বিচারপ্রার্থীরা হয়রান-পুলিশ ও আদালত কর্মচারীদের গাফিলতিতে লাখ লাখ সমন-পরোয়ানা ঝুলছে by আশরাফ-উল-আলম
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সোর্স জালাল উদ্দীনের লাশ উদ্ধার হয়েছিল ডিবি কার্যালয়ের ছাদের পানির ট্যাংক থেকে। ঢাকা মহানগর অতিরিক্ত দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতে বিচারাধীন এ হত্যা মামলায় ২০০২ সালে সর্বশেষ সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তারপর আর কাউকে হাজির করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ।
১৯৯৯ সালের এ ঘটনায় পুলিশ কর্মকর্তাসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। হাইকোর্ট স্বেচ্ছাপ্রণোদিত চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। আট বছর পার হয়ে গেলেও হাইকোর্টের নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়নি।
রাজধানীর গুলশান থানায় দায়ের করা একটি মাদক মামলা ঢাকা মহানগর যুগ্ম দায়রা জজ ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১৩-তে বিচারাধীন। ১৯৯৭ সালে মামলাটি দায়েরের পর ওই বছরই তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। মূল আসামি রফিকুল ইসলাম ওরফে লাল মিয়া প্রথম থেকেই পলাতক। নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আটজন সাক্ষীর মধ্যে গত ১৫ বছরে মাত্র একজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন।
ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী সাক্ষ্য নিয়ে ফৌজদারি আদালতের মামলা নিষ্পত্তি করতে হয়। সাক্ষী হাজির করার দায়িত্ব সাক্ষী যে এলাকায় বসবাস করে সেই এলাকার থানা কর্তৃপক্ষের। জোরালো অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের গাফিলতির কারণে সমন ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও তামিল হয় না।
অবশ্য পুলিশের এই গাফিলতির কথা স্বীকার করেননি পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার আনিসুর রহমান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশের পাঠানো নথি হয়তো কোথায়ও আটকে থাকে বা নথিতে সংযুক্ত করা হয় না।
ঢাকার আদালতগুলোতে (মহানগর দায়রা, জেলা দায়রা, মুখ্য মহানগর হাকিম, মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত ও বিভিন্ন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কতজন সাক্ষীর সমন বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রাজধানীর বিভিন্ন থানায় পাঠানো হয়েছে সেই হিসাব কোনো আদালতের দপ্তরে নেই। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনুমান, প্রায় আড়াই লাখ সাক্ষীর সমন ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ঢাকার বিভিন্ন থানায় পড়ে আছে। আর এ কারণে ঢাকার আদালতগুলোতে লক্ষাধিক মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় পড়ে আছে। অন্যদিকে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, সাক্ষীকে আদালতের পাঠানো সমন বা পরোয়ানা তামিল করে প্রতিবেদনও যথাসময়ে পাঠানো হয়। থানায় কোনো সমন বা পরোয়ানা পড়ে থাকে না। কিন্তু অনেক মামলার নথিতে দেখা গেছে, কোনো প্রতিবেদন তাতে নেই। ফলে মামলা নিষ্পত্তি হয় না। ঢাকায় ১৫ বছর আগের কিছু চাঞ্চল্যকর মামলাসহ ১০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রায় চার হাজার মামলার বিচার নিষ্পত্তি হচ্ছে না সাক্ষীর অভাবে। সারা দেশের আদালতগুলোতেও একই অবস্থা। সুপ্রিম কোর্টে পাঠানো হিসাব অনুযায়ী সারা দেশে বিচারাধীন ফৌজদারি মামলার সংখ্যা তিন লাখ ৭৪ হাজার। এগুলোর মধ্যে নালিশি মামলায় সাক্ষী হাজির করে বাদী পক্ষ। আর থানায় দায়ের করা মামলার সাক্ষী হাজির করার দায়িত্ব পুলিশের। সাক্ষীর অভাবে ঝুলে আছে প্রায় দুই লাখ ফৌজদারি মামলা। গড়ে প্রতিটি মামলায় কমপক্ষে সাতজন সাক্ষী থাকলে ঝুলে থাকা মামলাগুলোতে সাক্ষীর সংখ্যা দাড়ায় ১৪ লাখ। তাদের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ সাক্ষীর প্রতি আদালতের জারি করা সমন বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল করে না সংশ্লিষ্ট পুলিশ। আদালতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, সারা দেশের আদালতগুলো থেকে জারি করা প্রায় সাত লাখ সমন বা পরোয়ানা তামিল করছে না পুলিশ।
সম্প্রতি ঢাকার একটি আদালত সংশ্লিষ্ট পুলিশের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নেওয়ায় ওই আদালতে মামলা নিষ্পত্তির গতি বেড়েছে। রাজধানীর পল্লবী থানার একটি মামলার আদেশে ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া উল্লেখ করেছেন, সাক্ষীদের প্রতি বারবার সমন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার পরও পুলিশ আদালতে সাক্ষী হাজির করছে না। অথচ ফৌজদারি কার্যবিধি আইন এবং ২০০৯ সালের ফৌজদারি বিধি ও আদেশ (ভলিউম-১) সাক্ষী আদালতে হাজির করার দায়িত্ব রাষ্ট্রপক্ষ তথা পুলিশের।
১৫ বছর ধরে চলা মামলার আসামি নুরু মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আইন ও বিচারের প্রতি আমাদের কোনো আস্থা নেই। এত বছর ধরে মামলায় হাজিরা দিতে দিতে আমরা দিশেহারা হয়ে পড়েছি। আদালত প্রতি ধার্য তারিখে একই কথা বলেন, সাক্ষী হাজির হয় না, কী করার আছে। এ কথা শুনতে আর ভালো লাগে না। এর চেয়ে ১৫ বছর আগে সাজা দিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যেত।'
ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতের সরকারি কেঁৗসুলি পিপি আবদুল্লাহ আবু কালের কণ্ঠকে বলেন, পাঁচ-দশ বছরের বেশি সময় ধরে যেসব মামলা বিচারাধীন রয়েছে তার প্রায় সবই সাক্ষী হাজির না হওয়ার জন্য ঝুলে আছে। পুলিশ সাক্ষীদের হাজির করছে না। আবার সাক্ষী বাসা-বাড়ি পরিবর্তন করে অন্যত্র গেছে_এ ধরনের প্রতিবেদনও দিচ্ছে না। আদালত থেকে সমন বা পরোয়ানা পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু পুলিশ সাড়া দিচ্ছে না। এটা দায়িত্বে অবহেলা। তবে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সাক্ষী হাজির করার বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ায় বর্তমানে কিছু মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতের অতিরিক্ত সরকারি কেঁৗসুলি (এডিশনাল পিপি) মো. শাহজাহান হাওলাদারও মামলার এই দীর্ঘসূত্রতার জন্য পুলিশের অবহেলাকে দায়ী করেন।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একই অভিযোগ করেন অ্যাডভোকেট রায়হান মোর্শেদ। তিনি জানান, পুলিশের বিরুদ্ধে আদালতের আদেশ না মানার বিষয়ে আদালত থেকে তেমন নির্দেশও দেওয়া হয় না। আদালতের পাঠানো সমন বা পরোয়ানা নিয়ে একশ্রেণীর পুলিশ ব্যবসা করে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। তারা সাক্ষীদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে টাকা-পয়সা আদায় করে থাকে।
সাক্ষীকে আদালতের পাঠানো সমন বা পরোয়ানা তামিলের বিষয়ে পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার আনিসুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, থানায় খোঁজ নিয়ে তাঁরা দেখেছেন, আদালতের পাঠানো সমন বা পরোয়ানা সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যরা যথাসময়ে তামিল করেন। আদালতকে তা অবহিত করাও হয়। তিনি বলেন, আদালতের সমন ও পরোয়ানা তামিল করার জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক পুলিশ সদস্যকে দায়িত্ব দেওয়া রয়েছে। তাঁরা এ দায়িত্বে অবহেলা করেন না। তাহলে তামিল প্রতিবেদন আদালতে কেন পাওয়া যায় না_এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হয়তো কোথায়ও আটকে থাকে বা নথিতে সংযুক্ত করা হয় না।
আরো কিছু নজির : ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা আদালতে বিচারাধীন একটি অস্ত্র মামলার সাক্ষী ১৪ জন। এর মধ্যে মাত্র পাঁচজন সাক্ষ্য দিয়েছেন গত ১৩ বছরে। বাকি ৯ জনের বিরুদ্ধে আদালত থেকে পাঠানো সমন বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট থানা কর্তৃপক্ষ কোনো প্রতিবেদন না দেওয়ায় এ মামলাটিও নিষ্পত্তি হচ্ছে না। ১৯৯৮ সালে রাজধানীর রমনা থানায় দায়ের করা এ মামলাটি বিচারের জন্য এ আদালতে স্থানান্তরিত হয় ১৯৯৯ সালে। অস্ত্রসহ ধরা পড়া আসামি বজলুর রহমান এখন পলাতক।
ঢাকা মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-৩-এ ১১ বছর ধরে চলছে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা একটি মামলা। ২০০১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি খিলগাঁও থানার রিয়াজবাগ থেকে তিনটি ককটেলসহ গ্রেপ্তার হয় দুই কিশোর শাহীন ও সোহেল। খিলগাঁও থানার দায়ের করা এ মামলার নথি থেকে দেখা যায়, আটজন সাক্ষীর মধ্যে বাদীসহ মাত্র তিনজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। বাকি পাঁচজন গত ১১ বছরে হাজির হননি। এর মধ্যে আদালত থেকে বারবার সমন ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ আদালতের এসব নির্দেশনা তামিল করেনি।
ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-৫-এ বিচারাধীন পল্লবী থানায় দায়ের করা বিশেষ ক্ষমতা আইনের একটি মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠন করা হয়। এ পর্যন্ত এ মামলায় কোনো সাক্ষী আদালতে হাজির হয়ে সাক্ষ্য দেননি। সাক্ষীর বিরুদ্ধে পাঠানো সমন ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল না করায় দায়িত্বরত সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতেও আদালত নির্দেশ দিয়েছেন। এর পরও সাক্ষী হাজির করছে না পুলিশ।
চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ২০০৩ সালে দুই আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে পারেনি পুলিশ। শিবির ক্যাডারদের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন এই দুই নেতা। মামলার সাক্ষী ৩২ জন। তাঁদের হাজির করতে আদালত প্রথমে সমন এবং পরে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও পুলিশ তাঁদের হাজির করতে পারছে না। অথচ থানা থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে বুড়িশ্চর এলাকায় সাক্ষীদের বসবাস।
রাজধানীর গুলশান থানায় দায়ের করা একটি মাদক মামলা ঢাকা মহানগর যুগ্ম দায়রা জজ ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১৩-তে বিচারাধীন। ১৯৯৭ সালে মামলাটি দায়েরের পর ওই বছরই তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। মূল আসামি রফিকুল ইসলাম ওরফে লাল মিয়া প্রথম থেকেই পলাতক। নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আটজন সাক্ষীর মধ্যে গত ১৫ বছরে মাত্র একজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন।
ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী সাক্ষ্য নিয়ে ফৌজদারি আদালতের মামলা নিষ্পত্তি করতে হয়। সাক্ষী হাজির করার দায়িত্ব সাক্ষী যে এলাকায় বসবাস করে সেই এলাকার থানা কর্তৃপক্ষের। জোরালো অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের গাফিলতির কারণে সমন ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও তামিল হয় না।
অবশ্য পুলিশের এই গাফিলতির কথা স্বীকার করেননি পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার আনিসুর রহমান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশের পাঠানো নথি হয়তো কোথায়ও আটকে থাকে বা নথিতে সংযুক্ত করা হয় না।
ঢাকার আদালতগুলোতে (মহানগর দায়রা, জেলা দায়রা, মুখ্য মহানগর হাকিম, মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত ও বিভিন্ন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কতজন সাক্ষীর সমন বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রাজধানীর বিভিন্ন থানায় পাঠানো হয়েছে সেই হিসাব কোনো আদালতের দপ্তরে নেই। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনুমান, প্রায় আড়াই লাখ সাক্ষীর সমন ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ঢাকার বিভিন্ন থানায় পড়ে আছে। আর এ কারণে ঢাকার আদালতগুলোতে লক্ষাধিক মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় পড়ে আছে। অন্যদিকে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, সাক্ষীকে আদালতের পাঠানো সমন বা পরোয়ানা তামিল করে প্রতিবেদনও যথাসময়ে পাঠানো হয়। থানায় কোনো সমন বা পরোয়ানা পড়ে থাকে না। কিন্তু অনেক মামলার নথিতে দেখা গেছে, কোনো প্রতিবেদন তাতে নেই। ফলে মামলা নিষ্পত্তি হয় না। ঢাকায় ১৫ বছর আগের কিছু চাঞ্চল্যকর মামলাসহ ১০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রায় চার হাজার মামলার বিচার নিষ্পত্তি হচ্ছে না সাক্ষীর অভাবে। সারা দেশের আদালতগুলোতেও একই অবস্থা। সুপ্রিম কোর্টে পাঠানো হিসাব অনুযায়ী সারা দেশে বিচারাধীন ফৌজদারি মামলার সংখ্যা তিন লাখ ৭৪ হাজার। এগুলোর মধ্যে নালিশি মামলায় সাক্ষী হাজির করে বাদী পক্ষ। আর থানায় দায়ের করা মামলার সাক্ষী হাজির করার দায়িত্ব পুলিশের। সাক্ষীর অভাবে ঝুলে আছে প্রায় দুই লাখ ফৌজদারি মামলা। গড়ে প্রতিটি মামলায় কমপক্ষে সাতজন সাক্ষী থাকলে ঝুলে থাকা মামলাগুলোতে সাক্ষীর সংখ্যা দাড়ায় ১৪ লাখ। তাদের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ সাক্ষীর প্রতি আদালতের জারি করা সমন বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল করে না সংশ্লিষ্ট পুলিশ। আদালতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, সারা দেশের আদালতগুলো থেকে জারি করা প্রায় সাত লাখ সমন বা পরোয়ানা তামিল করছে না পুলিশ।
সম্প্রতি ঢাকার একটি আদালত সংশ্লিষ্ট পুলিশের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নেওয়ায় ওই আদালতে মামলা নিষ্পত্তির গতি বেড়েছে। রাজধানীর পল্লবী থানার একটি মামলার আদেশে ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া উল্লেখ করেছেন, সাক্ষীদের প্রতি বারবার সমন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার পরও পুলিশ আদালতে সাক্ষী হাজির করছে না। অথচ ফৌজদারি কার্যবিধি আইন এবং ২০০৯ সালের ফৌজদারি বিধি ও আদেশ (ভলিউম-১) সাক্ষী আদালতে হাজির করার দায়িত্ব রাষ্ট্রপক্ষ তথা পুলিশের।
১৫ বছর ধরে চলা মামলার আসামি নুরু মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আইন ও বিচারের প্রতি আমাদের কোনো আস্থা নেই। এত বছর ধরে মামলায় হাজিরা দিতে দিতে আমরা দিশেহারা হয়ে পড়েছি। আদালত প্রতি ধার্য তারিখে একই কথা বলেন, সাক্ষী হাজির হয় না, কী করার আছে। এ কথা শুনতে আর ভালো লাগে না। এর চেয়ে ১৫ বছর আগে সাজা দিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যেত।'
ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতের সরকারি কেঁৗসুলি পিপি আবদুল্লাহ আবু কালের কণ্ঠকে বলেন, পাঁচ-দশ বছরের বেশি সময় ধরে যেসব মামলা বিচারাধীন রয়েছে তার প্রায় সবই সাক্ষী হাজির না হওয়ার জন্য ঝুলে আছে। পুলিশ সাক্ষীদের হাজির করছে না। আবার সাক্ষী বাসা-বাড়ি পরিবর্তন করে অন্যত্র গেছে_এ ধরনের প্রতিবেদনও দিচ্ছে না। আদালত থেকে সমন বা পরোয়ানা পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু পুলিশ সাড়া দিচ্ছে না। এটা দায়িত্বে অবহেলা। তবে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সাক্ষী হাজির করার বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ায় বর্তমানে কিছু মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতের অতিরিক্ত সরকারি কেঁৗসুলি (এডিশনাল পিপি) মো. শাহজাহান হাওলাদারও মামলার এই দীর্ঘসূত্রতার জন্য পুলিশের অবহেলাকে দায়ী করেন।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একই অভিযোগ করেন অ্যাডভোকেট রায়হান মোর্শেদ। তিনি জানান, পুলিশের বিরুদ্ধে আদালতের আদেশ না মানার বিষয়ে আদালত থেকে তেমন নির্দেশও দেওয়া হয় না। আদালতের পাঠানো সমন বা পরোয়ানা নিয়ে একশ্রেণীর পুলিশ ব্যবসা করে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। তারা সাক্ষীদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে টাকা-পয়সা আদায় করে থাকে।
সাক্ষীকে আদালতের পাঠানো সমন বা পরোয়ানা তামিলের বিষয়ে পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার আনিসুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, থানায় খোঁজ নিয়ে তাঁরা দেখেছেন, আদালতের পাঠানো সমন বা পরোয়ানা সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যরা যথাসময়ে তামিল করেন। আদালতকে তা অবহিত করাও হয়। তিনি বলেন, আদালতের সমন ও পরোয়ানা তামিল করার জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক পুলিশ সদস্যকে দায়িত্ব দেওয়া রয়েছে। তাঁরা এ দায়িত্বে অবহেলা করেন না। তাহলে তামিল প্রতিবেদন আদালতে কেন পাওয়া যায় না_এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হয়তো কোথায়ও আটকে থাকে বা নথিতে সংযুক্ত করা হয় না।
আরো কিছু নজির : ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা আদালতে বিচারাধীন একটি অস্ত্র মামলার সাক্ষী ১৪ জন। এর মধ্যে মাত্র পাঁচজন সাক্ষ্য দিয়েছেন গত ১৩ বছরে। বাকি ৯ জনের বিরুদ্ধে আদালত থেকে পাঠানো সমন বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট থানা কর্তৃপক্ষ কোনো প্রতিবেদন না দেওয়ায় এ মামলাটিও নিষ্পত্তি হচ্ছে না। ১৯৯৮ সালে রাজধানীর রমনা থানায় দায়ের করা এ মামলাটি বিচারের জন্য এ আদালতে স্থানান্তরিত হয় ১৯৯৯ সালে। অস্ত্রসহ ধরা পড়া আসামি বজলুর রহমান এখন পলাতক।
ঢাকা মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-৩-এ ১১ বছর ধরে চলছে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা একটি মামলা। ২০০১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি খিলগাঁও থানার রিয়াজবাগ থেকে তিনটি ককটেলসহ গ্রেপ্তার হয় দুই কিশোর শাহীন ও সোহেল। খিলগাঁও থানার দায়ের করা এ মামলার নথি থেকে দেখা যায়, আটজন সাক্ষীর মধ্যে বাদীসহ মাত্র তিনজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। বাকি পাঁচজন গত ১১ বছরে হাজির হননি। এর মধ্যে আদালত থেকে বারবার সমন ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ আদালতের এসব নির্দেশনা তামিল করেনি।
ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-৫-এ বিচারাধীন পল্লবী থানায় দায়ের করা বিশেষ ক্ষমতা আইনের একটি মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠন করা হয়। এ পর্যন্ত এ মামলায় কোনো সাক্ষী আদালতে হাজির হয়ে সাক্ষ্য দেননি। সাক্ষীর বিরুদ্ধে পাঠানো সমন ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল না করায় দায়িত্বরত সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতেও আদালত নির্দেশ দিয়েছেন। এর পরও সাক্ষী হাজির করছে না পুলিশ।
চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ২০০৩ সালে দুই আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে পারেনি পুলিশ। শিবির ক্যাডারদের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন এই দুই নেতা। মামলার সাক্ষী ৩২ জন। তাঁদের হাজির করতে আদালত প্রথমে সমন এবং পরে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও পুলিশ তাঁদের হাজির করতে পারছে না। অথচ থানা থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে বুড়িশ্চর এলাকায় সাক্ষীদের বসবাস।
No comments