হুমায়ূন আহমেদ : এক অনন্য উদাহরণ by জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী
একজন সৃষ্টিশীল মানুষ তার চারপাশ, পরিবেশ, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি পরিবার থেকে নানা উপাদান আহরণের মাধ্যমে নিজ সৃষ্টিকর্মকে সাধারণের কাছে অসাধারণরূপে হাজির করেন। এ প্রক্রিয়া অনুসরণে তাকে অনেক বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে হয়। যিনি যত সহজে এ পথ অতিক্রম করবেন তার স্থিতি এবং স্থায়িত্ব তত বেশি রয়ে যায় সমাজ, রাষ্ট্র এবং সর্বসাধারণের মনে।
আপন সৃষ্টিশৈলীর মাধ্যমে সৃষ্টিশীল ব্যক্তিটি গভীর ছাপ রেখে যান ধরাধামে। হুমায়ূন আহমেদ, সেই হাতেগোনা সৃষ্টিশীল মানুষের একজন; যার অনন্য লেখনী শক্তির প্রভাবে বাংলা ভাষাভাষী লাখো পাঠক মুগ্ধ হয়ে থেকেছে, অপেক্ষায় থেকেছে তার নবসৃষ্টির ধারায় অবগাহনের জন্য।
এ কথাগুলো যখন বলছি তখন হুমায়ূন আহমেদ আর আমাদের মাঝে নেই। সৃষ্টি প্রক্রিয়ার অবিভাজ্য নিয়মে তাকেও মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের মতো অদম্য মানসিকতার ব্যক্তিত্বকে অনেকটা অকালেই হারিয়েছি আমরা। জীবদ্দশায় তিনি তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন, যা অতুলনীয়। শিল্প-সংস্কৃতির যে মাধ্যমেই তিনি হাত দিয়েছেন সেই মাধ্যমে সফলতা এসে ভর করেছে ঈর্ষণীয়ভাবে। গল্প, উপন্যাস, নাটক কিংবা সিনেমা_ সর্বক্ষেত্রেই তিনি অনন্য নজির স্থাপন করে গেছেন বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য। বাংলাদেশের একটি সাধারণ পরিবার থেকে সময়ের পালাবদলের সঙ্গে, নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মোকাবেলার মাধ্যমে নিজেকে শাণিত করে এমন জোরালোভাবে উপস্থিত হওয়ার শক্তি আর কয়জনের আছে?
হুমায়ূন আহমেদ শুধু গল্প কথকই ছিলেন না, তার সাবলীল গদ্যের আলোকচ্ছটায় এবং কাহিনীর গতিময়তা, প্রকাশভঙ্গির ঋজুতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে একজন পাঠক তার লেখার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘোরের মধ্যে কাটিয়ে দিতে বাধ্য হতো। প্রশ্ন হতে পারে, কী এমন শক্তি ছিল তার? ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, হুমায়ূন আহমেদ স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের গ্রামীণ এবং শহুরে জীবনধারার মিশ্রণের প্রভাবে যে মধ্যবিত্ত পরিবার কাঠামো গড়ে উঠেছে এবং ধীরে ধীরে এ মধ্যবিত্ত শ্রেণী নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও জীবনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মানসিকতা হৃদয়ে ধারণ করে সমাজে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করেছে, তাদেরই জীবনাচরণ দক্ষ শিল্পীর মতো তুলি হাতে যেন এঁকেছেন। যার ফলে প্রতিটি রেখা, রঙ এবং বিষয় অনেক গভীর এবং স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়েছে আমাদের কাছে। এককথায় বলা যায়, হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যধারা মধ্যবিত্তশ্রেণীর জন্য দর্পর্ণস্বরূপ, যার সামনে দাঁড়ালে প্রায় সব কিছুই দেখা যায় স্বচ্ছ আকারে। সবাই জানি, মুক্তিযুদ্ধের পরপর 'নন্দিত নরকে' উপন্যাস লেখার মধ্য দিয়ে সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদের আবির্ভাব। আবির্ভাব লগ্নেই তিনি নিজ গুণে চমকে দিয়েছিলেন সবাইকে। আহমদ শরীফের মতো প্রাজ্ঞ অধ্যাপক তখনই লিখলেন, 'হুমায়ূন আহমেদ বয়সে তরুণ, মনে প্রাচীন দ্রষ্টা, মেজাজে জীবন-রসিক, স্বভাবে রূপদর্শী, যোগ্যতায় দক্ষ রূপকার। ভবিষ্যতে তিনি বিশিষ্ট জীবনশিল্পী হবেন_ এ বিশ্বাস ও প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করব।'
এ কথাও সত্য, সময় যত এগিয়েছে হুমায়ূন আহমেদের লেখায় ভর করেছে বিস্তৃত জনমানস, জীবনবোধ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সব চরিত্র। তার লেখার বড় একটি অংশজুড়ে আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো বিশাল প্রেক্ষাপটের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যুক্ত থাকার সুযোগ যার হয়েছে তার চেয়ে এ বিষয়ে আর ভালোভাবে উপস্থাপন করতে কে পারবেন? হুমায়ূন আহমেদ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে তার বাবাকে হারিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি তার পরিবার নিয়ে যুদ্ধের ভয়াল অবস্থার মধ্যে নানা ঘটনা এমনকি মৃত্যুর হাত থেকেও ফিরে এসেছেন। এমন যার অভিজ্ঞতা তার হাত দিয়েই সৃষ্টি হয়েছে 'জোছনা ও জননীর গল্প' শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাসসহ একগুচ্ছ উপন্যাস ও স্মরণীয় কিছু ছোটগল্প। 'জোছনা ও জননীর গল্প' উপন্যাসের প্রায় সব ঘটনাই সত্যাশ্রয়ী। কখনও আত্মজৈবনিক উপাদান, কখনও যুদ্ধদিনের অভিজ্ঞতা, কখনও-বা গ্রন্থপাঠ বা অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে উপাদান সংগ্রহ করে লেখক নির্মাণ করছেন উপন্যাসের কেন্দ্রীয় কাহিনী। হুমায়ূন আহমেদ নিজেই বলেছেন_ 'জোছনা ও জননীর গল্প' ইতিহাসের বই নয়, এটি একটি উপন্যাস। তার পরও ইতিহাসের খুব কাছাকাছি থাকার চেষ্টা আমি করেছি। উপন্যাসে বর্ণিত প্রায় সব ঘটনাই সত্যি। কিছু নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। কিছু অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে ধার নেওয়া।' 'জোছনা ও জননীর গল্প' উপন্যাসে হুমায়ূন আহমেদ সৃষ্টি করেছেন অসাধারণ সব চরিত্র। ইরতাজউদ্দিন, মরিয়ম, নাইমুল, সোবহান, ফয়জুর রহমান, কলিমউল্লাহ, ছদরুল আমিন, আসগর, পণ্ডিত ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরীর মতো চরিত্ররা, যারা ধারণ করে আছে মুক্তিযুদ্ধকালীন নির্মম বাস্তবতা। তার এ ধারার স্মরণীয় উপন্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম_ আগুনের পরশমণি, শ্যামলছায়া, সৌরভ, ১৯৭১ ইত্যাদি।
উপমহাদেশীয় ইতিহাস নিয়েও হুমায়ূন আহমেদের আগ্রহ ছিল। যার বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই 'বাদশাহ নামদার'-এর মতো ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাসে। মোগল সম্রাট হুমায়ুনের জীবনী আশ্রয় করে রচিত এ উপন্যাসে ইতিহাসের নানা বাস্তবতা এবং ঘটনা_ লেখকের বর্ণনার সাবলীলতায় ইতিহাস থেকে আলাদা রূপ পেয়েছে। এ উপন্যাসের ভূমিকায় হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন_ 'কেউ যদি জানতে চান 'বাদশাহ নামদার' লেখার ইচ্ছা কেন হলো, আমি তার সরাসরি জবাব দিতে পারব না। কারণ সরাসরি জবাব আমার কাছে নেই। শৈশবে আমাদের পাঠ্য তালিকায় চিতোর রানীর দিলি্লর সম্রাট হুমায়ুনকে রাখি পাঠানো বিষয়ক একটি কবিতা ছিল। একটি লাইন এ রকম_ বাহাদুর শাহ আসছে ধেয়ে করতে চিতোর জয়। এ কবিতা শিশুমনে প্রবল ছাপ ফেলে বলেই শেষ বয়সে সম্রাট হুমায়ুনকে নিয়ে উপন্যাস লিখতে বসব এ রকম মনে করার কোনো কারণ নেই। সব ঔপন্যাসিকই বিচিত্র চরিত্র নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন। এ অর্থে হুমায়ুন অতি বিচিত্র এক চরিত্র। যেখানে তিনি সাঁতারই জানেন না, সেখানে সারাজীবন তাঁকে সাঁতরাতে হয়েছে স্রোতের বিপরীতে। তাঁর সময়টাও ছিল অদ্ভুত। বিচিত্র চরিত্র এবং বিচিত্র সময় ধরার লোভ থেকেও 'বাদশাহ নামদার লেখা হতে পারে। আমি নিশ্চিত না।'
ইতিহাসকে এমন সাবলীল ও সরলতায় উপস্থাপনের শক্তি হুমায়ূন আহমেদের মতো একজন জাত লেখকের পক্ষেই সম্ভব। জীবনের শেষ পর্যায়ে দীর্ঘ কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন তিনি। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মধ্যাহ্ন। অসাম্প্রদায়িকতার ঊধর্ে্ব উঠে চিরকালীন মানবিকতার এ রকম আখ্যান সমকালে আর লেখা হয়নি। তিনি ছিলেন জীবনবাদী শিল্পী, তার প্রায় সব লেখায় আছে জীবনের জয়গান।
হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশিত দুই শতাধিক গ্রন্থের মধ্যে এমন অনেক গ্রন্থই আছে, যা বিস্তর আলোচনার জন্ম দিতে পারে। শুধু সাহিত্যেই নয়, নাটক-সিনেমা বানানোতেও হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার অনেক নাটক একসময় আমাদের দেশের দর্শককে দিয়েছিল নির্মল বিনোদন। পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা তৈরিতে এবং মানুষের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে ধারণা দিয়েছে। সিনেমায় ক্ষেত্রবিশেষে তিনি আলাদা হলেও চিরাচরিত হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টিশৈলীরই পরিচয় বহন করেছে।
একজন লেখক লিখেই ক্ষান্ত হন না। পাঠককে পাঠে অভ্যস্ততার ক্ষেত্রে তিনি অসামান্য ভূমিকা পালন করেছেন সুষ্ঠুভাবে। আমাদের দেশের বইয়ের বাজার এবং সর্বস্তরের পাঠককে বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করানোর নিপুণ কাজটি হুমায়ূন আহমেদ নিজের মতো করেছেন। ফলে প্রকাশনা একটি শিল্পরূপে আমাদের দেশে শক্ত অবস্থান করে নিয়েছে। হুমায়ূন আহমেদকে পাঠকপ্রিয় কিংবা জনপ্রিয় ধারার লেখক বলে মন্তব্য করেন অনেকেই। ব্যক্তিগত সফলতার মানদণ্ডে যদি তাকে অবমূল্যায়ন করা হয় সেটা হবে আমাদেরই ব্যর্থতা। কেননা হুমায়ূন আহমেদের পরিশ্রম, মেধা, বিচক্ষণতা, সৃষ্টি এবং কর্মপরিধির বিস্তার আগামী প্রজন্মের জন্য উদাহরণ হিসেবেই ভাবা উচিত। আজকের যে তরুণ কলম হাতে সাহিত্য রচনায় মনোযোগী হতে চাইছেন, হুমায়ূন আহমেদের কৃতিত্ব তার সামনে সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে থাকবে। শুধু সাহিত্য ক্ষেত্র কেন, জীবনে নিজ গুণে সাফল্য অর্জনের অন্যতম উদাহরণ এ দেশে হুমায়ূন আহমেদ।
হুমায়ূন আহমেদ আমাদের মাঝে আজ নেই। তবে তার সৃষ্টিভাণ্ডার রয়ে গেছে; আগামী দিনগুলোতেও থেকে যাবে অবিকল। তার সৃষ্টির প্রতি আমাদের নতুন করে নজর দেওয়ার সময় হয়েছে। কারণ এভাবেই হয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্মে জন্ম নেবে আরও অনেক হুমায়ূন আহমেদ। যারা সমৃদ্ধ করবে আমাদের ভাষা, আমাদের সাহিত্য, আমাদের সমাজ। হুমায়ূন আহমেদের অকাল প্রয়াণের পর আজই তার প্রথম জন্মদিন। ১৯৪৮ সালের এ দিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মেধাবী, বিনয়ী, সদা হাস্যোজ্জ্বল, প্রখর জীবনবাদী এই লেখকের জন্য রইল গভীর ভালোবাসা।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী :শিক্ষাবিদ
এ কথাগুলো যখন বলছি তখন হুমায়ূন আহমেদ আর আমাদের মাঝে নেই। সৃষ্টি প্রক্রিয়ার অবিভাজ্য নিয়মে তাকেও মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের মতো অদম্য মানসিকতার ব্যক্তিত্বকে অনেকটা অকালেই হারিয়েছি আমরা। জীবদ্দশায় তিনি তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন, যা অতুলনীয়। শিল্প-সংস্কৃতির যে মাধ্যমেই তিনি হাত দিয়েছেন সেই মাধ্যমে সফলতা এসে ভর করেছে ঈর্ষণীয়ভাবে। গল্প, উপন্যাস, নাটক কিংবা সিনেমা_ সর্বক্ষেত্রেই তিনি অনন্য নজির স্থাপন করে গেছেন বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য। বাংলাদেশের একটি সাধারণ পরিবার থেকে সময়ের পালাবদলের সঙ্গে, নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মোকাবেলার মাধ্যমে নিজেকে শাণিত করে এমন জোরালোভাবে উপস্থিত হওয়ার শক্তি আর কয়জনের আছে?
হুমায়ূন আহমেদ শুধু গল্প কথকই ছিলেন না, তার সাবলীল গদ্যের আলোকচ্ছটায় এবং কাহিনীর গতিময়তা, প্রকাশভঙ্গির ঋজুতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে একজন পাঠক তার লেখার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘোরের মধ্যে কাটিয়ে দিতে বাধ্য হতো। প্রশ্ন হতে পারে, কী এমন শক্তি ছিল তার? ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, হুমায়ূন আহমেদ স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের গ্রামীণ এবং শহুরে জীবনধারার মিশ্রণের প্রভাবে যে মধ্যবিত্ত পরিবার কাঠামো গড়ে উঠেছে এবং ধীরে ধীরে এ মধ্যবিত্ত শ্রেণী নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও জীবনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মানসিকতা হৃদয়ে ধারণ করে সমাজে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করেছে, তাদেরই জীবনাচরণ দক্ষ শিল্পীর মতো তুলি হাতে যেন এঁকেছেন। যার ফলে প্রতিটি রেখা, রঙ এবং বিষয় অনেক গভীর এবং স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়েছে আমাদের কাছে। এককথায় বলা যায়, হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যধারা মধ্যবিত্তশ্রেণীর জন্য দর্পর্ণস্বরূপ, যার সামনে দাঁড়ালে প্রায় সব কিছুই দেখা যায় স্বচ্ছ আকারে। সবাই জানি, মুক্তিযুদ্ধের পরপর 'নন্দিত নরকে' উপন্যাস লেখার মধ্য দিয়ে সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদের আবির্ভাব। আবির্ভাব লগ্নেই তিনি নিজ গুণে চমকে দিয়েছিলেন সবাইকে। আহমদ শরীফের মতো প্রাজ্ঞ অধ্যাপক তখনই লিখলেন, 'হুমায়ূন আহমেদ বয়সে তরুণ, মনে প্রাচীন দ্রষ্টা, মেজাজে জীবন-রসিক, স্বভাবে রূপদর্শী, যোগ্যতায় দক্ষ রূপকার। ভবিষ্যতে তিনি বিশিষ্ট জীবনশিল্পী হবেন_ এ বিশ্বাস ও প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করব।'
এ কথাও সত্য, সময় যত এগিয়েছে হুমায়ূন আহমেদের লেখায় ভর করেছে বিস্তৃত জনমানস, জীবনবোধ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সব চরিত্র। তার লেখার বড় একটি অংশজুড়ে আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো বিশাল প্রেক্ষাপটের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যুক্ত থাকার সুযোগ যার হয়েছে তার চেয়ে এ বিষয়ে আর ভালোভাবে উপস্থাপন করতে কে পারবেন? হুমায়ূন আহমেদ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে তার বাবাকে হারিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি তার পরিবার নিয়ে যুদ্ধের ভয়াল অবস্থার মধ্যে নানা ঘটনা এমনকি মৃত্যুর হাত থেকেও ফিরে এসেছেন। এমন যার অভিজ্ঞতা তার হাত দিয়েই সৃষ্টি হয়েছে 'জোছনা ও জননীর গল্প' শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাসসহ একগুচ্ছ উপন্যাস ও স্মরণীয় কিছু ছোটগল্প। 'জোছনা ও জননীর গল্প' উপন্যাসের প্রায় সব ঘটনাই সত্যাশ্রয়ী। কখনও আত্মজৈবনিক উপাদান, কখনও যুদ্ধদিনের অভিজ্ঞতা, কখনও-বা গ্রন্থপাঠ বা অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে উপাদান সংগ্রহ করে লেখক নির্মাণ করছেন উপন্যাসের কেন্দ্রীয় কাহিনী। হুমায়ূন আহমেদ নিজেই বলেছেন_ 'জোছনা ও জননীর গল্প' ইতিহাসের বই নয়, এটি একটি উপন্যাস। তার পরও ইতিহাসের খুব কাছাকাছি থাকার চেষ্টা আমি করেছি। উপন্যাসে বর্ণিত প্রায় সব ঘটনাই সত্যি। কিছু নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। কিছু অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে ধার নেওয়া।' 'জোছনা ও জননীর গল্প' উপন্যাসে হুমায়ূন আহমেদ সৃষ্টি করেছেন অসাধারণ সব চরিত্র। ইরতাজউদ্দিন, মরিয়ম, নাইমুল, সোবহান, ফয়জুর রহমান, কলিমউল্লাহ, ছদরুল আমিন, আসগর, পণ্ডিত ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরীর মতো চরিত্ররা, যারা ধারণ করে আছে মুক্তিযুদ্ধকালীন নির্মম বাস্তবতা। তার এ ধারার স্মরণীয় উপন্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম_ আগুনের পরশমণি, শ্যামলছায়া, সৌরভ, ১৯৭১ ইত্যাদি।
উপমহাদেশীয় ইতিহাস নিয়েও হুমায়ূন আহমেদের আগ্রহ ছিল। যার বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই 'বাদশাহ নামদার'-এর মতো ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাসে। মোগল সম্রাট হুমায়ুনের জীবনী আশ্রয় করে রচিত এ উপন্যাসে ইতিহাসের নানা বাস্তবতা এবং ঘটনা_ লেখকের বর্ণনার সাবলীলতায় ইতিহাস থেকে আলাদা রূপ পেয়েছে। এ উপন্যাসের ভূমিকায় হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন_ 'কেউ যদি জানতে চান 'বাদশাহ নামদার' লেখার ইচ্ছা কেন হলো, আমি তার সরাসরি জবাব দিতে পারব না। কারণ সরাসরি জবাব আমার কাছে নেই। শৈশবে আমাদের পাঠ্য তালিকায় চিতোর রানীর দিলি্লর সম্রাট হুমায়ুনকে রাখি পাঠানো বিষয়ক একটি কবিতা ছিল। একটি লাইন এ রকম_ বাহাদুর শাহ আসছে ধেয়ে করতে চিতোর জয়। এ কবিতা শিশুমনে প্রবল ছাপ ফেলে বলেই শেষ বয়সে সম্রাট হুমায়ুনকে নিয়ে উপন্যাস লিখতে বসব এ রকম মনে করার কোনো কারণ নেই। সব ঔপন্যাসিকই বিচিত্র চরিত্র নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন। এ অর্থে হুমায়ুন অতি বিচিত্র এক চরিত্র। যেখানে তিনি সাঁতারই জানেন না, সেখানে সারাজীবন তাঁকে সাঁতরাতে হয়েছে স্রোতের বিপরীতে। তাঁর সময়টাও ছিল অদ্ভুত। বিচিত্র চরিত্র এবং বিচিত্র সময় ধরার লোভ থেকেও 'বাদশাহ নামদার লেখা হতে পারে। আমি নিশ্চিত না।'
ইতিহাসকে এমন সাবলীল ও সরলতায় উপস্থাপনের শক্তি হুমায়ূন আহমেদের মতো একজন জাত লেখকের পক্ষেই সম্ভব। জীবনের শেষ পর্যায়ে দীর্ঘ কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন তিনি। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মধ্যাহ্ন। অসাম্প্রদায়িকতার ঊধর্ে্ব উঠে চিরকালীন মানবিকতার এ রকম আখ্যান সমকালে আর লেখা হয়নি। তিনি ছিলেন জীবনবাদী শিল্পী, তার প্রায় সব লেখায় আছে জীবনের জয়গান।
হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশিত দুই শতাধিক গ্রন্থের মধ্যে এমন অনেক গ্রন্থই আছে, যা বিস্তর আলোচনার জন্ম দিতে পারে। শুধু সাহিত্যেই নয়, নাটক-সিনেমা বানানোতেও হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার অনেক নাটক একসময় আমাদের দেশের দর্শককে দিয়েছিল নির্মল বিনোদন। পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা তৈরিতে এবং মানুষের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে ধারণা দিয়েছে। সিনেমায় ক্ষেত্রবিশেষে তিনি আলাদা হলেও চিরাচরিত হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টিশৈলীরই পরিচয় বহন করেছে।
একজন লেখক লিখেই ক্ষান্ত হন না। পাঠককে পাঠে অভ্যস্ততার ক্ষেত্রে তিনি অসামান্য ভূমিকা পালন করেছেন সুষ্ঠুভাবে। আমাদের দেশের বইয়ের বাজার এবং সর্বস্তরের পাঠককে বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করানোর নিপুণ কাজটি হুমায়ূন আহমেদ নিজের মতো করেছেন। ফলে প্রকাশনা একটি শিল্পরূপে আমাদের দেশে শক্ত অবস্থান করে নিয়েছে। হুমায়ূন আহমেদকে পাঠকপ্রিয় কিংবা জনপ্রিয় ধারার লেখক বলে মন্তব্য করেন অনেকেই। ব্যক্তিগত সফলতার মানদণ্ডে যদি তাকে অবমূল্যায়ন করা হয় সেটা হবে আমাদেরই ব্যর্থতা। কেননা হুমায়ূন আহমেদের পরিশ্রম, মেধা, বিচক্ষণতা, সৃষ্টি এবং কর্মপরিধির বিস্তার আগামী প্রজন্মের জন্য উদাহরণ হিসেবেই ভাবা উচিত। আজকের যে তরুণ কলম হাতে সাহিত্য রচনায় মনোযোগী হতে চাইছেন, হুমায়ূন আহমেদের কৃতিত্ব তার সামনে সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে থাকবে। শুধু সাহিত্য ক্ষেত্র কেন, জীবনে নিজ গুণে সাফল্য অর্জনের অন্যতম উদাহরণ এ দেশে হুমায়ূন আহমেদ।
হুমায়ূন আহমেদ আমাদের মাঝে আজ নেই। তবে তার সৃষ্টিভাণ্ডার রয়ে গেছে; আগামী দিনগুলোতেও থেকে যাবে অবিকল। তার সৃষ্টির প্রতি আমাদের নতুন করে নজর দেওয়ার সময় হয়েছে। কারণ এভাবেই হয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্মে জন্ম নেবে আরও অনেক হুমায়ূন আহমেদ। যারা সমৃদ্ধ করবে আমাদের ভাষা, আমাদের সাহিত্য, আমাদের সমাজ। হুমায়ূন আহমেদের অকাল প্রয়াণের পর আজই তার প্রথম জন্মদিন। ১৯৪৮ সালের এ দিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মেধাবী, বিনয়ী, সদা হাস্যোজ্জ্বল, প্রখর জীবনবাদী এই লেখকের জন্য রইল গভীর ভালোবাসা।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী :শিক্ষাবিদ
No comments