আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলন- বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা কতটুকু? by সমীরণ রায়

এক সমাজ, এক গন্তব্য—এ স্লোগান ধারণ করে আজ রোববার কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে শুরু হচ্ছে তিন দিনব্যাপী আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলন। এটি আসিয়ানের ২১তম আসর। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১০টি দেশের এ গতিশীল গ্রুপের জন্ম ১৯৬৭ সালে। ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ফিলিপাইনকে নিয়ে যাত্রা শুরু করে এই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সংস্থা।


১৯৮৪ সালে ব্রুনাই এতে যোগ দেয়। ১৯৯০-এর দশকের শেষভাগে যোগ দেয় ভিয়েতনাম, লাওস, মিয়ানমার ও কম্বোডিয়া। শুরুর দিকে তিন থেকে পাঁচ বছরে একবার শীর্ষ সম্মেলন হতো। ২০০১ সাল থেকে বছরে একবার সম্মেলন হয়েছে। ২০০৮ সালে আসিয়ান চার্টার কার্যকর হয়। তার পর থেকে সনদ অনুসারে বছরে দুবার এ শীর্ষ সম্মেলন হচ্ছে।
দেশগুলো ২০১৫ সালের মধ্যে আসিয়ান কমিউনিটি গঠনের অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক কমিউনিটি, রাজনৈতিক নিরাপত্তা কমিউনিটি ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক কমিউনিটি গড়ার মাধ্যমে তা করা হচ্ছে। তিনটি ক্ষেত্রেই দেশগুলো ধাপে ধাপে একীভূত হচ্ছে। চাপিয়ে দিয়ে নয়, ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ইতিমধ্যে এ অঞ্চল শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। তারা ২০০১ সাল থেকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল চুক্তি বলবৎ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। তবে সদস্যরা অর্থনৈতিক একীভূতকরণকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। দেশগুলো আমদানি শুল্ক কমিয়ে ২০১৫ সালের মধ্যে আসিয়ান মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গড়ে তুলবে। ৬১ কোটি মানুষের এ অঞ্চলে বর্তমানে মাথাপিছু গড় আয় প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ডলার। গত এক দশকে গড় প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৬ শতাংশ। গত বছর আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য আড়াই হাজার বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ বাণিজ্য হয়েছে নিজেদের মধ্যে। ৭৫ শতাংশ হয়েছে বহির্বিশ্বের সঙ্গে, যার শীর্ষে আছে চীন। তারপর ২৭টি দেশের ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া। গত তিন বছরে আসিয়ান যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্যদের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করেছে। কানাডা, রাশিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সঙ্গেও আসিয়ানের বাণিজ্য দ্রুত বাড়ছে। ইতিমধ্যেই নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও কানাডার সঙ্গেও চুক্তি সম্পাদনের লক্ষ্যে আলোচনা চলছে। বিশ্বমন্দার মধ্যেও আসিয়ান বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রবৃদ্ধি অর্জন অব্যাহত রেখেছে। ২০০৯ সালে ২৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এসেছিল। ২০১০ সালে তা ৬৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। এর সিংহভাগই এসেছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইইউ ও চীন থেকে। পর্যটক আকর্ষণের ক্ষেত্রেও এ অঞ্চল সাফল্য দেখিয়ে যাচ্ছে।
এমন একটি অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার জন্য অনেক দেশই উন্মুখ থাকে। গত দশকের শুরুতেই চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে নিয়ে আসিয়ান+৩ গঠিত হয়। ২০০৫ সালে ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড মিলে আসিয়ান+৬ হয়। সবার অংশগ্রহণে পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তার পর থেকে এটি বার্ষিক আয়োজনে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছরের শেষভাগে অনুষ্ঠিত আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনের সঙ্গে ইস্ট এশিয়া সামিটও অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এদিকে প্রশান্ত মহাসাগরের তীরবর্তী ২১টি দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোট ‘এপেক’ গঠনের মাধ্যমে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার পরও যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে নিজস্ব স্বার্থ অটুট রাখার বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি। রাশিয়াও পাঁচ দশক আগের মৈত্রী সম্পর্ক ধরে রেখে এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য-বিনিয়োগ সহযোগিতা জোরদার করতে চায়। তাই যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া ২০১০ সালে এর পূর্ণ সদস্য হয়। ২০১১ সালের মতো এবারও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন। দ্বিতীয় মেয়াদে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর এটাই তাঁর প্রথম বিদেশ সফর। তিনি একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র থাইল্যান্ড ও গণতন্ত্রের পথে আগুয়ান মিয়ানমার সফর করবেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও আসছেন। এতে এবারের আসিয়ান সম্মেলনকে ঘিরে নতুন উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে। ইস্ট এশিয়া সামিট এখন ১৮টি দেশের প্যান-এশিয়ান ফোরামে পরিণত হয়েছে।
আসিয়ান নিয়ে বিশ্বের তারকা অর্থনীতিগুলোর অদম্য আগ্রহ বাংলাদেশকেও আকৃষ্ট করেছে। বাণিজ্য-বিনিয়োগে ন্যায্য হিস্যা আদায়ে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগ দিয়েছে। পাশাপাশি সার্ক মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থা, বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী সাতটি দেশ নিয়ে বিমসটেক, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আটটি দেশ নিয়ে ডেভেলপিং-৮, ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী ১৯টি দেশ নিয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা আইওআর এবং নেপাল, ভুটান ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্য নিয়ে ‘প্রবৃদ্ধি চতুষ্টয়’ গড়ার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার করার বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ এখন আসিয়ান আঞ্চলিক ফোরামের সদস্য। ২৭টি দেশের এ ফোরামে প্যান-এশিয়ান ১৮টি দেশের বাইরে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানসহ এশিয়ার নয়টি দেশ আছে।
বাংলাদেশকে ভবিষ্যতের আসিয়ান+৯ বা আসিয়ান+১২-তে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়াসহ কয়েকটি দেশের সমর্থন পাওয়া যেতে পারে। এসব দেশে শ্রমিকের মজুরি অনেক বেড়ে গেছে। তাই তারা শ্রমঘন শিল্পপণ্যের জোগান অন্য দেশ থেকে আনতে চায়। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওসসহ যেসব দেশ আউটসোর্স হিসেবে কাজ করছে, তাদের সামর্থ্য সীমিত। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত কম মজুরিতে পর্যাপ্ত শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে। এখন দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষের বয়স ১৫ থেকে ৬৪ বছরের মধ্যে। আন্তর্জাতিকভাবে এই জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সুবিধাকে একটি দেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনের স্বর্ণযুগ বলা হয়। বিশ্বব্যাংকের মতে, এ বিশাল কর্মক্ষম মানুষকে পুরোদমে কাজে লাগাতে পারলে প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে উন্নীত হবে এবং ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে। অপর দিকে, বাংলাদেশের এ কর্মক্ষম বিশাল জনগোষ্ঠী প্যান-এশিয়ান ফোরামের উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর জন্য আকর্ষণীয় সম্পদ হতে পারে, যা ব্যাপক বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রধান উপকরণ হতে পারে। এতে অবকাঠামো উন্নয়ন ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলাও সহজ হবে। আসিয়ানের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বর্তমানের চার বিলিয়ন ডলার থেকে বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। একটা উইন-উইন সম্পর্ক গড়ে উঠবে। বাণিজ্য-বিনিয়োগ বাড়লে দেশের সেবা খাতও বিকাশ লাভ করবে। এ লক্ষ্য অর্জনে সরকারি নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। প্যান-এশিয়ান ফোরামে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধাগুলো তুলে ধরতে হবে। এভাবে আসিয়ানসহ প্যান-এশিয়ান ফোরামের সঙ্গে কার্যকর বাণিজ্য-বিনিয়োগ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
 সমীরণ রায়: বাণিজ্য বিশ্লেষক।
samiron.roy.1957@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.