স্মরণ- অবিস্মরণীয় সেই মানুষটি by সামসুল ওয়ারেস
একেবারে শূন্য থেকে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, নিজস্ব স্বাধীনতা তৈরি করে, কঠোর পরিশ্রমে আর হয়তো বা কিছুটা সৌভাগ্যের ছোঁয়া নিয়ে যে কজন মানুষকে সার্থক হতে দেখেছি, তাঁদের মধ্যে নিতুনদাকেই মনে পড়ে বেশি। তাঁর কাছে অসম্ভব বলে কিছু ছিল না। একবার কিছু করার (সৃষ্টির) কথা মনে হলে তা না করা পর্যন্ত নিস্তার নেই।
রাতদিন ঘুমহীন শুধু লেগে থাকা। অবিশ্বাস্য একরোখা মানুষ। আর্ট কলেজে ছাত্রাবস্থায় নিদারুণ অর্থকষ্ট। সিনেমার পোস্টার এঁকে যৎসামান্য উপার্জন। শিল্পী ও চলচ্চিত্র অভিনেতা সুভাষ দত্তের সযত্ন সহযোগিতা ও উৎসাহ তখন তাঁকে জীবনসংগ্রামে আত্মবিশ্বাসী ও দৃঢ় হতে সাহায্য করে। পরবর্তী সময়ে প্রচুর সম্পদের অধিকারী হয়েও নিতুনদার চরিত্রে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তিনি ছিলেন চিরসবুজ ও উদার। বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তাঁর অকাতর সাহায্য পেয়েছে। তার মধ্যে ছিল আত্মবিশ্বাস ও গর্ববোধ, ছিল না অহংকার। কাঁচপুরে তাঁর বিশাল আধুনিক ওয়ার্কশপ কাম কারখানায় যখন তিনি নিরলস কর্মব্যস্ত ছিলেন, তখন খাদ্যতালিকায় চিকিৎসকের নিষেধ থাকায় তিনি তাঁর খাবার নিজেই রান্না করতেন। ১৯৫৯ সালে ব্যাচেলর অব ফাইন আর্টস পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করা সত্ত্বেও আর্ট কলেজে চিত্রকলার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ না পাওয়ার দুঃখ ও ক্রোধমিশ্রিত বেদনা তাঁকে সারা জীবন তাড়া করে। তিনি ছিলেন এক নির্ভীক সৈনিক, তাঁর যুদ্ধে তিনি একাই লড়েছেন। মৃত্যুর আগেই তিনি প্রবাদপুরুষে পরিণত হন।
আর্ট কলেজ থেকে পাস করে নিতুনদা ইউএসআইএসে (যুক্তরাষ্ট্র তথ্যসেবা) শিল্পী হিসেবে যোগ দেন। কাজ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডের প্রচারমূলক তথ্যাদির প্রদর্শন। পাকিস্তান আমলে প্রেসক্লাবের উল্টো দিকের হলুদ ভবনে এবং পরে বিজয়নগর সড়কের পাশে স্বল্প পরিসরে এসব প্রদর্শনীর শৈল্পিক অভিব্যক্তি ও নিতুনদার উদ্ভাবনাশক্তি আমাদের অভিভূত করত। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, নিখুঁত এসব প্রদর্শনীতে আলোর ব্যবহার ছিল অভিনব ও চিত্তাকর্ষক। ইউএসআইএসে চাকরি করা সত্ত্বেও নিতুনদা তখন প্রগতিশীল পাক-মার্কিনবিরোধী বামপন্থী রাজনীতির সমর্থক ছিলেন। তাঁর আঁকা বলিষ্ঠ পোস্টার ও ব্যানার সে সময় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সে সময় তিনি শিল্পকলা একাডেমীর তৎকালীন গোলাকার গ্যালারিতে তাঁর শিল্পকর্মের এক প্রদর্শনী করেন। বর্গাকৃতির সাদা বোর্ডের তৈরি ফ্রেমে রঙিন কম্পোজিশন কিছুটা ত্রিমাত্রিক রিলিফের ধাঁচে ও ডাচ্ ‘ডিস্টেল’ রীতির জ্যামিতিক প্রভাবে সৃষ্ট তাঁর নিখুঁত শিল্পকর্মগুলো ছিল স্থাপত্যমণ্ডিত ও অভিনব। চাকরির সুবাদে তিনি কয়েকবার আমেরিকায় যান। কাজের প্রতি নিষ্ঠার জন্য মার্কিনরা তাঁকে পছন্দ করত। তারা যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর থাকা ও একটি ভালো চাকরির ব্যবস্থা করে। কিন্তু নিতুনদা দেশে থাকাই মনস্থ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর আঁকা পাকিস্তানবিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পোস্টারগুলো ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি কিছুকাল ‘বিটপি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হন এবং পরে তাঁর নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ‘অটবি’ গঠন করেন। অটবির আগে অবশ্য অল্প সময় তিনি ‘আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস’ প্রতিষ্ঠান গড়েন। স্বাধীনচেতা সৃজনশীল মানুষেরা বেশি দিন পরের জন্য কাজ করতে পারেন না। সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ও সৃষ্টির পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে প্রয়োজন নিজস্ব প্রতিষ্ঠান। অটবি তাঁকে তাঁর পছন্দ অনুযায়ী সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হওয়ার সীমাহীন সুযোগ করে দেয়। নিতুনদার অক্লান্ত পরিশ্রম ও কর্মনিষ্ঠা অল্প দিনের মধ্যেই অটবিকে একটি আধুনিক ফার্নিচার ও ক্রেস্ট তৈরির প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। অচিরেই বাংলাদেশের অফিস-আদালত আর বাসাবাড়িতে অটবির ফার্নিচার শোভা পেতে শুরু করে। সম্পূর্ণ বাংলাদেশে তৈরি অটবির আন্তর্জাতিক মানের আসবাব বাংলাদেশে নাগরিক সংস্কৃতি বিকাশে ও আধুনিক রুচিবোধ সৃষ্টিতে বিপ্লবী ভূমিকা রাখে।
অটবির কারখানা তখন মিরপুরে। মাইল্ড ও স্টেইনলেস স্টিল, চামড়া, রেক্সিন ইত্যাদি সামগ্রীর তৈরি সোফা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। নিতুনদা বিভিন্ন ধরনের ডিজাইন করেন আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে কারখানায় তৈরি হয় নতুন নতুন আসবাব। মিরপুরের কারখানায় এক টুকরো চৌকো খালি জায়গা ছিল। নিতুনদা সেখানে তৈরি করেন মাটি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক এক বিশাল ভাস্কর্যের ডামি। ডামি থেকে স্টিলের ছাঁচ। ছাঁচ থেকে কংক্রিটে তৈরি হয় বিশাল ভাস্কর্য। ভাস্কর্যটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে খোলা জায়গায় নিতুনদার নকশায় ও পরিকল্পনায় একটি চৌকো প্ল্যাটফর্ম ও বেদির ওপর স্থাপন করা হয়। এ কাজে তিনি ছিলেন শতভাগ নিবেদিত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অসহযোগ ও অবহেলা সত্ত্বেও তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিজস্ব অর্থ ব্যয়ে ভাস্কর্যটি সম্পন্ন করেন। মাটির ভাস্কর্যটি দেখার জন্য আমি আর স্থপতি রবিউল হুসাইন বহুবার তাঁর আহ্বানে মিরপুর যাই। রাজশাহীতে ভাস্কর্যটির উদ্বোধনের সময় তিনি বহু গুণী শিল্পী, স্থপতি, কবিসহ জাহানারা ইমামকে নিয়ে যান। তাঁর মধ্যে এক অসাধারণ আশাবাদ কাজ করতে দেখেছি। রাজশাহীর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক এই শিল্পকর্ম বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ভাস্কর্য।
নিতুন কুন্ডু মূলত আসবাব প্রস্তুতকারক ব্যবসায়ী হলেও শিল্পসত্তা কখনো বিসর্জন দেননি। নতুন নতুন আসবাব তৈরি করে তিনি যেমন শৈল্পিক আনন্দ পেয়েছেন, তেমনি ঢাকা শহরের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য নিজস্ব অর্থায়নে সোনারগাঁও হোটেলের মোড়ে নির্মাণ করেন অনেকটা নিউক্লিয়ার স্ট্রাকচারের মতো দেখতে স্টেইনলেস স্টিলের ভাস্কর্য ও ফোয়ারা। পরবর্তীকালে তিনি চাটগাঁ বিমানবন্দরের প্রবেশমুখে নির্মাণ করেন ‘শাম্পান’ নৌকার আদলে এক ভাস্কর্য। এসব কাজে তাঁর শৈল্পিক ও প্রযুক্তিগত প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায়।
নিতুনদা ছিলেন সংসার-নিবেদিতপ্রাণ। এক ছেলে ও এক মেয়ে, দুজনের দুটি পাসপোর্ট সাইজের ছবি তিনি শার্টের বুক পকেটে সব সময় বহন করতেন। নিতুনদা ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল তরতাজা বন্ধুবৎসল মানুষ। প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসের ২৮ কি ২৯ তারিখে ফোন করতেন, নববর্ষ শুরুর রাতটা যেন সস্ত্রীক তাঁর ফ্ল্যাটে কাটাই। অনেক ইংরেজি নববর্ষের রাত তাঁর বাসায় কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীদের মাঝে হইচই-আপ্যায়নে, আতশবাজি পুড়িয়ে কেটেছে। আজকাল আর ওই রাতে কোথাও যাই না। নিজের বাড়িতেই থাকি। নিতুনদার প্রাণবন্ত মুখটি তখন নিজের অজান্তেই চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে এই সৃজনশীল মানুষটির স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
সামসুল ওয়ারেস
স্থপতি
No comments