কণ্ঠস্বর-সবুজের জয় by রাহাত খান

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বামফ্রন্টকে একেবারে ধসিয়ে দিয়ে বড় মার্জিনে জিতেছে তৃণমূল কংগ্রেস-কংগ্রেস জোট। জয় বর্ণনা করতে গিয়ে এভাবে বললেও হয় :'দাদার বদলে দিদি। লালের বদলে সবুজ। ভট্টাচার্যের বদলে বন্দ্যোপাধ্যায়।'


মাইলফলক এই জয়ের পরপরই দিদি অর্থাৎ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিজয়ের আনন্দে ফেটে পড়া নেতাকর্মীরা স্লোগাত্মক একটা ছড়া গানও গেয়ে শুনিয়েছেন। গানটা হচ্ছে : 'দিদি, তুমি এ করলে কি, সিপিএম এখন খাবে কি! হেরে গেল বুদ্ধ, বাংলা হলো শুদ্ধ।'
৩৪ বছর একটানা একেবারে শিকড় গেড়ে বসা দলকে নির্বাচনে সমূলে উৎপাটনের পর ছড়া কেটে গান গেয়ে এমন ধারা আনন্দোৎসব হতেই পারে। দুই কংগ্রেস জোটের জয় যেন অবিশ্বাসকেও হার মানায়। আনন্দোৎসব হবে, এ আর বিচিত্র কী!
তবে যাকে ঘিরে এই আনন্দোৎসব, সেই দিদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ে মুখে শুধু একটা স্মিত হাসি। নেতাকর্মীদের আনন্দোৎসবে যোগ দেওয়ার আর কোনো লক্ষণ নেই। কেমন যেন চুপচাপ, স্থির ও শান্ত। নেতাকর্র্মীদের বলেছেন শহরে, গ্রামেগঞ্জে কোথাও বিজয়-মিছিল বের না করতে। বলেছেন, দেশে আইন-শৃঙ্খলা ও শান্তি রাখার জন্য যার যা কিছু করার আছে তাকে সেই ভূমিকা পালন করতে। মমতা বলেছেন, সবাইকে নিয়ে নির্বাচন জয়ের একটা বিজয়-উৎসব পালন করা হবে। তবে সেটা যথাসময়ে জোটের নেতাকর্মীদের জানিয়ে দেওয়া হবে। এই মুহূর্তে নয়।
নির্বাচন জয়ের পর চুপচাপ, স্থির ও শান্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগের সেই ব্যক্তিটি যেন নন। নির্বাচনী প্রচারণার আগে ও পরে তিনি ছিলেন যেনবা এক চঞ্চল ময়ূরী। মঞ্চে দাঁড়িয়ে অগি্নবর্ষী বক্তৃতা দিতেন। কখনওবা নেচে-গেয়ে বামফ্রন্টের সমালোচনায় মত্ত হতেন। বামফ্রন্টের সমালোচনায় মমতা যেন ছিলেন একাই একশ'। পশ্চিমবঙ্গ সিপিআইএমের সেক্রেটারি বিমান বসু তো মঞ্চজুড়ে মমতার দাপাদাপিকে বলতেন 'নাটুকেপনা'। বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আরেক ধাপ এগিয়ে মমতার বক্তৃতা দেওয়া, মিছিল করা ইত্যাদিকে বলতেন 'যাত্রাপালা'। বলতেন, যাত্রাপালায় একক অভিনয়।
এখন অবশ্য বিমান বসু কিংবা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কেউই মমতার রাজনীতিকে যাত্রাপালা বলে আর অসম্মান করেন না। পশ্চিমবঙ্গে লালদুর্গে পতনের পর তারা মুখে চুন পড়া জোঁকের মতো নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। বলছেন এমন সব সুন্দর ও ভদ্র কথাবার্তা, যা আগে কখনও বলতেন না। বরং বলতেন, মমতার এই লম্ফঝম্ফ করাটাই সার, ওটা কোনো রাজনীতিই নয়। বলতেন, বামফ্রন্ট জনগণের ভোটে, তাদের সমর্থনে ৩৪ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আছে। আরও থাকবে বহুকাল, বহুযুগ।
মমতার পাহাড় ধসিয়ে নির্বাচন জেতার কথায় পরে আসছি। আগে বলা দরকার, কোনো রাজ্যে ৩৪ বছর একটানা ক্ষমতায় থাকাটাও তো রাজনীতিতে কোনো সাধারণ বা ছোট ঘটনা নয়। ১৯৭৭ সাল থেকে অন্তত জ্যোতি বসুর একটানা মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময়কাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বিশ্বাস করত তাদের ভাগ্যোন্নয়ন হলে বামদের দিয়েই হবে। লাল ঝাণ্ডা পতাকা তখন সাধারণ মানুষের জন্য একটা অনুপ্রেরণা ছিল। 'কমরেড, লাল সালাম' বললে শিহরণ বয়ে যেত সাধারণ মানুষের মধ্যে। বেশিরভাগ বামপন্থি নেতার আপাত সাদাসিধে জীবনও সিপিআইএমকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলেছিল।
এ ছাড়া মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময় জ্যোতি বসু বাংলার কৃষকদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য যে কৃষি বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন, সেটা সিপিআইএমের বহুকাল একটানা ক্ষমতায় থাকার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। কিন্তু জ্যোতি বসুর বয়সের কারণে বা ধরা যাক কনিষ্ঠ সহযোগীদের বিরক্ত-ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণে মুখ্যমন্ত্রিত্বের আসন থেকে সরে যাওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের পায়ের নিচ থেকে ক্রমে মাটি সরতে শুরু করে। মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে জ্যোতি বসুর বিদায় নেওয়াটাই যে পরবর্তী সময়ে বামফ্রন্টের প্রতি মানুষের ক্রমে আস্থাহীন হয়ে পড়ার একমাত্র কারণ, তা মোটেও নয়। অনেকদিন, পুরো ৩৪ বছর একটানা ক্ষমতায় থেকে বামফ্রন্টের মধ্যে অনেকটা জমিদারসুলভ আচার-আচরণ এসে গিয়েছিল। রাজ্যের সবকিছু, এমনকি অজপাড়াগাঁয়ের মনোহারী দোকানটি পর্যন্ত তারা দলীয়করণ করে। কমিউনিস্ট দাদাদের 'তুষ্ট' করতে না পারলে, যত মেধাবী আর যোগ্য হোক, কারও চাকরি হয় না। বামদের আমলে দুর্নীতি এমন রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে যে, বার্ষিক উন্নয়নসূচির বিশ শতাংশের বেশি কোনোদিন তারা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। শহরে, গ্রামেগঞ্জে, পাড়ায় পাড়ায় কমিউনিস্ট শাসকরা গড়ে তুলেছিল এমন সব কমরেডদের, যাদের সাধারণ লোকেরা গোপনে বলত 'হার্মাদ বাহিনী'। পাড়ায় কোনো 'কমরেড' কোনো মেয়েকে লাঞ্ছিত করেছে তো এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একটাই উপায় ছিল, তা হচ্ছে 'কমরেড দাদা'কে সন্তুষ্ট করা। জজকোর্ট, হাইকোর্ট, প্রশাসন, পুলিশ, পঞ্চায়েত সবই ছিল 'কমরেড, লাল সালাম'দের দলীয়করণের আওতায়।
ভারতের কেরালা, ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গে তো রাজনীতিতে কমিউনিস্টদের পাকা স্থান পাওয়া হয়েই গিয়েছিল। অন্ধ্র প্রদেশ, বিহার এবং উত্তর প্রদেশেও প্রতিবার লোকসভায় দু'চারটি করে আসন পাওয়া যায়। ভারতীয় রাজনীতিতে বামফ্রন্টীয় রাজনীতি ক্রমেই বৃহত্তর বিকাশের দিকে এগোচ্ছিল। গত লোকসভা নির্বাচনে সাড়া ভারতে তাদের আসন সংখ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ৬২টি। ইউপিএ সরকারে মন্ত্রিত্ব না নিয়েও সরকারকে তারা বাইরে থেকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল। ইউপিএ সরকারও তাদের সমর্থনে নিরঙ্কুশভাবে দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করে যাচ্ছিল।
এই সময় সর্বভারতীয় কমিউনিস্ট দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাত নিজেদের শক্তি দেখানোর এবং ইউপিএ সরকারের প্রত্যেকটা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপের সূচনা করেন। প্রকাশ কারাত ও তার স্ত্রী বৃন্দা কারাতের নিজস্ব নির্বাচনী এলাকা বলতে কিছু নেই। যা ছিল সেখানে তাদের নির্বাচন জয়ের কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। অত বড় নেতা প্রকাশ কারাত কমিউনিস্ট দলের পলিটব্যুরোর সদস্য। তারপর পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল। নিজের নির্বাচনী এলাকা থেকে জেতার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে তাকে তো অনির্বাচিত করে রাখা যায় না। সুতরাং প্রত্যেকবার প্রকাশ কারাত এবং বৃন্দা কারাতকে পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্টদের জন্য নিরাপদ দুটি আসন থেকে নির্বাচিত করার ব্যবস্থা নেওয়া হতো।
এই প্রকাশ কারাতের অদূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে ভারতে কমিউনিস্টদের অগ্রগমন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তিনি 'বেঙ্গলি হেটার' ছিলেন কি-না জানি না, তবে অনেকটা তার বাধার কারণেই জ্যোতি বসু ভারতের একটি কোয়ালিশন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। এই প্রকাশ কারাত ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়ার আগে দিলি্লর রাজনীতিতে এমনই শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী হওয়ার ভাব দেখান, যেনবা তার ইশারা-ইঙ্গিত এবং সমর্থন ছাড়া কংগ্রেসের কোয়ালিশন সরকার একদিনও টিকবে না। শেষ পর্যন্ত ভারত-মার্কিন পরমাণু শক্তির প্রযুক্তি বিনিময় চুক্তির বিরোধিতা করে ইউপিএ সরকার থেকে নিজেদের সমর্থন প্রত্যাহার করেই নিলেন তারা। শুধু তা-ই নয়, আদর্শের বাইরে গিয়ে সাম্প্রদায়িক দল বিজেপির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। অনেকে মনে করেন, ভারতে কমিউনিস্ট প্রভাবের বারোটা বাজিয়েছেন এই প্রকাশ কারাতই। পশ্চিমবঙ্গের হালফিল বিধানসভা নির্বাচনেও কমিউনিস্টরা যে চরম সুবিধাবাদী এবং প্রয়োজনে আদর্শ বিসর্জন দিতে দ্বিধা করে না_ এই ধারণার ছায়াপাত ঘটেছে। এসব কারণেই ৩৪ বছরের লালদুর্গের শাসন বিধানসভা নির্বাচনে পাহাড়-পতনের মতো ধসিয়ে দিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের অগি্নকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কমিউনিস্টদের ব্যাপারে শেষ কথাটা বলে নিই। পৃথিবীর কোথাও তো মার্কস-লেনিনের সেই শাসন নেই। ব্যক্তির উদ্যোগ এবং আকাঙ্ক্ষাকে ব্যাষ্টির বলয়ে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিলে যা ঘটার, পৃথিবীজুড়ে কমিউনিস্ট দেশগুলোতে তা-ই ঘটেছে। লোকসান দিতে দিতে এবং পরাশক্তির ডাটফাট বজায় রাখতে গিয়ে ৭৬ বছরেই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং ১৫ টুকরা হয়ে যাওয়া নিশ্চিত হয়ে যায়। পূর্ব ইউরোপেও একইভাবে কমিউনিস্ট শাসনের পতন হয়। চীন নিজেদের এখনও কেন কমিউনিস্ট রাষ্ট্র মনে করে, তা চীনই জানে। কিন্তু একদলীয় ব্যবস্থার আওতায় দেশটা যে পুঁজিবাদী তৎপরতার 'স্বর্গ' হয়ে উঠেছে, এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করার কিছু নেই। উত্তর কোরিয়াকেও কমিউনিস্ট দেশ বলে লোকে জানে। কিন্তু ওখানে কমিউনিজম কোথায়, ওখানে তো কিম 'ডাইন্যাসি'র রাজত্ব চলছে। কিউবায় চলছে কাস্ত্রোর পর কাস্ত্রোর ছোট ভাই রাউলের শাসন। আর ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি, মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি বলতে দুই-চারটি দল আছে, কিন্তু এরা তো ভারতীয় সংবিধান, পুঁজিবাদ এবং গণতান্ত্রিক কাঠামো মেনেই নির্বাচন করে। তাহলে এই বিশ্বে মার্কস-লেনিন প্রবর্তিত কমিউনিস্ট দল বা শাসন কোথায় আছে?
কোথাও নেই। এখনও লাল সালাম, কমরেড_ এসব শব্দ অত্যন্ত অর্থহীনভাবে রাজনীতির প্রায় আড়ালে চলে যাওয়া কমিউনিস্ট দল ও গ্রুপগুলো ব্যবহার করে বটে। তবে কমিউনিস্ট শাসন বলতে যা বোঝায় তা বিশ্বের কোথাও নেই। কোনোদিন ফিরে আসবে এমন সম্ভাবনাও অত্যন্ত ক্ষীণ এবং সুদূরপরাহত।
ভারতের গণতান্ত্রিক এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আওতায় কমিউনিস্টরা এখনও রাজনীতি করে যাচ্ছে, তবে সেটা তো পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারই অনুসারী। খামাখা কমিউনিস্ট শাসনের তকমা আঁটতে যাওয়া কেন? যে যা-ই হোক, যে রাজ্যে বহুকাল লুপ্ত কমিউনিজমের লাল ঝাণ্ডা উড়ত, শোনা যেত কমরেড, লাল সালাম ইত্যাদি শব্দ_ সেই রাজ্য থেকে বামফ্রন্টকে নির্বাচনী তোপের মুখে উড়িয়ে দিয়েছেন সারা ভারতে অগি্নকন্যা বলে পরিচিত তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বড় একটা কালো কুচকুচে পানির নালার ধারে দুই রুমের টালির ছাদ দেওয়া পৈতৃক বাড়িতে বাস করেন। অত্যন্ত সাধারণ শাড়ি পরা, সাজসজ্জাহীন একরোখা, জেদি মেয়েটিই ১৩ বছরের নানা রাজনৈতিক নিগ্রহ সহ্য করে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্টের লালদুর্গকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে ভারতের জাতীয় নেতা এবং অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় ঠিকই বলেছেন, মাত্র ১৩ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রামে ৩৪ বছরের একটা জগদ্দল পাথরের চাপা পরা থেকে রাজ্যবাসীকে উদ্ধার করা ইতিহাসেরও ইতিহাস। মমতা বাস্তুবিকই তার জীবদ্দশায় ঐতিহাসিক একটি কর্তব্য সমাধা করলেন।
মমতা সম্ভবত আসছে শুক্রবারে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করবেন। তিনি রাজ্যের ভেঙে পড়া দশা দূর করতে চান। কমিউনিস্টরা প্রশাসনসহ সর্বত্র যে যথেচ্ছ দুর্নীতির বীজ বুনে গেছে, তা সর্বপ্রথমে চান দূর করতে। ভাঙা অর্থনীতির সংস্কার এবং সমৃদ্ধি সাধনও তার প্রশাসনের অন্যতম অগ্রাধিকার।
কাজটা মোটেও সহজ নয়। তবে মমতা হেরে যাওয়ার পাত্রী নন। গোড়া থেকেই সুস্থির চিত্তে প্রশাসন চালানোর জন্য প্রস্তুত তিনি। এটুকু বলা যায়, জনগণের প্রাণঢালা সমর্থন তিনি পাবেন।

রাহাত খান : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.