গণতন্ত্র দিবস- গণতন্ত্রই হোক আরাধ্য by এম এম খালেকুজ্জামান
গত শতকের একান্ন সালে কোরিয়ায়
নিযুক্ত জাতিসংঘ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল ডগলাস ম্যাক আর্থারকে
পদচ্যুত করেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান। সেনাধ্যক্ষের দায়িত্বের
নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে ম্যাক আর্থার যুদ্ধের নীতিনির্ধারণী বক্তব্য
দিয়েছিলেন—এই অপরাধে ম্যাক আর্থারকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রত্যাহার করে দেশে
পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তবে দেশে সাধারণ আমেরিকানরা তাঁকে তুমুল অভিনন্দন জানিয়ে
বরণ করে নেয় এবং তাঁকে প্রত্যাহারের কারণে সাধারণ জনগণের তোপের মুখে পড়েন
প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান। তবে তিনি নীতিভঙ্গের কারণে সেনাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে
নেওয়া শাস্তিমূলক পদক্ষেপের সপক্ষে অটল থাকেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৪ সালে
ম্যাক আর্থার তাঁর কর্মজীবনের স্মৃতিকথায় স্বীকার করেন, প্রেসিডেন্ট সঠিক
সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন তাঁকে প্রত্যাহার করে।
সামরিক
বাহিনীর ওপর বেসামরিক কর্তৃত্বের প্রতিষ্ঠা মার্কিনব্যবস্থার মৌলিক বিষয়।
অস্ত্রের শক্তিমত্তা থাকা সত্ত্বেও সহনশীলতার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত সেনাপ্রধান
আদতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিই সম্মান দেখিয়েছেন। যদিও মার্কিন
সংবিধানে সেভাবে গণতন্ত্র শব্দটি খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে শেষ পর্যন্ত
গণতন্ত্রই হচ্ছে মার্কিন সংবিধানের মৌল নির্যাস। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন
সংবিধান হওয়া সত্ত্বেও এ পর্যন্ত মাত্র ২৭টি সংশোধনী এনেছেন মার্কিন
আইনপ্রণেতারা। সংখ্যাগরিষ্ঠের ওজর তুলে অযথা সংবিধান সংশোধন করে গণতন্ত্রকে
নস্যাৎ করেননি তাঁরা।
২০০৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, প্রতিবছরের ১৫ সেপ্টেম্বরকে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রসমূহ এবং তার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনগুলো আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করবে। ২০০৮ সাল থেকে যা সদস্য রাষ্ট্রগুলো পালন করে আসছে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসের মৌল প্রস্তাবে বলা হয়, গণতন্ত্রের কোনো একক মডেল নেই। কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে কোনো নির্দিষ্ট সীমানায় আবদ্ধ না থেকে সার্বত্রিক বিরাজমানতা বজায় রেখেছে। গণতন্ত্রে জনগণ নিজেরাই নিজেদের স্বাধীন ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে নিজ নিজ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
সেই খ্রিষ্টপূর্ব সময়কাল থেকেই গণতন্ত্র সক্রেটিসের পছন্দের তালিকায় স্থান পায়নি। তাঁর সাক্ষাৎ শিষ্য প্লেটো গুরুর দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে গণতন্ত্রকে মূর্খের শাসন বলে রীতিমতো গালমন্দ করেছেন দ্য রিপাবলিক বইয়ে। গণতন্ত্র গ্রহণ করেননি আরেক আদি চিন্তক অ্যারিস্টটলও। তবে এই দ্বিতীয় সহস্রাব্দে এসে পৃথিবীর দেশে দেশে শাসনপদ্ধতি হিসেবে গণতন্ত্রের চেয়ে গ্রহণযোগ্য কোনো তন্ত্রের পথ দেখাতে পারেননি কোনো দার্শনিক বা চিন্তকই। চলমান পৃথিবীর শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য আচরিত শাসনব্যবস্থা। গত শতকের শেষ দশকে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে যাওয়ার পর গণতন্ত্রকে অন্য কোনো তন্ত্রের সঙ্গে সেভাবে আর প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে না। তবে শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র জনপ্রিয়তা পাওয়ার কারণ হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য দেওয়া, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমঝোতার বাতাবরণ সৃষ্টির প্রয়াসকে অন্যতম ধরা হয়ে থাকে।
এই বঙ্গীয় সমতটের আদিগন্ত গণতন্ত্র সম্পর্কে নীহার রঞ্জন রায় বলেছিলেন, গৌরবঙ্গ সমতটে তখন কোনো রাজার আধিপত্য নেই। রাষ্ট্র ছিন্নভিন্ন। ক্ষত্রীয় বণিক, ব্রাহ্মণ নাগরিক যে যার ঘরে সবাই রাজা। আজ যে রাজা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় প্রভুত্ব দাবি করছে, কাল তাঁর কাটা মুণ্ডু ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে। এই নৈরাজ্যের নাম দেওয়া হয়েছে মাৎস্যন্যায়। রাজা নেই অথচ সবাই রাজার গদিতে বসতে চায়। এই অরাজক নীতিহীন জগদ্দল শাসনকাল থেকে উত্তরণের আশায় রাজা গোপালকে ক্ষমতা গ্রহণ করতে হয়। যদিও কথিত আছে, গোপাল নিজ ইচ্ছায় নয়, বরং প্রকৃতিগণের ইচ্ছায় রাজদণ্ডের দায়িত্ব নেন। এমনটাই জানা যায় খলিমপুর তাম্রলিপির এক শ্লোকে, আর আজ তাম্রলিপি তিরোহিত হয়েছে দৈনিক পত্রিকা দ্বারা, যা আকীর্ণ থাকে বিবদমান রাজনৈতিক গোপালদের সমূহ হানাহানিতে, উদ্দেশ্য রাজসিংহাসন দখল করা।
মানুষের জীবনযাত্রার নানা কাল পর্যায়ে যেমন চড়াই-উতরাই থাকে, রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম প্রাচীনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রকেও নানা উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। ১৮৩৫ সালে ফরাসি চিন্তাবিদ অ্যালেক্সি ডি টকভিল মার্কিন গণতন্ত্র সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, ‘গণতন্ত্র অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে যখন, তখন তা জ্ঞান ও সভ্যতার এক অনুকূল পর্যায়ে উপনীত হয়। কিছু কিছু জাতির প্রাথমিক পাঠ এতটাই ক্লেদাক্ত হয়ে থাকে, সেই সঙ্গে তাদের চারিত্রিক আবেগ অজ্ঞতা ও পরিপার্শ্ব সম্পর্কে ভ্রান্তি এমন প্রচণ্ড থাকে যে, তারা তাদের দুর্দশার কারণই চিহ্নিত করতে সক্ষম হয় না এবং এমন রোগের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়, যার উপশমের পদ্ধতি সম্পর্কেও জ্ঞান থাকে না।’
তবে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে আত্মসংশোধন এবং নবীকরণের মধ্য দিয়ে চলার পথের বাধাগুলো সরিয়ে চলমানতা জারি রাখার ক্ষমতা। অন্যভাবে বলা যায়, আত্মশুদ্ধির সৌন্দর্যকে ধারণ করে বলেই গণতন্ত্র এখনো আরাধ্য শাসনব্যবস্থা।
এম এম খালেকুজ্জামান: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
২০০৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, প্রতিবছরের ১৫ সেপ্টেম্বরকে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রসমূহ এবং তার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনগুলো আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করবে। ২০০৮ সাল থেকে যা সদস্য রাষ্ট্রগুলো পালন করে আসছে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসের মৌল প্রস্তাবে বলা হয়, গণতন্ত্রের কোনো একক মডেল নেই। কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে কোনো নির্দিষ্ট সীমানায় আবদ্ধ না থেকে সার্বত্রিক বিরাজমানতা বজায় রেখেছে। গণতন্ত্রে জনগণ নিজেরাই নিজেদের স্বাধীন ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে নিজ নিজ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
সেই খ্রিষ্টপূর্ব সময়কাল থেকেই গণতন্ত্র সক্রেটিসের পছন্দের তালিকায় স্থান পায়নি। তাঁর সাক্ষাৎ শিষ্য প্লেটো গুরুর দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে গণতন্ত্রকে মূর্খের শাসন বলে রীতিমতো গালমন্দ করেছেন দ্য রিপাবলিক বইয়ে। গণতন্ত্র গ্রহণ করেননি আরেক আদি চিন্তক অ্যারিস্টটলও। তবে এই দ্বিতীয় সহস্রাব্দে এসে পৃথিবীর দেশে দেশে শাসনপদ্ধতি হিসেবে গণতন্ত্রের চেয়ে গ্রহণযোগ্য কোনো তন্ত্রের পথ দেখাতে পারেননি কোনো দার্শনিক বা চিন্তকই। চলমান পৃথিবীর শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য আচরিত শাসনব্যবস্থা। গত শতকের শেষ দশকে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে যাওয়ার পর গণতন্ত্রকে অন্য কোনো তন্ত্রের সঙ্গে সেভাবে আর প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে না। তবে শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র জনপ্রিয়তা পাওয়ার কারণ হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য দেওয়া, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমঝোতার বাতাবরণ সৃষ্টির প্রয়াসকে অন্যতম ধরা হয়ে থাকে।
এই বঙ্গীয় সমতটের আদিগন্ত গণতন্ত্র সম্পর্কে নীহার রঞ্জন রায় বলেছিলেন, গৌরবঙ্গ সমতটে তখন কোনো রাজার আধিপত্য নেই। রাষ্ট্র ছিন্নভিন্ন। ক্ষত্রীয় বণিক, ব্রাহ্মণ নাগরিক যে যার ঘরে সবাই রাজা। আজ যে রাজা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় প্রভুত্ব দাবি করছে, কাল তাঁর কাটা মুণ্ডু ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে। এই নৈরাজ্যের নাম দেওয়া হয়েছে মাৎস্যন্যায়। রাজা নেই অথচ সবাই রাজার গদিতে বসতে চায়। এই অরাজক নীতিহীন জগদ্দল শাসনকাল থেকে উত্তরণের আশায় রাজা গোপালকে ক্ষমতা গ্রহণ করতে হয়। যদিও কথিত আছে, গোপাল নিজ ইচ্ছায় নয়, বরং প্রকৃতিগণের ইচ্ছায় রাজদণ্ডের দায়িত্ব নেন। এমনটাই জানা যায় খলিমপুর তাম্রলিপির এক শ্লোকে, আর আজ তাম্রলিপি তিরোহিত হয়েছে দৈনিক পত্রিকা দ্বারা, যা আকীর্ণ থাকে বিবদমান রাজনৈতিক গোপালদের সমূহ হানাহানিতে, উদ্দেশ্য রাজসিংহাসন দখল করা।
মানুষের জীবনযাত্রার নানা কাল পর্যায়ে যেমন চড়াই-উতরাই থাকে, রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম প্রাচীনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রকেও নানা উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। ১৮৩৫ সালে ফরাসি চিন্তাবিদ অ্যালেক্সি ডি টকভিল মার্কিন গণতন্ত্র সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, ‘গণতন্ত্র অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে যখন, তখন তা জ্ঞান ও সভ্যতার এক অনুকূল পর্যায়ে উপনীত হয়। কিছু কিছু জাতির প্রাথমিক পাঠ এতটাই ক্লেদাক্ত হয়ে থাকে, সেই সঙ্গে তাদের চারিত্রিক আবেগ অজ্ঞতা ও পরিপার্শ্ব সম্পর্কে ভ্রান্তি এমন প্রচণ্ড থাকে যে, তারা তাদের দুর্দশার কারণই চিহ্নিত করতে সক্ষম হয় না এবং এমন রোগের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়, যার উপশমের পদ্ধতি সম্পর্কেও জ্ঞান থাকে না।’
তবে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে আত্মসংশোধন এবং নবীকরণের মধ্য দিয়ে চলার পথের বাধাগুলো সরিয়ে চলমানতা জারি রাখার ক্ষমতা। অন্যভাবে বলা যায়, আত্মশুদ্ধির সৌন্দর্যকে ধারণ করে বলেই গণতন্ত্র এখনো আরাধ্য শাসনব্যবস্থা।
এম এম খালেকুজ্জামান: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
No comments