আমাদের ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থাটা হবে অনলাইনভিত্তিক—রাগিব হাসান

ইউনিভার্সিটি অব আলাবামা অ্যাট বার্মিংহামের সহকারী অধ্যাপক এবং বাংলা উইকিপিডিয়ার ব্যুরোক্রেট ও প্রশাসক রাগিব হাসান অনলাইনে ভিডিও পাঠ দেওয়ার জন্য যন্ত্রগণক ও শিক্ষক—এই দুটি সাইট চালু করেছেন। অনলাইনে ভিডিওর মাধ্যমে শিক্ষাদান নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রজন্ম ডট কমের সঙ্গে।


যন্ত্রগণক ও শিক্ষক তৈরির ধারণাটা কোথায় পেলেন? কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলায় মুক্তশিক্ষা চালু করার ধারণাটা প্রথম মাথায় আসে ২০১১-এর শুরুতে। আমি তখন যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করছিলাম। ওখানে কোর্স পড়াতে গিয়ে মনে হলো, এই কোর্সটা বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থীরও কাজে লাগতে পারে। কিন্তু দেশে গিয়ে এত সময় ধরে কোর্স পড়ানো সম্ভব না, তাই ভাবলাম কোর্সটাকে পুরোপুরি অনলাইনে পড়াব। সব ঠিকঠাক করে যন্ত্রগণক ডট কম নতুন করে চালু করি গত জুলাই মাসে। প্রথমেই দুটি কোর্স দিয়ে শুরু করি। অভূতপূর্ব সাড়া পাই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। আমার কম্পিউটার নিরাপত্তা কোর্সে অল্প কয়েক দিনেই এক হাজার ২০০ জন শিক্ষার্থী নিবন্ধন করেন। প্রতিটা কুইজ দেন ৫০০-৬০০ জন করে।
এটা দেখে আমার মনে হলো, শুধু কম্পিউটার বিজ্ঞানের ওপর সীমাবদ্ধ না থেকে আসলে সব বিষয়ের ওপরই কোর্স পড়ানো যেতে পারে। তাই দেশে-বিদেশে নানা জায়গায় ছড়িয়ে থাকা বিজ্ঞানী, শিক্ষক, পিএইচডি গবেষক—এঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করি ফেসবুক ও ই-মেইলের মাধ্যমে। অনেকেই সাড়া দিয়ে পড়াতে এগিয়ে এসেছেন। শিক্ষক সাইটে এখন ১০টি কোর্স চলছে এবং আরও ছয়টি কোর্স এ মাসেই শুরু হবে।
যন্ত্রগণক ও শিক্ষক সাইটের সব কোর্স দেওয়া হচ্ছে মুক্ত লাইসেন্স ক্রিয়েটিভ কমন্সের অধীনে, আর এখানে কোর্স করতে কারও কোনো পয়সা লাগবে না, শুধু ইন্টারনেটে যুক্ত একটি কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন থাকাই যথেষ্ট। এখানে যাঁরা কোর্স পড়াচ্ছেন, তাঁরাও সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করছেন কেবল বাংলা ভাষা ও স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার তাগিদে।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অনলাইন কোর্স জরুরি?
একটা উদাহরণ দিই—আমি যখন যন্ত্রগণক সাইটে কম্পিউটার বিজ্ঞানের কোর্স চালু করলাম, তখন বাংলাদেশ থেকে অনেকগুলো ই-মেইল পেলাম। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে একজন জানালেন, তাঁর খুব ইচ্ছা ছিল কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়ার, কিন্তু এইচএসসির পর অর্থাভাবে আর পড়তে পারেননি। কাজেই এভাবে অনলাইনে কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়ার সুযোগ পেয়ে তাঁর আজীবনের এই স্বপ্নটি পূরণ হচ্ছে, তাই তিনি অত্যন্ত আনন্দিত।
এই ব্যাপারটাকে আরেকভাবে ভেবে দেখুন। বাংলাদেশে প্রচুর শিক্ষার্থী উচ্চতর শিক্ষা, যেমন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার সুযোগ পান না। কারণ, শিক্ষার্থীর চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আসনসংখ্যা অনেক অনেক কম। আসন কম, তার কারণ আমাদের দেশে সবার জন্য উচ্চতর শিক্ষার ব্যবস্থা করার মতো সামর্থ্য নেই। অথচ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে এই সমস্যার সমাধান আমরা খুব সহজেই মেটাতে পারি। একটা কোর্স অনলাইনে রেখে দিলে সেটা চিরকালের জন্য লাখ লাখ শিক্ষার্থীর কাজে লাগতে পারে।
উন্নত বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় সাম্প্রতিককালে কোর্সেরা, উডাসিটি বা এডএক্স নামের প্রকল্পের মাধ্যমে একইভাবে অনলাইনে কোর্স করাচ্ছে। কোর্সগুলো চমৎকার এবং বিশ্বের নানা জায়গা থেকে লাখ লাখ শিক্ষার্থী সেখানে ভর্তি হচ্ছেন। কিন্তু সমস্যা হলো, এসব কোর্স হলো ইংরেজিতে পরিচালিত। ফলে বাংলাদেশের সব শিক্ষার্থীর কাছে এই কোর্সগুলোর সুবিধা নেওয়া সম্ভব হয় না। হাজার হলেও মাতৃভাষা হলো শিক্ষার সর্বোত্তম মাধ্যম।
এটা কি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শুরু করা যায়?
অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা ব্যক্তিগত পর্যায়ের চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই ভালো করে শুরু হতে পারে, তবে এখানে একটা কথা আছে। এই প্রতিষ্ঠানটি হতে হবে অবাণিজ্যিক। কারণ, যখনই লাভের কথা মাথায় আসবে, শিক্ষার বদলে সনদ বিক্রির ব্যাপারটাই সেখানে মুখ্য হয়ে দাঁড়াবে। কাজেই অবাণিজ্যিক একটি প্রতিষ্ঠান এখানে ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। আমি তাই শিক্ষক ডট কম সাইটের জন্য শিক্ষক ফাউন্ডেশন গড়ে তোলার জন্য কাজ করছি, যা হতে যাচ্ছে সম্পূর্ণ অবাণিজ্যিক একটি প্রতিষ্ঠান।
এ কোর্সগুলোর মূল্যায়ন কীভাবে সম্ভব?
শিক্ষক সাইটে আসলে আমরা এখন পর্যন্ত কুইজভিত্তিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা রেখেছি। প্রতিটি বক্তৃতার সঙ্গে একটি কুইজ পরীক্ষা দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা কুইজের জবাব দেওয়ামাত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা মূল্যায়ন করে ই-মেইলে সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীর কাছে ফলাফল ও উত্তরের ব্যাখ্যা পাঠানো হচ্ছে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে আমরা এমসিকিউ কুইজ ছাড়াও অন্যান্য মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করার আশা রাখি। তবে আনুষ্ঠানিক সনদ দেওয়ার ব্যবস্থা করা নানা কারিগরি কারণে এখনো সম্ভব হবে না। শিক্ষক ডট কম আরও বড় পরিসরে বিস্তার লাভ করলে সেটার কথা ভাবব।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটাকে কীভাবে নিচ্ছে?
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন পর্যন্ত এই ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামায়নি বা উৎসাহ দেখায়নি। আসলে পুরো ব্যাপারটি একেবারেই নতুন একটা ধারণা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই ব্যাপারে এগিয়ে এলে খুব চমৎকার হতো।
তবে আমাদের ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থাটা হবে অনলাইনভিত্তিক। প্রথাগত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সেই ব্যাপারটা যত তাড়াতাড়ি ধরতে পারে, ততই তাদের মঙ্গল।

No comments

Powered by Blogger.