আঞ্চলিক সহযোগিতা-দক্ষিণ এশিয়া :বিকেন্দ্রীকরণ ও গণতন্ত্রায়ন by ইমতিয়াজ আহমেদ
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সার্ক নামের সংস্থার সদস্য। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় সম্মেলন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ সংস্থার আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ। তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় লে. জেনারেল এইচএম এরশাদ। পাকিস্তানের ক্ষমতা ছিল জেনারেল জিয়াউল হকের হাতে। ভুটান ও নেপালে কায়েম ছিল রাজতন্ত্র।
কিন্তু এখন কতই না পরিবর্তন। এ সংস্থাভুক্ত কোনো দেশেই সামরিক শাসন নেই। ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটছে নির্বাচনের মাধ্যমে। পাকিস্তানে নির্বাচিত একটি সরকার প্রায় পাঁচ বছর ক্ষমতায় রয়েছে, যাকে অনন্য বলেই অভিহিত করা হচ্ছে। ভুটানের রাজপরিবার থেকেই দেশকে গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন উঠছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রকৃতই কি গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে? নাকি কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণই প্রাধান্য বিস্তার করে আছে।
এ ধরনের সমস্যার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র চর্চার ধরনকেই অনেকে দায়ী করছেন। গণতন্ত্র বলতে এখন নিছকই নিয়মিত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানকে বোঝানো হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক কাঠামো এবং বিভিন্ন দলের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের চর্চা না হলে সুশাসনের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটাই স্বাভাবিক। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ বা শ্রীলংকায় এর মাত্রায় হেরফের থাকতেই পারে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের কর্তৃত্ববাদী মনোভাব বলা যায় সব দেশেই মোটামুটি সমান। এ থেকে বের হয়ে আসার জন্য সিভিল সোসাইটির তাগিদ আছে যথেষ্টই। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে নিষ্কৃতি মিলবে, তেমন ভরসা করা হচ্ছে না।
পনেরো বছর আগের একটি আলোচনার কথা আমি বলতে চাই। ১৯৯৬ সালে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন মনিটর করার জন্য বাংলাদেশ থেকে একটি দল গিয়েছিল। ওই বছরের জুনেই আমাদের দেশে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তা ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এবং নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সে সময়ে সদ্যবিদায়ী প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন তদারকির জন্য আমরা দু'জনেই ছিলাম বাংলাদেশ থেকে যাওয়া দক্ষিণ এশীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রতিনিধি দলে। করাচির পার্ল কন্টিনেন্টাল হোটেলে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার সময় তিনি স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, এ দুটি বিষয়ে উপলব্ধির যথেষ্ট অভাব এ অঞ্চলের দেশগুলোতে কমবেশি পরিলক্ষিত হয়। তিনি বেশ চিত্তাকর্ষক মন্তব্য করেছিলেন এভাবে, আমরা 'স্বায়ত্তশাসন' শব্দটির যথার্থ অর্থ বুঝি না। ব্রিটিশ ও ইউরোপীয়রা সম্ভবত তা বোঝে। আমরা কেবল বুঝি নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অথবা স্বাধীনতা। এভাবেই আমরা ১৯৪৭ এবং ১৯৭১ সালকে দেখতে পারি।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বিকেন্দ্রীকরণ কিংবা ক্ষমতার বণ্টন। যদি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে তাহলে এর অপব্যবহার হতে পারে। দুর্নীতিরও অনেক সুযোগ থাকে। লর্ড অকটনের উক্তি আমরা স্মরণ করতে পারি : 'চড়বিৎ ঃবহফং ঃড় পড়ৎৎঁঢ়ঃ, ধহফ ধনংড়ষঁঃব ঢ়ড়বিৎ পড়ৎৎঁঢ়ঃং ধনংড়ষঁঃবষু.'
প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। কেন্দ্র থেকে ইউনিট ও সাব-ইউনিটে কিংবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও অঞ্চলের মধ্যে তা বণ্টন করতে হয়।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সরকারের দুটি স্তর_ উভয়েই কাজ করবে একই ভূখণ্ডে এবং একই মানুষকে নিয়ে। কিন্তু প্রত্যেকে নিজ নিজ অঙ্গনে থাকবে স্বায়ত্তশাসিত। এটা ঘটতে পারে কেন্দ্র-প্রদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিংবা পার্লামেন্টের উচ্চ ও নিম্ন কক্ষের মধ্যে। যেভাবেই দেখি না কেন, মূল কথা হচ্ছে ক্ষমতা ভাগাভাগি করা। রাষ্ট্রের ক্ষমতা থাকবেই। একই সঙ্গে সমাজের হাতেও ক্ষমতা চাই। এ প্রসঙ্গে আমরা রবীন্দ্রনাথের 'কথামালা' নিয়ে কথা বলতে পারি। ১৮৯০ সালের আগস্টে লন্ডন সফরকালে এর বর্ণনা তিনি দিয়েছিলেন। মাস দুয়েক থাকার পরই লন্ডন তাকে ক্লান্ত করে তুলেছিল। ুএকঘেয়েমিও ছিল। এক সমাজ ও সংস্কৃতিতে যা আদর্শ ও নিয়ম, অন্য সমাজে যে তা নয় সেটা বোঝাতে তিনি আমাদের জানা একটি গল্পকেই তার মতো বলেছিলেন অনেকটা এভাবে :এক চতুর শেয়ালের বন্ধু ছিল এক পণ্ডিত সারস। একদিন শেয়াল সারসকে মধ্যহ্নভোজে আমন্ত্রণ জানাল। কিন্তু স্যুপ পরিবেশন করল থালায়। সারসের লম্বা ঠোঁট। তাই থালা থেকে স্যুপ খেতে পারল না। সে না খেয়েই বাসায় ফিরে এলো। পরের দিন সারস শেয়ালকে খাবারের আমন্ত্রণ জানাল এবং গরম ভাত পরিবেশন করল সরু গলার একটি জগে। শেয়ালটি কিছুই খেতে পারল না। সারসটি মজা করে খেল। শেয়ালটি অভুক্ত রয়ে গেল।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, পরিবেশিত খাবার উভয়ের জন্যই সুস্বাদু ছিল। কিন্তু পরিবেশন পাত্রই সব পার্থক্য টেনে দিল। সাংস্কৃতিক নিয়মকানুন কিংবা রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়তো কোনো সমাজের জন্য আদর্শ; কিন্তু কোন্ পাত্রে তা রাখা আছে সেটা বুঝতে হবে। খাদ্যের স্বাদ উপভোগ এবং তা পেটের উপযোগী করে তোলার জন্য পাত্রের কথা ভাবতেই হবে। ইউরোপের সংস্কৃতিতে গণতন্ত্রের বিকেন্দ্রীকরণ যেভাবে হয়েছে সেটা দক্ষিণ এশিয়ায় হুবহু প্রয়োগ করতে যাওয়া ভুল হবে এবং এ কারণেই এ কাজটি বেশ কঠিন।
ভারতবর্ষে মোগল রাজত্ব ছিল কয়েকশ' বছরের। সেখানে এক ধরনের ফেডারেল ব্যবস্থা ছিল। সম্রাট আকবর সাম্রাজ্যকে ১২ ভাগে ভাগ করেছিলেন। আওরঙ্গজেব তা বাড়িয়ে করেন ২১টি। দখল করা এলাকায় কর্তৃত্ব সংহত করা এবং প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়াতেই এ পদক্ষেপ। কিন্তু আধুনিক সমাজের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ বলতে যা বোঝায়, এটা আদৌ তা নয়। এখন ভারসাম্য ও ক্ষমতার বণ্টনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
ঔপনিবেশিক শাসনামলে দক্ষিণ এশিয়াতে বিশেষভাবে রাষ্ট্র ও সমাজের ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। জাতি, জাতীয়তাবাদ, জাতি-রাষ্ট্র এসব ধারণা সামনে এসেছে। স্বায়ত্তশাসন ও সমাজের নানা স্তরে গণতন্ত্রায়নের দাবি জোরালো হচ্ছে। ১৯০৫-১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গের কথা ধরা যাক। প্রশাসনিক বিভক্তি কেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে প্রতিবাদের ঢেউ সৃষ্টি করল? পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের পূর্ববঙ্গে প্রবেশে কোনো বাধা ছিল না, পাসপোর্ট-ভিসাও চালু করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাগ এবং প্রদেশের স্বায়ত্তশাসনকে দেখা হয়েছিল 'জাতি' বিবেচনায়, এখন যাকে বলা যায় সমাজ। এই সমাজ সভ্যতা ও ঐতিহাসিকভাবে রাষ্ট্র থেকে পৃথক সত্তা বজায় রেখে চলেছে। এ প্রতিবাদের মধ্যে জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার তেমন স্থান ছিল না।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিভক্তির বিষয়টি নিয়েও আলোচনা করা যায়। জনগণের রায় কার্যকর করা শাসকদের পক্ষে কেন এত কঠিন হয়ে উঠল? প্রকৃতপক্ষে, স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে প্রশাসনিক সুবিধা বা গণতন্ত্রায়ন ও জনগণের ক্ষমতায়নের দৃষ্টিতে নয় বরং দেখা হয়েছে 'জাতি' এবং অঞ্চলের পুনর্বিন্যাস হিসেবে। আরও মজার বিষয় যে, একাত্তর-পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয় রাষ্ট্রেই গণতন্ত্র চর্চা বাড়েনি বরং কর্তৃত্ববাদী শাসন জোরালো হয়েছে। শ্রীলংকাতেও তামিল টাইগাররা বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন চেয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলীদের কর্তৃত্ববাদী শাসন চেপে বসেছে তাদের ওপর। ভারতের গুজরাট রাজ্যে বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদির শাসনের কথা আমরা বলতে পারি। মানবতার বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধ সংঘটনের পরও তিনি বিপুল ভোটে পুনর্নির্বাচিত হচ্ছেন।
ভারতের আরেকটি দৃষ্টান্তও উদ্বেগজনক। বিকেন্দ্রীকরণ কীভাবে কর্তৃত্বপরায়ণতা নিয়ে আসে সেটা দেখা যাবে এ খবরে। এএফপি পরিবেশিত খবরে বলা হয়, রাজস্থানের দাউসা জেলার একটি পঞ্চায়েত ছেলেদের সঙ্গে মোবাইলে মেয়েদের যখন তখন কথা বলার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। দুটি ছেলেমেয়ে পালানোর ঘটনার পর এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
এ অবস্থায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ থেকে কী ফল মিলবে? আমাদের তিনটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। প্রথমত, গণতন্ত্রের ভিত গভীরে প্রোথিত করা। কেবল ইলেক্টোরাল ডেমোক্রেসি বা নির্বাচিত কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন নয়, বরং আলোচনা ও মতামতের ভিত্তিতে শাসনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। রাজনৈতিক ও সামাজিক উভয় ক্ষেত্রেই এর প্রয়োগ চাই। প্রকৃতপক্ষে ইলেক্টোরাল ডেমোক্রেসিকে যুক্তিসঙ্গতভাবেই অনুদার বা সংকীর্ণ গণতন্ত্র হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। যদি রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে গণতন্ত্র্রের চর্চা হতে থাকে, সরকারের অর্থ ব্যয় এবং বিভিন্ন পদে নিয়োগে এর প্রভাব পড়ে এবং দলের মধ্যেও গণতন্ত্র চালু হয় তাহলে মানি ও মাসলের ক্ষমতা খর্ব হবে এবং রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের অনৈতিক সংযোগও ছিন্ন হবে। এমনকি শীর্ষ নেতাদের যা খুশি তা করার কর্তৃত্বেও টান পড়বে।
দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দল পরিচালনায় পেশাদারিত্ব আনা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে পরিবারতন্ত্র জেঁকে বসেছে। প্রধান দলগুলোতে এ প্রবণতা ব্যাপক। প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীতে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ হলে তা থেকে সুফল মেলে, এ অভিজ্ঞতা রয়েছে। করপোরেট সেক্টরও এ নীতি অনুসরণ করছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলে এর প্রতিফলন দেখা যায় না। তারা এ পথে না চললে রাষ্ট্র ও সমাজের গণতন্ত্রায়ন কঠিন হবে।
তৃতীয়ত, সিভিল সোসাইটির ক্ষমতায়ন। দক্ষিণ এশিয়া কিংবা ঔপনিবেশিক-পূর্ব যুগের ভারতবর্ষে সিভিল সোসাইটিকে পলিটিক্যাল সোসাইটি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে দেওয়া হয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলে সিভিল সোসাইটি সামনে চলে আসে এবং স্বাধীনতার সংগ্রামে সক্রিয় অবদান রাখে। তবে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর তাদের মধ্যে মেরুকরণ লক্ষ্য করা যায়। আরও মজার ব্যাপার যে, তারা এটা করেন গণতন্ত্র ও বিকেন্দ্রীকরণের স্লোগান তুলেই। আর এ কারণেই সিভিল সোসাইটির ক্ষমতায়নের জন্য এখন প্রয়োজন সৃজনশীল প্রয়াস। রাষ্ট্র ও সমাজে যে বিভাজন তার অবসানের জন্য তাদের নির্ধারক ভূমিকার প্রয়োজন অপরিসীম।
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ : অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক
এ ধরনের সমস্যার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র চর্চার ধরনকেই অনেকে দায়ী করছেন। গণতন্ত্র বলতে এখন নিছকই নিয়মিত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানকে বোঝানো হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক কাঠামো এবং বিভিন্ন দলের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের চর্চা না হলে সুশাসনের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটাই স্বাভাবিক। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ বা শ্রীলংকায় এর মাত্রায় হেরফের থাকতেই পারে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের কর্তৃত্ববাদী মনোভাব বলা যায় সব দেশেই মোটামুটি সমান। এ থেকে বের হয়ে আসার জন্য সিভিল সোসাইটির তাগিদ আছে যথেষ্টই। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে নিষ্কৃতি মিলবে, তেমন ভরসা করা হচ্ছে না।
পনেরো বছর আগের একটি আলোচনার কথা আমি বলতে চাই। ১৯৯৬ সালে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন মনিটর করার জন্য বাংলাদেশ থেকে একটি দল গিয়েছিল। ওই বছরের জুনেই আমাদের দেশে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তা ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এবং নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সে সময়ে সদ্যবিদায়ী প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন তদারকির জন্য আমরা দু'জনেই ছিলাম বাংলাদেশ থেকে যাওয়া দক্ষিণ এশীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রতিনিধি দলে। করাচির পার্ল কন্টিনেন্টাল হোটেলে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার সময় তিনি স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, এ দুটি বিষয়ে উপলব্ধির যথেষ্ট অভাব এ অঞ্চলের দেশগুলোতে কমবেশি পরিলক্ষিত হয়। তিনি বেশ চিত্তাকর্ষক মন্তব্য করেছিলেন এভাবে, আমরা 'স্বায়ত্তশাসন' শব্দটির যথার্থ অর্থ বুঝি না। ব্রিটিশ ও ইউরোপীয়রা সম্ভবত তা বোঝে। আমরা কেবল বুঝি নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অথবা স্বাধীনতা। এভাবেই আমরা ১৯৪৭ এবং ১৯৭১ সালকে দেখতে পারি।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বিকেন্দ্রীকরণ কিংবা ক্ষমতার বণ্টন। যদি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে তাহলে এর অপব্যবহার হতে পারে। দুর্নীতিরও অনেক সুযোগ থাকে। লর্ড অকটনের উক্তি আমরা স্মরণ করতে পারি : 'চড়বিৎ ঃবহফং ঃড় পড়ৎৎঁঢ়ঃ, ধহফ ধনংড়ষঁঃব ঢ়ড়বিৎ পড়ৎৎঁঢ়ঃং ধনংড়ষঁঃবষু.'
প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। কেন্দ্র থেকে ইউনিট ও সাব-ইউনিটে কিংবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও অঞ্চলের মধ্যে তা বণ্টন করতে হয়।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সরকারের দুটি স্তর_ উভয়েই কাজ করবে একই ভূখণ্ডে এবং একই মানুষকে নিয়ে। কিন্তু প্রত্যেকে নিজ নিজ অঙ্গনে থাকবে স্বায়ত্তশাসিত। এটা ঘটতে পারে কেন্দ্র-প্রদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিংবা পার্লামেন্টের উচ্চ ও নিম্ন কক্ষের মধ্যে। যেভাবেই দেখি না কেন, মূল কথা হচ্ছে ক্ষমতা ভাগাভাগি করা। রাষ্ট্রের ক্ষমতা থাকবেই। একই সঙ্গে সমাজের হাতেও ক্ষমতা চাই। এ প্রসঙ্গে আমরা রবীন্দ্রনাথের 'কথামালা' নিয়ে কথা বলতে পারি। ১৮৯০ সালের আগস্টে লন্ডন সফরকালে এর বর্ণনা তিনি দিয়েছিলেন। মাস দুয়েক থাকার পরই লন্ডন তাকে ক্লান্ত করে তুলেছিল। ুএকঘেয়েমিও ছিল। এক সমাজ ও সংস্কৃতিতে যা আদর্শ ও নিয়ম, অন্য সমাজে যে তা নয় সেটা বোঝাতে তিনি আমাদের জানা একটি গল্পকেই তার মতো বলেছিলেন অনেকটা এভাবে :এক চতুর শেয়ালের বন্ধু ছিল এক পণ্ডিত সারস। একদিন শেয়াল সারসকে মধ্যহ্নভোজে আমন্ত্রণ জানাল। কিন্তু স্যুপ পরিবেশন করল থালায়। সারসের লম্বা ঠোঁট। তাই থালা থেকে স্যুপ খেতে পারল না। সে না খেয়েই বাসায় ফিরে এলো। পরের দিন সারস শেয়ালকে খাবারের আমন্ত্রণ জানাল এবং গরম ভাত পরিবেশন করল সরু গলার একটি জগে। শেয়ালটি কিছুই খেতে পারল না। সারসটি মজা করে খেল। শেয়ালটি অভুক্ত রয়ে গেল।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, পরিবেশিত খাবার উভয়ের জন্যই সুস্বাদু ছিল। কিন্তু পরিবেশন পাত্রই সব পার্থক্য টেনে দিল। সাংস্কৃতিক নিয়মকানুন কিংবা রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়তো কোনো সমাজের জন্য আদর্শ; কিন্তু কোন্ পাত্রে তা রাখা আছে সেটা বুঝতে হবে। খাদ্যের স্বাদ উপভোগ এবং তা পেটের উপযোগী করে তোলার জন্য পাত্রের কথা ভাবতেই হবে। ইউরোপের সংস্কৃতিতে গণতন্ত্রের বিকেন্দ্রীকরণ যেভাবে হয়েছে সেটা দক্ষিণ এশিয়ায় হুবহু প্রয়োগ করতে যাওয়া ভুল হবে এবং এ কারণেই এ কাজটি বেশ কঠিন।
ভারতবর্ষে মোগল রাজত্ব ছিল কয়েকশ' বছরের। সেখানে এক ধরনের ফেডারেল ব্যবস্থা ছিল। সম্রাট আকবর সাম্রাজ্যকে ১২ ভাগে ভাগ করেছিলেন। আওরঙ্গজেব তা বাড়িয়ে করেন ২১টি। দখল করা এলাকায় কর্তৃত্ব সংহত করা এবং প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়াতেই এ পদক্ষেপ। কিন্তু আধুনিক সমাজের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ বলতে যা বোঝায়, এটা আদৌ তা নয়। এখন ভারসাম্য ও ক্ষমতার বণ্টনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
ঔপনিবেশিক শাসনামলে দক্ষিণ এশিয়াতে বিশেষভাবে রাষ্ট্র ও সমাজের ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। জাতি, জাতীয়তাবাদ, জাতি-রাষ্ট্র এসব ধারণা সামনে এসেছে। স্বায়ত্তশাসন ও সমাজের নানা স্তরে গণতন্ত্রায়নের দাবি জোরালো হচ্ছে। ১৯০৫-১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গের কথা ধরা যাক। প্রশাসনিক বিভক্তি কেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে প্রতিবাদের ঢেউ সৃষ্টি করল? পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের পূর্ববঙ্গে প্রবেশে কোনো বাধা ছিল না, পাসপোর্ট-ভিসাও চালু করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাগ এবং প্রদেশের স্বায়ত্তশাসনকে দেখা হয়েছিল 'জাতি' বিবেচনায়, এখন যাকে বলা যায় সমাজ। এই সমাজ সভ্যতা ও ঐতিহাসিকভাবে রাষ্ট্র থেকে পৃথক সত্তা বজায় রেখে চলেছে। এ প্রতিবাদের মধ্যে জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার তেমন স্থান ছিল না।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিভক্তির বিষয়টি নিয়েও আলোচনা করা যায়। জনগণের রায় কার্যকর করা শাসকদের পক্ষে কেন এত কঠিন হয়ে উঠল? প্রকৃতপক্ষে, স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে প্রশাসনিক সুবিধা বা গণতন্ত্রায়ন ও জনগণের ক্ষমতায়নের দৃষ্টিতে নয় বরং দেখা হয়েছে 'জাতি' এবং অঞ্চলের পুনর্বিন্যাস হিসেবে। আরও মজার বিষয় যে, একাত্তর-পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয় রাষ্ট্রেই গণতন্ত্র চর্চা বাড়েনি বরং কর্তৃত্ববাদী শাসন জোরালো হয়েছে। শ্রীলংকাতেও তামিল টাইগাররা বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন চেয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলীদের কর্তৃত্ববাদী শাসন চেপে বসেছে তাদের ওপর। ভারতের গুজরাট রাজ্যে বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদির শাসনের কথা আমরা বলতে পারি। মানবতার বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধ সংঘটনের পরও তিনি বিপুল ভোটে পুনর্নির্বাচিত হচ্ছেন।
ভারতের আরেকটি দৃষ্টান্তও উদ্বেগজনক। বিকেন্দ্রীকরণ কীভাবে কর্তৃত্বপরায়ণতা নিয়ে আসে সেটা দেখা যাবে এ খবরে। এএফপি পরিবেশিত খবরে বলা হয়, রাজস্থানের দাউসা জেলার একটি পঞ্চায়েত ছেলেদের সঙ্গে মোবাইলে মেয়েদের যখন তখন কথা বলার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। দুটি ছেলেমেয়ে পালানোর ঘটনার পর এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
এ অবস্থায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ থেকে কী ফল মিলবে? আমাদের তিনটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। প্রথমত, গণতন্ত্রের ভিত গভীরে প্রোথিত করা। কেবল ইলেক্টোরাল ডেমোক্রেসি বা নির্বাচিত কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন নয়, বরং আলোচনা ও মতামতের ভিত্তিতে শাসনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। রাজনৈতিক ও সামাজিক উভয় ক্ষেত্রেই এর প্রয়োগ চাই। প্রকৃতপক্ষে ইলেক্টোরাল ডেমোক্রেসিকে যুক্তিসঙ্গতভাবেই অনুদার বা সংকীর্ণ গণতন্ত্র হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। যদি রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে গণতন্ত্র্রের চর্চা হতে থাকে, সরকারের অর্থ ব্যয় এবং বিভিন্ন পদে নিয়োগে এর প্রভাব পড়ে এবং দলের মধ্যেও গণতন্ত্র চালু হয় তাহলে মানি ও মাসলের ক্ষমতা খর্ব হবে এবং রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের অনৈতিক সংযোগও ছিন্ন হবে। এমনকি শীর্ষ নেতাদের যা খুশি তা করার কর্তৃত্বেও টান পড়বে।
দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দল পরিচালনায় পেশাদারিত্ব আনা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে পরিবারতন্ত্র জেঁকে বসেছে। প্রধান দলগুলোতে এ প্রবণতা ব্যাপক। প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীতে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ হলে তা থেকে সুফল মেলে, এ অভিজ্ঞতা রয়েছে। করপোরেট সেক্টরও এ নীতি অনুসরণ করছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলে এর প্রতিফলন দেখা যায় না। তারা এ পথে না চললে রাষ্ট্র ও সমাজের গণতন্ত্রায়ন কঠিন হবে।
তৃতীয়ত, সিভিল সোসাইটির ক্ষমতায়ন। দক্ষিণ এশিয়া কিংবা ঔপনিবেশিক-পূর্ব যুগের ভারতবর্ষে সিভিল সোসাইটিকে পলিটিক্যাল সোসাইটি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে দেওয়া হয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলে সিভিল সোসাইটি সামনে চলে আসে এবং স্বাধীনতার সংগ্রামে সক্রিয় অবদান রাখে। তবে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর তাদের মধ্যে মেরুকরণ লক্ষ্য করা যায়। আরও মজার ব্যাপার যে, তারা এটা করেন গণতন্ত্র ও বিকেন্দ্রীকরণের স্লোগান তুলেই। আর এ কারণেই সিভিল সোসাইটির ক্ষমতায়নের জন্য এখন প্রয়োজন সৃজনশীল প্রয়াস। রাষ্ট্র ও সমাজে যে বিভাজন তার অবসানের জন্য তাদের নির্ধারক ভূমিকার প্রয়োজন অপরিসীম।
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ : অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক
No comments