স্বপ্নের সেই চেনা মৃত্যু by সাইদুজ্জামান

মুশফিকুর রহিম নির্দিষ্ট করে বলতে পারলেন না জয়ের আবাহন থেকে ঠিক কোন মুহূর্তটায় পিছলে পড়ল তাঁর দল। ১০ থেকে শুরু করে ১৬৭ রানে শেষ হওয়া ইনিংসে কি আর 'টার্নিং পয়েন্ট' বলে কিছু থাকে? তার পরও আছে এবং সেটি দেখা গেছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসের ব্যাটিংয়ে।


ওয়ানডের বাজারে ৭৮ ওভারে ২৪৫ রান করে জেতা 'দুষ্প্রাপ্য' নয়, তবে টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে একটু কঠিন। আর বাংলাদেশের জন্য যা আরেকবার পাঁচ শ রান করে ফেলার মতো ব্যাপার। সম্ভবত সেটা বুঝতে পেরে বাংলাদেশ দলকে নীরব সমর্থন দিয়েই বাড়ি ফিরেছেন দর্শকরা।
কেন? মুশফিকুর রহিমের উত্তরটা শুনলে মনে হতে পারে ব্যর্থতা আড়ালের চেষ্টা। কিন্তু বিশ্বকাপ জেতার আগে ওয়ানডেতে শ্রীলঙ্কার অতীতের কথা মনে করে দেখুন। অনেক জেতা ম্যাচও সে সময়টায় হেরেছিল লঙ্কানরা। ও রকম পরিস্থিতির সঙ্গে অনভ্যস্ততাই সেসব হারের প্রধান কারণ। প্রায় ১১ মাস পর টেস্ট খেলতে নেমে গতকাল সেই অনভ্যস্ততার জালেই আটকা পড়েছে বাংলাদেশ। টিনো বেস্টের ক্যারিয়ার সেরা বোলিং তো ঘটনাপ্রবাহ মাত্র। তাই মুশফিক যখন ব্যাখ্যা দেন, 'পরিকল্পনা ছিল চা বিরতি পর্যন্ত দেখেশুনে খেলা। এরপর শেষ সেশনে হাতে উইকেট থাকলে জয়ের চেষ্টা করব। কিন্তু তা হয়নি। আসলে এমন পরিস্থিতি আমাদের সামনে খুব বেশি আসেনি।'
অনভ্যস্ততা ক্রিকেটে এমনই প্রভাব বিস্তার করে যে, তামিম ইকবালও কাল গুটিয়ে নেন নিজেকে। কিন্তু ইনিংসের পঞ্চম ওভারেই রবি রামপলের বাইরের একটি বল তাড়া করতে গিয়ে আউট তিনি, যা দেখে কে যেন অস্ফুুটে বলে উঠলেন, 'সকাল সকাল ক্যারিবীয়দের অল আউট করে দিয়ে কী ভুলই করল বাংলাদেশ!' তামিম গেলেন তো কি, আমরা আছি না, দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে জুনায়েদ সিদ্দীক ও শাহরিয়ার নাফীসের ব্যাটিংয়ে এমন আস্থাই ছিল শুরুতে। কিন্তু চতুর্থ দিনের খেলার পরই নিজ দলের পেস বোলারদের 'নির্দেশনা' দিয়ে রেখেছিলেন ড্যারেন স্যামি, 'দেখেছ, রুবেল কিভাবে বোলিং করেছে? ওর মতো বোলিং করতে হবে।' রামপলের অত নির্দেশনার দরকার হয় না, তবে প্রায় প্রতিটি বলই অধিনায়কের নির্দেশিত জায়গায় ফেলেছেন বেস্ট। গতি সব সময়ই আছে, তবে সেটি বজায় রাখতে গিয়ে লাইন লেন্থে গণ্ডগোল করে ফেলেন ক্যারিবীয় এই ফাস্ট বোলার। আবার একটু অনুপ্রেরণা পেলে হয়ে ওঠেন বিধ্বংসী। কাল বেস্টকে শুরুর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন জুনায়েদ। বেরিয়ে যাওয়া বেস্টের ওই বলটা কেন যে থার্ডম্যানে খেলতে গেলেন বাঁহাতি এই ওপেনার!
১৬ ওভারে ৪৫ রানে ২ উইকেট, কাগজে-কলমে তখনো জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। কিন্তু টেস্টের বাস্তবতা এবং দুই দলের শরীরী ভাষায় কার্যত দিনের প্রথম সেশনেই ব্যাকফুটে বাংলাদেশ। অনন্যোপায় হয়ে বেস্টকে পুল করতে গিয়ে শাহরিয়ার নাফীসের আকাশে বল তুলে দেওয়া যেন সেই উদ্বেগেরই বহিঃ প্রকাশ। তবু ২০০৯ সালে গ্রেনাডা ২১৫ রান তাড়া করে ম্যাচ জেতানোর মতো ঢাকায়ও কি জেতাতে পারবেন না সাকিব আল হাসান? আশার সেই সলতেটুকুও দিনের সেরা ডেলিভারিতে নিভিয়ে দেন বেস্ট। সাকিবসহ ৫-০-১৩-৩, টিনো বেস্টের এই প্রথম স্পেলটাই শেষ দিনের চুম্বক অংশ। ক্যারিবীয় স্পিনারদের সুইপ-টুইপ খেলে ড্রেসিংরুমের রক্তচাপ কমাতে চেষ্টা করেছিলেন মুশফিক, যা দেখে আবারও বেস্টের হাতে বল তুলে দেন স্যামি। বাংলাদেশ অধিনায়ককে ফিরিয়ে আস্থার প্রতিদানও দিয়েছেন বেস্ট। ৮৫ রানে পঞ্চম ব্যাটসম্যান হিসেবে মুশফিকের বিদায়ের পর ঘোরতর সমর্থকও বাংলাদেশের জয়ের আশা ছেড়ে দিয়ে থাকবেন। তবে টেস্ট বিনোদন তখনো কিছু বাকি ছিল তাঁদের জন্য। বেস্টের তিনটি বাউন্সার গায়ে নিয়েও ফাইন লেগের ওপর দিয়ে মাহমুদ উল্লাহর বিশাল ছক্কায় গ্যালারির উচ্ছ্বাস থেকে বোঝার উপায় নেই যে, ম্যাচটা হারতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই দ্বৈরথে বেস্টের জয় দিয়েই শেষ হয়েছে ঢাকা টেস্ট।
২৪ রানে ম্যাচ জেতানো ৫ উইকেট, তাই মাহমুদ উল্লাহকে বোল্ড করার আনন্দে নাচানাচির পর স্মারক হিসেবে একটা স্টাম্প নিতে ভোলেননি টিনো বেস্ট। তেমন একটি স্মারক প্রাপ্য সোহাগ গাজীরও। অভিষেক টেস্টে বোলিং শুরু করা, তাও ক্রিস গেইলের বিপক্ষে, কঠিনতম সেই পরীক্ষায় উতরে গিয়ে অনন্য একটা রেকর্ডও কাল গড়ে ফেলেছেন এই অফস্পিনার। টেস্ট অভিষেকে এখন তিনিই বাংলাদেশের সেরা। অভিষেকে এক ইনিংসে ছয়টি করে উইকেট সোহাগের আগে নিয়েছেন ইলিয়াস সানি, মঞ্জুরুল ইসলাম ও নাঈমুর রহমান। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় ইনিংসে সোহাগের নেওয়া ৭৪ রানে ৬ উইকেটই এক ইনিংসে বাংলাদেশি কোনো বোলারের সেরা বোলিং ফিগার। ম্যাচেও সেরা তিনিই। ২০০৯ সালে কিংস্টনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অভিষেকে ১১০ রানে ৮ উইকেট নিয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ, ২১৯ রানে ৯ উইকেট নিয়ে সেটা টপকে গেছেন সোহাগ।
অন্যদের ছাপিয়ে যাওয়ার পথে দলের সামনেও তিনি খুলে দিয়েছিলেন দারুণ সম্ভাবনার দরজা। ৬ উইকেটে ২৪৪ রান নিয়ে পঞ্চম দিন শুরুর আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের লক্ষ্য ছিল তিন শ রানের লিড। কিন্তু আগের দিনের ২১৫ রানের লিডের সঙ্গে আর মাত্র ২৯ রান যোগ করতেই গুটিয়ে যায় ক্যারিবীয়দের দ্বিতীয় ইনিংস। এদিন নিজের পঞ্চম বলেই স্যামিকে এলবিডাব্লিউর ফাঁদে ফেলেন সোহাগ। দুই ওভার পর টানা দুই বলে রামপল ও বেস্টকে বোল্ড করা এই অফস্পিনারকে অভিষেকেই হ্যাটট্রিক উদ্‌যাপন করতে দেননি শিবনারায়ণ চন্দরপল। অবশ্য পরের ওভারেই প্রথম ইনিংসের ডাবল সেঞ্চুরিয়ানকে ফিরিয়ে দিয়ে রেকর্ড বইয়ে নিজের নামটা লিখিয়ে ফেলেন সোহাগ। দলের সামনে খুলে দেন চূড়ান্ত সাফল্যের পথও।
নবাগত সোহাগ গাজী জানবেন কী করে যে, সেই পথ দিয়ে স্রোতের মতো এসে স্নায়ুচাপ ভাসিয়ে দেবে পুরো ড্রেসিংরুম, যে কক্ষের বাসিন্দাদের এমন পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচয় নেই বললেই চলে!

No comments

Powered by Blogger.