নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি by এ এম এম শওকত আলী
আগামী নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য-বক্তব্য প্রায়ই শোনা যাচ্ছে পত্রপত্রিকার মাধ্যমে। এসব বক্তব্য দুই ভাগে ভাগ করা যায়। অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামোর বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এখনো ঝুলে আছে রাজনৈতিক ঐকমত্যের অভাবে। সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায় সত্ত্বেও এখনো এ বিষয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের অবস্থান দুই মেরুতে।
এ সমস্যা ১৯৯৬ সাল থেকেই দৃশ্যমান। যদিও ১৯৯৬ সাল-পরবর্তী আরো দুটি নির্বাচন হয়েছে। মাঝেমধ্যে নির্ধারিত সময়ের আগেই মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথাও শোনা যাচ্ছে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের কালচার উন্নত দেশে থাকলেও বাংলাদেশে কখনো দেখা যায়নি।
আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম সম্পন্ন করার লক্ষ্যে কমিশন এখন ভীষণ ব্যস্ত। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কাজ শেষ হবে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে। এ কাজের প্রধান অংশ হলো (এক) নতুন ভোটার ও যারা আগে ভোটার হয়নি, তাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা। অর্থাৎ ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা এবং (দুই) নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ। দুটি কাজই কষ্টসাধ্য। প্রথম অংশের বিষয়ে অতীতে অনেক সমালোচনা ছিল। এর কিছু আলামত বর্তমানেও আছে। ঢাকার অধুনাসৃষ্ট দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় বহু ভোটার বাদ পড়েছে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর এমনই একটি সংবাদ একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশ করা হয়েছে। কারণ হিসেবে প্রচারণার অভাব চিহ্নিত করা হয়। তবে কমিশনের দাবি, এ বিষয়ে যথাযথ নির্দেশ উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছে। এ বিতর্কের অবসান কোনো দিনই হবে না।
২০০৯ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের প্রথা চালু হয়। ওই সময়ও ভোটার তালিকার বিষয়ে কিছু অভিযোগ ছিল। তখন একটা অভিমত ছিল- সারা বছর ধরেই তালিকা হালনাগাদের কাজ চালু রাখা। এটা সঠিকভাবে এখন করলে কাজের চাপ এত বেশি হওয়ার কথা নয়। অভিযোগও কম হওয়ারই সম্ভাবনা ছিল। বর্তমান বছরে মোট ভোটার নিবন্ধন পরিকল্পনা রয়েছে ৭০ লাখ। গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৩৭ লাখ ২০ হাজার ব্যক্তি নিবন্ধিত হয়েছে। তবে ৭০ লাখ হলো অনুমিত সংখ্যা। এর বেশিও হতে পারে, আবার কমও হতে পারে। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৫৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ৪৭ শতাংশ কাজ ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা যায়। কারণ কমিশনের মূল্যায়ন অনুযায়ী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৫০ লাখ ভোটার নিবন্ধিত হবে, যা লক্ষ্যমাত্রার ৭১ শতাংশ। মধ্যবর্তী নির্বাচনের বিষয়ে কমিশন-প্রধান স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন। এ বিষয়ে কমিশন প্রস্তুত। কিন্তু সেপ্টেম্বরের পরেও লক্ষ্যমাত্রার ৩০ শতাংশ কাজ অসম্পন্ন থাকবে। তবে এ বিষয়ে কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নেই। রাজনৈতিক কালচার এ প্রথার বিরুদ্ধে। যদি এ ধরনের নির্বাচন হয়, তাহলে ক্ষমতাসীন দলের এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এখন পর্যন্ত এ নিয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য এ দল দেয়নি। এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না দেওয়ারই কথা। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য রাজনৈতিক বিবেচনা ও মূল্যায়নই মূল মাপকাঠি। সাম্প্রতিককালে ভারতের ক্ষমতাসীন সরকার কিছুটা অবিরাম পর্যুদস্ত হওয়ার পরও এ সিদ্ধান্ত হয়নি। ভারতীয় সংসদ কয়েক দিন কার্যত অচল ছিল। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দল বিদ্যমান কংগ্রেস জোটকে ত্যাগ করলেও ক্ষমতাসীন দলের কোনো ক্ষতি হয়নি। অন্যান্য দল সরকারের বাইরে থেকে কংগ্রেস জোটকে সমর্থন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ভারতের প্রধান বিরোধী দল অর্থাৎ বিজেপি মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী জোটও মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা হয়নি। বাংলাদেশের এ বিষয়টি ভারতের অনুরূপ নয়। আওয়ামী লীগভুক্ত অন্যান্য দল ছাড়াই ক্ষমতাসীন দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।
নির্বাচন কমিশনের আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতির দ্বিতীয় অংশটি প্রথমটির তুলনায় জটিল। কাজটি করার জন্য ১৯৭৬ সালের নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ-সংক্রান্ত একটি আইন বিদ্যমান। এ আইনের বিধান অনুসরণ করেই এ কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। অন্যথায় ক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আইনের আশ্রয় গ্রহণ করবে। এ আইনে অবশ্য কমিশনকে সীমানা নির্ধারণ করার পদ্ধতি নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়া আছে। সাধারণত যেকোনো আইনের আওতায় প্রণীত বিধিতে পদ্ধতি বলা হয়। তবে এ আইনের বিধি প্রণয়নের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এ দৃষ্টিকোণে বিচার করলে বলা যায়, আলোচ্য বিষয়ে কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে এ আইনের একটি বিধান এ বিষয়ে কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কমিশনের সিদ্ধান্তের বিষয়ে কোনো আদালতে বা কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। অর্থাৎ পদ্ধতিগত বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্ত প্রশ্নাতীত হবে। তবে এ কথাও সত্যি যে এ ধরনের বিধান আদালত, বিশেষ করে উচ্চ আদালত সহজে মানতে রাজি নন। আইনবিদ ও বিচারকরা এ ধরনের বিধানকে আদালতের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা খর্ব করার শামিল বলে যুক্তি প্রদর্শন করে থাকেন। তবে এ ক্ষেত্রে আইনের বিধানটি সংবিধানের ১২৫(ক) ধারা সুরক্ষিত করেছে। এ ধারায়ও বলা আছে, সীমানা নির্ধারণ-সংক্রান্ত কোনো আইনের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। সংশ্লিষ্ট আইনে সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিষয়ে কয়েকটি বাধ্যতামূলক বিধান রয়েছে। তা অবশ্যই কমিশনকে অনুসরণ করতে হবে।
প্রথম বিধানটি হলো- সংবিধানের ৬৫(২) ধারা দ্বারা নির্ধারিত সংসদ সদস্যদের সংখ্যা অনুযায়ী সারা দেশে একক নির্বাচনী এলাকা নিরূপণ করতে হবে। অর্থাৎ সংবিধান দ্বারা নির্ধারিত সংখ্যার অধিক কোনো নির্বাচনী এলাকা হবে না। এর পরের অনুসরণীয় বিধানে এলাকা নির্ধারণের জন্য মাপকাঠির কথা বলা হয়েছে। মাপকাঠির মধ্যে রয়েছে- (এক) প্রশাসনিক সুবিধা, (দুই) প্রতি নির্বাচনী এলাকা ঘনসন্নিবিষ্ট (compact) হতে হবে এবং (তিন) এ বিষয়ে সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যার বিষয় আমলে নিতে হবে। তবে শেষোক্ত বিষয়ে 'বাস্তবসম্মত' শব্দটিও যুক্ত আছে। অর্থাৎ এ বিষয়ে কমিশনকে কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে দেখা গেছে, এলাকা কিছু ক্ষেত্রে একক ভূখণ্ড নয়। বিষয়টি এলাকার আয়তন ও জনসংখ্যার ওপর নির্ভর করবে।
এর পরের বিধানে কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে। এক. সীমানা নির্ধারণে কমিশনকে প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। দুই. এরপর প্রতি নির্বাচনী এলাকার ভৌগোলিক সীমানাসহ একটি প্রাথমিক তালিকা গেজেটে প্রকাশিত হবে। তিন. একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশিত তালিকার বিষয়ে কারো কোনো আপত্তি বা মতামত প্রেরণের সুযোগ দিতে হবে। চার. কমিশন উত্থাপিত আপত্তি ও মতামত বিবেচনা করে প্রয়োজনবোধে তালিকা সংশোধন করবে। পাঁচ. চূড়ান্ত তালিকা পুনরায় গেজেটে প্রকাশ করতে হবে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে সময়সাপেক্ষ। এ বিষয়ে অধুনা উত্থাপিত কিছু অভিমতের বিষয়ও কমিশন জানে। এ বিষয়গুলোসহ রাজনৈতিক দলের মতামতও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর।
কমিশন গত ২০০৮ সালের ২৯ এপ্রিল গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সীমানা নির্ধারণের অনুসরণীয় পদ্ধতি প্রকাশ করেছিল। তবে এটা ছিল প্রাথমিক তালিকা। ২০০৮ সালে জনসংখ্যাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ফলে ঢাকা শহরে নির্বাচনী এলাকার সংখ্যা আট থেকে ১৫-তে বৃদ্ধি পায়। এবারও একই পদ্ধতি অনুসরণ করলে আসনসংখ্যা ১৫ থেকে ২৫ হবে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে ওই সময় ১৩০টি আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারিত হয়। তবে এখন অনেকে ২০০৮ সালের পূর্ববর্তী অবস্থানে ফিরে যাওয়ার অভিমত কমিশনকে দিয়েছেন। পক্ষান্তরে এর বিপরীতে অনেকে ২০০৮ সালের অবস্থান অক্ষুণ্ন রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ না করা পর্যন্ত এখনো কিছু বলা সম্ভব নয়। এ তালিকা প্রকাশের পরও কিছু আপত্তি অবশ্যই হবে। কারো আপত্তি ও মতামত দেওয়ার সুযোগ আইনে রয়েছে। এ ধরনের আরো কিছু রদবদল-সংক্রান্ত অভিমত কমিশন পেয়েছে।
গত ১০ মার্চ নির্বাচন কমিশন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম ও সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিষয়ে মতামত বিনিময় করেছে। এর পূর্ণাঙ্গ তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। ভোটার তালিকা প্রণয়নের অগ্রগতির তথ্য জানা গেলেও সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। অনুমান করা সম্ভব যে এ বিষয়ে কমিশন বর্তমানে বিভিন্ন মহলের মতামত গ্রহণের কাজে ব্যস্ত। এ কাজটি শেষ হলে তারা এ বিষয়ে প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করবে। ওই সময়ও আপত্তি ও মতামত দেওয়ার সুযোগ থাকবে। এ প্রক্রিয়া অক্টোবর বা নভেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করা হলে ভালো হয়। স্মরণ করা যেতে পারে যে গত ২০০৮ সালের সীমানা নির্ধারণের প্রাথমিক তালিকা ২৯ এপ্রিল গেজেটে প্রকাশ করেছিল। তালিকা প্রকাশের পর আপত্তি ও পুনরায় মতামত দেওয়ার জন্য সুযোগ দিতে, সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণেও সময়ের প্রয়োজন হবে। অক্টোবর, ২০১২
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম সম্পন্ন করার লক্ষ্যে কমিশন এখন ভীষণ ব্যস্ত। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কাজ শেষ হবে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে। এ কাজের প্রধান অংশ হলো (এক) নতুন ভোটার ও যারা আগে ভোটার হয়নি, তাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা। অর্থাৎ ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা এবং (দুই) নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ। দুটি কাজই কষ্টসাধ্য। প্রথম অংশের বিষয়ে অতীতে অনেক সমালোচনা ছিল। এর কিছু আলামত বর্তমানেও আছে। ঢাকার অধুনাসৃষ্ট দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় বহু ভোটার বাদ পড়েছে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর এমনই একটি সংবাদ একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশ করা হয়েছে। কারণ হিসেবে প্রচারণার অভাব চিহ্নিত করা হয়। তবে কমিশনের দাবি, এ বিষয়ে যথাযথ নির্দেশ উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছে। এ বিতর্কের অবসান কোনো দিনই হবে না।
২০০৯ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের প্রথা চালু হয়। ওই সময়ও ভোটার তালিকার বিষয়ে কিছু অভিযোগ ছিল। তখন একটা অভিমত ছিল- সারা বছর ধরেই তালিকা হালনাগাদের কাজ চালু রাখা। এটা সঠিকভাবে এখন করলে কাজের চাপ এত বেশি হওয়ার কথা নয়। অভিযোগও কম হওয়ারই সম্ভাবনা ছিল। বর্তমান বছরে মোট ভোটার নিবন্ধন পরিকল্পনা রয়েছে ৭০ লাখ। গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৩৭ লাখ ২০ হাজার ব্যক্তি নিবন্ধিত হয়েছে। তবে ৭০ লাখ হলো অনুমিত সংখ্যা। এর বেশিও হতে পারে, আবার কমও হতে পারে। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৫৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ৪৭ শতাংশ কাজ ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা যায়। কারণ কমিশনের মূল্যায়ন অনুযায়ী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৫০ লাখ ভোটার নিবন্ধিত হবে, যা লক্ষ্যমাত্রার ৭১ শতাংশ। মধ্যবর্তী নির্বাচনের বিষয়ে কমিশন-প্রধান স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন। এ বিষয়ে কমিশন প্রস্তুত। কিন্তু সেপ্টেম্বরের পরেও লক্ষ্যমাত্রার ৩০ শতাংশ কাজ অসম্পন্ন থাকবে। তবে এ বিষয়ে কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নেই। রাজনৈতিক কালচার এ প্রথার বিরুদ্ধে। যদি এ ধরনের নির্বাচন হয়, তাহলে ক্ষমতাসীন দলের এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এখন পর্যন্ত এ নিয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য এ দল দেয়নি। এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না দেওয়ারই কথা। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য রাজনৈতিক বিবেচনা ও মূল্যায়নই মূল মাপকাঠি। সাম্প্রতিককালে ভারতের ক্ষমতাসীন সরকার কিছুটা অবিরাম পর্যুদস্ত হওয়ার পরও এ সিদ্ধান্ত হয়নি। ভারতীয় সংসদ কয়েক দিন কার্যত অচল ছিল। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দল বিদ্যমান কংগ্রেস জোটকে ত্যাগ করলেও ক্ষমতাসীন দলের কোনো ক্ষতি হয়নি। অন্যান্য দল সরকারের বাইরে থেকে কংগ্রেস জোটকে সমর্থন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ভারতের প্রধান বিরোধী দল অর্থাৎ বিজেপি মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী জোটও মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা হয়নি। বাংলাদেশের এ বিষয়টি ভারতের অনুরূপ নয়। আওয়ামী লীগভুক্ত অন্যান্য দল ছাড়াই ক্ষমতাসীন দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।
নির্বাচন কমিশনের আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতির দ্বিতীয় অংশটি প্রথমটির তুলনায় জটিল। কাজটি করার জন্য ১৯৭৬ সালের নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ-সংক্রান্ত একটি আইন বিদ্যমান। এ আইনের বিধান অনুসরণ করেই এ কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। অন্যথায় ক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আইনের আশ্রয় গ্রহণ করবে। এ আইনে অবশ্য কমিশনকে সীমানা নির্ধারণ করার পদ্ধতি নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়া আছে। সাধারণত যেকোনো আইনের আওতায় প্রণীত বিধিতে পদ্ধতি বলা হয়। তবে এ আইনের বিধি প্রণয়নের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এ দৃষ্টিকোণে বিচার করলে বলা যায়, আলোচ্য বিষয়ে কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে এ আইনের একটি বিধান এ বিষয়ে কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কমিশনের সিদ্ধান্তের বিষয়ে কোনো আদালতে বা কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। অর্থাৎ পদ্ধতিগত বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্ত প্রশ্নাতীত হবে। তবে এ কথাও সত্যি যে এ ধরনের বিধান আদালত, বিশেষ করে উচ্চ আদালত সহজে মানতে রাজি নন। আইনবিদ ও বিচারকরা এ ধরনের বিধানকে আদালতের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা খর্ব করার শামিল বলে যুক্তি প্রদর্শন করে থাকেন। তবে এ ক্ষেত্রে আইনের বিধানটি সংবিধানের ১২৫(ক) ধারা সুরক্ষিত করেছে। এ ধারায়ও বলা আছে, সীমানা নির্ধারণ-সংক্রান্ত কোনো আইনের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। সংশ্লিষ্ট আইনে সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিষয়ে কয়েকটি বাধ্যতামূলক বিধান রয়েছে। তা অবশ্যই কমিশনকে অনুসরণ করতে হবে।
প্রথম বিধানটি হলো- সংবিধানের ৬৫(২) ধারা দ্বারা নির্ধারিত সংসদ সদস্যদের সংখ্যা অনুযায়ী সারা দেশে একক নির্বাচনী এলাকা নিরূপণ করতে হবে। অর্থাৎ সংবিধান দ্বারা নির্ধারিত সংখ্যার অধিক কোনো নির্বাচনী এলাকা হবে না। এর পরের অনুসরণীয় বিধানে এলাকা নির্ধারণের জন্য মাপকাঠির কথা বলা হয়েছে। মাপকাঠির মধ্যে রয়েছে- (এক) প্রশাসনিক সুবিধা, (দুই) প্রতি নির্বাচনী এলাকা ঘনসন্নিবিষ্ট (compact) হতে হবে এবং (তিন) এ বিষয়ে সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যার বিষয় আমলে নিতে হবে। তবে শেষোক্ত বিষয়ে 'বাস্তবসম্মত' শব্দটিও যুক্ত আছে। অর্থাৎ এ বিষয়ে কমিশনকে কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে দেখা গেছে, এলাকা কিছু ক্ষেত্রে একক ভূখণ্ড নয়। বিষয়টি এলাকার আয়তন ও জনসংখ্যার ওপর নির্ভর করবে।
এর পরের বিধানে কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে। এক. সীমানা নির্ধারণে কমিশনকে প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। দুই. এরপর প্রতি নির্বাচনী এলাকার ভৌগোলিক সীমানাসহ একটি প্রাথমিক তালিকা গেজেটে প্রকাশিত হবে। তিন. একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশিত তালিকার বিষয়ে কারো কোনো আপত্তি বা মতামত প্রেরণের সুযোগ দিতে হবে। চার. কমিশন উত্থাপিত আপত্তি ও মতামত বিবেচনা করে প্রয়োজনবোধে তালিকা সংশোধন করবে। পাঁচ. চূড়ান্ত তালিকা পুনরায় গেজেটে প্রকাশ করতে হবে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে সময়সাপেক্ষ। এ বিষয়ে অধুনা উত্থাপিত কিছু অভিমতের বিষয়ও কমিশন জানে। এ বিষয়গুলোসহ রাজনৈতিক দলের মতামতও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর।
কমিশন গত ২০০৮ সালের ২৯ এপ্রিল গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সীমানা নির্ধারণের অনুসরণীয় পদ্ধতি প্রকাশ করেছিল। তবে এটা ছিল প্রাথমিক তালিকা। ২০০৮ সালে জনসংখ্যাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ফলে ঢাকা শহরে নির্বাচনী এলাকার সংখ্যা আট থেকে ১৫-তে বৃদ্ধি পায়। এবারও একই পদ্ধতি অনুসরণ করলে আসনসংখ্যা ১৫ থেকে ২৫ হবে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে ওই সময় ১৩০টি আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারিত হয়। তবে এখন অনেকে ২০০৮ সালের পূর্ববর্তী অবস্থানে ফিরে যাওয়ার অভিমত কমিশনকে দিয়েছেন। পক্ষান্তরে এর বিপরীতে অনেকে ২০০৮ সালের অবস্থান অক্ষুণ্ন রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ না করা পর্যন্ত এখনো কিছু বলা সম্ভব নয়। এ তালিকা প্রকাশের পরও কিছু আপত্তি অবশ্যই হবে। কারো আপত্তি ও মতামত দেওয়ার সুযোগ আইনে রয়েছে। এ ধরনের আরো কিছু রদবদল-সংক্রান্ত অভিমত কমিশন পেয়েছে।
গত ১০ মার্চ নির্বাচন কমিশন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম ও সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিষয়ে মতামত বিনিময় করেছে। এর পূর্ণাঙ্গ তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। ভোটার তালিকা প্রণয়নের অগ্রগতির তথ্য জানা গেলেও সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। অনুমান করা সম্ভব যে এ বিষয়ে কমিশন বর্তমানে বিভিন্ন মহলের মতামত গ্রহণের কাজে ব্যস্ত। এ কাজটি শেষ হলে তারা এ বিষয়ে প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করবে। ওই সময়ও আপত্তি ও মতামত দেওয়ার সুযোগ থাকবে। এ প্রক্রিয়া অক্টোবর বা নভেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করা হলে ভালো হয়। স্মরণ করা যেতে পারে যে গত ২০০৮ সালের সীমানা নির্ধারণের প্রাথমিক তালিকা ২৯ এপ্রিল গেজেটে প্রকাশ করেছিল। তালিকা প্রকাশের পর আপত্তি ও পুনরায় মতামত দেওয়ার জন্য সুযোগ দিতে, সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণেও সময়ের প্রয়োজন হবে। অক্টোবর, ২০১২
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments