হলমার্ক কেলেঙ্কারি-জানতেন হাতে গোনা কয়জন ফেঁসে গেছেন অনেকেই by শেখ শাফায়াত হোসেন

'হলমার্ক গ্রুপের আজকের এই সাফল্য অর্জনের মূলে সবচেয়ে বড় অবদান সোনালী ব্যাংক লি., হোটেল শেরাটন করপোরেট শাখার (বর্তমানে রূপসী বাংলা শাখা)। সোনালী ব্যাংক লি.-এর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের আন্তরিক সদিচ্ছা ও সহযোগিতার ফলে হলমার্কের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান অতিদ্রুত আজকের এই অবস্থানে এসেছে।'


নিজেদের এক প্রকাশনায় এভাবেই সোনালী ব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতার কথা ফলাওভাবে প্রচার করে বিপুল আর্থিক কেলেঙ্কারির দায়ে অভিযুক্ত হলমার্ক গ্রুপ।
হলমার্ক গ্রুপের একটি স্মরণিকায় তাদের সঙ্গে সোনালী ব্যাংকের শাখা ও আঞ্চলিক পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাখামাখির চিত্র ফুটে ওঠে। সেখানে প্রকাশিত একটি ছবিতে দেখা যায়, হলমার্ক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হলমার্ক স্পিনিং মিলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করছেন সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক মীর মহিদুর রহমান। পাশে দাঁড়ানো ব্যাংকটির রূপসী বাংলা শাখার ব্যবস্থাপক এ কে এম আজিজুর রহমান ও হলমার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদসহ আরো কয়েকজন।
কেলেঙ্কারির কথা ফাঁস হওয়ার পর অবশ্য সেই মহাব্যবস্থাপক মীর মহিদুর রহমানকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) এবং শাখাব্যবস্থাপক এ কে এম আজিজুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করে আপাতত দৃশ্যপট থেকে দূরে রাখা হয়েছে। অথচ এই ঘটনায় ফেঁসে গেছেন ব্যাংকের এমন কিছু কনিষ্ঠ ও অধস্তন কর্মকর্তা, যাঁরা হলমার্কের ঋণ জালিয়াতির বিষয়ে কেবল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আজ্ঞা পালন করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এঁদের মধ্যে এমন কর্মকর্তাও রয়েছেন যাঁরা সদ্য চাকরিতে ঢুকে শিক্ষানবিশকাল পার করছিলেন। জানা গেছে, বাইরের প্রতিষ্ঠানের করা নিরীক্ষা প্রতিবেদনে শনাক্ত করা ৩২ জন কর্মকর্তার মধ্যে এরকম অনেকের নাম এসেছে যাঁদের নীতি-নির্ধারণী কোনো ক্ষমতাই নেই। সংশ্লিষ্ট শাখায় কাজ করার জন্যই তাঁরা ফেঁসে গেছেন। এখন তাঁরা সামাজিকভাবেও নিগৃহীত হচ্ছেন। খুব দ্রুত তাঁদের নামে মামলাও হতে যাচ্ছে।
অন্যদিকে হলমার্ক গ্রপের সঙ্গে অস্বাভাবিক লেনদেন যাদের চোখে পড়েছিল এবং যাঁরা এ ব্যাপারে সময় সময় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছিলেন, এখন উল্টো তাঁদেরকেই ফাঁসানোর চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের পরিদর্শনে ঋণ নিয়ে অনিয়মের বিষয়টি দুই-আড়াই বছরের ঘটনা হিসেবে তুলে ধরা হলেও বিভিন্নভাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকৃতপক্ষে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে হলমার্ককে নিয়মবহির্ভূত ঋণ সুবিধা দিয়ে এসেছে সোনালী ব্যাংক। ২০০০ সালে হলমার্ক প্যাকেজিং নামে কার্টন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও শিল্পগোষ্ঠী হিসেবে হলমার্কের যাত্রা শুরু হয় ২০০৭ সালে। ওই বছর থেকেই সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখায় ঋণ ও অগ্রিমসংক্রান্ত নানা অনিয়ম ঘটতে থাকে। ওই সময় রূপসী বাংলা শাখার ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে ছিলেন এ কে এম আজিজুর রহমান। প্রিন্সিপাল শাখার এক পরিদর্শনে অনিয়মের ঘটনা ধরা পড়লে আজিজুর রহমান বিষয়টি স্বীকারও করে নিয়েছিলেন। 'এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না'- এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০০৯ সালের ২৬ জুলাই মহাব্যবস্থাপকের কাছে একটি চিঠিও দিয়েছিলেন তিনি। তবে সে কথা তিনি রাখতে পারেননি। এক শাখায় তিন বছরের বেশি থাকার কথা না থাকলেও রূপসী বাংলা শাখায় তিনি ছিলেন টানা পাঁচ বছর। তাঁর সময়ে এ শাখায় ঋণপত্র অনিয়মের ঘটনা নিয়মে পরিণত হয়। ২০১০ সালের দিকে এই অনিয়মের মাত্রা গুরুতর আকার ধারণ করে। তা চলতে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের সাম্প্রতিক নিরীক্ষায় দেশের ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির এ ঘটনা বেরিয়ে আসার পূর্বপর্যন্ত।
সোনালী ব্যাংকের নিয়োগকৃত অডিট ফার্ম সাইফুল শামসুল আলম অ্যান্ড কম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টসের ফাংশনাল অডিট বা বিশেষ কার্যক্রম নিরীক্ষা প্রতিবেদনে অনিয়মের বিস্ময়কর সব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, হোটেল রূপসী বাংলা শাখা মহাব্যবস্থাপক দপ্তরের তদারকির আওতায় আসে ২০১১ সালের ১ জুলাই। ওই সময় (২১ মার্চ ২০১১ থেকে ৩১ জানুয়ারি ২০১২) মহাব্যবস্থাপক দপ্তরের কাজ করতেন মহাব্যবস্থাপক মীর মহিদুর রহমান। এর আগে (২০০৯-২০১০ সালে) প্রিন্সিপাল শাখার দায়িত্বে থাকাকালে তিনি ওই অনিয়ম শনাক্ত করেছিলেন বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, ১ জুলাই ২০১১-তে তিনি রূপসী বাংলা শাখা তদারকির দায়িত্ব পান কিন্তু কোনো এক রহস্যময় কারণে তিনি এই শাখার অনিয়মের বিষয়ে চুপ থেকেছেন এবং এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য ও মীর মহিদুরের কার্যক্রমের সময়সীমা পর্যালোচনা করে কিছুটা ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে। ২০১১ সালের মে মাসের ১৩ তারিখ প্রধান অতিথি হিসেবে হলমার্ক স্পিনিং মিলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে ধামরাইয়ের কালামপুরের সুতিপাড়ায় গিয়েছিলের সোনালী ব্যাংকের এই মহাব্যবস্থাপক। অথচ তিনি রূপসী বাংলা শাখার তদারকির দায়িত্বে আসেন এরও প্রায় দেড় মাস পর। অর্থাৎ অনেক আগে থেকেই তিনি হলমার্ক ও ব্যাংকটির অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
সোনালী ব্যাংকের একাধিক সূত্রের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে, মহিদুর রহমান ও আজিজুর রহমান প্রথম থেকেই হলমার্কের ঋণ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। হলমার্কের মালিক পক্ষের সঙ্গে তাদের দহরম-মহরম ছিল। আর বিশাল অনিয়মের ঘটনাটি তাদের সহযোগিতাতেই ঘটেছে। ঘটনাটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীসহ হাতে গোনা কয়েকজন কর্মকর্তা জানতেন। তাঁরা অনেকদিন পর্যন্ত বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখতে পারলেও শেষরক্ষা হয়নি। অবশেষে শাখাটি পরিদর্শন হয়। কিন্তু তার আগেই বিশাল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয় হলমার্কসহ বেশকিছু গোষ্ঠী।
এদিকে সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে দায়িত্বরত একজন মহাব্যবস্থাপক কালের কণ্ঠকে বলেছেন, 'হলমার্কের নাম আগে কখনো শোনেননি এমন কর্মকর্তাও পড়ে গেছেন বরখাস্তদের তালিকায়। অনিয়মের প্রতিবাদ করেছিলেন যাঁরা, তাঁদের অনেকেও এই ঘটনায় ফেঁসে গেছেন। ফাংশনাল অডিটে সংশ্লিষ্ট বিভাগে দায়িত্ব পালন করার কারণে ঢালাওভাবে অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। আবার আড়াল করা হয়েছে অনেক দোষী ব্যক্তিকে।' সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনও সম্প্রতি তাঁর এক নিবন্ধে এমন কথাই লিখেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল সাময়িকভাবে বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তারা এখন ঘুরছেন ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে। কারো কারো ডাক পড়ছে দুর্নীতি দমন কমিশনে। কেউ নিজে থেকে গিয়ে অবস্থান ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন। পরিচালনা পর্ষদের কর্মকর্তারা এর আগে বলেছেন, নিরীক্ষা প্রতিবেদনে যাঁদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তদন্তের স্বার্থে তাঁদের সবাইকেই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছে। তাঁরা যে সবাই দোষী তা নয়। তদন্তে যাঁরা নির্দোষ প্রমাণিত হবেন তাঁরা যথারীতি চাকরিতে ফিরে যাবেন। কিন্তু এতে স্বস্তি পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তরুণ একজন কর্মকর্তা জানান, নিজেদের কর্মস্থলেই তাঁরা এখন দোষী বলে চিহ্নিত, ধিকৃত হচ্ছেন। পারিবারিক, সামাজিকভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন।
হলমার্ক গ্রুপের সঙ্গে দীর্ঘদিন ব্যবসা করছে এমন কয়েকটি বায়িং ফার্মের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হলমার্ক গ্রুপ ৩৪-৩৫টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে দাবি করলেও প্রকৃত অর্থে তাদের ৪/৫টি প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান উৎপাদনেও এসেছে বছর দুয়েক হলো। প্রথম দিকে গোষ্ঠীটির টেক্সটাইল কারখানায় শ'খানেকের মতো লাইন থাকলেও বর্তমানে লাইন চালু রয়েছে মাত্র ১০/১২টি। প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৪০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করার বিষয়টিও সত্য নয় বলে জানিয়েছেন ওই ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলেছেন, হলমার্কের কখনোই এত কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিল না। তবে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি কিছু লোক নিয়োগ দিয়েছে। সব মিলিয়ে ১০ থেকে ১২ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী হতে পারে।
হলমার্কের উৎপাদিত পণ্যও খুব একটা মানসম্পন্ন নয় বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠজনরা। তাঁরা জানিয়েছেন, হলমার্কের এমডি তানভীর মাহমুদ কেবল ব্যবসা সম্প্রসারণের দিকটাই দেখেছেন। কিন্তু ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দেননি। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার কাজে এমন সব লোক বসিয়েছিলেন যাঁরা ওই কাজের যোগ্য নন। ফলে খুব অল্প সময়ে ফুলেফেপে ওঠা হলমার্কের উৎপাদিত পণ্যের মান যেমন খারাপ হতে থাকে, তেমনি ব্যবসায়িকভাবে লোকসানের মুখে পড়ে যান তানভীর মাহমুদ। এসব বিষয়ে জানতে তানভীর মাহমুদের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে কল করে সেটি চালু পাওয়া গেলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। পরে এসএমএস পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
এদিকে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে দুদকের ভূমিকাকেই মুখ্য বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা। এ বিষয়ে ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, এ রকম পরিস্থিতিতে অভিযুক্তদের সবাই নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেন। সোনালী ব্যাংকের ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। তবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হলে তথ্যপ্রমাণাদি থাকতে হবে। প্রমাণাদির ভিত্তিতে যাঁর যতখানি দায়, তাঁর শাস্তিও তেমনই হবে। তবে এ বিষয়ে মামলাটি হতে হবে দুদকের পক্ষ থেকে। কেননা সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা সরকারি চাকরিজীবী। তাঁদের বিরুদ্ধে নিজ প্রতিষ্ঠানের মামলা করাটা ফৌজদারি আইনে 'অরক্ষণীয়' বলে পরিগণিত হবে। এক্ষেত্রে দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় কেবল দুদক মামলা করলেই তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.