সমকালীন প্রসঙ্গ-পদ্মা সেতু প্রকল্প বৃত্তান্ত by জামিলুর রেজা চৌধুরী

পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঠিকাদারের প্রাক-যোগ্যতা মূল্যায়নে 'কোয়ালিটি অ্যান্ড কস্ট বেইজড সিলেকশন' পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় বিশ্বব্যাংকের গাইডলাইন অনুসারেই। ওইখানে কারিগরি মূল্যায়নের ওপর শতকরা ৯০ ভাগ 'ওয়েইটেজ' এবং ভিন্ন একটি খামে জমা দেওয়া আর্থিক প্রস্তাবের মূল্যায়নের ওপর শতকরা ১০ ভাগ ওয়েইটেজের মূল্যায়ন করা হয়।


যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব জমা দিয়েছিল তাদের উপস্থিতিতেই কারিগরি মূল্যায়ন প্রদত্ত নম্বর ঘোষণা করা হয় এবং আংশিক প্রস্তাব ও খামগুলো খুলে সবাইকে
জানিয়ে দেওয়া হয়

পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংকের আকস্মিক সরে যাওয়া নিয়ে ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যমে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের তরফেও কম কথাবার্তা হয়নি। আমি আর সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। কোনো বিচার-বিশ্লেষণও নয়। কারিগরি পর্যায়ে যুক্ত থাকার সুবাদে প্রকল্পটিকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ হয়েছে। সে ব্যাপারেই দু'চার কথা।
২০০৭ সালে প্রস্তাবিত পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নের জন্য এডিবি (এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) বাংলাদেশ সরকারকে কারিগরি সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ এবং এ লক্ষ্যে পরামর্শকদের কাছ থেকে প্রস্তাব আহ্বান করে। এতে বিভিন্ন দেশের ছয়টি খ্যাতনামা প্রকৌশলী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব দাখিল করে এবং ফিলিপাইনের ম্যানিলায় অবস্থিত সদর দফতরে বসে এডিবি নিজেই এ প্রস্তাবগুলো মূল্যায়ন করে। একই সময় বাংলাদেশ সরকার একটি বিশেষজ্ঞ দল নিয়োগ এবং সমান্তরালভাবে ওইসব প্রস্তাব এডিবির গাইডলাইন অনুসারে মূল্যায়ন করতে থাকে। আমাদের মূল্যায়নে এডিবির মূল্যায়ন সমীক্ষায় কিছু ভুলত্রুটি ধরা পড়ে এবং তা চিহ্নিত করায় এডিবি তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদন সংশোধন করে। এরই ভিত্তিতে নিউজিল্যান্ডের একটি প্রতিষ্ঠান মনসেল, কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান নর্থ-ওয়েস্ট হাইড্রোলিক ও অস্ট্রেলিয়ার প্রতিষ্ঠান স্মাক পরামর্শক নির্বাচিত হয়।
বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই পরামর্শক সম্পর্কিত মূল্যায়ন প্রতিবেদনটি অনুমোদন করে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেয়। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, এ ধরনের একটি জটিল ও বৃহৎ প্রকল্পে ডিজাইনের আগে প্রচুর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং তা বিশ্লেষণ করে ডিজাইন প্রণয়ন করতে হয়। এই প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন করে ২০১০ সালের মাঝামাঝি সেতুর ড্রইং প্রণয়ন শুরু করা হয়। একই সঙ্গে প্রকল্পের বিভিন্ন প্যাকেজের জন্য ঠিকাদারদের প্রাক-যোগ্যতা নির্ধারণের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। এই বিভিন্ন প্যাকেজের প্রাক-যোগ্যতার ক্রাইটেরিয়া নির্ধারণের সময় বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সঙ্গে অনেক আলোচনা করে চূড়ান্ত করা হয়।
এদিকে ২০০৯ সালের মাঝামাঝি এই প্রকল্পের বিভিন্ন কারিগরি দিক নিয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য একটি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল নিয়োগ করা হয়। এর অন্তর্ভুক্ত ১০ বিশেষজ্ঞের মধ্যে তিনজন জাপানি বিশেষজ্ঞ, একজন হল্যান্ডের বিশেষজ্ঞ, একজন নরওয়েজিয়ান বিশেষজ্ঞ এবং বাকি পাঁচজন বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ।
ডিজাইন পরামর্শক সংস্থা যে প্রতিবেদনগুলো বিভিন্ন সময় সরকারের কাছে জমা দেয়, তা পর্যালোচনা করে এই বিশেষজ্ঞ প্যানেল তাদের মতামত দেয়। এই মতামতের ভিত্তিতে ২০১১ সালের মাঝামাঝির দিকে ডিজাইনটি প্রায় চূড়ান্ত করা হয়। প্রাক-যোগ্যতা নির্ধারণের জন্য সরকার আরেকটি কমিটি করে, যাদের সুপারিশমালা বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকা অনুমোদন করে।
এদিকে এই প্রকল্পের পরিবেশগত সমীক্ষা এবং অ্যাকশন প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন করা হয়। মূল সেতুর ঠিকাদারের প্রাক-যোগ্যতা নির্ধারণে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ডিজাইন কনসালট্যান্ট ও বাংলাদেশের প্রাক-যোগ্যতা মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশে মতভেদ দেখা দেয়। মূলত একটি চীনা কোম্পানিকে কেন প্রাক-যোগ্য বিবেচনা করা হয়নি, সে বিষয়ে বিশ্বব্যাংক বারবার জানতে চায় এবং তাদের প্রাক-যোগ্য ঘোষণার জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ কমিটি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়, তারা যে অভিজ্ঞতা সনদ প্রস্তাবের সঙ্গে জমা দিয়েছে তা ভুয়া।
তারা বলেছিল যে, চীনের একটি সেতুতে তারা ইস্পাতের পাইল ব্যবহার করেছে। এর সমর্থনে তারা একটি আলোকচিত্রও জমা দেয়। পরে দেখা যায়, আলোকচিত্রের সেতুটি আসলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত। এ ধরনের জালিয়াতি ধরা পড়ার পরদিন আমরা কিছু জানানোর আগেই তারা চিঠি দিয়ে প্রকল্প থেকে নিজেদের প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয়। এরপরই বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের কমিটির সুপারিশকৃত প্রাক-যোগ্য ঠিকাদারদের তালিকা লিখিতভাবে অনুমোদন করে।
একইভাবে নদী শাসনের ঠিকাদারদের প্রাক-যোগ্যতা তালিকায় ডিজাইন কনসালট্যান্ট ও বাংলাদেশ সরকারের কমিটির সুপারিশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক দ্বিমত পোষণ করে। বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকারের তিনজন বিশেষজ্ঞ চীনের প্রকল্পগুলো সরেজমিন পরিদর্শন করে কোম্পানিগুলোর প্রদত্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন জমা দেয়। এই তালিকাপত্র প্রায় চূড়ান্ত হওয়ার পথে।
২০১০ সালে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নির্মাণ তদারকি পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য সরকার পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রস্তাব আহ্বান করে। এই প্রস্তাব কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে তারও খুঁটিনাটি বিশ্বব্যাংক নির্দিষ্ট করে দেয়। এই মূল্যায়নের কাজ করার জন্য সরকার একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি নিয়োগ করে এবং ২০১১ সালের শুরুতে কারিগরি প্রস্তাবের ওপরে তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদন বিশ্বব্যাংকের অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করে। এই কমিটিতে বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ অনুসারে তাদেরই অবসরপ্রাপ্ত একজন বিশেষজ্ঞকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কমিটির মূল্যায়ন বিশ্বব্যাংক লিখিতভাবে অনুমোদন করে।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, এখানে 'কোয়ালিটি অ্যান্ড কস্ট বেইজড সিলেকশন' পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় বিশ্বব্যাংকের গাইডলাইন অনুসারেই। ওইখানে কারিগরি মূল্যায়নের ওপর শতকরা ৯০ ভাগ 'ওয়েইটেজ' এবং ভিন্ন একটি খামে জমা দেওয়া আর্থিক প্রস্তাবের মূল্যায়নের ওপর শতকরা ১০ ভাগ ওয়েইটেজের মূল্যায়ন করা হয়। যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব জমা দিয়েছিল তাদের উপস্থিতিতেই কারিগরি মূল্যায়ন প্রদত্ত নম্বর ঘোষণা করা হয় এবং আংশিক প্রস্তাব ও খামগুলো খুলে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়।
এছাড়া বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের কমিটিকে প্রতিটি পরামর্শক দলের যে ২৭ জন 'কি পারসোনালের' নাম-অভিজ্ঞতা উল্লেখ আছে তা সঠিক কি-না তা যাচাই করার জন্য দিকনির্দেশনা দেয়। সেই অনুসারে কমিটি এসব বিশেষজ্ঞের অভিজ্ঞতা সনদ যাচাই করে দেখে। তাতে দেখা যায়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞের যে অভিজ্ঞতা কারিগরি প্রস্তাবে উল্লেখ আছে, তা প্রমাণ করার জন্য যথাযথ সনদ তারা উপস্থাপন করতে পারেননি। কেউ কাজ করেছেন এক ক্ষেত্রে, সনদ জমা দিয়েছেন আরেক ক্ষেত্রের। এ ধরনের একটি ঘটনার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়ে তাদের অসাবধানতার জন্য ভুল স্বীকার করে। সব মিলিয়ে তিনজন এমন ব্যক্তি পাওয়া যায়। তবে এরই ভিত্তিতে কারিগরি প্রস্তাব পুনর্মূল্যায়ন এবং আর্থিক প্রস্তাবের অসঙ্গতিগুলো দূর করা হয়। নির্ধারিত ওয়েইটেজ ব্যবহার করে সরকার গঠিত কমিটি তাদের চূড়ান্ত মূল্যায়ন বিশ্বব্যাংকে প্রেরণ করে। এই প্রতিবেদন অনুমোদনের পর সরকার যখন অপেক্ষা করছিল, তখনই বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ উপস্থাপন করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে তাদের কার্যক্রম স্থগিত করে।
আগেই যেমনটি বলেছি, পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে সরকার ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যকার দ্বিমত ও দ্বৈরথ নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। পদ্মা সেতু প্রকল্পের কারিগরি বিভিন্ন দিক কীভাবে মূল্যায়িত হয়েছে, সেটাই জানালাম। বিচার-বিবেচনার ভার পাঠকের।

অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ, চেয়ারম্যান
পদ্মা সেতু প্রকল্প বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল
 

No comments

Powered by Blogger.