দুর্যোগ-নাম না জানা এক ঝড়ের কবলে by শেখ রোকন
এটা ঠিক, প্রায় এক মাস আগে, গত ১০ অক্টোবর গভীর রাতে উপকূলীয় পাঁচ জেলা_ ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়টিরও নাম খুঁজে পায়নি সংবাদমাধ্যম; কিন্তু ক্ষুদ্র এই নিবন্ধের উপজীব্য অন্য এক ঝড়। নামহীন, নির্দিষ্ট গতিবেগহীন ও অভিমুখহীন এক ধূসর ঝড়।
একুশ শতকের শুরুতে আফগানিস্তানে তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সূচনা করতে গিয়ে মার্কিন সেনা কমান্ডারও সেটাকে আখ্যা দিয়েছিলেন ধূসর যুদ্ধ বা 'গ্রে ওয়ার' হিসেবে। কারণ এমন যুদ্ধের নির্দিষ্ট ক্ষেত্র নেই, নিয়ম নেই, নির্ধারিত শত্রু-মিত্র নেই। তার ভাষায়, সে এক অনন্ত যুদ্ধ। উদ্দেশ্য যাই হোক, যেমনই হোক, ওই কমান্ডারের কথা যে হাড়ে হাড়ে সত্য, এখন টের পাচ্ছি আমরা। এক যুগ পর পেছনে তাকিয়ে মনে হয়, সত্যিই তখন এক নতুন যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। আমরা চাই বা না চাই, আফগানিস্তান কিংবা আমেরিকা যত দূরঅস্তই হোক; ধূসর যুদ্ধের ততোধিক ধূসর কুয়াশা যে আমাদেরও ঘিরে ধরছে, বাংলাদেশি শিক্ষার্থী নাফিসকে ঘিরে নিউইয়র্ক কাণ্ড তার প্রমাণ। তুলনা প্রীতিকর হোক না হোক, নামহীন ঝড়টিও নানা অর্থে ধূসর যুদ্ধের মতোই।
ধূসর যুদ্ধের মতো ঝড়ের নামহীনতার সমস্যায় ভূপেন হাজারিকা হয়তো দুই কলি গানেই সমাধান দিয়ে দিতেন_ 'তার কোনো নাম নেই, তার কোনো নাম নেই; দিতে পার নাম তার অনামিকা'। হৃদয়ে যে ঝড় ওঠে, সেখানে এমন সমাধান দেওয়াই যায়; কিন্তু সাগর ও উপকূলের এই মামলা ততটা সহজ নয়। নামহীন এই ঝড় উদ্বেগজনক তো বটেই; কিন্তু প্রথমেই যা তৈরি হয় তার নাম খটকা। নাম থাকবে না?
গত কয়েক বছর ভারত মহাসাগরের উত্তরাংশে উদ্ভূত যেসব নিম্নচাপ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে তার সবগুলোরই নাম ছিল_ সিডর, আইলা, নার্গিস, বিজলী, রেশমি প্রভৃতি। পাঠকের কৌতূহলের প্রতি সাড়া দিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ প্রক্রিয়া ও তাৎপর্য নিয়ে সংবাদও প্রকাশ হয়েছে। অনেকে জানেন, সাগরে নিম্নচাপ শুরু হলেই আঞ্চলিক আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রগুলো সেটির দিকে নজর রাখে। কেন্দ্রস্থলে বাতাসের গতিবেগ কমবেশি ৬৫ কিলোমিটারে পেঁৗছলেই নিম্নচাপ ঘূর্ণিঝড়ে 'পরিণত' হয়। তখন পূর্বনির্ধারিত তালিকা থেকে তার নামকরণ হয়। অবশ্য নিম্নচাপেরও একটি কারিগরি নাম থাকে। সাধারণত মৌসুমের (মে থেকে নভেম্বর) প্রথম নিম্নচাপটিকে এক নম্বর ধরে গণনা দিয়ে শুরু হয়। সঙ্গে থাকে সাগরের নামের সংক্ষেপিত রূপ।
১০ অক্টোবর রাতের আঁধারে আমাদের উপকূলে আছড়ে পড়া ঘূর্ণিঝড় কিংবা নিম্নচাপটিকেও একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। যদিও ঝড়ের সময় আমাদের আবহাওয়া দফতর ঘুমিয়ে ছিল; যদিও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব স্বয়ং ফোন করে বুধবার বিকেলে চার নম্বর বিপদ সংকেত প্রদর্শনের অনুরোধ করা সত্ত্বেও 'অফিস সময়' ফুরিয়ে যাওয়ার অজুহাতে তা আমলে নেয়নি; আইএমডি (ইন্ডিয়ান মেটিওরোজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট) নিম্নচাপটির গতিবিধির ওপর নজর রেখেছিল। তারা এর নাম দিয়েছিল 'বিওবি ওয়ান'। বে অব বেঙ্গল ওয়ান। মর্যাদার দিক থেকে 'ঘূর্ণিঝড়' না হলেও এর গতিবেগ প্রায় ঘূর্ণিঝড়ের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। শীর্ষকালীন তিন মিনিটে ছিল ঘণ্টায় ৫৫ কিলোমিটার।
গতিবেগের তুলনায় নিম্নচাপটি উপকূলে ক্ষয়ক্ষতি করেছিল বেশি। ২০০৯ সালে আমাদের উপকূলে আঘাত হানা 'সুপার সাইক্লোন' আইলায় (সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার) যেখানে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল কমবেশি ৩৩০, সেখানে সাধারণ একটি 'নিম্নচাপ' কেড়ে নিল ১২৮ জনের প্রাণ! প্রায় পাঁচ হাজার ঘরবাড়ির নানা মাত্রার ক্ষয়ক্ষতি, হাজার হাজার গাছপালা উপড়ে পড়া, ক্ষেতের ফসল ও পুকুরের মাছ নষ্ট হওয়ার বিষয় তো রয়েছেই।
সামান্য নিম্নচাপে অসামান্য ক্ষতির একটি কারণ অব্যবস্থাপনা, সন্দেহ নেই। আবহাওয়া দফতর যদি সতর্ক থাকত; যদি উপকূলে সময়মতো পূর্বাভাস প্রচার হতো, তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এত প্রাণ হারাতে হতো না। সম্পদের ক্ষতিও কম হতো। আমরা তো দেখলাম, সতর্কতা ও প্রস্তুতির গুণেই যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলে আছড়ে পড়া সুপার হারিকেন স্যান্ডিতে (সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৭৫ কিলোমিটার) প্রাণহানি নিয়ন্ত্রণে ছিল_ দুইশ' পার হয়নি। তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ আবার বিপদে পড়েছিল ঝড়ের সময় 'অ্যাডভেঞ্চার' উপভোগ করতে গিয়ে কিংবা বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটজনিত আগুনে। সতর্কতার গুণেই কিন্তু আইলার প্রাণহানির সংখ্যা সিডরের তুলনায় কম ছিল। অনেকের মনে থাকার কথা, সিডরের সময় সংখ্যাটি ১০ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সংশ্লিষ্টরা সতর্ক ছিল বলেই অন্ধ্রপ্রদেশে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় নিলমে প্রাণহানি হয়নি বললেই চলে।
একই সঙ্গে অবশ্য অন্য দিকটিও ভাবার মতো। তাত্তি্বক দিক থেকে এটি তো নিম্নচাপই ছিল, ঘূর্ণিঝড় নয়। কোনো নিম্নচাপের কেন্দ্রস্থলে ৩০ থেকে ৫০ কিলোমিটার বাতাসের গতিবেগ থাকলে সাধারণত তিন নম্বর সতর্ক সংকেতই প্রচার করে থাকে আবহাওয়া অধিদফতর। আলোচ্য নিম্নচাপটির ক্ষেত্রেও হয়তো তা-ই অনুসৃত হয়েছে। শেষ মুহূর্তে, বাতাসের গতিবেগ যখন বাড়ছিল তখন সতর্ক সংকেত তিন থেকে চারে উন্নীত করাই হয়তো উচিত ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেটা বাড়িয়ে কি কোনো লাভ হতো? ওই সময়ের মধ্যে মাঠপর্যায়ে কি সতর্ক বার্তার এই পরিবর্তন প্রচার করা সম্ভব হতো? তারও অনেক আগে যে বিপুলসংখ্যক জেলে মাছ ধরতে মাঝ সাগরে গিয়েছিলেন, তাদের কি ফিরিয়ে আনা যেত? তিন নম্বর সংকেত ঠেলেই তো তারা সাগরে গিয়েছিল। চার নম্বর সতর্ক সংকেত পেলেও তারা ক'জন ফিরতেন জানি না। এর আগে বিভিন্ন গবেষণা, সমীক্ষা ও কেসস্টাডিতে দেখা গেছে, জীবিকার অলঙ্ঘনীয় প্রয়োজনে ওইসব জেলে জীবনের দিকে নজর খানিকটা কমই দিতে পারেন। যদি ফিরেও আসতেন, প্রাণহানি হয়তো কমত; ঘরবাড়ি, গাছগাছালি, ফসলের মাঠ ও মাছের পুকুরের ক্ষয়ক্ষতি কি নিয়ন্ত্রণ করা যেত?
প্রশ্ন আরও আছে। মৌসুমে এক বা দুটি নিম্নচাপ না হয় সামাল দেওয়া গেল; কিন্তু একের পর এক যদি আসে? বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সাগরে নিম্নচাপের সংখ্যা বেড়েই চলছে। এখন প্রায় প্রমাণিত যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এই নতুন বিপদ। সাগরে নিম্নচাপের আধিক্য নিয়ে গবেষণা করেছেন জলবায়ু বিজ্ঞানী ড. আহসান উদ্দিন আহমেদ। গত বছরের জানুয়ারিতে সমকালের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, নিম্নচাপ বা সাগর উত্তাল হওয়ার ঘটনা গড়পড়তা অনেক বেড়ে গেছে। আগে যেখানে ৫-৬টা হতো, সেটা দাঁড়িয়েছে ১০-১২টায়।
এখন সেই হার আরও বেড়েছে আশঙ্কা করা যায়। এই অক্টোবরেই ২০ দিনে তিনটি নিম্নচাপ দেখা গেল উত্তর ভারত মহাসাগর এলাকায়। এর একটি আলোচ্য নিম্নচাপটি। পরের সপ্তাহে আরেকটি নিম্নচাপ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয় এবং সোমালিয়া উপকূলে 'মারজান' নামে আঘাত হানে। আরেকটি নিম্নচাপ যে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ঘূর্ণিঝড় 'নিলম' নাম ধারণ করে অন্ধ্র উপকূলে আঘাত হানে সেটা আগেই বলেছি। এমন কতটা নিম্নচাপ আমরা সামাল দেব? আর সতর্কতার মূল্যও বিবেচনার বিষয়। সাদা চোখে দেখলে নিম্নচাপের খবর এলে জেলেরা জাল ও নৌকা গুটিয়ে তীরে ফিরে আসবেন, ল্যাঠা চুকে গেল। কিন্তু সাগরে না গেলে তাদের চলবে কীভাবে? জেলেদের বড় অংশ মহাজনের কাছ থেকে আগাম মজুরি, আড়তদারের কাছে আগাম দাম নিয়ে সাগরে যান। নিম্নচাপের কারণে বারবার ফিরে আসতে হলে, সেগুলো পরিশোধ হবে কীভাবে? নিম্নচাপের ফলে ফসলের পঞ্জিকাই-বা কীভাবে অনুসরণ করা যাবে?
সাগরে দেখা দেওয়া ঘন ঘন নিম্নচাপের এই হচ্ছে উচ্চতর বিপদ। এই হচ্ছে 'নাম না জানা ঝড়'। সতর্ক সংকেত নেই, প্রস্তুতি নেই; ক্ষয়ক্ষতির বেলায় বার আনা। কথায় আছে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়; এখন দেখা যাচ্ছে, ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে নিম্নচাপের ধকল বেশি। এর গতিবেগ আবহাওয়া অধিদফতরে ধর্তব্য নয়; কিন্তু একজন জেলের কিংবা কৃষকের গোটা মৌসুমের সর্বনাশ করে দিয়ে যেতে পারে। 'ধ্বংসযজ্ঞ' না থাকায়; আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীর মনোযোগ হয়তো মিলবে না; কিন্তু উপকূলের উৎপাদন ব্যবস্থা ও প্রতিবেশ চক্রের বারটা বাজিয়ে দিতে পারে। ঘূর্ণিঝড় যেখানে বাঘের মতো আক্রমণ করে, নিম্নচাপ সেখানে যেন কেউটে সাপ।
আমরা সিডর, আইলা, নার্গিসদের ঠেকাতে নানা ব্যবস্থা নিচ্ছি। আশ্রয়কেন্দ্র, মাটির কেল্লা বাড়াতে হবে; উপকূলীয় বাঁধের নেটওয়ার্কটির উচ্চতা বাড়াতে হবে; সতর্কীকরণ ব্যবস্থা উন্নত ও সহজবোধ্য করতে হবে। পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে কীভাবে খাপ খাইয়ে চলা যায়, সে চেষ্টা চলছে। চলছে তহবিলের সংস্থান চেষ্টা। কিন্তু নিম্নচাপ নামের ধূসর ঝড়টি প্রায় নীরবে-নিভৃতে আমাদের গ্রাস করছে, তার কবল থেকে মুক্তি পেতে আমরা কি কিছু করছি? আমাদের নীতিনির্ধারকরা কি বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন? সময় কিন্তু বয়ে যাচ্ছে। যত দেরি হবে, নাম না জানা এই ঝড় তত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে।
শেখ রোকন :সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
ধূসর যুদ্ধের মতো ঝড়ের নামহীনতার সমস্যায় ভূপেন হাজারিকা হয়তো দুই কলি গানেই সমাধান দিয়ে দিতেন_ 'তার কোনো নাম নেই, তার কোনো নাম নেই; দিতে পার নাম তার অনামিকা'। হৃদয়ে যে ঝড় ওঠে, সেখানে এমন সমাধান দেওয়াই যায়; কিন্তু সাগর ও উপকূলের এই মামলা ততটা সহজ নয়। নামহীন এই ঝড় উদ্বেগজনক তো বটেই; কিন্তু প্রথমেই যা তৈরি হয় তার নাম খটকা। নাম থাকবে না?
গত কয়েক বছর ভারত মহাসাগরের উত্তরাংশে উদ্ভূত যেসব নিম্নচাপ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে তার সবগুলোরই নাম ছিল_ সিডর, আইলা, নার্গিস, বিজলী, রেশমি প্রভৃতি। পাঠকের কৌতূহলের প্রতি সাড়া দিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ প্রক্রিয়া ও তাৎপর্য নিয়ে সংবাদও প্রকাশ হয়েছে। অনেকে জানেন, সাগরে নিম্নচাপ শুরু হলেই আঞ্চলিক আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রগুলো সেটির দিকে নজর রাখে। কেন্দ্রস্থলে বাতাসের গতিবেগ কমবেশি ৬৫ কিলোমিটারে পেঁৗছলেই নিম্নচাপ ঘূর্ণিঝড়ে 'পরিণত' হয়। তখন পূর্বনির্ধারিত তালিকা থেকে তার নামকরণ হয়। অবশ্য নিম্নচাপেরও একটি কারিগরি নাম থাকে। সাধারণত মৌসুমের (মে থেকে নভেম্বর) প্রথম নিম্নচাপটিকে এক নম্বর ধরে গণনা দিয়ে শুরু হয়। সঙ্গে থাকে সাগরের নামের সংক্ষেপিত রূপ।
১০ অক্টোবর রাতের আঁধারে আমাদের উপকূলে আছড়ে পড়া ঘূর্ণিঝড় কিংবা নিম্নচাপটিকেও একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। যদিও ঝড়ের সময় আমাদের আবহাওয়া দফতর ঘুমিয়ে ছিল; যদিও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব স্বয়ং ফোন করে বুধবার বিকেলে চার নম্বর বিপদ সংকেত প্রদর্শনের অনুরোধ করা সত্ত্বেও 'অফিস সময়' ফুরিয়ে যাওয়ার অজুহাতে তা আমলে নেয়নি; আইএমডি (ইন্ডিয়ান মেটিওরোজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট) নিম্নচাপটির গতিবিধির ওপর নজর রেখেছিল। তারা এর নাম দিয়েছিল 'বিওবি ওয়ান'। বে অব বেঙ্গল ওয়ান। মর্যাদার দিক থেকে 'ঘূর্ণিঝড়' না হলেও এর গতিবেগ প্রায় ঘূর্ণিঝড়ের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। শীর্ষকালীন তিন মিনিটে ছিল ঘণ্টায় ৫৫ কিলোমিটার।
গতিবেগের তুলনায় নিম্নচাপটি উপকূলে ক্ষয়ক্ষতি করেছিল বেশি। ২০০৯ সালে আমাদের উপকূলে আঘাত হানা 'সুপার সাইক্লোন' আইলায় (সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার) যেখানে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল কমবেশি ৩৩০, সেখানে সাধারণ একটি 'নিম্নচাপ' কেড়ে নিল ১২৮ জনের প্রাণ! প্রায় পাঁচ হাজার ঘরবাড়ির নানা মাত্রার ক্ষয়ক্ষতি, হাজার হাজার গাছপালা উপড়ে পড়া, ক্ষেতের ফসল ও পুকুরের মাছ নষ্ট হওয়ার বিষয় তো রয়েছেই।
সামান্য নিম্নচাপে অসামান্য ক্ষতির একটি কারণ অব্যবস্থাপনা, সন্দেহ নেই। আবহাওয়া দফতর যদি সতর্ক থাকত; যদি উপকূলে সময়মতো পূর্বাভাস প্রচার হতো, তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এত প্রাণ হারাতে হতো না। সম্পদের ক্ষতিও কম হতো। আমরা তো দেখলাম, সতর্কতা ও প্রস্তুতির গুণেই যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলে আছড়ে পড়া সুপার হারিকেন স্যান্ডিতে (সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৭৫ কিলোমিটার) প্রাণহানি নিয়ন্ত্রণে ছিল_ দুইশ' পার হয়নি। তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ আবার বিপদে পড়েছিল ঝড়ের সময় 'অ্যাডভেঞ্চার' উপভোগ করতে গিয়ে কিংবা বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটজনিত আগুনে। সতর্কতার গুণেই কিন্তু আইলার প্রাণহানির সংখ্যা সিডরের তুলনায় কম ছিল। অনেকের মনে থাকার কথা, সিডরের সময় সংখ্যাটি ১০ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সংশ্লিষ্টরা সতর্ক ছিল বলেই অন্ধ্রপ্রদেশে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় নিলমে প্রাণহানি হয়নি বললেই চলে।
একই সঙ্গে অবশ্য অন্য দিকটিও ভাবার মতো। তাত্তি্বক দিক থেকে এটি তো নিম্নচাপই ছিল, ঘূর্ণিঝড় নয়। কোনো নিম্নচাপের কেন্দ্রস্থলে ৩০ থেকে ৫০ কিলোমিটার বাতাসের গতিবেগ থাকলে সাধারণত তিন নম্বর সতর্ক সংকেতই প্রচার করে থাকে আবহাওয়া অধিদফতর। আলোচ্য নিম্নচাপটির ক্ষেত্রেও হয়তো তা-ই অনুসৃত হয়েছে। শেষ মুহূর্তে, বাতাসের গতিবেগ যখন বাড়ছিল তখন সতর্ক সংকেত তিন থেকে চারে উন্নীত করাই হয়তো উচিত ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেটা বাড়িয়ে কি কোনো লাভ হতো? ওই সময়ের মধ্যে মাঠপর্যায়ে কি সতর্ক বার্তার এই পরিবর্তন প্রচার করা সম্ভব হতো? তারও অনেক আগে যে বিপুলসংখ্যক জেলে মাছ ধরতে মাঝ সাগরে গিয়েছিলেন, তাদের কি ফিরিয়ে আনা যেত? তিন নম্বর সংকেত ঠেলেই তো তারা সাগরে গিয়েছিল। চার নম্বর সতর্ক সংকেত পেলেও তারা ক'জন ফিরতেন জানি না। এর আগে বিভিন্ন গবেষণা, সমীক্ষা ও কেসস্টাডিতে দেখা গেছে, জীবিকার অলঙ্ঘনীয় প্রয়োজনে ওইসব জেলে জীবনের দিকে নজর খানিকটা কমই দিতে পারেন। যদি ফিরেও আসতেন, প্রাণহানি হয়তো কমত; ঘরবাড়ি, গাছগাছালি, ফসলের মাঠ ও মাছের পুকুরের ক্ষয়ক্ষতি কি নিয়ন্ত্রণ করা যেত?
প্রশ্ন আরও আছে। মৌসুমে এক বা দুটি নিম্নচাপ না হয় সামাল দেওয়া গেল; কিন্তু একের পর এক যদি আসে? বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সাগরে নিম্নচাপের সংখ্যা বেড়েই চলছে। এখন প্রায় প্রমাণিত যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এই নতুন বিপদ। সাগরে নিম্নচাপের আধিক্য নিয়ে গবেষণা করেছেন জলবায়ু বিজ্ঞানী ড. আহসান উদ্দিন আহমেদ। গত বছরের জানুয়ারিতে সমকালের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, নিম্নচাপ বা সাগর উত্তাল হওয়ার ঘটনা গড়পড়তা অনেক বেড়ে গেছে। আগে যেখানে ৫-৬টা হতো, সেটা দাঁড়িয়েছে ১০-১২টায়।
এখন সেই হার আরও বেড়েছে আশঙ্কা করা যায়। এই অক্টোবরেই ২০ দিনে তিনটি নিম্নচাপ দেখা গেল উত্তর ভারত মহাসাগর এলাকায়। এর একটি আলোচ্য নিম্নচাপটি। পরের সপ্তাহে আরেকটি নিম্নচাপ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয় এবং সোমালিয়া উপকূলে 'মারজান' নামে আঘাত হানে। আরেকটি নিম্নচাপ যে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ঘূর্ণিঝড় 'নিলম' নাম ধারণ করে অন্ধ্র উপকূলে আঘাত হানে সেটা আগেই বলেছি। এমন কতটা নিম্নচাপ আমরা সামাল দেব? আর সতর্কতার মূল্যও বিবেচনার বিষয়। সাদা চোখে দেখলে নিম্নচাপের খবর এলে জেলেরা জাল ও নৌকা গুটিয়ে তীরে ফিরে আসবেন, ল্যাঠা চুকে গেল। কিন্তু সাগরে না গেলে তাদের চলবে কীভাবে? জেলেদের বড় অংশ মহাজনের কাছ থেকে আগাম মজুরি, আড়তদারের কাছে আগাম দাম নিয়ে সাগরে যান। নিম্নচাপের কারণে বারবার ফিরে আসতে হলে, সেগুলো পরিশোধ হবে কীভাবে? নিম্নচাপের ফলে ফসলের পঞ্জিকাই-বা কীভাবে অনুসরণ করা যাবে?
সাগরে দেখা দেওয়া ঘন ঘন নিম্নচাপের এই হচ্ছে উচ্চতর বিপদ। এই হচ্ছে 'নাম না জানা ঝড়'। সতর্ক সংকেত নেই, প্রস্তুতি নেই; ক্ষয়ক্ষতির বেলায় বার আনা। কথায় আছে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়; এখন দেখা যাচ্ছে, ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে নিম্নচাপের ধকল বেশি। এর গতিবেগ আবহাওয়া অধিদফতরে ধর্তব্য নয়; কিন্তু একজন জেলের কিংবা কৃষকের গোটা মৌসুমের সর্বনাশ করে দিয়ে যেতে পারে। 'ধ্বংসযজ্ঞ' না থাকায়; আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীর মনোযোগ হয়তো মিলবে না; কিন্তু উপকূলের উৎপাদন ব্যবস্থা ও প্রতিবেশ চক্রের বারটা বাজিয়ে দিতে পারে। ঘূর্ণিঝড় যেখানে বাঘের মতো আক্রমণ করে, নিম্নচাপ সেখানে যেন কেউটে সাপ।
আমরা সিডর, আইলা, নার্গিসদের ঠেকাতে নানা ব্যবস্থা নিচ্ছি। আশ্রয়কেন্দ্র, মাটির কেল্লা বাড়াতে হবে; উপকূলীয় বাঁধের নেটওয়ার্কটির উচ্চতা বাড়াতে হবে; সতর্কীকরণ ব্যবস্থা উন্নত ও সহজবোধ্য করতে হবে। পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে কীভাবে খাপ খাইয়ে চলা যায়, সে চেষ্টা চলছে। চলছে তহবিলের সংস্থান চেষ্টা। কিন্তু নিম্নচাপ নামের ধূসর ঝড়টি প্রায় নীরবে-নিভৃতে আমাদের গ্রাস করছে, তার কবল থেকে মুক্তি পেতে আমরা কি কিছু করছি? আমাদের নীতিনির্ধারকরা কি বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন? সময় কিন্তু বয়ে যাচ্ছে। যত দেরি হবে, নাম না জানা এই ঝড় তত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে।
শেখ রোকন :সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
No comments