দূরদেশ- গাজায় হামলার পেছনে নির্বাচনী রাজনীতি? by আলী রীয়াজ

যাঁরা দুনিয়ার খবরাখবর রাখেন, তাঁরা সবাই জানেন, ইসরায়েলের সঙ্গে হামাসের একটা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। গণমাধ্যমে সেই খবরের পাশাপাশি সাংবাদিক ও বিশ্লেষকদের প্রশ্ন হচ্ছে, সর্বাত্মক যুদ্ধ আসন্ন কি না। সহজ ভাষায় বললে, ইসরায়েলের সেনাবাহিনী গাজায় প্রত্যক্ষ আগ্রাসন চালাবে কি না, সেটা নিয়েই আলোচনা।


ফিলিস্তিনি এলাকা গাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংগঠন হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক সাপে-নেউলের; ফলে সংঘাত হবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধও নতুন কিছু নয়। ১৯৪৮ সাল থেকেই এই যুদ্ধ চলে আসছে। দফায় দফায় লড়াই হয়েছে, এই লড়াই আসলে কোনো দিনই থেমে থাকেনি। অসম এই লড়াইয়ে ইসরায়েলের বিজয়ী হওয়া আসলে খবর নয়, দীর্ঘ মেয়াদে বিবেচনা করলে বলতে হয়, ফিলিস্তিনিরা যে এখনো টিকে আছে, সেটাই সম্ভবত বিস্ময়ের। সেটা দীর্ঘ মেয়াদের প্রশ্ন, প্রশ্নটা ইতিহাসবিদদের জন্য বললে অত্যুক্তি হবে না। গণমাধ্যমের জন্য সাধারণত প্রশ্ন হলো, এখন কী হচ্ছে, কীভাবে এই দফা শুরু হলো, এর দায় কার, কত দূর যাবে এই দফার লড়াই। এসব প্রশ্ন নিয়েই এখন গণমাধ্যমের উৎসাহ। কিন্তু সে কাজেও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো খুব বেশি সাফল্য দাবি করতে পারে কি না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
বুধবার থেকে ইসরায়েলের বিমানগুলোর বিরতিহীন হামলার পরিণতি হলো গাজার নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু। ইতিমধ্যে, এই লেখার সময় পর্যন্ত, কম করে হলেও ৩০ জন মারা গেছে, তার মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি শিশু। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব শিশুর নামধাম পর্যন্ত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে জায়গা পায় না। এসব গণমাধ্যমের খবরে সব সময়ই একটা ‘বড় চিত্র’ তুলে ধরার অজুহাত খাড়া করা হয় এসব মানবিক দিক নিয়ে কথা না বলার জন্য। ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হামাসের রকেট হামলায় নিহতের সংখ্যা তিনজন। কিন্তু তাঁদের মৃত্যু কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। যেকোনো দেশে যেকোনো শিশুর অপঘাতে মৃত্যুই আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়, আর এ ধরনের মৃত্যু যদি হয় প্রতিদিনের বিষয়, তখন আমরা তাকে স্বাভাবিক মনে করলেও তার গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয়। গণমাধ্যমের শ্রোতা-দর্শকেরা এ নিয়ে কম সংবেদনশীল হন, তাতে নাটকীয় খবরের উপাদান থাকে কম; কিন্তু যে পিতামাতারা তাঁদের সন্তান হারান, তাঁদের জন্য এর চেয়ে বড় কোনো ঘটনাই নেই। কে কার সঙ্গে যুদ্ধ করল, কে বিজয়ী হলো, এই বিজয়ে কার কী লাভ হবে, তা আর তাঁদের বিবেচনার বিষয় থাকে না।
ঢাকায় বিবিসির সংবাদদাতা অমিতাভ ভট্টশালীর ফেসবুকের সূত্রে ১৫ নভেম্বর যখন জানতে পারি, বিবিসির আরবি বিভাগের ফটো এডিটর জেহাদ মাসওয়ারির ১১ মাসের শিশুসন্তান আলী বিমান হামলায় প্রাণ হারিয়েছে, প্রাণ হারিয়েছেন জেহাদ মাসওয়ারির ভ্রাতৃবধূ, তাঁর ভাই লড়ছেন মৃত্যুর সঙ্গে, তখন কেবল এটাই মনে হলো, জেহাদ এই শোকের ভার বইবেন কী করে। টেলিভিশনের পর্দায় এ রকম শিশুদের মৃত্যুর খবর বড়জোর কয়েক সেকেন্ডের ‘ফটো শুট’। বিবিসির সঙ্গে আমার চাকরিসূত্রে যে যোগাযোগ, তা শেষ হয়েছে এক যুগ আগে। ফলে এখন যাঁরা কাজ করেন তাঁদের অনেকের সঙ্গেই আমার পরিচয় নেই। জেহাদকেও আমি চিনি না, কিন্তু অমিতাভ ভট্টশালীর খবরে অন্যদের মন্তব্যগুলো দেখে মনে হলো, যে যেখানেই থাকুক না কেন, পরিচিত হোক অথবা না হোক, এ রকম সংবাদ সবাইকেই নাড়া দেয়। তার পরও যুদ্ধের খবর বলে যা প্রচারিত হয় তার মধ্যে মানুষের এই যে অবর্ণনীয় কষ্ট, তার কতটুকু থাকে? যে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয় সাধারণ মানুষ, তার কতটুকু আমরা জানতে পারি?
তার পরও যুদ্ধের দামামা যখন বাজে, তখন এই দামামা যাঁরা বাজান, তাঁরা বুঝতে চান না কত নিরপরাধ মানুষকে, কত শিশুকে এভাবে প্রাণ দিতে হবে। এখন গাজায় সেই দামামাই বেজে উঠতে শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচের অনেক দেশেই চলছে সংঘাত, তার সঙ্গে আরও একটি ভয়াবহ অধ্যায় যুক্ত হতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা অনেকেরই। এই যুদ্ধের ভয়াবহতার মাত্রা কত হবে, তা অনুমান করা দুরূহ। আশঙ্কা হচ্ছে, এই দফায় যুদ্ধ বাধলে তার আগুন হয়তো কেবল ইসরায়েলের এক সীমান্তে সীমিত থাকবে না। এই যুদ্ধে লেবাননও জড়িয়ে পড়তে পারে বলেই অনেকের আশঙ্কা। কেননা কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, হামাস কয়েক মাস ধরে ইসরায়েলের ওপর যে চাপ সৃষ্টি করেছে, তাদের রকেট হামলার পরিমাণ বাড়িয়েছে, তার কারণ হলো, তারা চাইছে এই দফায় যুদ্ধকে সম্প্রসারিত করতে। আরব বসন্তের কারণে এই অঞ্চলে ইসরায়েলের প্রতি অতীতে সহানুভূতিশীল রাষ্ট্র মিসরের অবস্থান যে এখন হামাসের অনুকূলে, হামাসের নেতারা সেটা ভালো করেই জানেন। মিসরের প্রধানমন্ত্রী গাজায় উপস্থিত হয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তাতেও এই ধারণার পক্ষে যুক্তি মেলে। সিরিয়া পরিস্থিতির কারণে ইসরায়েলকে গোলান উপত্যকায় কড়া নজর রাখতে হচ্ছে বলে হামাস মনে করতেই পারে, এটাই চাপ সৃষ্টির জন্য ভালো সময়।
কিন্তু হামাস চাইছে বলেই কি ইসরায়েল এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে? এ যুদ্ধের সূচনার জন্য তাহলে হামাসকেই দায়ী করতে হবে? মোটেই তা নয়। গাজায় হামাসের সামরিক নেতা আহমেদ জাবারিকে হত্যার পর এবার এই ঘটনাপ্রবাহের সূচনা। যুদ্ধবিরতির জন্য যখন দুই পক্ষ আলোচনা করছিল, তখন ইসরায়েলের এই অভিযানের কারণ কি অন্যত্র? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন অনেকে।
এই যুদ্ধের জন্য ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যে কারণ হিসেবে কাজ করছে, সেটা যাঁরা ইসরায়েলি রাজনীতির ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা বুঝতে পারবেন। ১৯৮১ সালের জুনে দেশের আসন্ন নির্বাচনে পরাজয় যখন প্রায় নিশ্চিত, তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন সিদ্ধান্ত নিলেন ইরাকের পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালানোর। পরমাণু স্থাপনা যেমনি ধ্বংস হলো, তেমনি পরের নির্বাচনে বিজয়ী হলেন বেগিন। ১৫ বছরের পরের ঘটনা, ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের ঠিক দুই মাস আগে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী সিমোন পেরেস লেবাননে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে বিমান অভিযানের নির্দেশ দিলেন। ব্যাপক এই বিমান হামলায় হিজবুল্লাহর ক্ষতি হলেও জাতিসংঘের একটি অফিসে হামলার জন্য ইসরায়েলকে মুখোমুখি হতে হয় আন্তর্জাতিক সমালোচনার। অভ্যন্তরীণভাবে পেরেসের জন্য তা ইতিবাচক হয়নি মোটেই। পেরেস সেই নির্বাচনে বিজয়ী হননি। সর্বশেষ যেবার হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের সংঘাত হয়, সেটা চার বছর আগে। তখন প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট হামাসের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন; কেননা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জনমত জরিপে এগিয়ে ছিলেন। আশা ছিল, তাতে করে আসন্ন নির্বাচনে তাঁর দলের পক্ষেই ভোটাররা রায় দেবেন, কেননা জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে তাঁদের যে দুর্বলতার অভিযোগ, তাঁরা তা মেটাতে পারবেন। কিন্তু ফলাফল তাঁর পক্ষে যায়নি; ভোটাররা বেছে নিয়েছিলেন তুলনামূলকভাবে কট্টরপন্থী দলকেই। আসন্ন নির্বাচনে কোনো বড় ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হবেন না নেতানিয়াহু, এটা প্রায় নিশ্চিত; তার পরও তিনি সম্ভবত কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চাননি। নির্বাচনের সঙ্গে ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের যোগাযোগ হয়তো দেশের নেতারা মানতে চাইবেন না। কিন্তু লক্ষণ দেখে অন্য কোনো রকম উপসংহারে পৌঁছার সুযোগ খুবই কম।
আরেকটি আশঙ্কার কথাও কোনো বিশ্লেষক বলছেন, যা চলমান যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ। তাঁদের ধারণা, এই যুদ্ধ হচ্ছে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পূর্বপ্রস্তুতি। হামাসের সঙ্গে ইরানের যোগাযোগের অজুহাতে ইসরায়েল ইরানকে যুদ্ধে জড়াতে পারে। এই আশঙ্কার পক্ষে এখনো জোরদার প্রমাণ মেলেনি বটে, তবে কিছুদিন আগে পর্যন্ত ইসরায়েল যেভাবে কথাবার্তা বলছিল, তাতে মনে হচ্ছিল, সে ইরানের সঙ্গে একটা যুদ্ধ বাধাতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রকে সেই যুদ্ধে টেনে নেওয়ার চেষ্টায় ইসরায়েল এই পথ নিয়েছে বলে যাঁরা মনে করেন, তাঁদের সঙ্গে আমি এখনো একমত নই, কিন্তু তাই বলে এই বক্তব্যকে একেবারে নাকচ করে দেওয়ার আগে ভেবে দেখা দরকার।
কারণ যা-ই হোক, আমার আশঙ্কা, ইসরায়েল ও হামাস—দুই পক্ষ আগুন নিয়ে খেলতে শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো যুদ্ধের শুরু হলে তার নিয়ন্ত্রণ যাঁরা যুদ্ধ শুরু করবেন তাঁদের হাতেই থাকবে, এমন না-ও হতে পারে। সেটাই এখন একটা বড় আশঙ্কার বিষয়।

ইলিনয়; ১৬ নভেম্বর ২০১২
 আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.