আয়কর আহরণ : চাই স্থিতিশীল উদ্যোগ by মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

শব্দের মধ্যে যে উদ্দেশ্য ও বিধেয় লুকিয়ে থাকে, সেটিই শব্দের প্রকৃত অর্থ নির্ধারক। শব্দের ভাবগত, ভাষাগত, ব্যুৎপত্তিগত অর্থ স্থান, কাল, পাত্রভেদে ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করতে পারে কিন্তু মূল বা ধাতুগত স্বকীয়তা তার ঠিক থাকে সর্বদা, সর্বত্র। 'আদায়' শব্দটি আরবি 'আদা' ধাতুমূল থেকে উৎপত্তি। মূল অর্থ পালন করা, সম্পাদন করা, সাধন করা।


সংস্কৃতে আ প্রত্যয়ের সঙ্গে সদা ধাতুযোগে আদায় শব্দটি গঠিত। দা ধাতুমূল দায়বদ্ধতার প্রতীক। প্রজা মালিক বা রাজা বা রাষ্ট্রের কাছে দেয় পরিশোধে দায়বদ্ধ। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব লাভের আগ পর্যন্ত বেশির ভাগ সময় বিদেশি শাসনের অধীনে থাকা আমাদের এই দেশ ও সমাজে প্রাচীনকাল থেকেই ট্যাক্স বা খাজনা বা নজরানা সংগ্রহ কার্যক্রমে জোর-জবরদস্তি বা বাধ্য করা অর্থে, পাওনা উদ্ধার অর্থে 'আদায়' শব্দটি ব্যবহার হয়ে এসেছে। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি কর্তৃক অধিগ্রহণকৃত এ দেশীয় ভূমির মালিকানাসূত্রে খাজনা সংগ্রহের দায়িত্ব জমিদার শ্রেণীর কাছে অর্পিত হয়। জমিদাররা জমির প্রকৃত মালিক ছিল না, তারা জমির চাষবাসেও ছিল না, তারা কম্পানির হয়ে খাজনা সংগ্রাহক ছিল মাত্র। এই সংগ্রহ কাজে কম্পানিকে দেয় পরিশোধের পর উদ্বৃত্ত কমিশন হিসেবে প্রাপ্তির প্রত্যাশী ছিল মধ্যস্বত্বভোগী এই সিন্ডিকেট। ফলে রায়তের সঙ্গে খাজনা সংগ্রহ কর্মে তাদের সম্পর্ক শেষমেশ জুলুম বা জোর-জবরদস্তির পর্যায়ে পৌঁছাত। জমিতে ফসল হলো কি না, রায়ত চাষবাস করে টিকে থাকতে পারবে বা পারছে কি না- এটা জমিদারদের বিবেচনার বিষয় ছিল না। খাজনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে আদায় শব্দটি সেভাবে একটা জোর-জুলুম, অত্যাচার, আত্মসাতের প্রতিভূ হিসেবে বিদ্যমান হয়ে দাঁড়ায়। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী দেশে ও পরিবেশে রাষ্ট্রকে দেয় 'আদায়ের' ঔপনিবেশিক আমলের এসব মানসিকতা অব্যাহত থাকা যুক্তিগ্রাহ্য হতে পারে না।
নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র কর্তৃক আইনের আওতায় কর আরোপ আর রাষ্ট্রকে সেই কর পরিশোধের বিষয়টি এ নিরিখে বিচার করলে দেখা যায় আদায় শব্দটা ততটা জুতসই নয়, যতটা ভূমি কর বা খাজনার ক্ষেত্রে খাটে। আয়করের দর্শন হলো রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাস করে নির্ধারিত পরিমাণের বেশি আয় বা সম্পদ অর্জিত হলে রাষ্ট্র তার একটা নির্দিষ্ট অংশ 'সমাজে সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থায় সমতা বিধান এবং আয়-উপার্জনের পরিবেশ সৃজন তথা অবকাঠামো নির্মাণ বাবদ আয়-উপার্জনের পরিমাণ ভেদে একটা হিস্যা' হিসেবে প্রাপ্য চাইতে পারে।
আয়কর দেওয়ার মতো আয় যে নাগরিকের আছে তিনি রাষ্ট্রকে দেয় কর পরিশোধ করবেন স্বেচ্ছায়, আইনগত বাধ্যবাধকতা পালন করে, নাগরিক দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে। তবে হ্যাঁ যদি তিনি তা পরিশোধে গড়িমসি করেন, এড়িয়ে চলেন, অসাধু পন্থা অবলম্বন করেন তাহলে আইনের আওতায় রাষ্ট্রের প্রাপ্য উদ্ধারে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। এ নিরিখেই সব করদাতার সঙ্গে 'আদায়'-জনিত মনোভাব পোষণ বা ক্ষমতার প্রয়োগ বা সে ধরনের পরিবেশ সৃজন যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। সীমারেখা মেনে চলা জরুরি এ জন্য যে তা না হলে কর আরোপ, আহরণ, প্রদান ও পরিশোধের ক্ষেত্রে ভিন্ন নেতিবাচক পরিস্থিতি উদ্ভব হতে পারে, করারোপ ও আহরণকারীর সঙ্গে করদাতার সম্পর্কের মধ্যে অবিশ্বাস, সংশয়, সন্দেহ দানা বাঁধতে পারে, আস্থায় চিড় ধরতে পারে, পরস্পরকে এড়িয়ে চলার, জোর-জবরদস্তির, পক্ষপাতিত্ব, আঁতাতের মতো অনেক কিছুই ঘটতে পারে। স্বচ্ছতার স্থলে অস্বচ্ছতার অনুপ্রবেশে কর আহরণের মতো রাজস্ব আয়ের দেহে সিস্টেম লস বা ইনফর্মাল রেভিনিউরূপী 'সুগারের' মাত্রা বেড়ে অর্থনীতি 'ডায়াবেটিসে' আক্রান্ত হতে পারে, 'সাইলেন্ট কিলার' নামে পরিচিত যে রোগটি দেহে বহু ব্যাধির আহ্বায়ক।
রাজস্ব প্রশাসনে কর 'আদায়' শব্দটিকে জোর-জবরদস্তি ও জুলুম (extortion), দখল, আত্মসাৎ, ফাঁকি (evade), সংশয়, সন্দেহের পাড়া থেকে বের করে এনে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে তাকে স্বচ্ছ, সুশোভন, পারস্পরিক উপলব্ধির মাধ্যমে স্বেচ্ছা প্রণোদনের ঘাটে ভেড়ানোর জন্য 'আদায়ের' পরিবর্তে 'আহরণ' (collection of tax or revenue) এ আরোহণের আহ্বান জানানো এবং এটি যাতে শুধু শব্দের পাড়া পরিবর্তন না হয় এটি মনমানসিকতায়ও যাতে স্থায়ী বাসা বরাদ্দ পায় তার জন্য আইনের চোখের সংস্কার ও পদ্ধতি প্রক্রিয়ার চিকিৎসারও উদ্যোগ আরো জোরদার হওয়া প্রয়োজন। চলমান প্রয়াস প্রচেষ্টা আরো জোরদার হোক এটাই প্রত্যাশা ও প্রার্থনা এবারের জাতীয় আয়কর দিবসে।
এবারের জাতীয় আয়কর দিবস উদ্‌যাপনকালে এটা জানা বেশ প্রশান্তি প্রদায়ক যে সরকারের অন্যান্য খাতের বা ক্ষেত্রের চেয়ে রাজস্ব, বিশেষ করে আয়কর আহরণে অগ্রগতি অব্যাহত আছে, উৎসাহব্যঞ্জকভাবেই। আনন্দদায়ক যে আয়কর প্রদানে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি তথা করদাতা বান্ধব পরিবেশ সৃজনে পদ্ধতি প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনার প্রয়াসের ফসল থেকে এ সাফল্য আসছে। এ সাফল্য ধরে রাখতে হবে অর্থনীতিতে কর জিডিপির অনুপাত ন্যায্য পর্যায়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত। বাঞ্ছিত পরিমাণ আয়কর আহরণ সরকারের রাজস্ব তহবিলের স্ফীতির জন্য নয় শুধু, সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থা সুষমকরণের দ্বারা সামাজিক সুবিচার সুনিশ্চিতকরণে, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও অঞ্চলগত উন্নয়ন বৈষম্য দূরীকরণের জন্যও জরুরি। দেশকে স্বয়ম্ভরের গৌরবে গড়তে ও পরনির্ভরতার নিগড় থেকে বের করে আনতে আয়কর অন্যতম প্রভাবক ভূমিকা পালন করবে। আয়কর বিভাগের প্রতিটি প্রয়াসে তাই থাকা চাই বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার সম্মিলনে উন্মোচিত আত্মবিশ্বাস, সহযোগিতাসঞ্জাত মনোভঙ্গি, পদ্ধতি সহজীকরণ, করদাতার আস্থা অর্জনের অয়োময় প্রত্যয়।
২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো বৃত্তাবদ্ধ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে কর রাজস্ব আহরণের সাফল্য লাভের পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি এনবিআরকে। গত চার অর্থবছরে সার্বিক রাজস্ব আয় প্রায় শতভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। আয়কর রাজস্ব বৃদ্ধির পেছনে এডিপির আকার বৃদ্ধিজনিত প্রবৃদ্ধিও সহায়ক ভূমিকায় এসেছে। এটা অবশ্য ঠিক যে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাস্তবায়িত এডিপির পরিমাণ ছিল মাত্র ১৮ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা আর ২০১১-১২ অর্থবছরে তা ৩৬ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়। এডিপির বাস্তবায়ন পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে স্থিরীকৃত আয়কর অধিক পরিমাণে আহরণের একটা অবারিত সুযোগ ও সম্পর্ক আছে। দেখা যাচ্ছে, এই চার অর্থবছরে কম্পানি ও কম্পানি ব্যতীত করের অনুপাত ৫৯:৪১ থেকে ৫৫:৪৫-এ উন্নীত হয়েছে, আর সার্বিক কর রাজস্বে আয়করের হিস্যা দাঁড়িয়েছে ২৫ থেকে ৩০-এর কাছাকাছি। তবে বলে রাখা ভালো, এখনো আয়কর কর রাজস্ব প্রাপ্তির পরিবারে তৃতীয় শরিক, অর্থনীতির আকার অবয়ব চেহারা ও চরিত্র অনুযায়ী আমদানি শুল্ক (আশু) ও মূল্য সংযোজন করকে (মূসক) টপকে আয়করের অবস্থান এক নম্বর হওয়া বাঞ্ছনীয় নয় কী? আয়করকে মোড়লীপনায় আসতে হলে আরো জোরে চালাতে হবে পা, হতে হবে আরো গতিশীল, চাই অধিকতর সমন্বিত উদ্যোগ। নতুন নতুন উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি পুরনো উদ্যোগের সালতামামি বা ফলোআপ আবশ্যক হবে। ২০০৬-০৭ সালে জমকালো জরিপের মাধ্যমে যে লক্ষাধিক করদাতা শামিল হয়েছিলেন করদাতার মিছিলে তাঁরা কি আছেন? ২০০৭-০৮ কিংবা ২০০৮-০৯ এ যাঁরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে করদাতা হয়েছিলেন তাঁদের খবর কী? দেশে যে পাঁচ লক্ষাধিক ক্রেডিট কার্ডধারী আছেন, আছেন প্রায় সমসংখ্যক গাড়ি-বাড়ির মালিক তাঁদের কাছে যাওয়ার সর্বশেষ অবস্থা কী? ভুয়া টিআইএন ব্যবহারকারীদের সঠিক পথে আনার প্রতিবন্ধকতাগুলোর দিকে নজর দেওয়ার সময় ফুরিয়ে যায়নি। আয়করদাতা যাতে নিজেই রিটার্ন ফরম পূরণ করতে পারেন সে ব্যাপারে যে সহায়ক নির্দেশিকা প্রকাশিত হয়েছিল, প্রচারিত হয়েছিল সিটিজেন চার্টার তা কি গণঅবহিতির অবয়বে আছে এখনো। আগেও যেসব কর তথ্যকেন্দ্র, সেবাকেন্দ্র খোলা হয়েছিল প্রকল্পের প্রেরণায় সেগুলোর কার্যকারিতা থেমে গেছে কি না তা দেখার অবকাশ রয়েছে। একই কার্যক্রম বারবার 'নতুন' করে চালু করলে ভিন্ন বার্তা পৌঁছাতে পারে টার্গেট গ্রুপের কাছে। কর মেলায় মানুষের উপচেপড়া ভিড় প্রমাণ করে করদাতাদের আগ্রহ বাড়ছে, অনেকেই ঝামেলামুক্ত উপায়ে বা পরিবেশে কর দিতে চান, কর দেওয়াকে দায়িত্ব মনে করছেন, তাঁদের এই আগ্রহকে ধরে রাখতে হবে, তাঁদের উদ্বোধিত দায়িত্ববোধের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে, তাঁদের আগ্রহকে সমীহ করতে হবে। করদাতাদের উদ্বুদ্ধকরণে প্রচার-প্রচারণার কাজে আগে তেমন কোনো বরাদ্দ ছিল না, কর আহরণের ব্যাপারে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক থেকে অতীতে বর্তমানের মতো প্রযত্ন প্রদানের নজির ছিল না, এখন এসব সুযোগকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর কোনো বিকল্প নেই। তবে সেই ১৯৯০ সাল থেকে এ পর্যন্ত সাত-আটটি প্রকল্প (বিদেশি সাহায্যপুষ্ট, বিদেশি বিশেষজ্ঞের ভারে ন্যুব্জ) বাস্তবায়ন করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শুধু অটোমেশন, অনলাইনিং, স্ট্রিমলাইনিং, স্ট্রেনদেনিংয়ের জন্য। ২০ বছরে সেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের দ্বারা অর্জিত অগ্রগতি দৃশ্যগোচর না হোক অন্তত অনুভব সম্ভব হবে যদি দেখা যায় সবার মাইন্ডসেট ও কর্মকুশলতায় গুণগত পরিবর্তন এসেছে। তবে এটাও ঠিক বর্তমানে যে অব্যাহত অগ্রগতি তার পেছনে সেই সব প্রয়াসের প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি এবং তা নেপথ্য প্রেরণা হিসেবে যে কাজ করছে তা অনস্বীকার্য। একই সঙ্গে সম্মানিত করদাতাদের সার্বিক সহযোগিতা, তাঁদের অভূতপূর্ব দায়িত্ববোধের উদ্বোধন, জটিল কর আইনগুলো সহজীকরণের প্রতি তাঁদের আকিঞ্চন প্রত্যাশাকে সাধুবাদ জানাতে হয়।
লেখক : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।

No comments

Powered by Blogger.