নেয় বলে মন্তব্য করে বিড়ম্বনার শিকার। বিদেশমন্ত্রী করতে ওবামার হাতে অবশ্য আরও একটি কার্ড আছে। তিনি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা টম ডনিলন। এ পদে থেকে আগে হেনরি কিসিঞ্জার ও কন্ডোলিৎসা রাইস পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন।
এর আগে হিলারি তাঁর সরে দাঁড়ানো প্রশ্নে যা বলেছেন তা ঠিকঠাক থাকলে তিনি ২০১৩ সালের প্রথমার্ধে চলে যাবেন। এর অর্থ দাঁড়ায় বাংলাদেশ যদি আগাম নির্বাচনে না যায়, মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে গেলে নির্বাচন হয়, তত দিনে যুক্তরাষ্ট্র একজন নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেয়ে যেতে পারে। তবে হিলারি যতই বলুন, তিনি ব্যক্তিগত জীবন কাটাবেন, কিন্তু যাঁরা আমাকে এখানে বলেছেন যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁর প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা উবে যায়নি, তাঁদের কথা ফেলনা নয়।
সিনেট ফরেন রিলেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান জন কেরি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী। ওয়াশিংটন পোস্ট -এ গত বুধবার আল ক্যামেন লিখেছেন, ‘এটা কি তাঁর জন্য আকর্ষণীয় সান্ত্বনা পুরস্কার? প্রতিরক্ষামন্ত্রী হতে তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতে অধীর অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলেন।’ বাংলাদেশি ‘জনতার মঞ্চ’ নয়, সত্যিই যাঁরা ওবামার জন্য গণতান্ত্রিক মঞ্চ গড়েছেন, কেরি তাঁদের অন্যতম। কিন্তু তাই বলে যেকোনো মূল্যে মন্ত্রিত্বের বা পুরস্কারের জন্য গোঁ ধরা কিংবা তা বিলানোর অবস্থায় মার্কিন রাজনীতি নেই। সিনেটের পদ হারানোর ঝুঁকি নিতে না পারলে কেরি যেমন আছেন তেমনই থাকতে পারেন।
তদুপরি নিউইয়র্ক টাইমস-এর বেস্টসেলিং লেখক জেমস ম্যানের বই দি ওবামিয়ানস পড়ে একটু অবাকই হলাম। তিনি লিখেছেন, ২০০৮ সালে ওবামা তাঁর প্রচারণা টিমের মধ্য থেকে একজনকেই উঁচু আসন (জাতিসংঘে রাষ্ট্রদূত) দিয়েছিলেন। তিনি সুসান রাইস। ২০০৮ সালে নিউ হ্যাম্পশায়ার প্রাইমারিতে ওবামা হিলারি ক্লিনটনের কাছে হেরে গিয়েছিলেন। সেই দুঃসময়ে ওবামার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন কেরি। কিন্তু নির্বাচনে জয়ের পর তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতে চাইলেও ওবামা তাঁকে নেননি।
এবারও কেরিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদটি না দেওয়ার কথা ওঠায় বিশেষজ্ঞরা বিস্মিত। ১৯৭১ সালে ভিয়েতনাম থেকে ফিরে কেরি যুদ্ধাপরাধ সংঘটনে নিক্সনকে অভিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর ভাবমূর্তি যুদ্ধবিরোধী, এটা সান্ত্বনা। সত্যিই যুদ্ধভীতি তাড়াতে কেরিকে বেছে নেওয়া হলে সেটি হবে ওবামার সাহসী পদক্ষেপ। তবে রাইস বা কেরি যে-ই আসুন, আগামী চার বছরে মার্কিনরা অনেক নতুন উদ্যোগ নেবে এশিয়ায়, তাদের ওই পিভোট বা আবর্তনকীলককে গতিশীল করতে। এক দিকে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান, অন্য দিকে চীনকে সামলাতে ওবামা টিমের দৌড়ঝাঁপের মধ্যে বাংলাদেশ নিজেকে কীভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, সেটা হবে দেখার বিষয়।
ওয়াশিংটন থেকে
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments