বুক অব ফ্যাক্টস- আবিষ্কার by আইজ্যাক আজিমভ

 ১৯০০ সালে ডেনমার্কের হুগো ডি ভ্রাইস, জার্মানির কার্ল এরিখ সরেনস ও অস্ট্রিয়ান এরিক ফন শেয়ারমক-জাইজেনেগ আলাদাভাবে প্রজননশাস্ত্র বা বংশগতির প্রধান সূত্র আবিষ্কার করেন। তবে প্রত্যেকেই তাঁদের পূর্বসূরি গ্রেগর মেন্ডেলের ৩৩ বছর আগে আবিষ্কৃত সূত্র নিয়ে কাজ করতে গিয়েই মূলত এই নতুন আবিষ্কারের সন্ধান পান।


উল্লেখ্য, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের (বর্তমানে চেক রিপাবলিক) জার্মানভাষী বিজ্ঞানী গ্রেগর মেন্ডেল আবিষ্কৃত সূত্রটি ছিল: মটরশুঁটি বা ওই জাতীয় প্রতিটি উদ্ভিদের উত্তরাধিকারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সব সময় একটি নির্দিষ্ট আদর্শ মেনে চলে। মেন্ডেলের এই সূত্র পরে ‘মেন্ডেলের উত্তরাধিকার সূত্র’ নামে পরিচিতি পায়। বংশগতির নতুন সূত্রের অভিসন্দর্ভ রচনায় তিন বিজ্ঞানীই মেন্ডেলকেই তাঁদের আবিষ্কারের সব কৃতিত্ব দেন। তিনজনই তাঁদের বৈজ্ঞানিক সততায় প্রশংসিত হন।
 দ্বাদশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত ইউরোপে উইন্ডমিল বা বায়ুকল সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। বায়ুকলের বহুবিধ ব্যবহার ছিল তখনকার পারস্যে, মধ্যপ্রাচ্যে ও চীনে। মুসলমানদের সঙ্গে খ্রিষ্টানদের তৃতীয় ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ থেকে ফিরে আসা ধর্মযোদ্ধারা ইউরোপে এসে প্রথম বাতাস ব্যবহার করে বায়ুকলের প্রচলন করে। পরে বায়ুকল নেদারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স আর জার্মানিতে অতি পরিচিত দৃশ্য হয়ে দাঁড়ায়।
 জার্মান রসায়নবিদ হেনিং ব্রান্ড প্রথম ফসফরাস আবিষ্কার করেন। তিনি যখন হন্যে হয়ে মৌলিক ধাতুকে সোনায় রূপান্তর করার উপায় খুঁজছিলেন, তখনই ঘটনাক্রমে নিজের মূত্র নিয়ে পরীক্ষা চালাতে গিয়ে ফসফরাস আবিষ্কার করেন।
 ১৮৪৯ সালে ওয়াল্টার হান্ট নামের এক আমেরিকান মিস্ত্রি সেফটি পিন উদ্ভাবন করেন। তবে এরও অনেক আগে খ্রিষ্টপূর্ব ১৩ থেকে ১৪ শতকে গ্রিক পেলোপনেসাসে মাইসিনিয়ানরা মেয়েদের পোশাক আটকে রাখার জন্য ব্রৌচের মতো এক ধরনের সোনার তৈরি পিন ব্যবহার করত।
 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফরাসি নৌবাহিনী অফিসার জাক ইব কস্তু অ্যাকুয়ালাং উদ্ভাবন করেন। ওই সময়ের অ্যাকুয়ালাং ছিল এক ধরনের মুখবন্ধ যন্ত্র, যা পানির নিচে ডুবুরিদের চাপ পদ্ধতিতে বাতাস সরবরাহ করত।
 আইসল্যান্ডে উপস্থিত হওয়া প্রথম মানুষ একজন কেলটিক সন্ন্যাসী। ৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আইসল্যান্ডে আসেন। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৭০ থেকে ৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে আইসল্যান্ডে গড়ে ওঠা জনবসতি পরিত্যক্ত হয়। এ সময়ের প্রায় ৮০ বছর পর নরওয়েজীয় ভাইকিংরা হাজির হয় এবং একটি স্থায়ী বসতি স্থাপন করে।
 অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে প্রথম পা রাখেন একজন আমেরিকান সিল শিকারি, তাঁর নাম জন ডেভিস। তিনি ১৮২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি অ্যান্টার্কটিকায় আসেন। কিন্তু ১৯৫৫ সালের আগ পর্যন্ত তাঁর অ্যান্টার্কটিকা আবিষ্কারের ঘটনা কেউ জানত না। পরে তাঁর জাহাজের লগ বই আবিষ্কৃত হলে ঘটনাটি জানাজানি হয়।
 ১৮৪৭ সালে ইতালিয়ান রসায়নবিদ এসকানিও সব্রেরো প্রথম নাইট্রোগ্লিসারিন তৈরি করেন। কিন্তু তাঁর আবিষ্কৃত এক ফোঁটা নাইট্রোগ্লিসারিন আগুনে উত্তপ্ত করতে গেলে ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটে। সব্রেরো ঘাবড়ে গিয়ে তাঁর গবেষণা থামিয়ে দেন। তিনি মনে করেন, তাঁর এই আবিষ্কার যুদ্ধে ব্যবহার হতে পারে। কিন্তু তাতে অন্য বিজ্ঞানীরা থেমে থাকেননি। ১৮৬৬ সালে আলফ্রেড নোবেল ডিনামাইট আবিষ্কার করেন। যা প্রথম দিকে ভারী সেতু, রেলরোড ধ্বংসে ব্যবহূত হতো।
 ১৮ বছরের এক ইংরেজ তরুণ উইলিয়াম হেনরি পারকিন প্রথম সিনথেটিক রং উৎপন্ন করেন ১৮৫৬ সালে। তাঁর শিক্ষক আগস্ট ভিলহেল্ম ফন হফমান ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক হিসেবে সিনথেটিক কুইনাইন তৈরির চেষ্টা করছিলেন। হফমান ছুটিতে জার্মানি গেলে পারকিন তাঁর গবেষণাগারে কুইনাইন নিয়ে আরও পরীক্ষা চালাতে গিয়ে অ্যানলাইন নামের এক যৌগ তৈরি করেন। অ্যালকোহলের সংস্পর্শে এসে এই যৌগ এক ধরনের রক্তবর্ণ রঙের মিশ্রণ তৈরি করে। ওই সময়ে কাপড়ের রং হিসেবে ব্যবহার হতো শুধু প্রাকৃতিক রং, যা তৈরিতে যথেষ্ট অর্থ ব্যয় হতো। পার্পল বা লাল-নীল মিশ্রণে তৈরি রক্তবর্ণ রং তখন উচ্চবিত্ত মহলে বিবেচিত হতো মর্যাদার প্রতীক হিসেবে। প্রাকৃতিক রং থেকে তৈরি এই পার্পল রং তখন রয়েল পার্পল কিংবা ইম্পেরিয়াল পার্পল নামে পরিচিত ছিল। গবেষণাগারে সিনথেটিক বা সংশ্লেষী পার্পল করার পর নতুন এক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যায় পারকিনের সামনে। তিনি স্কুল ছেড়ে দিয়ে ভাইকে নিয়ে কারখানা চালু করেন—এই আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই তাঁর ভাগ্য খুলে যায়, পরবর্তী সময়ে তিনি একজন ধনকুবেরে পরিণত হন।
 গ্যালিলিও যখন তাঁর শ্রেষ্ঠ বই ডায়ালগ কনসারনিং দ্য টু চিফ ওয়ার্ল্ড সিস্টেমস লেখেন, তিনি কোথাও উল্লেখ করেননি যে তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণাটি ছিল অত্যন্ত সত্যনির্ভর ও উন্নত।
 ১৭০০ সালের আগ পর্যন্ত কীভাবে পোর্সেলিন বা চীনামাটি তৈরি করতে হয়, তা ইউরোপীয়দের কাছে রহস্য ছিল। চীনামাটি তৈরির কৌশল শুধু চীনারা জানত। ১৭১২ সালে এক ফরাসি পাদরি ফ্রাসোয়া জেভিয়ার চীন থেকে পোর্সেলিন তৈরির গোপন সূত্র ইউরোপে নিয়ে আসেন। এর আগে বিচ্ছিন্নভাবে ইতালিতে নকল পোর্সেলিন তৈরি হতো। পশ্চিমা বিশ্বে প্রথম পূর্ণাঙ্গ পোর্সেলিন তৈরি করেন জার্মান রসায়নবিদ ইয়োহান ফ্রিডরিখ বটিগার। যদিও সাম্প্রতিক গবেষকদের কেউ কেউ বলছেন, বটিগার পোর্সেলিনের উন্নতি সাধন করেছিলেন সত্যি কিন্তু ইউরোপে পোর্সেলিন আবিষ্কারের কৃতিত্ব আসলে আরেক জার্মান গণিত ও পদার্থবিদ ওয়ালথার ফন শ্রিনহাউজেনের।
 ভাষান্তর: হাসান খুরশীদ

No comments

Powered by Blogger.